🪔 শুভ দীপাবলি 🪔
দীপাবলী শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে ❝দীপ❞ ও ❝আবলী❞ এই দুইটি শব্দ পাওয়া যায় । "দীপ" শব্দের অর্থ "প্রদীপ" আর "আবলী" শব্দের অর্থ "পংক্তি" ।
দীপাবলীর শব্দবিশ্লেষণগত দিক থেকে এটির দ্বারা সারিবদ্ধ প্রদীপ্ত দীপের আলোক উৎসব নির্দেশ করে , যা এখন পর্যন্ত পালন করা হয় । কিন্তু প্রাচীন গ্রন্থসমূহে দীপাবলীর এই নাম এবং বর্তমান উৎযাপন পদ্ধতি পাওয়া যায় না । প্রাচীন কালে এই দিনটি পালিত হলো ❝শারদীয় নবশস্যেষ্টি❞ নামে ।
এই নামটি অনেকের কাছেই নতুন । তাই এই নামের অর্থ অনেকেই বুঝতে পারছেন না । ❝নবশস্যেষ্টি❞ শব্দটিকে ভাঙলে পাওয়া যায় — নব + শস্য + ইষ্টি । "নব" অর্থ "নতুন", "শস্য" অর্থ "ফসল" আর "ইষ্টি" অর্থ "যজ্ঞ" ।
❝মনুসংহিতায় (৪।২৬)❞ নতুন ফসল ওঠার পর তা দিয়ে "নবশস্যেষ্টি" যজ্ঞ করার বিধান দেওয়া হয়েছ -
❝শস্যান্তে নবশস্যেষ্টয়া তথর্ত্বন্তে দ্বিজোঅধ্বরৈঃ❞ ।
এছাড়াও গোভিল , পারস্কর , আপস্তম্ব প্রভৃতি গৃহ্যসূত্রেও যব , মুগসহ নতুন শস্যাদি দিয়ে এসময় যজ্ঞের বিধান পাওয়া যায় ৷ আবার সনাতন ধর্মের শ্রৌত গ্রন্থসমূহে প্রতি অমাবস্যায় ❝দর্শেষ্টি❞ নামক যজ্ঞের বিধান আছে । এই শারদীয় অমাবস্যায় "দর্শেষ্টি" যজ্ঞের পাশাপাশি নতুন ফসল [ শস্য ] দিয়ে ❝নবশস্যেষ্টি❞ যজ্ঞ করারও বিধান থাকায় এই অমাবস্যা অন্যান্য অমাবস্যার তুলনায় এই আলাদা একটি গুরুত্ব লাভ করেছিল ।
✅ উপরিউক্ত আলোচনা থেকে দীপাবলীর এই তিথি আলোক উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করার পেছনে কয়েকটি কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে -
- ১। একই তিথিতে ❝নবশস্যেষ্টি❞ ও ❝দর্শেষ্টি❞ যজ্ঞ থাকায় প্রাচীন ভারতের প্রতি গৃহ যজ্ঞের শিখায় আলোকিত হয়ে উঠত ।
- ২। নতুন ফসল ঘরে ওঠায় সকলের মাঝে একটি উৎসবের আমেজ কাজ করত ৷
- ৩। বছরের অন্যান্য অমাবস্যার তুলনায় এই অমাবস্যা অপেক্ষাকৃত বেশি গাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ায় সেই অন্ধকারকেও দূর করার জন্য আলোর ( প্রদীপের ) ব্যবহার ।
- ৪। শরৎ শেষে হেমন্তকে বরণ । ফলে সব কিছু মিলিয়ে প্রাচীন কাল থেকেই এই রাত্রিতে আলোক শিখাপ্রত্যেক বাড়িতে প্রদীপ্ত হয়ে উঠত ৷ তখনকার যজ্ঞকেন্দ্রিক ধর্মীয় আচার এখন আর বিদ্যমান নাই । ফলে এখন প্রতি গৃহ যজ্ঞের শিখায় উজ্জ্বল হয় না , হয় প্রদীপ শিখায় ৷ আবার তখনকার দীপাবলী আর বর্তমান দীপাবলীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও আলাদা ৷
কিন্তু এর ভেতরে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় রয়েছে ৷ সেটা হচ্ছে সকলের মাঝে [ জ্ঞানের ] আলো ছড়িয়ে দেওয়া । তবে আমাদের শুধু প্রতীকী ভাবে প্রদীপ জ্বালিয়ে আমাদের দায়িত্ব শেষ করলে হবে না । আমাদের সমাজ থেকে কুসংস্কারের অন্ধকারকে সংস্কারের আলোক দ্বারা বিদীর্ণ করতে হবে ৷ অশিক্ষার অন্ধকারকে শিক্ষার আলো দ্বারা দূর করতে হবে ৷ অজ্ঞানতার অন্ধকারকে জ্ঞানের আলো দ্বারা দূর করতে হবে । তখনই আমাদের সমাজে প্রকৃত দীপাবলীর আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং স্বার্থক হবে দীপাবলী উৎসব পালন করে ৷
তবে এই দিনটি একটি মর্মান্তিক ঘটনারও সাক্ষ্য দেয় । এই দিনেই এক মহান ঋষির মৃত্যু হয়েছিলো । যিনি সর্ব প্রথম বেদের উপর করা মিথ্যাচারের জবাব দৃঢ় কন্ঠে দিয়েছিলেন । তিনি প্রায় ৫৪ টি শাস্ত্রার্থ (ধর্মীয় বিতর্ক) করেন । বিভিন্ন ধর্মের লোকের সাথে বিতর্ক করে তাদের মতকে খণ্ডন করে পবিত্র বেদের মতের স্থাপনা করেছিলেন । তিনিই লিখেছেন সেই কালজয়ী গ্রন্থ " ❝সত্যার্থ প্রকাশ❞ এই গ্রন্থের মাধ্যমে প্রায় সকল মতের খণ্ডন করে বেদের মহত্বকে তুলে ধরেছিলেন , যিনি শাস্ত্রকে অস্ত্র বানিয়ে সমাজে প্রচলিত বেদ বিরোধী কু-প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন , যিনি পবিত্র বেদের প্রকৃত অর্থ সকল স্থরের মানুষের কাছে তুলে ধরেছিলেন আর ব্জ্রকন্ঠে বলেছিলেন ❝ Back to the Vedas ❞ বেদের দিকে ফিরে এসো । তিনিই আমাদের সকলের প্রিয় " ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী "। তাই তার এই মহাপ্রয়াণ দিবসে তাকে জানাই শতকোটি প্রণাম । তার সাথে সাথে আসুন আমরা বেদ মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে দিনটা উদযাপন করি আর ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করি -
যন্মে ছিদ্রং চক্ষুষো হৃদয়স্য মনসো বাতিতৃন্নং বৃহস্পতির্মে তদ্দধাতু। শন্নো ভবতু ভুবনস্য যস্পতিঃ ॥
[ যজুর্বেদ ৩৬।২ ]
পদার্থ- (যত্ মে) আমার মাঝে যা (ছিদ্রং) অপূর্ণতা রয়েছে (চক্ষুষঃ) চক্ষু আদি ইন্দ্রিয়ের( হৃদয়স্য) বুদ্ধির , (মনসঃ বা) অথবা এইমনের যত (অতি তৃন্নং) দোষ বা অপূর্ণতা রয়েছে , (বৃহস্পতি) হে পরমাত্মা! (মে) আমার সেই অপূর্ণতাকে (দধাতু) পূর্ণ করো । (ভুবনস্য যঃ পতি) তিনিই সমস্ত সংসারের পালক , (নঃ) আমাদের জন্য (শম্) কল্যাণকারী (ভবতু) হোন ।
🌼 শেষ করছি সেই আলোর দিকে গমনের আকাঙ্ক্ষার একটি বিখ্যাত বৃহদারণ্যক উপনিষদের শ্লোক দিয়ে -
অসতো মা সদ্গময়ঃ তমসো মা জ্যোতির্গময় ॥ মৃত্যোর্মামৃতং গময় ॥
[ বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ১।৩।২৮ ]
অনুবাদঃ অসত্য থেকে আমাকে সত্যে নিয়ে যাও , অন্ধকার হতে আমাকে আলোতে/জ্যোতিঃ তে নিয়ে যাও মৃত্যু হতে আমাকে অমৃতে নিয়ে যাও । জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হোক সাবার হৃদয় , দূর হোক অজ্ঞানতার অন্ধকার ।
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর
0 মন্তব্যসমূহ