প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয় কেন, জলে ভাসিয়ে দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা

বিসর্জনের পর প্রতিমা জলে ভাসিয়ে দেয়া দেখে যাদের হাসি আসে, তাদেরকে জানানোর জন্য এই রচনা। আশা করি তারা এই লেখাটি পাঠ করে নিজেদের অজ্ঞতা দূর করবেন।


সমস্ত মহাজাগতিক সৃষ্টির ভিত্তি হচ্ছে পঞ্চভূত। ১.ক্ষিতি=পৃথিবী(মাটি), ২.অপ=জল, ৩.তেজ=আগুন, ৪.মরূত্‍=বায়ু, ৫.বোম=আকাশ (শূন্য)। গোটা সৃষ্টিকে ধারণ করে আছে এই পাঁচ উপাদান।আমাদের দেহও এই পঞ্চভূতে তৈরি। দুর্গা প্রতিমাও।


পঞ্চভূতে তৈরি প্রতিটি সৃষ্টিই নশ্বর অর্থাৎ পঞ্চভূতেই বিলীন হয়। সুতরাং, এরাও (দেহ, প্রতিমা) নশ্বর। দেহের মৃত্যু হয় ঠিকই অর্থাৎ আত্মা দেহ থেকে নির্গমনের পর দেহকে পুড়িয়ে ফেলা হয় অথবা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় নয়তো বা জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু আত্মার মৃত্যু নেই, বিনাশ নেই, ধ্বংস নেই। আত্মা অবিনশ্বর।দুর্গা প্রতিমার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা, ষষ্ঠীতে প্রতিষ্ঠিত প্রাণ দশমীতে বিসর্জনের পর সেই প্রতিমাকে জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পূজা তো করা হয় প্রাণের।


তাহলে কেন প্রতিমা বানিয়ে দুর্গা পূজা করছি?


আগেই বললাম, আত্মার কোন ক্ষয় নেই, কোন বিনাশ নেই। আত্মা অবিনশ্বর। আমি, তুমি, তোমরা সবাই এক একটি আত্মা। প্রত্যেকেই পরমাত্মা তথা ঈশ্বরের অংশ। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের পরম আশ্রয়স্থল পরমাত্মার দিকে ধাবিত। কিন্তু পরমাত্মার সাথে আত্মার এই মিলন তথা মোক্ষ লাভে বড় বাধা হচ্ছে মায়া। নশ্বর এই পৃথিবীতে আগমনের পর আমরা মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি।

ষড় রিপু হলো সনাতন শাস্ত্রমতে মানব মনের ছয়টি শত্রু। এগুলো হলোঃ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য (ঈর্ষা)। ষড়রিপুর নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য মানুষকে মোক্ষ লাভে বাঁধা প্রদান করে।

হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী এগুলি আত্মাকে জন্ম ও মৃত্যুর চক্রের সাথে আবদ্ধ করে এবং জড় জগতে সীমাবদ্ধ করে (মায়া)।


মহিষাশুর রূপ এই আসুরিক শক্তিগুলোকে বিনাশ করতে পারলেই জীবাত্মার সহিত পরমাত্মার মিলন সম্ভব। এর জন্য দরকার দৈব শক্তি রূপ দুর্গার আবির্ভাব। যিনি সকল আসুরিক শক্তির বধ করে আমাদের জন্ম মৃত্যু রূপ দুর্গতি থেকে মুক্তি দিতে পারেন তথা আমরা পরমানন্দ লাভ করতে পারি। তাই প্রত্যেকের মাঝে সুপ্তাবস্থায় অবস্থিত দেবী দুর্গার বোধন তথা জাগরণের মাধ্যমে আত্মার উন্নয়নই দুর্গা পূজার মাহাত্ম্য।


ঈশ্বর নির্গুণ, নিরাকার। আবার তিনি আত্মারূপে সাকার ভাবে আমাদের মাঝে অবস্থান করেন। ঈশ্বরের রূপ এই মায়ার চোখে দর্শন করা অসম্ভব। তাহলে কেন প্রতিমা তৈরি করে পূজা করা হচ্ছে, তাইতো?


ধরুন, আপনার বই পড়তে ভালো লাগে না। তবে ঐ গল্পটা আপনি সিনেমাটোগ্রাফির মাধ্যমে দেখতে বেশি আগ্রহ পান বা বুঝতে সহজ হয়। প্রতিমা পূজার ব্যাপারটিও একই।


নিরাকার পরম ব্রহ্মের আরাধনা করা অনেক কঠিন। তাই ঋষি মুনিরা সাকার উপাসনার ব্যবস্থা করেন। যাতে মানুষ পূজার আগ্রহ পায়,যাতে মানুষ সহজে বিষয়গুলো অনুধাবন করার চেষ্টা করে। প্রতিমা ভগবান নয়। প্রতিমা শুধু প্রতীকি মাত্র। প্রতিমার প্রতিটি অংশ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বিশেষ অর্থ ধারণ করে। মানুষ যাতে এই বিষয়গুলো সহজে বুঝে পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা করতে পারে, যাতে একটু সহজে পরমানন্দ লাভ তথা মোক্ষ লাভে সচেষ্ট হয় সেই উদ্দেশ্যেই সাকার উপাসনা।


ভালো করে খেয়াল করবেন, প্রতিমায় পূজা করা হয় না। পূজা হয় ঘটে।সেই ঘটের উপর আম্র পল্লব দিয়ে তার উপর নারকেল স্থাপন করা হয়। গামছা বা শালুক কাপড় দিয়ে ঘিরে দেয়া হয় ঘট। তারপর ষষ্ঠীতে চারদিকে একটা সুতা দিয়ে ঘিরে দেয়া হয় যেটাকে আমরা প্রাণ প্রতিষ্ঠা বলি। দশমীতে ঐ সুতা ছিঁড়ে দেয়া হয় তথা প্রাণ বিসর্জন। পূজার সময় অর্পিত সমস্ত ফুল দেখবেন ব্রাহ্মণ ঐ ঘটেই অর্পণ করেন।


এই ঘট হুবহু আমাদের দেহকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ দেহ ঘটে ঈশ্বর প্রদত্ত আত্মা রূপ প্রাণের পূজার তাৎপর্যই বোঝানোর চেষ্টা করা হয় ।এই বিষয়গুলো সকলের জন্য বোধগম্য হওয়া একটু কষ্টসাধ্য বিধায় সাকার রূপ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা।


অর্থাৎ,পূজা প্রতিমার হয় না। পূজা হয় প্রতিষ্ঠিত প্রাণ রূপ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই।


সুতরাং, পঞ্চভূতে তৈরি নশ্বর প্রতিমা জলে ভাসিয়ে দেয়া মৃত্যুর পর আমাদের দেহ পুড়িয়ে ফেলা/কবর দেয়া/জলে ভাসিয়ে দেয়ার মতই। এতে আশ্চর্য হবার মত বা হাসি ঠাট্টা করার মত কিছু নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ