এক বিশ্বাসঘাতক মুসলিমের গল্প - প্রফুল্ল উকিল, লেখক: অজয় দাশগুপ্ত

বিশ্বাসঘাতক মুসলিমের গল্প - প্রফুল্ল উকিল, লেখক: অজয় দাশগুপ্ত

প্রফুল্ল বাবু পেশায় আইনজীবী। চট্টগ্রাম শহরের তিন পোলের মাথায় সবুজ শোভিত বিশাল জায়গায় তাঁর বাড়ি। তখন এতো উঁচু উঁচু দালান ছিলো না। টিনের ছাউনি কিন্তু মজবুত চমৎকার ঘর দোর। জুবিলী রোড ধরে এতো গাড়ির যাতায়াতও ছিল না তখন। বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে তাঁর চেম্বার। চেম্বার পেরিয়েই ঢুকতে হয় বাড়িতে।


খুব চুপচাপ ধরনের মানুষ তিনি। নীরিহ ছেলে, ছেলের বৌ, নাতি নাতনী নিয়ে সংসার। ছেলেটি তাঁর চেয়েও নীরিহ। বাপের নাম যশ কিছুই বহন করলো না। পাকিস্তান  রেলওয়ের চাকরীতেই সন্তুষ্ট। 


প্রফুল্ল বাবু আদালতে যাওয়া আসা,মক্কেলদের সাথে দেখা ও খবরের কাগজ পড়ার বাইরে দুটো কাজ করতেন। ভোরে কোর্ট বিল্ডিং পর্যন্ত হেঁটেগিয়ে প্রাতঃভ্রমণ সেরে আসা, বিকেলে বাড়ির পেছনের মাঠে এক ঘন্টা  হাঁটাচলা। 


বুঝতে পারছিলেন, যুদ্ধ কাছিয়ে এসেছে। মনে মনে  শেখ মুজিবুরের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ঘোর সমর্থক তিনি। মাঝে মাঝে চাঁদাও দিতেন। মুক্তিযুদ্ধ ও তারুণ্য এ দুটো তাঁকে ভীষণ টানতো। কিন্তু চুপচাপ স্বভাবের বলে মাথা নীচু করে চশমার ওপর হাতে ধরা ভারী আতসী কাঁচ, ম্যাগনিফাইং গ্লাসে কাগজ পড়ার ভেতরই সীমাবদ্ধ ছিলেন তিনি। 


কয়েক মাস থেকে আনিচ নামের এক যুবকের সাথে পরিচয় হয়েছিল তাঁর। গোড়াতে খুব একটা পাত্তা দেন নি। তাঁর মতো কম কথা বলা লোক কারো নিকটজন হওয়া দুঃসাধ্যের ব্যাপার। কিন্তু আনিচ নিজ চেষ্টায় তা অতিক্রম করে নিকটের কেউ হয়ে উঠেছিল। তিনি মজা করে বলতেন, নিজের আনিচ বলো কেন? তোমার নাম তো আনিস। মাথা চুলকিয়ে ঘাড় নীচু করে ও বলতো, না স্যার আনিচ। এটাই ভালা। 


ঘনিষ্ঠ আনিচ একসময় তাঁর ভোরের হাঁটার সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। রোজ সন্ধ্যায় এসে বসে থাকতো তাঁর চেম্বারে। ফাইল পত্র গোছানো থেকে হয়ে উঠল সহকারী। তাঁর টাকায় তাঁর উৎসাহে আনিচ আইন কলেজেও ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। এতোটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে একদিন আনিচ কে নিয়ে গেলেন তাঁর স্বপ্নের জায়গা দেখাতে। সকাল দশটায় গাড়ি করে দু জনে পৌঁছে গেলেন শহরের উপকন্ঠে সবুজ মাঠের মতো একটি জায়গায়। ধুতি পাঞ্জাবী গলায় মাফলার জড়ানো প্রফুল্ল বাবু খুশীতে ডগমগ। সব দেখিয়ে শুনিয়ে বললেন, এর কথা কেউ জানে না বুঝলি। পোলার বৌটা জানলে খবর আছে।  এই জমিনে মেয়েদের জন্য একটা ফ্রি স্কুল বানাবো। নাম দেব সারদা সুন্দরী বিদ্যালয়। আমার মায়ের নাম। বলতে বলতে উজ্জ্বল চোখ দুটো চশমার আড়ালে জলে ভিজে গিয়েছিল তাঁর। আনিচ বুঝে ওঠার আগেই সে অশ্রু মুছে নেন তিনি। প্রথমবারের মতো আনিচের কাঁধে হাত দিয়ে বলেন, তোর নামে লেখা দিব, তুই দেখভাল করবি। পারবি না? অল্প দাড়ি কামানো গোঁফের আনিচ তাঁর দিকে না তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলেছিল, হ পারুম স্যার। নামটা জানি কি? সারদা সুন্দরী?? 


যুদ্ধ লেগে গেলে কে কোথায় ছিটকে পড়লো জানার উপায় নাই। আগে ভাগে আনিচকে পাঁচশ টাকা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, তোর ডর বেশী। মিলিটারি রাজাকারেরা তোরে পেলে শেষ করে দিবে।  তুই পালা। তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করে বিদায় নিয়েছিল আনিচ। 


মে মাসের সকাল দশটায় তাঁর বাড়ির দরজায়  লাথির শব্দে সবাই ভয়ে কাঁপছে।  যে যার মতো যেখানে সম্ভব লুকিয়ে গেলে প্রফুল্ল বাবু ঠান্ডা মাথায় দরজা খুললেন। দু জন পাকিস্তানী সৈন্য হাতে বন্দুক। সাথে একজন লুঙ্গি পরিহিত বাঙালি। বাঙালি টি বললো, আপ্নে প্রফুল্ল উকিল? তিনি মাথা নাড়লেন। হুকুম এলো, স্যার কথা বলবে চলেন একটু। তৈরী হবার সময় চাইলেন তিনি। পাঁচ মিনিটে তৈরী হয়ে ধুতি পাঞ্জাবী চশমায় রওনা হলেন প্রফুল্ল বাবু। মনে মনে ভাবলেন, আমি তো কারো ক্ষতি করি নি আমার কি হবে? চোখ ওপরে তুলে একবার চেয়ে নিলেন সারদা মা ও তাঁর মা সারদা সুন্দরী'র ছবির দিকে। 


পরদিন সকাল এগারটায় চোখ বন্ধ করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো। চোখ খুলে দিলে দেখলেন সেই সবুজ মাঠ। সেই তাঁর স্বপ্নের জায়গা। তিল তিল করে জমানো টাকার জমিন। এক সিপাহি পাছায় লাথি দিয়ে বললো, মালাউন কি স্কুল বানানে চাহাতা বুড্ডা? পাকিস্তান টুটনেকে লিয়ে? 


মাটিতে পড়ে গেলেন সত্তরের রেখা ছোঁয়া বৃদ্ধ উকিল। অতঃপর তাঁর বুকে ভারী বুটের পা তুলে দিয়ে সিপাহি কাকে যেন ডাকলো। ভালো করে তাকাতেও পারছেন না তিনি। ঝাপসা দৃষ্টি তে দেখলেন মুখে কাপড় জড়ানো একজন হাতে রিভলবার। সিপাহী সরে যাবার মূহুর্তে লোকটির রিভলবার তাক করলো প্রফুল্ল বাবু'র বুক। পরপর দুটি গুলি। মা বলে শেষ শব্দ উচ্চারণের সময় হঠাৎই দেখলেন রিভলবারধারীর মুখের কাপড় সরে গেছে।  পরিচিত সেই নীরিহ মুখ। সেই গোঁফহীন দাড়ি। 


আনিচ অকৃতজ্ঞ না। সে কথা রেখেছে। ঐ জমিনে এখন একটি স্কুল আছে। সাইনবোর্ডে লেখা,  দারুল আনিচ ফ্রি বয়েজ স্কুল।


জমি দান কারী প্রতিষ্ঠাতাঃ দানবীর আনিচ আহমদ। 


প্রফুল্ল উকিলের সারদা সুন্দরী রক্তে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে গেছে সবুজ বাংলাদেশে। কোথাও কেউ নাই প্রফুল্ল বাবু'র ম্যাগনিফাইং গ্লাসটাও হারিয়ে ফেলেছে তাঁর নাতি। এখন আমরা কেউই আর চোখে দেখি না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ