14 June 2025
বর্তমান সময়ে ধর্মান্তর একটি গভীর সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষত যাদের মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান নেই, অথবা যারা বিভিন্ন প্রলোভন ও কুসংস্কারে প্রভাবিত, তাদের মাঝে এই সংকট প্রকট হয়ে উঠছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে; আমরা কি নিজের ধর্মকে যথার্থভাবে জানিনবা প্রচার করি? আমরা কি উপলব্ধি করি, কতটা গভীর, সুসংহত, বিজ্ঞানসম্মত ও কল্যাণমুখী আমাদের সনাতন ধর্ম?
সনাতন ধর্ম : চিরন্তন ও অবিনশ্বর
‘সনাতন’ শব্দের অর্থ - চিরন্তন, যার কোনো শুরু নেই, শেষ নেই। এটি কোনো মানুষের প্রতিষ্ঠিত মত নয়, বরং ঈশ্বর থেকে উৎসারিত এক প্রাকৃতিক ও নৈতিক জীবনব্যবস্থা। এই ধর্ম হাজার-হাজার বছর ধরে ঋষিদের উপলব্ধি ও তপস্যার ফলস্বরূপ সংহত হয়েছে। এ ধর্মে মানুষের চিন্তা, চরিত্র, কর্ম, ও আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে ঈশ্বরলাভের পথ দেখানো হয়েছে।
"যে অতি উত্তম গুণযুক্ত সনাতন [নিত্য স্থায়ী] দেব [স্তুতিযোগ্য পরমেশ্বর] আছেন, তাঁকে যে মানব উপাসনা করবে; সে [সুখ দ্বারা] অনুভবযোগ্য হবে এবং আরো বিবিধ অন্ন [জীবনসাধন] ভোগ করবে৷" ~ অথর্ববেদ ১০/৮/২২
অর্থাৎ সেই সনাতন পরমেশ্বরকে স্মরণকারী ব্যক্তি উত্তম ভোক্তা হন ও সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত বিভিন্ন জীবনসাধন প্রাপ্ত হয়ে উন্নতি লাভ করতে থাকে।
"এই [সর্বব্যাপক] সনাতন [নিত্য স্থায়ী পরমাত্মা] এবং তিনি আজ [প্রতিদিন] নিত্য নবীন হয়ে থাকেন। দিন ও রাত্রি উভয়ে একে অপরের দ্বিবিধ রুপ দ্বারা উৎপন্ন হয়ে থাকে।" ~ অথর্ববেদ ১০/৮/২৩
অর্থাৎ রাত-দিনের এই চক্র সেই সৃষ্টির আদি হতেই চলছে। তারপরেও প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত আমাদের কাছে নতুনের মতো লাগে। ঠিক তেমনি অনাদি অনন্ত সনাতন হয়েও ঈশ্বর সবসময় নবীন।
এই ধর্ম আমাদের শেখায় যে ধর্ম কোনো কায়িক পরিচয় নয়, এটি আত্মার উন্নতি, প্রকৃতির যথাযথ উপযোগ গ্রহণ এবং সমন্বয়ের পথ।
সনাতন ধর্ম শান্তির ও সহিষ্ণুতার ধর্ম
সনাতন ধর্ম কখনোই জোরপূর্বক ধর্মপ্রচার, ভয়ভীতি প্রদর্শন বা অর্থের লোভ দেখিয়ে কাউকে দীক্ষিত করার পন্থায় বিশ্বাস করে না। এটি মুক্ত চিন্তা, যুক্তি ও আত্মোপলব্ধিকে গুরুত্ব দেয়। বেদে বলা হয়েছে_
"বিশ্বের সকলকে আর্য অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ করো।" ~ ঋগ্বেদ ৯/৬৩/৫
"প্রকৃত মননশীল মানুষ হও এবং অন্যকেও মানুষ হিসেবে গড়ে তোল।" ~ ঋগ্বেদ ১০/৫৩/৬
"সর্বভূতের কল্যাণের মহৎ চিন্তায় নিজের মনস্থির করো।" ~ যজুর্বেদ ৩৪/১
এই কয়েকটি প্রেরণাই প্রমাণ করে; সনাতন ধর্ম গোঁড়ামি নয়, বরং সহনশীলতা ও উদারতার সর্বোচ্চ শিখর। এই ধর্ম অন্যকে তুচ্ছ না করে, নিজেকে ও অন্যকেও শুদ্ধ করে আত্মোন্নতির সাধনা শেখায়।
সংস্কৃতি ও আচার : শুদ্ধ জীবনযাপনের নির্যাস
সনাতন ধর্মের প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠান কেবল ধর্মীয় নয়, বরং মানবমাত্রের উপকার ও শৃঙ্খলার অংশ। যেমন:
- ১। যজ্ঞ - ইন্দ্রিয় সংযম ও ত্যাগের মাধ্যমে পরিবেশ ও আত্মার শুদ্ধির প্রতীক।
- ২। জপ - মনঃসংযোগ ও শব্দশক্তির দ্বারা আত্মস্মরণ ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের প্রতীক।
- ৩। ধ্যান - চেতনার একাগ্রতা ও অন্তর্দৃষ্টি জাগরণের মাধ্যমে মানসিক স্থিতির প্রতীক।
- ৪। প্রাণায়াম - শ্বাসনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রাণশক্তি ও শারীরিক সুশৃঙ্খলার প্রতীক।
- ৫। পূজা - শ্রদ্ধা ও ভক্তির মাধ্যমে নিয়মিত আচরণ ও মানসিক শুদ্ধতার প্রতীক।
- ৬। উপবাস - ইচ্ছাশক্তি ও সংযমের মাধ্যমে শরীর-মন নিয়ন্ত্রণের প্রতীক।
- ৭। দান - অপরের কল্যাণে ত্যাগ ও কর্তব্যবোধের মাধ্যমে মানবিক শৃঙ্খলার প্রতীক।
- ৮। স্নান - বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ শুচিতার মাধ্যমে দৈনিক শৃঙ্খলার প্রতীক।
- ৯। সৎসঙ্গ - সৎচিন্তা ও চরিত্র গঠনের মাধ্যমে মানসিক উন্নতির শৃঙ্খলার প্রতীক।
- ১০। প্রণাম - নম্রতা ও বিনয়ের মাধ্যমে সামাজিক ও আত্মিক শৃঙ্খলার প্রতীক।
মানবমাত্রের কল্যাণ ও সুখ-শান্তির জন্য উপযুক্ত, তার সাধারণ কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো।
এই ধর্মে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে এক সূত্রে গাঁথার জন্য এমন একটি শৃঙ্খলা রচিত হয়েছে, যা যুগে যুগে মানবসভ্যতার স্থিতি ও শুদ্ধতার জন্য অনন্য উদাহরণ।
বিশ্বকল্যাণময় দর্শন
সনাতন ধর্ম শুধু আত্মমুক্তির লক্ষ্য স্থির করেনি, বরং সমগ্র বিশ্বের কল্যাণ চেয়েছে। এখানে আত্মার মুক্তি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অন্যের কল্যাণও ততটাই প্রয়োজনীয়। বেদ-উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে_
"হে মনুষ্য! উপরে ওঠাই হবে তোমার একমাত্র লক্ষ্য । পতিত হওয়া তোমার স্বভাবজাত নয় । দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন যাপনের শক্তি এবং দক্ষতা তোমাকে দেওয়া হয়েছে । এসো এবং পরমানন্দের এই শারীরিক রথে আরোহন করো এবং অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করো । অন্যের কল্যাণের জন্য জীবনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান প্রচার করো।" ~ অথর্ববেদ ৮/১/৬
"হে মনুষ্য! তোমরা এক সঙ্গে চল, এক সঙ্গে মিলিয়া আলোচনা কর। তোমাদের মন উত্তম সংস্কার যুক্ত হউক। পূর্বকালীন জ্ঞানী পুরুষেরা যেরূপ উত্তম কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করিয়াছে, তোমরাও সেইরূপ কর।" ~ ঋগ্বেদ ১০/১৯১/২
"তোমাদের সকলের মত এক হউক, মিলন ভূমি এক হউক, মন এক হউক, সকলের চিত্ত সম্মিলিত হউক, তোমাদের সকলকে একই মন্ত্রে সংযুক্ত করিয়াছি, তোমাদের সকলের জন্য অন্ন ও উপভোগ একই প্রকারের দিয়াছি।" ~ ঋগ্বেদ ১০/১৯১/৩
"তোমাদের সকলের লক্ষ্য সমান হউক, তোমাদের হৃদয় সমান হউক, তোমাদের মন সমান হউক। এই ভাবে তোমাদের সকলের শক্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হউক।" ~ ঋগ্বেদ ১০/১৯১/৪
এই প্রার্থনায় কেবল সনাতনী নয়, সকল মনুষ্য তথা জীবের শান্তি ও মঙ্গলের আহ্বান জানানো হয়েছে। এটি একমাত্র সনাতন ধর্মেই সম্ভব, যেখানে জীবজগৎকে ‘পর’ নয়, ‘পরম’ জ্ঞানে দেখা হয়।
একজন সনাতনী ধর্মান্তরের ফলে কী হারায়?
সনাতন ধর্ম (হিন্দুধর্ম) কেবল একটি বিশ্বাস নয়; এটি একটি সভ্যতা, একটি জীবনচক্র, এবং একটি অনাদি সত্যের উত্তরাধিকার। কেউ যখন সনাতন থেকে ধর্মান্তরিত হয়, তখন সে কেবল উপাসনার রীতিনীতিই বদলায় না; বরং সে হারায় নিজের মূল, পরিচয়, বোধ এবং ভবিষ্যতের পথ। নিচে যুক্তিসম্মতভাবে বিশ্লেষণ করা হলো, একজন সনাতনী ধর্মান্তরের মাধ্যমে কী হারায়:
১ . ঐতিহ্যগত আত্মপরিচয় ও বংশগত উত্তরাধিকার
সনাতন ধর্মের মূল শিকড় চলে গেছে বেদ তথা ঋগ্বেদীয় ঋষিদের পর্যন্ত; যারা "আত্মা", "ঋত", "ধর্ম", "যজ্ঞ" ও "তপস্যা"র মাধ্যমে সত্য অনুসন্ধান করেছেন। ধর্মান্তরের মাধ্যমে ব্যক্তি তার এই মহাকালের উত্তরাধিকার বিসর্জন দেয়। সে আর সেই ঋষিসন্তান থাকে না, বরং নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয় শাশ্বত ঐতিহ্যের প্রবাহ থেকে।
২. যুক্তির স্বাধীনতা ও আত্মবিকাশের পথ
সনাতন ধর্ম একমাত্র বিশ্বাসব্যবস্থা যেখানে ঈশ্বরকে প্রশ্ন করা, বিভিন্ন দর্শন অনুসন্ধান করা, এমনকি ঈশ্বরে অনাস্থাও প্রকাশ করা বৈধ। এখানে চার্বাক থেকে শুরু করে উপনিষদের আত্মজ্ঞান পর্যন্ত রয়েছে যুক্তির বৈচিত্র্য। ধর্মান্তরের ফলে ব্যক্তি এক কঠোর, একমাত্রিক ও ‘অবৈধ প্রশ্ন নিষিদ্ধ’ ব্যবস্থায় প্রবেশ করে, যেখানে যুক্তি নয়; অন্ধ আনুগত্যই ধর্ম।
সনাতন ধর্ম অনুযায়ী, আত্মা অজন্মা, অবিনাশী এবং বিভিন্ন জীবনে নিজের কর্মফলের মাধ্যমে উন্নতি করে মোক্ষলাভ করে। এই ধারাটি মহাজাগতিক ন্যায়বোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ধর্মান্তরের পর এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যক্ত হয়, আর ব্যক্তি এক সংকীর্ণ ধারণায় বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় "এক জীবন, এক বিচার, একবারেই চিরস্থায়ী পুরস্কার বা শাস্তি"।
সনাতন ধর্মে জীবন একটি চক্র, যেখানে ব্যক্তি ব্রহ্মচার্য, গার্হস্থ্য, বনপ্রস্থ ও সন্ন্যাস আশ্রম পার করে পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হয়। এই ধারাটি মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা ও বয়সভিত্তিক মনোবিজ্ঞানকে সম্মান করে। ধর্মান্তরে ব্যক্তি হারায় এই জীবনের স্বাভাবিক উন্নয়নরূপকে, এবং ঢুকে পড়ে একরৈখিক, দমনমূলক ধারণার জালে।
সনাতন ধর্মের প্রতিটি রীতি প্রকৃতি ও জীবনের সঙ্গে যুক্ত: প্রকৃতি শ্রদ্ধা / পূজা, বৃক্ষারোপণ, অন্নপ্রাশন, রথযাত্রা, দীপাবলি, জন্মাষ্টমী প্রভৃতি। ধর্মান্তরের ফলে ব্যক্তি এইসব ঋতুবৈচিত্র্যভিত্তিক উৎসব ও জীবনের প্রাকৃতিক উদযাপনকে হারায় এবং গ্রহণ করে এককেন্দ্রিক, ইতিহাসবিচ্ছিন্ন ও সংস্কারহীন উপাসনা-সংস্কৃতি।
সনাতন ধর্মে আত্মোন্নতি একমাত্র নিজ সাধনার ফল। যোগ, ধ্যান, ব্রত, উপবাস ও স্বচিন্তনের মাধ্যমে অর্জনই মোক্ষের পথ। ধর্মান্তরের পর ব্যক্তি নিজ সত্তার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং একটি বাইরের ‘উদ্ধারকর্তা’ বা ‘বিশেষ বার্তাবাহকের’ ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
বেদ, উপনিষদ, আচরণ্যক, মহাভারত, রামায়ণ, ভগবদ্গীতা, দর্শনসমূহ, সূত্রসমূহ ও সংহিতা ই্যাতাদি - সব মিলিয়ে সনাতন ধর্ম এক অনন্ত জ্ঞানভাণ্ডার। ধর্মান্তরের ফলে ব্যক্তি এই চিরন্তন মনীষার প্রবাহ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিযুক্ত করে এবং নিজ জ্ঞানের শিকড় হারিয়ে ফেলে।
ধর্মান্তরের ফলে ব্যক্তির পারিবারিক সংস্কার ভেঙে যায়। সে নিজ ধর্মীয় উপভোগ্য ইত্যাদি সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলে।
সনাতন ধর্মান্তর মানে কেবল আত্মপরিচয়ের বিলুপ্তি নয়, বরং হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আত্মত্যাগের প্রতি অবজ্ঞা। এক কালে যারা ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন ধর্ম বাঁচাতে, ধর্মান্তরের ফলে তাদের আত্মোৎসর্গকেও অস্বীকার করা হয়।
সনাতন ধর্মে মুক্তি আসে জ্ঞান, সদাচরণ ও আত্মজয়ের মাধ্যমে। ধর্মান্তরের ফলে ব্যক্তিকে বলা হয় "তুমি পাপী", "তোমার পাপ মোচনের জন্য নির্দিষ্ট পথ ছাড়া মুক্তি নেই"। এটি ব্যক্তি-স্বাধীনতার সম্পূর্ণ অপমান এবং মানসিক পরাধীনতার এক রূপ।
ধর্মান্তরিত রোধের কার্যকর ধাপ সমূহ
এ-ই “ধর্মান্তর” ভয়াবহ বাস্তবতা থেকে আমাদের পরিবার, সমাজ ও প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে দরকার গভীর চেতনা, ধর্মীয় অনুশীলন ও সঠিক দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশ অগ্নিবীর এই উদ্দেশ্যে যেসব কার্যকর নীতির কথা বলে, তা সত্যিকার অর্থেই একটি রক্ষাকবচরূপে কাজ করবে। যদি শিশু থেকেই একজন সন্তানের উপর এ-ই কার্যক্রম গুলো পূরণ করা হয়।
অগ্নিবীরের পঞ্চনীতি- যা প্রতিটি সনাতন অনুসারীর জানা ও পালন করা জরুরি:
১. বেদ ও বৈদিক শাস্ত্র পড়া ও পড়ানো
সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি হলো বেদ। বেদ মানে জ্ঞান; এই জ্ঞানই মানবজীবনের প্রকৃত লক্ষ্য নির্দেশ করে। অথচ অধিকাংশ সনাতনীই জানেন না তাঁদের ধর্মের শাশ্বত মূলভিত্তি কী, কেন তা শ্রেষ্ঠ। বেদ ও উপনিষদে এমন গভীর আত্মজ্ঞান, চেতনা, বৈজ্ঞানিক বোধ ও সর্বজনীন মানবিকতা রয়েছে, যা জানলে কেবল ধর্ম নয়; নিজেকে হারানোও অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই পরিবার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আশ্রম থেকে সমাজ; সবখানে নিয়মিত বেদাদি পাঠ, আলোচনা ও তার যথাযথ ব্যাখ্যা প্রচলন করতেই হবে।
২. সনাতন ধর্মের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরা
একটি জাতির আত্মপরিচয়ের মূলে থাকে তার ইতিহাস। সনাতন ধর্মের ইতিহাস কেবল আধ্যাত্মিকতাই নয়, ত্যাগ, জ্ঞান, শাসন, শিল্প ও মানবতার গৌরবগাথা। শ্রী রাম, শ্রী কৃষ্ণ, বিদুর, চাণক্য, মনু মহারাজ থেকে মহর্ষি দয়ানন্দ ও স্বামী বিবেকানন্দ; এনাদের সবাই আত্মমর্যাদা ও ধর্মনিষ্ঠার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত। যখন একটি সমাজ তার ইতিহাস জানে না, তখন সে শিকড়হীন গাছের মতো; যা সামান্য বাতাসেই ভেঙে পড়ে। এই শিকড়হীনতাই বাইরের শক্তিকে ঢুকতে দেয়, ধর্মান্তরের সুযোগ তৈরি করে। তাই সনাতনের ইতিহাস পাঠ আবশ্যিক।
৩. ধর্ম ও মতবাদের মধ্যে পার্থক্য জানানো
ধর্ম (Sanatan Dharma) কোনো মত নয়; এটি শাশ্বত, কারণ এটি প্রকৃতি ও চেতনার সাথে একাত্ম। এটি আত্মার, কর্মফলের ও মোক্ষের বিজ্ঞানসম্মত পথ। পক্ষান্তরে মতবাদ বা "ইজম" (ism) কেবল কোনো এক সময় বা সমাজে উদ্ভূত একটি বিশ্বাসের কাঠামো, যা পরিবর্তনশীল ও সংকীর্ণ। যখন সনাতন ধর্মকে অন্যান্য মতবাদের সমতুল্য ভাবা হয়, তখনই এর মৌলিক শ্রেষ্ঠত্ব ভেঙে পড়ে। তাই নতুন প্রজন্মকে শেখাতে হবে; সনাতন ধর্ম কোনো ধর্মীয় মত নয়, এটি জীবন ও ব্রহ্মাণ্ডের মৌলিক সত্য। এই পার্থক্য বোঝা মানেই আত্মরক্ষা।
৪. বৈশ্বিক ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা জানানো
বর্তমানে ধর্মান্তর কোনো সাধারণ ঘটনা নয়; এটি পরিকল্পিত, সংগঠিত ও বহুমাত্রিক একটি আগ্রাসন। একে শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হবে না। প্রেম, বন্ধুত্ব, উপহার, অর্থ, সাহায্য, মোহ; সব কিছুই এখন ব্যবহৃত হয় ধর্মান্তরের হাতিয়ার হিসেবে। শুধু কূপমণ্ডূক ভাবনায় আটকে থাকলে এই ফাঁদ বোঝা যাবে না। যুবসমাজকে স্থানীয় ও বৈশ্বিক কৌশল, সিনেমা-সিরিজে স্নায়ুযুদ্ধ এসব বিষয়ে সচেতন করতেই হবে, নইলে তারা প্রেমের ছলে বা দয়ার ছলনায় সর্বস্ব হারাবে।
৫. সনাতন ধর্ম কেন শ্রেষ্ঠ এবং ধর্মত্যাগের পরিণতি জানানো
সনাতন ধর্ম শ্রেষ্ঠ, কারণ এটি কেবল বিশ্বাস নয়; এটি একাধারে বিজ্ঞান, চেতনা ও কর্মনীতির পথ। এখানে ভক্তির সাথে যুক্ত আছে শক্তির সাধনা, কর্মের সাথে যুক্ত আছে আত্মউন্নয়ন, ও জ্ঞানের সাথে যুক্ত আছে মুক্তির দিশা। এই ধর্ম পরিত্যাগ মানে শুধু একটি পথ নয়; নিজেকেই হারানো। ধর্মত্যাগের পর একজন ব্যক্তি আত্মপরিচয়, সামাজিক স্বীকৃতি, ও নিজস্ব শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সে পড়ে অন্ধ অনুকরণে ও অপরিচিত ব্যবস্থায়। এটা এক ধরনের আত্মঘাতী বিকৃতি, যা ব্যক্তিকে ভেঙে দেয় এবং জাতিকে দুর্বল করে তোলে।
সনাতন ধর্ম কোনো কুসংস্কার নয়; এটি আত্মোপলব্ধি, শাশ্বত সত্য ও ন্যায়ের পথ। যারা জ্ঞানের আলোকে আন্তরিকভাবে ধর্মের গভীর অর্থ বোঝেন, তারা কখনোই নিজেদের ধর্মবোধ পরিত্যাগ করেন না। কারণ ধর্ম তাদের কাছে কেবল একটি বিশ্বাস নয়, বরং তা জীবনের মূল স্তম্ভ, আদর্শ, আচরণ, আত্মশুদ্ধি ও পরমার্থের পথ।
সুতরাং আমাদের কর্তব্য; প্রথমে নিজে জানুন, তারপর বুঝুন, হৃদয়ে ধারণ করুন, চর্চা করুন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেই আলো দেখান। একজন প্রকৃত সনাতনী কখনোই প্রলোভন, ভ্রান্ত প্রচার বা চাপে পড়ে ধর্মচ্যুত হন না; যদি তার মধ্যে থাকে আত্মবিশ্বাস, ধর্মজ্ঞান এবং নিজের শিকড়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
পরিশেষে, বিশ্ব কল্যাণের প্রর্থনা:
"অসত্য থেকে আমাকে সত্যে নিয়ে যাও, অন্ধকার থেকে আমাকে আলোতে নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে আমাকে অমৃতে নিয়ে যাও।" ~ বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ১।৩।২৮
"জগতের সবাই যেন সুখী হয়, সকলে যেন নিরাময় হয়, সকল মানুষ পরম শান্তি লাভ করুক, কশ্মিনকালেও যেন কেহ দুঃখ বোধ না করেন। ঈশ্বর আমাদেরকে আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক এই তিন প্রকার দুঃখ হতে শান্তি প্রদান করুন।" ~ উপনিষদ হতে অনুপ্রাণিত
"দ্যুলোক,, অন্তরিক্ষলােক ও পৃথিবীলোক শান্তিময় হউক। জল, ঔষধি ও বনস্পতি শান্তিময় হউক। সব বিদ্বান, বেদপাঠ এবং যাহা কিছু, সবই শান্তিময় হউক। সর্বত্র শান্তিময় হউক। সেই শান্তি আমি যেন প্রাপ্ত হই।" ~ যজুর্বেদ ৩৬/১৭
ও৩ম্ শান্তি। নমস্কার।
সূত্র: ফেসবুক
0 Comments