বাংলাদেশে আমাদের হিন্দু জীবন - ইন্দ্রনীল রায়

বাংলাদেশে আমাদের হিন্দু জীবন - ইন্দ্রনীল রায়

আমার নব্বই এর দশকে জন্ম। আমরা যখন ছোটো ছিলাম তখন হিন্দু-মুসলমান কী বুঝতাম না। সাম্প্রদায়িকতা কী এবং কেন বুঝতাম না। প্রাইমারী স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা কালে মনে পড়ে না কোনোরকম কমিউনাল হেইটের শিকার হয়েছি। শুধু জানতাম কালো পিঁপড়ে হিন্দু আর লাল পিঁপড়ে মুসলমান! কারণ কালো পিঁপড়ে কামড়ায় না! অর্থাৎ ছোটবেলা থেকেই সমাজ আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে হিন্দু মানে দুর্বল। হিন্দু মানেই সহনশীল। হিন্দু হয়ে জন্মেছো মানেই তোমাকে শত অত্যাচারে, শত বৈষম্যে মুখ বুজে থাকতে হবে।


এরপর হাইস্কুলে উঠলাম। তখন মাঠে খেলতে যেতাম। একটু বড় হয়ে হিন্দু মুসলিম বিভেদ একটু একটু করে বুঝতে শিখলাম। মুসলিম বন্ধুরা আমাদের উদ্দেশ্য করে ক্ষ্যাপানোর জন্য বলতো, "হিন্দু হিন্দু তুলসী পাতা, হিন্দুরা খায় গরুর মাথা"। আমরা শুনতাম কিন্তু কিছু বলতাম না। বাড়িতে মা বাবাকে বললে উল্টো আমাদের উপরেই রাগ করতো। বলতো এসব কথা নিয়ে বাইরে যেন আলোচনা না করি। আমাদের রাগ হতো, অভিমান হতো, আবার পরক্ষণেই সব ভুলে একসঙ্গে খেলতাম। তবে মনে এক দাগ কেটে যেতো। বুঝতাম ওদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য আছে। ওরা যা পারে, আমরা তা পারি না।


জীবনে প্রথমবার মালাউন গালিটা শুনেছিলাম ক্লাস সেভেনে থাকতে। তখন মা বাজারে পাঠাতেন টুকটাক এটা সেটা কিনে আনতে। দেখেছিলাম এক দোকানদার তার কর্মচারীকে মালাউনের বাচ্চা বলে গালি দিলেন। তখন বুঝিনি মালাউন মানে কী। এরপর নিজেই মালাউন গালি শুনলাম ক্লাস এইটে পড়ার কালে! খুব কাছের এক বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া হলে সে এই গালিটা আমাকে দেয়। ততদিনে জেনে গেছি এর অর্থ কী!


এরপর থেকে যত বয়স হয়েছে দুনিয়াকে আরও ভালভাবে চিনেছি, জেনেছি, বুঝেছি। বুঝেছি বাংলাদেশে মুসলমানদের হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক গালি দেওয়াটা নৈতিক অধিকার! হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করা মুসলমানদের আমোদের একটি অংশ! হিন্দুদের গরু খেতে বলাটা তাদের ঐতিহ্য!


তখন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমাদের ফিজিক্স শিক্ষক একদিন কোনো কারণ ছাড়াই মা কালী'কে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি করলেন। তখন ক্লাসে আমরা মুসলমান ছাত্রদের তুলনায় হিন্দু ছাত্ররা সংখ্যায় বেশি। তা সত্ত্বেও আমরা কেউ প্রতিবাদ করলাম না। এমনকি ক্লাস শেষে বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপও করিনি। কারণ বিষয়গুলো আমাদের কাছে খুব সাধারণ! শিক্ষক হলেও তিনি তো মুসলমান। হিন্দুধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ করার অলিখিত অধিকার তার রয়েছে!


বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অভিজ্ঞতার শেষ নেই! নিজের এলাকা ছেড়ে গেলাম ঢাকায়। উঠলাম এক মেসে। সেখানে আমি ছাড়া সবাই মুসলমান। ইচ্ছা ছিল নিজে রান্না করে খাবো। কিছুদিন রান্না করে খেলামও। কিন্তু পরে নিয়ম করা হল আলাদা রান্না করা যাবেনা, মেসের মিলই খেতে হবে। ওরা মাসে দুই একবার গরু খেতো। তখন পুরো এক সপ্তাহ আমি মিল বন্ধ রেখে বাইরে খেতাম। ওরা বুঝতো আমার অসুবিধা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও উল্টো আমাকে গরু খেতে বলতো। বলতো আমার আগে যে হিন্দু ছেলেটা ওদের সাথে থাকতো সে নাকি চেয়ে চেয়ে গরু খেতো! আমি জানি, এই সেইম ডায়লগ বাংলাদেশে প্রত্যেক হিন্দুই শুনেছে!


আমরা হিন্দুরা গরু কেন খাই না? গরু আমাদের মা কেন? অমুক দাদা গরু খায় তুমি কেন খাবে না? একবার খেলে কী হয়? একবার খেয়ে দেখো কত টেস্টি। এমন হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয়েছে মেসে এবং ক্লাসমেটদের কাছে। পরে বাধ্য হয়ে মেস বদলে নিজে মেস চালিয়েছি।


বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস চলাকালে প্রায়ই আমাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। ক্লাস করছি পলিমার সায়েন্সের সেখানে আলোচনা চলেছে নামাজের ফজিলত কী! কোরান কেন বিজ্ঞানের ঊর্ধ্বে ইত্যাদি। মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে ওয়াশরুমের নাম করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতাম। আমাদের বেশ কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন যারা ক্লাসে বিভিন্ন উসিলায় ধর্ম নিয়ে আলাপ জুড়ে দিতেন। একদিন আমাদের ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যার ক্লাসে বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ব্যক্তিজীবনে ইসলামের চর্চা করতেন! কারও দ্বিমত থাকলে যেন তার রুমে গিয়ে আলাপ করে আসে!


একবার তো আমি সরাসরি ক্লাসেই আমাদের এক শিক্ষকের থেকে ইসলামের দাওয়াত পেলাম! তিনি সরাসরি আমার নাম ধরে বললেন, "মুসলমান হয়ে যাও। অনেক শান্তি।" বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলাম, "স্যার আমি আমার ধর্মেই অনেক শান্তিতে আছি। আমার কাছে আমার ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ।" তখন আমার এক সহপাঠী (বন্ধু বলতে দ্বিধা হয়) বলেছিল, "স্যার! হেদায়েত আল্লাহর দান। সবার ভাগ্যে জোটে না।"


আমি ফেসবুকে হিন্দু নির্যাতনের নিউজ শেয়ার করায় আমার বন্ধুমহলে আমার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল। অথচ তারা ঠিকই কাশ্মীর থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত কান্না করতো!


শিক্ষাজীবনের একপর্যায়ে কয়েক মাসের জন্য একটি রেস্টুরেন্টে পার্ট টাইম জব নিয়েছিলাম। সেখানে একদিন জনপ্রিয় ইউটিউবার Rnar এর রাকিব ও তার বন্ধুবান্ধব এলেন। তখনও তিনি আজকের মতো এতটা জনপ্রিয় হননি। আমি শুরু থেকেই তার ভিডিও দেখতাম ও পছন্দ করতাম। রাকিবকে বললাম আমি তার ভিডিও দেখি একদম শুরু থেকে। তিনি খুশি হলেন। ইচ্ছা ছিল তারা খাবার শেষ করলে একটা সেলফি নেবো। কিন্তু খাবার টেবিলে রাকিব ও তার সহকর্মী বা বন্ধুদের আলাপ আলোচনা শুনে ইচ্ছেটা মরে গেল! তাদের আলোচনার বিষয় ছিল হিন্দুরা গরুর মুত খায়, হিন্দুরা নোংরা ইত্যাদি!


এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই। আজকাল দেখছি ছোটছোট বাচ্চারা প্রাইমারী স্কুল থেকেই কমিউনাল বুলিং এর শিকার হচ্ছে। মা বাবারা ভয় পাচ্ছেন তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে বা কোথাও একা ছাড়তে। আপনাদের কি মনে হয়না আমরা চুপ থাকি তাই পরিস্থিতি আরও জটিলতর হচ্ছে? কমিউনাল বুলিং নিয়ে খোলামেলা কথা বলার সময় কি আজও হয়নি? চুপ থাকলে সমস্যার সমাধান হবে?


আরেকটি মজার ব্যাপার হচ্ছে, একজন হিন্দু সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হলে আরেকজন হিন্দু কখনই সাপোর্ট করে না। কখনও কোনো সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন মুসলিমের থেকে হেল্প পাওয়া গেলেও হিন্দুরা কখনই পাশে দাঁড়ায় না। হিন্দুরা কি আসলেই কালো পিঁপড়া?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ