চন্দ্রাবতীর জীবন থেকে বর্তমান; ধর্মান্তরের স্টাইলটি প্রায় একই আছে

চন্দ্রাবতী

ভারতবর্ষের বিশ্বাসে ধর্মান্তর ছিল না। সকলেই ছিল যার যার ইষ্ট অনুসারে বিভিন্ন সম্প্রদায় ভূক্ত। যারা শিবের উপাসনা করতেন, তাদের বলা হত শৈব। একইভাবে কেউ বিষ্ণুর উপাসনা করে বৈষ্ণব নামে অথবা শক্তিকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে শাক্ত নামে খ্যাত হতেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেখা যায়, একই পরিবারে কেউ শিবের উপাসক ছিলেন ; তেমনি আবার বুদ্ধ বা মহাবীরের উপাসক ছিলেন। সনাতন ধর্মাবলম্বী হয়েও কেউ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের এবং জৈন সম্প্রদায়ের প্রবর্তক মহাবীর বা বিভিন্ন তীর্থঙ্করের উপাসনা করলে তাদের আলাদা ধর্ম বিশ্বাস হিসেবে চিহ্নিত করা হত না। বিষয়টি ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীর খ্যাতিমান গদ্যকবি বাণভট্টের 'হর্ষচরিত' গদ্যকাব্যের পঞ্চম উচ্ছ্বাসে দৃষ্টান্ত হিসেবে পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের পিতা মহারাজ প্রভাকরবর্ধন যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন তাঁর আরোগ্য কামনা করে যেমন কুলদেবতার পূজা করা হচ্ছিল, ভগবান শিবের পূজা করা হচ্ছিল; তেমনি বৌদ্ধ বিদ্যামন্ত্র 'মহামায়ূরী' পাঠ করা হচ্ছিল।


বর্তমানে কেউ ধর্মান্তরিত হলে যে, তাঁর বিশ্বাস সহ আবহমান সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন করতে হয়, এ বিষয়টি প্রাচীন ভারতবর্ষে ছিল না। এ বিষয়টি এদেশে এসেছে প্রথম আরবীয়, তুর্কি এবং সর্বশেষ ইউরোপীয় ধর্মীয় বিশ্বাসকে উপলক্ষ করে। আরবীয় এবং ইউরোপীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাসে নব্য এ ''ধর্মান্তর শব্দটি শুধু একটি শব্দই নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে অসংখ্য ঘটনার অভিঘাত। যাদের পরিবারে বিষয়টি ঘটে, তারা এই অভিঘাত হাড়েমজ্জায় টের পায়। সনাতন বিশ্বাসে যেহেতু ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি নেই; আছে শুধু শুদ্ধিকরণ যজ্ঞ। অর্থাৎ কেউ যদি মনে করে সে অশুদ্ধ পাপপথে এতদিন চলেছে, তার যখন বিষয়টি জ্ঞানোদয় হবে তখনই সে শুদ্ধি যজ্ঞের মাধ্যমে নিজেকে শুদ্ধ করে পাপের পথ অধর্মের পথ থেকে নিজেকে প্রত্যাহৃত করবে। বিপরীতে যারা ধর্মান্তরিত করে নিজেদের লোকবল বৃদ্ধি করতে চায় তাদের প্রধান লক্ষ্যই হল হিন্দু সম্প্রদায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের তাদের কাছে মৎস্য শিকারের নদী; যে নদীতে তারা আসে ধর্মান্তর নামক মৎস্য শিকারে। 


বর্তমান বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম বৃহৎ সামাজিক সমস্যা হল, স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় ফাঁদে পরে ধর্মান্তরিত হওয়া। এ ধর্মান্তরিত হওয়ার ফাঁদে হিন্দু সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত আজও পরছে। কিন্তু প্রায় হাজার বছর ধরে তারা বৈদেশিক ধর্মান্তরের অভিঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হলেও, খুবই আশ্চর্যজনক হলেও বিষয়টি সত্য যে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিষয়টি নিয়ে আজও স্বাচ্ছন্দ্যে খোলাখুলিভাবে কথা বলে না। নিজে সচেতন হয়ে অন্যদের সচেতন করে না। তবে বিষয়টি থেকে হিন্দু সম্প্রদায় মানুষেরা যদি সত্যিকার ভাবেই উত্তরণ চায়, তবে তাদের বিষয়টির ভয়াবহতা নিয়ে খোলাখুলিভাবে সকলের কথা বলতে হবে। একটি সময়ে মারণব্যাধি 'এইডস' রোগটি নিয়ে মানুষ অনেক লজ্জা পেত; বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা বলতে চাইত না। কিন্তু আজ সকলেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলে এবং রোগটির ভয়াবহতা সম্পর্কে জানে। এতে মানুষ দিনেদিনে যেমন সচেতন হয়েছে;  ঠিক তেমনি 'এইডস' রোগটিও আর মানুষকে অসচেতন ভাবে গ্রাস করতে পারে না।তবে এরপরেও যারা ভয়াবহ এই রোগের শিকার হয়; তারা অনেকটা জেনে-বুঝেই স্বেচ্ছায় 'এইডস' নামক মরণসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মঘাতী হয়।


এ ধর্মান্তরিত হওয়ার ফাঁদে কত যে হিন্দু পরিবার; কত মা-ছেলের সম্পর্ক; কত ভাই-বোনের সম্পর্ক; কত ভালবাসার প্রিয়জন এবং কতশত আত্মীয় পরিজন জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এর সঠিক পরিসংখ্যান কেউ কোনদিন দিতে পারবে না। শুধু যার পরিবার পরিজন যায়, তারাই অনুভব করতে পারে এর মর্মান্তিক বেদনা। আজ থেকে প্রায় পাঁচশত বছর পূর্বে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর জীবনেও এমনি ধর্মান্তরের নিষ্ঠুরতা দেখা যায়। প্রেমিক জয়ানন্দকে আমৃত্যু ভালবেসে গিয়েছেন, কিন্তু কোনদিনও আপন করে কাছে পাননি। প্রেমিকের শুধুই অনাকাঙ্ক্ষিত ধর্মান্তরিত হয়ে যাওয়ার অভিঘাতে। কেউ ধর্মান্তরিত হলে, সেই ব্যক্তির পরিণতি যে করুণ হয়; একথা জয়ানন্দ জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। আজও ফুলেশ্বরী নদীর জল কলকল ধ্বনিতে এ ঘটনার ব্যথা বুকে বয়ে নিয়ে চলছে। বিষয়টি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদগীতার তৃতীয় অধ্যায়ে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন।


শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাত্ স্বনুষ্ঠিতাৎ৷

স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ৷৷

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা: ৩.৩৫)


"নিজ ধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত আপাত দৃশ্যমান পরধর্ম থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই নিজধর্ম সাধনে যদি মৃত্যুও হয়, তবেও সে ধর্ম কল্যাণকর ; কিন্তু পক্ষান্তরে পরধর্ম ভয়াবহ। "


চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির, কিশোরগঞ্জ
চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির, কিশোরগঞ্জ

মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে তিনজন খ্যাতিমান মহিলা কবিকে পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন চণ্ডীদাসের সাধনসঙ্গিনী রামতারা বা রামী, শ্রীচৈতন্যদেবের পার্ষদ মাধবী এবং কিশোরগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের চন্দ্রাবতী। চন্দ্রাবতী হলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি এবং মহিলা হিসেবে প্রথম বাংলা ভাষায় রামায়ণের রচয়িতা। কিশোরগঞ্জের সদর উপজেলার পাতুয়ারী গ্রামে তাঁর জন্ম। তিনি ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন মনসামঙ্গলের রচয়িতাদের মধ্যে অন্যতম কবি দ্বিজ বংশীদাস এবং মায়ের নাম সুলোচনা। দেশের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীর জীবনকাহিনী নাটকের চেয়েও নাটকীয় এবং বেদনাবিধুর। কিশোরগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের মানুষের লোকগাথায় এক করুণ রসে সিক্ত কিংবদন্তি চরিত্ররূপে চন্দ্রাবতীর প্রেমকথা আজও বহমান। কবি চন্দ্রাবতীর প্রেমের কথা মৈমনসিংহ গীতিকায় অর্ন্তভুক্ত ‘চন্দ্রাবতী’ পালাটিতে অত্যন্ত সুন্দর করে করে বর্ণিত হয়েছে। কবির মৃত্যুর পরে কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ 'চন্দ্রাবতী' পালাটি  রচনা করে। ৩৫৪ ছত্র ও ১২ অঙ্কে বিভক্ত নয়নচাঁদ ঘোষ প্রণীত 'চন্দ্রাবতী' পালায় কবি চন্দ্রাবতীর জীবনকাহিনী এক করুণ রসের আবহে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। ‘চন্দ্রাবতী’ পালা থেকে জানা যায়, চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দ ছেলেবেলা থেকেই একত্রে খেলাধুলা করে বেড়ে উঠতে থাকে। ধীরেধীরে তাঁরা একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হয়। কবি নয়ানচাঁদ ঘোষের ভাষায়:


এক দুই তিন করি ক্রমে দিন যায়।

 সকালসন্ধ্যা ফুল তুলে কেউ না দেখতে পায়।। 

 ডাল যে নোয়াইয়া ধরে জয়ানন্দ সাথী ৷৷

 তুলিল মালতী ফুল কন্যা চন্দ্রাবতী ৷৷

 একদিন তুলি ফুল মালা গাঁথি তার ।

 সেইত না মালা দিয়া নাগরে সাজায় ॥


চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দ এ দুইপরিবারের অভিভাবকদের সম্মতি ছিল বিয়েতে। কিন্তু বিধি বাম চন্দ্রাবতীর ললাটে। যেদিন তাঁদের বিয়ের দিন ধার্য করা হয়, সেদিনই ঘটে নাটকীয়তা। ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীর খ্যাতিমান গদ্যকবি বাণভট্ট তাঁর 'হর্ষচরিত' গদ্যকাব্যের পঞ্চম উচ্ছ্বাসে বলেছেন,


"চঞ্চল বিদ্যুৎ যেমন প্রথমে উজ্জ্বল আলোক দিয়ে পরে প্রচণ্ড বজ্রপাত ঘটায়; চঞ্চল ভাগ্যও তেমনি প্রথমে মানুষকে সুখ দিয়ে পরে দারুণ দুঃখ দিয়ে থাকে।"


বিয়ে দিন ধার্য হয় চন্দ্রাবতীর। বিয়ে দিনে বিবিধ মাঙ্গলিকতার মধ্যেই সংবাদ আসে, এক মুসলিম নারীর প্রতি আসক্ত জয়ানন্দ। জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর সাথে প্রতারণা করে একইসাথে দুজনের সাথেই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ ঘটনা জানাজানি হতে চন্দ্রাবতীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। 


ঢুল বাজে ডাগর বাজে জয়াদি জুকার।

 মালা গাথে কুলের নারী মঙ্গল আচার ॥ 

এমন কালে দৈবেতে করিল কোন কাম।

 পাপেতে ডুবাইল নাগর চৈদ্দ পুরুষের নাম।।

কি হইল কি হইল কথা নানান জনে কয়।

 এই যে লোকের কথা প্রত্যয় না হয় ৷৷

 পুরীতে জুড়িয়া উঠে কান্দনের রোল।

 জাতিনাশ দেখ্যা ঠাকুর হইল উতরুল ৷৷

“কপালের দোষ, দোষ নহে বিধাতার। 

যে লেখা লেখ্যাচ্ছে বিধি কপালে আমার।

 মুনির হইল মতিভ্রম হাতীর খসে পা। 

ঘাটে আস্যা বিনা ঝরে ডুবে সাধুর না। 

পাড়া-পড়সি কয় 'ঠাকুর কইতে না জুয়ায়। 

কি দিব কন্যার বিয়া ঘটল বিষম দায়।।

 অনাচার কৈল জামাই অতি দুরাচার।

 যবনী করিয়া বিয়া জাতি কৈল মার ॥"

শিরেতে পড়িল বাজ মঠের মাথায় ফোড়। 

পুরীর যত বাদ্যভাণ্ড সব হৈল দূর ॥

 ধুলায় বসিল ঠাকুর শিরে দিয়ে হাত।

 বিনামেঘে হইল যেন শিরে বজ্রাঘাত।।


ঘটনার আকস্মিকতায় চন্দ্রার অবস্থা মৃতপ্রায় হয়ে গেল। সে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে পাষাণের মত হয়ে যায়। তাঁর শুধুই মনে পড়ে, বাল্যকাল থেকে জয়ানন্দের সাথে বিভিন্ন স্মৃতি। একসাথে সকাল বেলায় ফুল তোলা, নদীর কুলেতে জলকেলি করা ইত্যাদি। 


“কি কর লো চন্দ্রাবতী ঘরেতে বসিয়া ।” 

সখিগণ কয় কথা নিকটে আসিয়া।।

শিরে হাত দিয়া সবে জুড়য়ে কান্দন ।

 শুনিয়া হইল চন্দ্রা পাথর যেমন ৷৷ 

না কান্দে না হাসে চন্দ্ৰা নাহি বলে বাণী।

 আছিল সুন্দরী বন্যা হইল পাষাণী ॥ 

মনেতে ঢাকিয়া রাথে মনের আগুনে। 

জানিতে না দেয় কন্যা জল্যা মরে মনে ॥

এক দিন দুই দিন তিন দিন যায় ।

 পাতেতে রাখিয়া বন্যা কিছু নাহি খায়।

 রাত্রিকালে শর-শয্যা বহে চক্ষের পানি।

 বালিস ভিজিয়া ভিজে নেতের বিছানি ॥

 শৈশবের যত কথা আর ফ্যলতুলা । 

নদীর কূলেতে গিয়ে করে জলখেলা ॥


প্রতারক প্রেমিক জয়ানন্দের স্মৃতিতে চন্দ্রাবতীর দিনের পড়ে দিন নির্ঘুম রাত্রি কাটে। সে পাগলিনীর মত হয়ে যায়। এর মধ্যেই চন্দ্রাবতীর জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। কিন্তু চন্দ্রাবতী বিয়ে না করতে অনড়। পিতা দ্বিজ বংশীদাস সম্মতি এবং চন্দ্রাবতীর ইচ্ছায় ভগবান শিবকেই পতিরূপে গ্রহণ করে শিবমূর্তির সাথে বিয়ে হয় চন্দ্রাবতীর। বাকি জীবন এভাবেই তিনি কঠোর তপস্যায় অতিবাহিত করে নিজেকে দেবীর পর্যায়ে উন্নীত করেন। পিতা দ্বিজ বংশীদাস তখন চন্দ্রাবতীকে শিবপূজা এবং সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় ‘রামায়ণ’ রচনার নির্দেশ দেন।


নয়নে না আসে নিদ্রা অধমে রজনী। 

ভোর হইতে উঠে কন্যা যেমন পাগলি।।

 বাপেত বুঝিল তবে কন্যার মনের কথা। 

কন্যার লাগিয়া বাপের হইল মমতা ॥

 সম্বন্ধ আসিল বড় নানা দেশ হইতে। 

একে একে বংশীদাস লাগে বিচারিতে ।

চন্দ্রাবতী বলে “পিতা, মম বাক্য ধর। 

জন্মে না করিব বিয়া রইব আইবর।

শিবপূজা করি আমি শিবপদে মতি। 

দুঃখিনীর কথা রাখ কর অনুমতি ॥”

 অননুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে।

"শিবপুজো কর আর লেখ রামায়ণে॥” 


পিতার নির্দেশ পালন করে, কবি চন্দ্রাবতী পরবর্তীকালে শিবপূজায় ব্রতী হয়ে জীবনের এক পর্যায়ে এসে রচনা করলেন এক অনন্যসাধারণ ‘রামায়ণ’। 


নির্মাইয়া পাষাণশিলা বানাইলা মন্দির ।

 শিবপূজা করে কন্যা মন করি স্থির ॥

 অবসরকালে কন্যা লেখে রামায়ণ।

 যাহারে পড়িলে হয় পাপ বিমোচন ॥

 জন্মথ থাকিব কন্যা কুলের কুমারী।

 একনিষ্ট হইয়া পূজে দেব ত্রিপুরারী ॥ 

শুধাইলে না কয় কথা মুখে নাহি হাসি। 

একরাত্রে ফুটা ফুল ঝাইরা হইল বাসি ॥

এমন কালেতে শান হইল কোন কাম ।

 যোগাসনে বৈসে কন্যা লইয়া শিবের নাম ॥ 

বম্ বম্, ভোলানাথ গাল-বাদ্য করি।

 বিহিত আচারে পূজে দেব ত্রিপুরারী ॥


মুসলমান নারীর সাথে সম্পর্কের ভুল যখন জয়ানন্দ উপলব্ধি করতে পারে, তখনই সে তাকে মানসিকভাবে পরিত্যাগ করে চন্দ্রাবতীর কাছে সম্পূর্ণ চলে আসতে চায়। কিন্তু মুসলমান কাজি সাহেব সুযোগ পেয়ে জয়ানন্দকে ধর্মান্তরিত করে, সেই মুসলমান নারীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তৎকালীন রাজনৈতিক চাপে বিয়ের জন্য ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে হয় জয়ানন্দকে। ধর্মান্তরিত হয়ে তার নতুন নাম হয় জয়নাল। ঘটনার আকস্মিকতায় চন্দ্রাবতী মনে নিদারুণ আঘাত পান। বিপরীতে জয়ানন্দও জীবন্মৃত হয়ে যায়। কাজীর মৃত্যুতে সুযোগ বুঝে জয়ানন্দ আবার চন্দ্রাবতীর কাছে ফিরে আসার মনস্থির করে। বৈশাখ মাসের এক খরতাপ দিনে, সে চন্দ্রাবতীর কাছে পত্র পাঠে। সে পত্রের ছত্রে ছত্রে চন্দ্রাবতীর কাছে অনুতপ্ত হয়ে ভুল স্বীকার করে। সনাতন ধর্ম ত্যাগের মানসিক যন্ত্রণা তাকে দগ্ধ করতে থাকে। সে বুঝতে পারে সে অমৃত ছেড়ে বিষপান করেছে এবং পবিত্র তুলসীগাছকে পরিত্যাগ করে বুনো শেওড়া গাছকে পূজা করতে গিয়ে মাথায় দুঃখের পসরা তুলে নিয়েছে। আজ তার চারিদিকে জলে বিষ, বাতাসে বিষ; তার জীবন শুধুই বিষময়। মৃত্যু ছাড়া এ বিষময় জীবন থেকে পরিত্রাণের কোন পথ নেই।


জয়ানন্দ দিছে পর শূন চন্দ্রাবতী।। 

পত্রে পড়িল কন্যা সকল বারতা।

 পত্রেতে লেখ্যাচ্ছে নাগর মনের দুঃখকথা।।

"শুনেরে প্রাণের চন্দ্রা তোমারে জানাই । 

মনের আগুনে দেহ পুড়্যা হইছে ছাই।। 

অমৃতে ভাবিয়া আমি খাইয়াছি গরল। 

কণ্ঠেতে লাগিয়া রইছে কাল-হলাহল।।

জানিয়া ফুলের মালা কালসাপ গলে ।

 মরণে ডাকিয়া আমি আন্যাছি অকালে ॥

 তুলসী ছাড়িয়া আমি পূজিলাম সেওরা। 

আপনি মাথায় লইলাম দঃখের পসরা ॥ 

জলে বিষ বাতাসে বিশ্ব না দেখি উপায়।

 ক্ষমা কর চন্দ্রাবতী ধরি তোমায় পায় ॥ 

একবার দেখিব তোমার জন্মশেষ দেখা। 

একবার দেখিব তোমার নয়নভঙ্গি বাঁকা ॥

 একবার শুনিব তোমার মধুরসবাণী । 

নয়নজলে ভিজাইব রাঙ্গা পা দুইখানি।। 

না ছুঁইব না ধরিব দূরে থাক্যা খাড়া।

 পুণ্যমুখ দেখ্যা আমি জুড়াইব অন্তরা ॥

 শিশুকোলের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের মালা ।

 তোমারে দেখিতে কন্যা মন হইল উতলা ॥ 

জলে ডুবি বিষ খাই গলায় দেই দড়ি।

 তিলেক দাড়াইয়া তোমার চান্দমুখ হেরি ॥

 ভাল নাহি বাস কন্যা এই পাপিষ্ট জনে। 

জন্মের মতন হইলাম বিদায় ধরিয়া চরণে ॥

 এই দেখা চক্ষের দেখা এই দেখা শেষ । 

সংসারে নাহিক আমার সুখশান্তির লেশ ॥


প্রেমিক জয়ানন্দের অনুশোচনা এবং ক্ষমা প্রার্থনা একবিন্দুও টলাতে পারেনা চন্দ্রাবতীকে। হাজার অনুরোধ করেও একবারের জন্যেও দর্শন পান না চন্দ্রাবতীর। হৃদয়কে শক্ত করে শিব মন্দিরের কপাট বন্ধ করে থাকেন চন্দ্রাবতী। 


না খোলে মন্দিরের কপাট নাহি কয় কথা।

 মনেতে লাগিল যেমন শক্তিশেলের ব্যথা ॥

পাগল হইল জয়ানন্দ ডাকে উচ্চৈস্বরে। 

“দ্বার খোল চন্দ্রাবতী দেখা দেও আমারে ॥

না ছুইব না ধরিব দূরে থাক্যা খাড়া।

ইহজম্মের মতন কন্যা দেও মোরে সাড়া ॥

 দেবপূজার ফুল তুমি তুমি গঙ্গার পানি।

 আমি যদি ছুই কন্যা হইবা পাতকিনী ॥ 

নয়ন ভরে দেখ্যা যাই জন্মশোধ দেখা।

শৈশবের নয়ান দেখি নয়ানভঙ্গি বাকা ॥”


অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকেন জয়ানন্দ। জীবনের প্রতি ঘৃণা ধরে যায় জয়ানন্দের। বেঁচে থাকার সম্পূর্ণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তিনি চন্দ্রাবতীকে উদ্দেশ্য করে শিব মন্দিরের কপাটের গায়ে লিখে যান এ করুণার্থ বিদায়পত্র। সে বিদায়পত্রে জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে নিজেকে পাপিষ্ঠ বলে ধিক্কার দিয়ে চন্দ্রাবতীর কাছে জনমের মত বিদায় চান।


না খোলে মন্দিরের দ্বার মুখে নাহি বাণী । 

ভিতরে আছয়ে কন্যা যৈবনে যোগিনী।। 

চারি দিকে চাইয়া নাগর কিছু নাহি পায় । 

ফুট্যাছে মালতীফুল সামনে দেখতে পায় ৷।

 পুষ্প না তুলিয়া নাগর কোন কাম করে।

লিখিল বিদায়পত্র কপাট উপরে ॥

“শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের সাথী।

অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী ॥

পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত ।

 বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত ॥”


স্থানীয় ফুলেশ্বরী নদী বা মতান্তরে সুনন্দা নদীতে আত্মহত্যা করেন জয়ানন্দ।অভিমানী চন্দ্রাবতী জয়ানন্দকে ফিরিয়ে দিলেও, মন থেকে ভালবাসাকে  মুছে ফেলতে পারেননি। জয়ানন্দ মন্দিরের কপাটের বাইরে বিদায়পত্র লিখে চলে যাওয়া পড়ে চন্দ্রাবতী মন্দিরের কপাট খোলে। সে তখন কপাটের গায়ে তাঁর উদ্দেশ্যে জয়ানন্দের বিদায় বারতা দেখতে পায়। শোকে পাষাণ হৃদয়ও তাঁর ছলছল করে উঠে।


ধ্যান ভাঙ্গি চন্দ্রাবতী চারিদিকে চায় ।

 নির্জ্জন অঙ্গন নাহি কারে দেখতে পায়।।

খুলিয়া মন্দিরের দ্বার হইল বাহির ॥

কপাটে আছিল লেখা পড়ে চন্দ্রাবতী।

অপবিত্র হইল মন্দির হইল অধোগতি ॥


চন্দ্রাবতী কলশি নিয়ে নদীর ঘাটে স্নান তর্পণ করতে যায়। তাঁর চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝড়ে পড়ছে। সে দেখে নদী উজানে বয়ে চলছে। তাঁর হৃদয়েও নদীর মত বেদনার উজান ধারা বয়ে চলছে। চন্দ্রাবতী আশেপাশে তাখিয়ে দেখে, উজান নদীর ঘাটে শুধু সেই একাকিনী। কেউ নেই চারিপাশে। ঠিক তখনই ঘটে তাঁর হৃদয়ে বজ্রপাত। সে দেখে জয়ানন্দের নিথর দেহ জলের ঢেউতে ভেসে যাচ্ছে। চন্দ্রের মত অপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত সেই দেহ। দেখে মনে হচ্ছে পূর্ণিমার পূর্ণচন্দ্র যেন ঢেউয়ের উপরে ভাসছে। এ দেখে চন্দ্রাবতী শোকে পাগলিনী হয়ে যায়।


কলসী লইয়া জলের ঘাটে করিল গমন । 

করিতে নদীর জলে স্নানাদি তপণ ॥ 

জলে গেল চন্দ্রাবতী চক্ষে বহে পানি । 

হেনকালে দেখে নদী ধরিছে উজানী ॥ 

একেলা জলের ঘাটে সঙ্গে নাহি কেহ।

জলের উপরে ভাসে জয়ানদের দেহ ॥

দেখিতে সান্দর নাগর চান্দের সমান ।

ঢেউয়ের উপর ভাসে পুন্নুমাসীর চান ॥ 

আখিতে পলক নাহি মুখে নাই সে বাণী। 

পারেতে খাড়াইয়া দেখে উমেদা কামিনী ॥


জয়ানন্দের নদীতে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে আত্মহত্যা বেদনাহত চন্দ্রাবতীকে আরো শোকগ্রস্ত করে তোলে।বেদনাভারাতুর শোক ভুলে থাকার প্রচেষ্টায় পিতার আদেশে রামায়ণকথা রচনায় প্রবৃত্ত হন। চন্দ্রাবতীর কষ্ট মূর্তিমতী হয়ে উঠে সীতা চরিত্রে। রামায়ণ পালাটি শেষ করে যেতে পারেননি চন্দ্রাবতী; এর আগেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। চন্দ্রাবতী অজস্র লোকগীতি রচনা করেন। নৌকার মাঝির কণ্ঠে, ব্রতে, বিয়েতে এবং প্রতিদিনের গার্হস্থ্য জীবনে আজও শোনা যায় চন্দ্রাবতীর লোকগীতিগুলো। দীনেশচন্দ্র সেনের মতে কবি চন্দ্রাবতী ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মৈমনসিংহ-গীতিকার ‘জয়-চন্দ্রাবতী’ উপাখ্যানের এক করুণ রসের নায়িকারূপে ভাটি অঞ্চল সহ সারা বাংলায় তিনি অমর হয়ে আছেন।  চন্দ্রাবতীর লিখিত অসমাপ্ত রামায়ণটি ১৯৩২ সালে দীনেশচন্দ্র সেন প্রকাশ করেন।পূর্ববঙ্গ-গীতিকার চতুর্থ খন্ডের ২য় ভাগে এ রামায়ণ স্থান পেয়েছে। কবি চন্দ্রাবতীর সৃজনপ্রতিভার বাইরে ব্যক্তি চন্দ্রাবতীর জীবন এবং তাঁর প্রেমশোকগাথা লোকসমাজ-সাহিত্যে বেশি প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত। এর ফলে কিংবদন্তি চরিত্ররূপে কবি চন্দ্রাবতী ভাটি এলাকার লোকগাথায় এবং লোকমানসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। বঙ্গের সুবিদিত লোকসাহিত্যগবেষক  দীনেশচন্দ্র সেন ও ক্ষিতিশ চন্দ্র মৌলিকের সম্পাদনায় প্রকাশিত যথাক্রমে মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকায় ‘চন্দ্রাবতী’ পালাটি রয়েছে। এমনকি চন্দ্রাবতী লিখিত ‘মলুয়া’, ‘দস্যু কেনারামের পালা’ ও ‘রামায়ণ’ পালাও এতে সংকলিত আছে।


এ ধর্মান্তরের কারণেই কবি চন্দ্রাবতী হারায় তাঁর প্রেমাস্পদ জয়ানন্দকে। বিনিময়ে সারাটি জীবন তাঁকে জয়চন্দ্রের বিচ্ছেদজ্বালা সহ্য করতে হয়েছে। হয়ত তাঁর  বিচ্ছেদজ্বালায় সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে এবং সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বলিদান দিয়েছে জীবন। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে, ধর্মান্তরিত প্রসঙ্গে আজও ঠিক একই স্থানে দাড়িয়ে আছি আমরা। ছলে বলে কৌশলে ধর্মান্তরিত হচ্ছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই না। তাই বিনাশের আবহ স্বচক্ষে দেখেও আমরা একই ভুল বারবার করি। এখনও নিরবচ্ছিন্ন করেই চলছি। আমাদের সাধুসন্তরা যেভাবে আত্মঘাতী নির্বোধের মত সর্বধর্ম সমন্বয়ের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে, তাতে সমস্যা আরও প্রকটিত হচ্ছে। আমাদের সাধুসন্ন্যাসীদের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয়, নিজধর্ম প্রচার নয়, সর্বধর্ম সমন্বয় এবং প্রচারই তাদের একমাত্র কাজ।এখনও কি সময় আসেনি, আমাদের ঝেড়ে কাশি দেয়ার? বিষয়টি নিয়ে আমরা যত বেশী গোপনীয়তা করার চেষ্টা করছি, ততই দুর্ঘটনার চক্র আষ্টেপৃষ্টে আমাদের বেঁধে ফেলছে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী থেকে আজ পর্যন্ত, একই ধারাবাহিক পুনরাবৃত্তি দেখছি আমরা আমাদের আশেপাশে। আমরা চাইনা আর কোন জয়ানন্দ সাময়িক ফাঁদে জয়নুল হয়ে পরিশেষে আত্মহত্যা করে জীবনকে শেষ করে দিক। আর কোন চন্দ্রাবতী ভালবাসার মানুষকে না পেয়ে, কুমারী অবস্থায় একটু একটু করে জীবনকে শেষ করে দিক। প্রায় পাঁচশত বছর পূর্বে চন্দ্রাবতীর জীবনে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক নিষ্ঠুরতম ঘটনার চরিত্রগুলো আজও আমাদের আশেপাশে। তেমনিভাবে সমাধানও আমাদের আশেপাশে এবং সর্বোপরি আমাদের মধ্যে। শুধু প্রয়োজন সচেতনতা। 


কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


সূত্র: ফেসবুক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ