নাছিরনগর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ : বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে

ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিমা
ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিমা

আজ ভয়াল ৩০ অক্টোবর, নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে নির্মমভাবে সাম্প্রদায়িক আক্রমনের পঞ্চম বর্ষপূর্তি। নাছিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপরে নৃশংস সাম্প্রদায়িক আক্রমণে ভুক্তভোগীদের কাছে এখনো বিচারের বানী নিভৃতে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ কাঁদে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়:

"আমি-যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে

 হেনেছে নিঃসহায়ে,

আমি-যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে

বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে"

নিরপরাধ রসরাজকে আজও মিথ্যা  মামলার ঘানি টানতে দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, এ একই টাইপের স্টাইলে আর কতকাল নির্যাতিত হবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ?


কান্নারত হিন্দু নারী
কান্নারত হিন্দু নারী

ইসলাম ধর্ম অবমাননাকর ছবি ফেসবুকে পোস্ট করার মিথ্যা অভিযোগ এনে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ অক্টোবর সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীগোষ্ঠী মিথ্যা প্রচারণা শুরু করে। সেই সাম্প্রদায়িক প্রচারণার পরবর্তীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার  পুলিশ নাসিরনগরের হরিপুর গ্রামের রসরাজ দাস নামে এক হিন্দু গরীব  যুবককে গ্রেফতার করে। এরপরেও এ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অজুহাত তুলে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানের মঠ,মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘরে নৃশংস সাম্প্রদায়িক আক্রমণ করে। সে সময়ের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, রসরাজের মোবাইল থেকে ধর্ম অবমাননাকর ছবি পোস্ট হয়নি (বাংলা ট্রিবিউন, ২৯ নভেম্বর ২০১৬)।

"রসরাজ দাসনাসিরনগরের রসরাজ দাসের ব্যবহার করা মোবাইল ফোন থেকে ধর্ম অবমাননাকর ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্তি পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন।বাংলা ট্রিবিউনকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, ‘পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ফরেনসিক বিভাগ বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে এ সংক্রান্ত মতামত জানিয়েছে। সোমবার প্রতিবেদনটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশের কাছে পৌঁছেছে।’তিনি আরও বলেন, ‘মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে রিপোর্ট এসেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে- জব্দকৃত রসরাজ দাসের মোবাইল ফোন থেকে ছবিটি পোস্ট করার আলামত পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, সাইবার ক্যাফে থেকে যেসব যন্ত্রাংশ জব্দ করা হয়েছে, সেগুলো থেকেও ছবি পোস্টের আলামত মেলেনি।’এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ছবি পোস্টের সময় রসরাজ মাছ ধরতে বিলে ছিলেন বলে লোকজন মারফত জানা গেছে। এটা প্রমাণ হলে বোঝা যাবে রসরাজ এর সঙ্গে জড়িত নন।’


তিনি বলেন, ‘আল-আমিন সাইবার ক্যাফে থেকে কিছু আলামত সরিয়ে নেওয়ায় সেখান থেকে ছবি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল কিনা তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে যে সব আলামত সেখান থেকে জব্দ করা হয়েছে, তাতে ছবি পোস্ট দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’


এদিকে, নাসিরনগরে মন্দির ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় লোকজন জড়ো করতে হরিপুর ইউনিয়ন যুবদল সভাপতি মো. বিল্লাল মিয়া দুটি ট্রাক ভাড়া করেছিলেন বলে আদালতকে জানিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি নিজের একটি ট্রাক্টরে করে লোকজন আনেন। একই সঙ্গে তিনি ধর্ম অবমাননার প্রতিবাদে হওয়া সমাবেশেও অংশ নেন।সোমবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে এসব কথা স্বীকার করেছেন বিল্লাল মিয়া।"

পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্যেই সুস্পষ্ট যে নারিরনগরের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক আক্রমণে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চড়ানো হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির সাম্প্রদায়িক চক্রান্তের শিকার হতে হয়েছে অসহায় জেলে রসরাজ দাসকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে যখন ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার ছবি পোস্ট করা হয়, তখন রসরাজ বিলে মাছ ধরছিল। তার স্যামসাং এনড্রয়েড মোবাইলফোন সেটটি তখন বাড়িতে ছিল। ছোট ভাইয়ের মাধ্যমে বিষয়টি জেনে সে বাড়ি ছুটে যায়। 


কান্নারত হিন্দু নারী ও তার পরিবার
কান্নারত হিন্দু নারী ও তার পরিবার

রসরাজের নামে ফেসবুক আইডি থাকলেও সে ফেসবুকের পাসওয়ার্ড সে জানে না। রসরাজের ফেসবুক আইডিতে ছবি পোস্টের পর তা ডিলিট করা ও ক্ষমা চেয়ে স্ট্যাটাস দেওয়ার কাজটি  ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে করা হয়। গরীব অসহায় রসরাজের বাড়িতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের নেতত্বে ২০ সদস্যের প্রতিনিধি দল পরিদর্শনে যায়। পরিদর্শন শেষে শাহরিয়ার কবির সাংবাদিকদের  (বাংলা ট্রিবিউন: ৬ নভেম্বর, ২০১৬) বলেন :

 "রসরাজের ঘরে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ছবি রয়েছে। যে মুসলমান ক্রিকেটারের ছবি ঘরে সাঁটিয়ে রাখে সে কখনও এত সাম্প্রদায়িক আচরণ করতে পারে না। এছাড়া সে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, রসরাজ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শিকার। তাকে ফাঁসানো হয়েছে।"

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরসহ ২০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকও সাংবাদিকদের (বাংলা ট্রিবিউন: ৬ নভেম্বর, ২০১৬) জানান:

"রসরাজের পক্ষে কোনও আইনজীবীকে লড়তে দেওয়া হয়নি। তার পক্ষে একজন ওকালতনামা জমা দিতে চাইলে বিচারক সেটা গ্রহণ করেননি। রসরাজের কোনও কথা না শুনেই তাকে রিমান্ডে দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগে রবিবার নাসিরনগরে বেশ কিছু মন্দির এবং বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়।"



কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


সূত্র: ফেসবুক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ