![]() |
কবি অতুল প্রসাদ সেনের বাড়িটি এখন মুন্সিবাড়ি! সংগৃহীত ছবি |
জসীম রেজা, ১৫ জুন, ২০২৫ ১৯:১০
‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা! তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!’ বিখ্যাত এই গানটির রচিয়তা কবি অতুল প্রসাদ সেন। এই কবির কালজয়ী ২০৮টি গানের মধ্যে দেশের প্রতি ভালোবাসা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধার কথা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন ও ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের সময় কবির গানগুলো বেশ আন্দোলিত করেছিল। আজ এই বিখ্যাত কবির বাড়িটি অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছে, কবির গান ও কবিতা সংরক্ষণের জন্য তার নিজ বাড়ি শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার মগর গ্রামে স্থায়ীভাবে একটি লাইব্রেরি করা প্রয়োজন। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং সঠিক তদারকির অভাবে কবির বাড়িটিও বেদখল হয়ে গেছে। কালের বিবর্তনে অতুল প্রসাদ সেনের স্মৃতিময় বাড়িটি এখন মুন্সিবাড়ি হিসেবে পরিচিত লাভ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পঞ্চপল্লী গুরুরাম উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন,
‘কবির বাড়িটি স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র সুকৌশলে দখল করেছে।
তাদের ভয়ে এখন কেউ মুখ খোলে না। অথচ এত বড় একজন গুণী কবির স্মৃতি সংরক্ষণ তো করা হয় না বরং তার নাম যাতে চিরতরে মুছে যায় সেই চেষ্টাই চলছে। এখন কবি অতুল প্রসাদ সেনের বাড়িটি মুন্সিবাড়ি হিসেবে বেশি পরিচিত। এই বাড়িটির বর্তমানে প্রধান কর্তার নাম নান্নু মুন্সি।
সেই নামে মুন্সিবাড়ি।’
ঢাকা থেকে কবির বাড়িতে যেতে হলে প্রথমে ঢাকার যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে নড়িয়ার ‘শরীয়তপুর পদ্ম পরিবহন, নড়িয়ার ‘শরীয়তপুর সুপার পরিবহন’ বা কীর্তিনাশা পরিবহনযোগে নড়িয়ার বাসস্ট্যান্ডে যেতে হয়। ওই জায়গা থেকে নৌকায় ৫ টাকা ভাড়া দিয়ে কীর্তিনাশা নদী পার হতে হবে। অটোরিকশাযোগে নড়িয়া থেকে ভোজেশ্বের বাজার পর্যন্ত ২০ টাকা ভাড়া। ভোজেশ্বর বাজার থেকে আবার অটোরিকশাযোগে ৩০ টাকা দিয়ে পঞ্চপল্লী বাজার পর্যন্ত যেতে হবে।
ওই বাজারের পাশে একটি কালর্ভাট ব্রিজ পার হয়ে পায়ে হেটে ইটের আকাঁ বাকা রাস্তা ধরে মিনিটখানেক হাটলেই একটি বিশাল দিঘী পাওয়া যাবে। ওই দিঘীর পাড়েই কবি অতুল প্রসাদ সেনের বাড়ি।
এক সময় এই বাড়িটি কবি অতুল প্রসাদ সেনের বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই বাড়িটি নান্নু মুন্সির বাড়ি হিসেবে পরিচিত। বাড়িটির চারপাশ সবুজ গাছ-গাছালিতে ভরপুর, চারপাশ শান্ত, কাঁঠাল গাছে থরে থরে হলুদ রংয়ে কাঁঠাল ধরেছে। বাড়িটিতে প্রথমে ঢুকলেই দুটি ঘর চোখে পড়ে। প্রথম ঘরটিতে স্থানীয় একজন বসবাস করেন। বাড়ির পূর্ব পাশে ইটের দেয়াল ঘেরা দুই তলা বিশিষ্ট একটি পাকা বিল্ডিং করে বসবাস করছেন নান্নু মুন্সি ও তার পরিবার। নান্নু মুন্সির ঘরের পশ্চিম পাশে আরো একটি জরাজীর্ণ ঘর রয়েছে। ওই ঘরটিই কবি অতুল প্রসাদ সেনের ঘর হিসেবে বলা হলেও সেখানে ওই বাড়ির লোকজনই বসবাস করেন। এখানে কবির কোনো কবিতা বা গানের কোনো সংরক্ষণ নেই। ওই বাড়িতে বসবাসরত লোকজনকে কবি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তারা কথা বলতে রাজি হননি।
তবে সেখানে তানভির নামের এক বালকের সাথে কথা হয়। তানভির বলেন, প্রতিদিনই এখানে মানুষ আসেন কবির বাড়ি দেখার জন্য। কিন্তু আমাদের এই বাড়িতে কবি অতুল প্রসাদ সেনের কোনো কিছুই নাই। পাশে নির্মিতব্য এক বিশাল অট্টালিকা দেখিয়ে বলেন, এটা তার বাবা নির্মাণ করছেন। তার বাবা বিদেশে থাকেন।
১৮৭১ সালের ২০ অক্টোবর মামা বাড়ি জন্মগ্রহণের পরও দাদা বাড়ির নিভৃত পল্লী শরিয়তপুর নড়িয়া উপজেলার বিঝারী ইউনিয়নের মগর গ্রামের সাথে কবির নিবির যোগাযোগ ছিল। গ্রামটির শান্ত ও সিগ্ধ পরিবেশে কবির শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। এ গ্রামে কবি তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত করেন পঞ্চপল্লী গুরুরাম উচ্চ বিদ্যালয়। তাইতো পঞ্চপল্লী গুরুরাম উচ্চ বিদ্যালয়ে তার একটি মুর্যাল নির্মাণ করা হলেও তার পৈত্রিক ভিটাটি বেহাল অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আর এই সুযোগে কতিপয় স্থানীয় প্রভাবশালী বাড়িটি দখল নিয়ে নিজের মুন্সিবাড়ি বাড়ি বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।
১৯৩৪ সালের ২৬ আগস্ট কলকাতার লখনৌতে অতুল প্রসাদ সেন পরলোক গমন করলেও তার অমর সৃষ্টি বাংলার নতুন প্রজন্মের কাছে রয়েছে অমূল্য সম্পদ হিসেবে। ২০০৩ সালে প্রথিতযশা দুই বাংলার সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অতুল প্রসাদ সেনের বাড়ি ও তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি দেখতে শরীয়তপুর আসেন। পঞ্চপল্লী গুরুরাম উচ্চ বিদ্যালয়ে অতুল প্রসাদ সেনের নামে একটি মুর্যাল উদ্বোধন করেন।
কবির বাড়ি দেখতে আসা ইব্রারাহিম দেওয়ান নামে এক দর্শনার্থীর সাথে দেখা হয়। তিনি বলেন,
এতো বড় একজন কবির বাড়ি আমাদের এলাকায় অবস্থিত। অথচ বাস্তবে আসলে তা বুঝার কোনো উপায় নেই। তার লেখা বাংলায় অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
তিনি কবির স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি ভূমিদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার করে সাহিত্য চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে নির্মাণের দাবি জানান।
সূত্র: কালের কণ্ঠ
0 Comments