বাঙালির প্রাচীন সমৃদ্ধির দ্যোতক গজলক্ষ্মী - তমাল দাশগুপ্ত

চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রাপ্ত গঙ্গাল সভ্যতার গজলক্ষ্মী


ভার্জিল একবার বলেছিলেন তিনি গঙ্গারিডাই জাতির বীরত্বের কাহিনী স্বর্ণ ও গজদন্তমণ্ডিত অক্ষরে লিখে রাখবেন (In foribus pugnam, ex auro solidoque elephanto, Gangaridum faciam…)


স্বর্ণ তো বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে আসত, বাংলার বিভিন্ন ক্যাশ ক্রপ বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে। যদিও পূর্ব ভারতে গঙ্গাল রাজ্যের রাজধানী থেকে অনতিদূরে সেযুগে স্বর্ণখনি ছিল এরকম একটা ইঙ্গিত আছে (সুবর্ণরেখা নদী স্বর্ণের স্মৃতিবাহী, স্বর্ণ খনি সেযুগে থাকা অসম্ভব না) পেরিপ্লাস অভ দ্য এরিথ্রিয়ান সি গ্রন্থে, যেখানে গঙ্গাল রাষ্ট্রে ক্যালটিস নামে স্বর্ণমুদ্রা প্ৰচলিত থাকার কথা বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত লাবণ্যবতী ও সুবর্ণবতী নামে দুটি নদী গঙ্গাল সভ্যতার রাজধানীর দুই ধমনীর মত ছিল: আজকের উত্তর চব্বিশ পরগনার নোয়াই ও সোনাই খাল। কাজেই স্বর্ণসংযোগ একটা কিছু থাকবে।


কিন্তু গজদন্ত ছিল গঙ্গাল সভ্যতায় বিশেষ সিগনেচার। হাতি জিনিসটা গঙ্গাল সাম্রাজ্যর বিশেষত্ব ছিল। বস্তুত আপনি যদি তেইশশো বছর আগেকার চন্দ্রকেতুগড়, গঙ্গাল সভ্যতার মহানগর গঙ্গে, বা দেবগঙ্গা মহানগরের (চন্দ্রকেতুগড় আদিযুগের শেষ বা মধ্যযুগের শুরুর সময়ের নাম) রাজপথ কল্পনা করতে চান তাহলে হাতির দৃশ্য, হাতির গন্ধ, হাতির বৃংহণ কল্পনা করুন। আমাদের রাজপথে যেমন আজকে গাড়ি চলে ওদের হাতি চলত। অবশ্য ঘোড়াও ছিল কিন্তু সংখ্যায় কিছু কম, কারণ বাইরে থেকে আনতে হত।


হাতির দাঁতের নানা শিল্পকর্ম পাওয়া গেছে চন্দ্রকেতুগড় থেকে।


খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের গ্রীক পুরাণ আর্গোনোটিকা গঙ্গাল জাতীয় বীর ডাটিস এর উল্লেখ করে। এই ডাটিস সম্ভবত দাঁতি বা দন্তীর গ্রীক উচ্চারণ। এ নাম হাতির দাঁতের স্মৃতিবাহী হতে পারে।


প্রসঙ্গত, গ্রীক গঙ্গারিডাই বা ল্যাটিন গঙ্গারিডি আসলে গঙ্গারিড শব্দের বহুবচন। গঙ্গারিড মানে গঙ্গার জাতীয়। অর্থাৎ জাতিটার নাম গ্রীকরা পাঞ্জাব অঞ্চলে এসে যা শুনেছিলেন তা হল গঙ্গার। এবং সুনীতি চ্যাটার্জি বলেন যে সেযুগের ‘বাংলা’ ভাষায় এ নামটা ছিল গঙ্গাল। কারণ সংস্কৃত বহুবচন আ:, দ্রাবিড় বহুবচন আর – উভয়েই বাংলায় আল হয়ে যায়। দ্রাবিড়ার মানে যেমন দ্রাবিড়জন। সেভাবে গঙ্গাল মানে গঙ্গাজন।


অর্থাৎ দেশীয় নামটা গঙ্গাঋদ্ধি, গঙ্গাহৃদি, গঙ্গারাঢ় এরকম ছিল না। গঙ্গারিডাই গ্রীক শব্দ। বাঙালিদের পূর্বজরা গঙ্গাল নামে পরিচিত ছিলেন। সে তো জাতির নাম পাল্টায়, ইতিহাস সাক্ষী আছে। বিশেষত ওই গঙ্গাল জাতি, ওই গঙ্গাল সভ্যতা ভয়ানক আক্রমণের ও দমন পীড়নের শিকার হয়েছিল দুই সহস্র বছর আগে, কাজেই পূর্বনাম মুছে ফেলার ক্ষেত্রে একটা আর্যাবর্ত আগ্রাসন কাজ করেছিল।


প্লুটার্ক বলেন যে গঙ্গাল রাষ্ট্রের ৬০০০ রণহস্তী ছিল। ডিওডোরাস বলেন যে আলেকজান্ডার ও তাঁর সেনাবাহিনী এই গঙ্গারিডাই রণহস্তীর খ্যাতি শুনে আর এগোন নি, তবে ডিওডোরাস উল্লেখ করেছেন যে গঙ্গারিডাই সেনাবাহিনীতে ৪০০০ রণহস্তী ছিল।


আপনি যদি প্রাচীন চন্দ্রকেতুগড় রাজপথে আজ রাতে হাঁটতে বেরোন, পাহাড়ের মত, মেঘের মত, মা দুর্গার সহচর (গণ), আদরের সন্তান গণেশের মত অনেক হাতি দেখবেন যারা সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ির সামনে এখন বিশ্রাম করছে।


আর বাঙালির ওই প্রাচীন সমৃদ্ধির দ্যোতক ছিলেন এই গজলক্ষ্মী। তিনি আমাদের রাষ্ট্রের হস্তীবাহিনী দ্বারা সুরক্ষিত ছিলেন।


© তমাল দাশগুপ্ত


দেখছেন চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রাপ্ত গঙ্গাল সভ্যতার গজলক্ষ্মী। বর্তমান অবস্থান অজানা, বিদেশে আছে খুব সম্ভবত। ছবি sylph-ocular ডট কম থেকে।

প্রথম প্রকাশ: তমাল দাশগুপ্ত ফেসবুক পেজ, ১ জুলাই ২০২১


# সূত্র ফেসবুক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ