মুসলিম বন্ধুদের মানসিকতা - অপরাজিতা পূজা

আমরা সবাই এক সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম। তখন ইন্টারনেট-ফেসবুক ছিল না, রাজপথেই রক্ত-ঝরানো আদর্শিক বাম রাজনীতি করেছি। মিটিং-মিছিল-থানা-পুলিশ-ডেপুটেশন ছিল আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। খুব করে স্বপ্ন দেখতাম একটা আদর্শ প্রগতিশীল বাংলাদেশের, যেখানে মানুষে-মানুষে কোনো ধর্মীয় ভেদাভেদ থাকবে না, সবার হাতে কাজ আর মুখে খাবার থাকবে। তবে আশির দশকের শেষ থেকেই আমাদের মোহভঙ্গ হয়, নব্বইয়ের শুরুতে তা এক প্রকার প্রকট হয়। বুঝতে পারি যে সাথের অনেক কমরেডও ভেতরে ভেতরে আসলে ইসলামিক রাজনীতির ভাবাদর্শ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। 


দেশ এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে এতটাই অস্থির হয় যে নব্বই এর মাঝামাঝি থেকে দু-হাজারের শুরুতে আমাদের ছাত্র রাজনীতির ক্লোজ গ্রুপ সবাই আগে-পরে বিদেশে পাড়ি জমাই। বিদেশে এসে প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো না, কারণ আমাদের গ্রুপ প্রবাসেও এতটা বড় ছিল যে দেশের অভাব বুঝতাম না। প্রতি উইকেন্ডেই ইয়াসিন-জান্নাতুল-ফারদিন-মাধবী-অরুন-গার্গী-কৌশাম্বীনি-ফারজানাদের (নাম পরিবর্তিত) মতো সম-মনাদের নিয়ে দেদার আড্ডা-খানাপিনা, লাল জলে চুমুক। মাঝে-মধ্যে মনে হতো আমরা বাংলাদেশে যা চেয়েছি সেই জীবন বিদেশে পেয়েছি। গরু আর শুয়োরের BBQ হচ্ছে, সবাই সব খাচ্ছি। কোনো ধর্মীয় ভেদাভেদ নেই। 


সুখ বেশিদিন সইলো না। ইয়াসিন-জান্নাতুল-ফারদিন-ফারজানারা আস্তে আস্তে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে লাগলো। এখন তো জান্নাতুল-ফারজানা হিজাবি, নামাজী। হালাল ছাড়া তো খায় না, এমনকি হিন্দুদের বাড়ি খাওয়াও পাপ মনে করে। ইয়াসিন এর মস্ত দাড়ি, কপালে নামাজের কালো দাগ। যে ইয়াসিন এক সময় মুক্তমনা কবি হিসেবে বন্ধু মহলে পরিচিত ছিল আজ সে ধর্ম ছাড়া কিছুই বোঝে না, সে মুসলিম সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ফারদিন কিছুটা ব্যালান্স করে, তবে সেও ওই পথের পথিক হবে বোঝা যায়। এদের সকলের ছেলে-মেয়ে বিদেশে পড়াশুনা করেও প্রচন্ড গোড়া, মাথায় শুধু ধর্ম। 


অন্যদিকে অরুন দা, গার্গী দি, কৌশাম্বীনি, মাধবী আজও বামপন্থায় বিশ্বাসী। রাম মন্দিরের বিরোধিতা করে পোস্ট, আবার অন্যদিকে বাড়িতে ইফতারের আয়োজন। LGBTQ দের নিয়ে মাথাব্যথা, অথচ নিজের মাতৃভূমিতে হিন্দু অত্যাচার নিয়ে নীরবতা। অরুন দা ২০২১ এর রক্তাত্ত শারদীয়ার পর একটা পোস্ট করেছিল, গার্গী দি-মাধবী-কৌশাম্বীনি সে প্রয়োজন টুকুও বোধ করেনি। বলা-বাহুল্য এরা কেউ হিন্দু ধর্ম-সংস্কৃতি মানে না। এদের ছেলে-মেয়েরা সব বিদেশী বিয়ে করে করে খ্রীষ্টান হচ্ছে, ডিভোর্স দিয়ে আবার বিয়ে করছে। 


আজ জীবনের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে এসব দেখে মন যখন ভীষণ ভারাক্রান্ত তখন আশার আলো দেখছি। হাজারে-হাজারে শিক্ষিত, রুচিশীল এবং একই সাথে ধর্মীয় ভাবে বেশ গোড়া ভারতীয়-বাংলাদেশী স্টুডেন্টসরা এসব দেশে পড়তে -চাকরি করতে ঢুকছে। ঝক-ঝকে তরুণ প্রজন্ম, কিন্তু এদের মধ্যে আমাদের মতো “এক তরফা” মানবতার কথা নেই। এরা মন্দিরে যায়, বিতর্ক সভায় হিন্দুদের হয়ে কথা বলে, প্রান্তিক হিন্দুদের জন্যে Fundraising করে, রাজনীতিতে প্রবল আগ্রহ, ফেসবুকে হিন্দুত্ববাদ নিয়ে ভীষণ সক্রিয়। সব যখন ভাবছিলাম শেষ তখন নতুন ভোরের দেখা পেলাম। 


একটা উপলব্ধি করলাম, বামপন্থী রাজনীতি করলেও ইয়াসিন-জান্নাতুলরা দিন শেষে মুসলিম থাকে। মানবতার আজীবনের জন্যে Lease নিয়েছে শুধু অরুন দা, কৌশাম্বীনি, মাধবীরা। অরুন দা, মাধবীদের মতো এক পাক্ষিক সেক্যুলারিজম মানা মানুষ মুসলিমদের ভয়ে পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ নষ্ট করেছে, ইউরোপ-আমেরিকাতে পালিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা নষ্ট করছে। আমাদের দুইটা প্রজন্ম পরবর্তী প্রজন্মের হিন্দুদের জন্যে রেখে যাচ্ছে শুধু মিথ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা। আমাদের সম্ভব হলে ক্ষমা করো।🌻

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ