৯ শহীদ পরিবারে নেই পূজার আনন্দ

জুলাই আগস্ট বিপ্লবে নয়জন হিন্দু নিহতদের ছবি

 সমকাল প্রতিবেদক, প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৪ | ০১:০৬ | আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৪ | ০৭:৪১


কেমন আছেন– প্রশ্নে কেঁদে ফেললেন সবিতা রানী দাস। পাল্টা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘

কইলজার টুকরা পুতটাই (ছেলে) নাই। পুত ছাড়া কীরম (কেমন) থাকতারি! বেহের (সবার) পূজা আছে। আমার পুত নাই, পূজাও নাই।’


ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জীবন দেওয়া ১৮ বছর বয়সী কলেজছাত্র তনয় দাসের মায়ের মতো সন্তানহারা মা-বাবার ঘরে এবার পূজার আনন্দ নেই। নিহতদের স্ত্রী-সন্তানরাও উৎসবের দিনে কেঁদে ফিরছেন প্রিয়জনের বেদনায়।


যারা স্বর্গগত


শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পতন ঘটানো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৯ জন জীবন দিয়েছেন। এই ৯ পরিবারে নেই এবার উৎসব। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাদারীপুরের সমন্বয়ক দীপ্ত দে ১৮ জুলাই পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় আহত অবস্থায় শকুনি লেকের পানিতে পড়ে মারা গেছেন।


একই দিনে ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে বুকে গুলি লাগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তারোয়ারের। ২৩ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। গণহত্যার প্রতিবাদে আড়াই মাসের সন্তান ঘরে রেখে ৪ আগস্ট হবিগঞ্জে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে নেমে প্রাণ দেন রিপন চন্দ্র শীল।

১৮ জুলাই দুপুরে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে আন্দোলনে যোগ দেন রুদ্র সেন। বিকেল ৩টার দিকে সুরমা এলাকায় পুলিশ-ছাত্রলীগের যৌথ হামলায় আহত রুদ্র নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার সময় পানিতে পড়ে মারা যান।


২০ জুলাই গাজীপুরের বোর্ডবাজারে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী তনয়। একই দিন সাভারে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে পুলিশ পেটে গুলি করে ২৪ বছর বয়সী পোশাক শ্রমিক শুভ শীলের। রাজধানীর শনির আখড়ায় পুলিশের গুলিতে একই দিন নিহত হন দুই শিশুসন্তানের জনক ৪০ বছর বয়সী সৈকত চন্দ্র দে।


১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটি এলাকায় চারতলা বাড়ির ছাদে মাথায় গুলিবিদ্ধ ছয় বছরের রিয়া গোপ চার দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হার মানে। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার রথিন বিশ্বাস ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে।


ধারণা করা হয়, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ সমর্থক। তবে হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক সমকালকে বলেছেন, শহীদের সংখ্যাতেই স্পষ্ট, হিন্দুরা আর আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক নয়। কিছু হিন্দু নেতা নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিরোধিতা করলেও সাধারণ হিন্দুরা ছিলেন পক্ষে। তারা শেখ হাসিনার পতনে রক্ত ও জীবন দিয়েছেন। এ অভ্যুত্থানও হিন্দু নয়; শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে।


রিপনের স্বপ্ন ছিল ছেলের সঙ্গে যাবেন মণ্ডপে


রিপন শীল গত মে মাসে পুত্রসন্তানের পিতা হন। ছেলের নাম রাখেন আবির শীল স্বাধীন। ছেলের প্রথম পূজা বলে কথা। তাকে নিয়ে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরার পরিকল্পনা ছিল। অবুঝ শিশু স্বাধীন জানেই না, বাবা আর ফিরে আসবে না। কখনোই তাঁর হাত ধরে ঘোরা হবে না মণ্ডপে!


শনিবার সকালে শহরের অনন্তপুর এলাকায় রিপনের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, নেই পূজার আয়োজন। আশপাশে ঢাকের বাদ্য শোনা গেলেও রিপনের বাড়িতে শ্মশানের নীরবতা। রিপনের মা, বোন, স্ত্রী ও স্বজন বিলাপ করছেন। বোন চম্পা শীল বলেন, ছেলেকে নিয়ে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরার কথা বলত রিপন। বলেছিল, 


‘দিদি, জামাইবাবুর কাছে এবার তোর পূজার জন্য টাকা চাওয়া লাগবে না। আমি সবাইকে নতুন জামা কিনে দেব।’


আগের দিন আন্দোলনে গিয়ে ছোট ভাই শিপন শীল গুলিবিদ্ধ হন। এর প্রতিবাদে ৪ আগস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন রিপন। শিপন এখনও শয্যাশায়ী। রিপনের মা রুবী রানী শীল বলেন,


‘এক ছেলে নেই। আরেক ছেলে আহত। কাকে নিয়ে পূজা করব?’


শহরতলির পইল বাজারের একটি স্যালুনে চাকরি করে রিপনই সংসার চালাতেন। পূজার জন্য হবিগঞ্জ ছাত্রদল ২০ হাজার টাকা দিয়েছে রিপনের পরিবারকে। এর আগে বিএনপি নেতারা আড়াই লাখ ও জামায়াত ১ লাখ টাকা সহায়তা দেয়। রিপনের পিসি ঊষা রানী শীল বলেন, 


‘শুধু সহায়তা নয়, হত্যারও বিচার চাই।’


আমাদের দুর্গা চলে গেছে


শনিবার নবমীর দিন নারায়ণগঞ্জ শহরের নয়ামাটি হোসিয়ারি শিল্প এলাকায় দেখা গেল পূজার উৎসব। দুই গলির মুখে মণ্ডপ। ভিড় ঠেলে গলি দিয়ে রিয়ার বাসায় গিয়ে শ্মশানের শোক! দরজা খুললেন রিয়ার ঠাকুমা। জিজ্ঞেস করতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এলেন রিয়ার মা বিউটি ঘোষ। জানালেন, রিয়ার বাবা দীপক কুমার গোপ কাজে রয়েছেন।


পূজার ছুটি পায়নি– প্রশ্নে বিউটি ঘোষ বললেন, 


‘ছুটি দিয়ে কী হবে আমাদের? নতুন জামা কাকে পরাব? আমাদের দুর্গা তো চলে গেছে।’ 


রিয়ার দাদি বললেন, 


‘ঠাকুর দেখতে যাইনি এবার। মন টানে না। কারা রিয়াকে মারল, কেন মারল– কিছুই তো জানলাম না তিন মাসেও।’


রিয়ার মা বিউটি ঘোষ বললেন, মেয়েটা আমার খাচ্ছিল। জোর করে একটু মুরগির মাংস মুখে দিলাম। অনেক চঞ্চল আর মেধাবী ছিল। ছাদে গেল আর দুই মিনিটের মধ্যেই ওর বাবা কোলে করে নিথর দেহে নিয়ে ফিরে এলো। গুলিটা মাথায় না লেগে যদি হাতে-পায়ে লাগত, হয়তো বেঁচে থাকত।


বিউটি-দীপক দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল রিয়া। ক্লাস ওয়ানে পড়ত। পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল। বিউটি বললেন, 


‘এবার পূজায় রান্নাও করিনি। একবেলা খেলে আরেক বেলা খেতে পারি না। রেঁধে কী হবে? হাত ওঠে না রান্নায়।’ 


তিনি জানান, সরকারের কেউ আসেনি। বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা এসেছিলেন। কেউ আর্থিক সহায়তা দেয়নি। চিকিৎসা করাতে পারলে হয়তো আবারও তিনি মা হতে পারতেন।


রিয়া হত্যায় মামলা হয়নি। সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বির অভিযোগ, 

ঘটনার দিন শামীম ওসমান ও তাঁর লোকজন শহরে অস্ত্রের মহড়া দেয়। সেই সময়ে ছোড়া গুলিতেই রিয়া মারা গেছে।


চোখের জলে তনয়ের মা


কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার ভাটিনগর গ্রামের হরিকান্ত দাস পেশায় জেলে। হাওরে মাছ ধরে অভাবের সংসার চলে। লেখাপড়ার জন্য একমাত্র ছেলেকে মামার বাড়ি কুলিয়ারচরে পাঠিয়ে দেন।


সবিতা রানী জানালেন, ছাত্র আন্দোলন শুরুর দিকে টেইলার্সের কাজ শিখতে টঙ্গীর বোর্ডবাজার এলাকায় যায় তনয়। বন্ধুদের ফোনে শ্রাবণ মাসের ৪ তারিখে (১৯ জুলাই) হাঁটতে বের হয়েছিল। সেই সময়ে গলায় গুলি লাগে। ক্ষোভ ঝেড়ে বললেন, 


‘আমরা হিন্দুরা সারাজীবন হাসিনারে ভোট দিলাম। আর হাসিনা আমার পুতটারে মাইরা লাইল!’


বিলাপ করে সবিতা রানী বললেন, 


‘আমার পুতই নাই, পূজা কীতা করতাম! পুতটা যহন আছিন, কত আনন্দ আছিন আমরার। পুত আমার নতুন গেঞ্জি-শার্ট কিনত।’ 


তনয়ের মা জানালেন, ছেলের মৃত্যুর পর বাড়িতেই আছেন। এবার পূজা দেখতেও যাননি। ঘরেই ছেলের জন্য প্রার্থনায় সময় কাটান, কেঁদে ভাসান চোখ।


অনাথ ধ্রুব ও মাতৃকা কোথায় যাবে


শনির আখড়ার ডিশগলিতে ছেলে ধ্রুব, মেয়ে মাতৃকা এবং স্ত্রী স্বপ্না রানীকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে সৈকত চন্দ্র দের। ২০ জুলাই সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়েছিলেন, বাইরে কী হচ্ছে দেখতে। মাতুয়াইলে গুলিতে প্রাণ যায় তাঁর।


স্বপ্না জানালেন, বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা এসে ২ লাখ টাকা দিয়ে গেছেন। এই টাকায় তো জীবন যাবে না। ছেলে ধ্রুব ক্লাস সিক্সে পড়ে; মেয়ে মাতৃকা পড়ে ক্লাস ফোরে। দেবর-ভাশুররা দায়িত্ব নিচ্ছেন না। তাই ঢাকার বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। আগামী মাসে চলে যাবেন বাবার বাড়ি রংপুরে।


স্বপ্না নবমীর দিনেও ঘরেই ছিলেন, যখন অন্য হিন্দু নারীরা উৎসবে মেতেছিলেন। স্বপ্না বললেন, 


‘এখন আর কোথাও যাই না। ছেলেমেয়ে দুটোও যায় না। ওদের বাবা নেই, কে নিয়ে যাবে পূজায়! আমাদের আর পূজার আনন্দ নেই।’


দীপ্তদের ঘরে জ্বলেনি পূজার দীপ


স্বপন কুমার দে এবং মনিকা দে দম্পতির দুই ছেলে দীপ্ত ও হেমন্তকে নিয়ে গতবার পূজা উদযাপন করেন। এবার তাদের কান্না থামছে না। ভোলার স্বপন কুমার দে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাদারীপুর কার্যালয়ের সাবেক কর্মকর্তা। বাবার চাকরির সুবাদে দীপ্তর মাদারীপুরেই বেড়ে ওঠা। ২২ বছর বয়সী তরুণ মাদারীপুর সরকারি কলেজে প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। আন্দোলনের কলেজ শাখার সমন্বয়ক ছিলেন।


স্বপন-মনিকা দম্পতি জানালেন, এবারের পূজায় আয়োজন নেই। মনিকা দে বললেন, 


ছেলেটা বেঁচে থাকল আনন্দ থাকত। ছেলে ছাড়া কীভাবে পূজা উদযাপন করব?


হৃদয়ের জন্য বিদীর্ণ পরিবারের হৃদয়


পটুয়াখালী শহরের রতন চন্দ্র তারোয়া পেশায় কাঠমিস্ত্রি। মাসে আয় ১০-১২ হাজার টাকা। পরিবারের আর্থিক অসংগতির কথা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদয় চন্দ্র নিজের ডায়েরিতে লিখে গেছেন। তাঁর মা হার্টের রোগী হয়েও বাসাবাড়িতে কাজ করেন। হৃদয় চাকরি পেয়ে দুঃখ ঘোচাবে– এ আশায় দিন গুনছিলেন মা-বাবা। কিন্তু ফুসফুস ভেদ হয়ে যাওয়া বুলেট হৃদয়ের পরিবারের হৃদয়কেই বিদীর্ণ করেছে।


রতন তারোয়া ফোনে বললেন, 


ছেলেকে ছাড়া কি পূজা হয় বাবা! সবাই বলে, আমার ছেলে শহীদ হয়েছে; সম্মান দেয়। আমার মন তো মানে না। আমার তো সব শেষ। ছেলে ছাড়া কীভাবে মা বাঁচে!


কাকুতিতেও মায়া হয়নি, ধরে গুলি পুলিশের


সাধনা শীলের একটাই ছেলে– শুভ শীল। শান্ত, নম্র। বিলাপ করে সাধনা বললেন, আমার ছেলে কিছুর মধ্যেই নেই। পুলিশ শার্টের কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে পেটে গুলি করে মেরে ফেলল!


ঝিনাইদহ সদরের বিকাশ শীলের ছেলে শুভ শীল আশুলিয়ার চক্রবর্তী এলাকার কেএসি ফ্যাশন লিমিটেডে কাজ করতেন। এসএসসি পাস করে ২০২০ সালে করোনাকালে চাকরি শুরু করেন।


বিকাশ শীল বললেন,

২০ জুলাই রাতে হাসপাতালে গিয়ে দেখি, ছেলেটা গুলি খেয়ে ভর্তি। একটু জল চেয়েছিল। অপারেশন হবে বলে ডাক্তার জল খেতে দেননি। অপারেশন করতে নিল; কিন্তু আর ফিরল না। জল খাওয়াও হলো না।


শুভর বড় ভাই সোহাগ শীল জানান, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শুভ ফোনে বলে গেছে, পেটে বন্দুক ঠেকিয়ে পুলিশ গুলি করেছে। কাকুতিমিনতি করার পরও ছাড়েনি। শুভ ফোনে বলেছিল, 


‘দাদা, আমি শেষ।’


(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন হবিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি)


সূত্র: সমকাল

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ