যুদ্ধবাজ অসুরদের বিনাশ হোক - রামেন্দু মজুমদার

যুদ্ধবাজ অসুরদের বিনাশ হোক - রামেন্দু মজুমদার
রামেন্দু মজুমদার

 প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২৩ । ১৭:১৯ ।


ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে আমি থাকতাম লক্ষ্মীপুর শহরে। এখন এটা জেলা শহর হলেও, তখন ছিল থানা শহর। আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল শহর থেকে ১০-১২ মাইল দূরে দত্তপাড়ায়। পূজার সময়-বর্ষার শেষ দিকে হলেও, নৌকায় যেতে হতো। ভ্রমণটা বেশ উপভোগ্য ছিল; আমাদের যেন তর সইতো না, কখন বাড়ি পৌঁছাব। দুর্গাপূজা থেকে লক্ষ্মী পূজা পর্যন্ত আমরা গ্রামে থাকতাম। এ ক’দিন ভীষণ আনন্দে কাটত আমাদের।


আমাদের বাড়িতে তখন চার হিস্যা বা শরিক ছিল; তাই প্রথম দিকে চারটা প্রতিমায় পূজা হতো। পরে অবশ্য তা বিভিন্ন কারণে একটা পূজায় পরিণত হয়। তারপরও আনন্দের ঘাটতি ছিল না।


তবে একটা দুর্ভাগ্যজনক স্মৃতি মনে পড়ছে; সেটা ১৯৪৬ সালের। পূজা উপলক্ষে শহর থেকে বাড়ি যাচ্ছিলাম আমরা। তখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। আমার বয়স তখন পাঁচ বছরের মতো, ঘটনা তেমন মনে নেই, তবে বাবার কাছ থেকে শুনেছি– আমাদের নৌকা থামিয়ে দেওয়া হলো, বলা হলো আমাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হবে। আমরা এক বস্ত্রে একটা বাড়িতে আশ্রয় নিই, আমাদের বাড়ি লুট হয়। এক পর্যায়ে আমার বাবার এক বন্ধু আবদুল হাকিম এমএলএ মিলিটারি নিয়ে এসে আমাদের উদ্ধার করে শহরে দিয়ে যান।


এ ঘটনার পর আমরা পূজায় আর গ্রামের বাড়িতে যাইনি, শহরেই থাকতাম। লক্ষ্মীপুর শহরে তিন-চার জায়গায় পূজা হতো। সেগুলো আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতাম। তবে আনন্দের কোনো কমতি ছিল না। তবে ছোটবেলার পূজার আনন্দটা ছিল অন্যরকম। এখন তো যখন ইচ্ছা আমরা নতুন জামা-কাপড় কিনতে পারি, তখন পূজার সময় বা নববর্ষে নতুন জামা-কাপড় পাওয়া যেত। একটা সম্পন্ন পরিবার হলেও, আমার মা-বাবা বাহুল্য একেবারে পছন্দ করতেন না। যেমন, বহু বছর আমরা জানতেই পারিনি আমাদের একটা ছোটখাটো জমিদারি ছিল; কারণ বাবা এ নিয়ে কোনোদিন কিছু বলেননি। আমরা কখনও অভাব বোধ করিনি ঠিক, তবে কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত কিছু ভোগের সুযোগ হয়নি। ছোটবেলায় ট্রেনে বরাবরই আমরা তৃতীয় শ্রেণির কামরায় যাতায়াত করতাম; একটু বড় হয়ে মা-বাবাকে বলে ইন্টারক্লাসে চড়ার ব্যবস্থা করি। ফলে ছোটবেলায় পূজা আমাদের জন্য অন্যরকম আনন্দ বয়ে আনত।


আমি প্রাথমিক পড়েছি লক্ষ্মীপুর শহরে আমাদের বাসার খুব কাছের এক বিদ্যালয়ে; মাধ্যমিক শিক্ষাও এ শহরেই। উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য পার্শ্ববর্তী কুমিল্লা শহরে আসতে হয়; তারপর ১৯৬১ সালে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কুমিল্লায়ও বেশ জমজমাট পূজা হতো। তবে পূজার ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও লক্ষ্মীপুর চলে যেতাম। তখন তো বেশ বড় হয়েছি, পূজা নিয়ে ছোটবেলার উত্তেজনাটা তেমন কাজ করত না; তবে পরিবারের সঙ্গে মিলে পূজার সময়টা ভালোই কাটত। আমার লক্ষ্মীপুরের পাট একভাবে চুকে যায় ১৯৭০ সালে, যখন আমার বিয়ের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে না পেরে আমার মা-বাবা দেশ ছেড়ে চলে যান। তারা লক্ষ্মীপুর শহরের বাড়িটা আমাদের এক পারিবারিক চিকিৎসক আবদুল আওয়ালকে নামমাত্র মূল্যে দিয়ে দেন। পরে গ্রামের বাড়ির সম্পত্তিও আমি সেখানকার একটা স্কুলকে দান করে দিই। আজকে যদি পেছন ফিরে তাকাই, তাহলে বলতে হবে– লক্ষ্মীপুর ছাড়ার পর পূজার আনন্দ ঠিক লক্ষ্মীপুরের মতো করে পাইনি। আর এখন তো পূজায় কোনো আনন্দই পাই না। মনে হয় না যে, আমার নিজের কোনো উৎসব হচ্ছে। দেশে বছর বছর পূজার মণ্ডপ সংখ্যা বাড়ছে বটে, তবে আনন্দ কমে গেছে। ১৯৪৬-এর যে দাঙ্গার কথা বললাম, তার পরও আমরা সাম্প্রদায়িকতা টের পাইনি। আমার বিশেষত মুসলিম বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সম্পর্কটা এত নিবিড় ছিল যে, তখনকার রাষ্ট্র চরম সাম্প্রদায়িক হওয়ার পরও, সাম্প্রদায়িকতার আঁচ আমাদের গায়ে লাগেনি। আর এখন সাম্প্রদায়িকতা যেন এ দেশে জেঁকে বসেছে। সমাজও পাল্টে গেছে। আসলে তখন রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক হলেও সমাজটা ছিল বহুলাংশে অসাম্প্রদায়িক; এখন রাষ্ট্র তো বটেই, সমাজেও ওই বিষ ঢুকেছে।


১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর আমরা ভেবেছিলাম– এ দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। দেখা গেল, সাম্প্রদায়িকতা কিছু মানুষের রক্তে ঢুকে গেছে। আমার কাছে মনে হয়, রাজনীতিতে যখন সাম্প্রদায়িক শক্তি জায়গা পেল তখনই পরিস্থিতি দ্রুত অবনতিশীল হলো। বঙ্গবন্ধু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। সেটা কিন্তু তাঁকে সবংশে খুন করার পর আর রইল না; এখনও যার ধারাবাহিকতা চলছে। পরিস্থিতি এখন এমন জায়গায় গেছে, আমার মনে হয়, রাষ্ট্র ও সমাজে অসাম্প্রদায়িকতার পুনরুদ্ধার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।


আমরা মুখে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলি বটে, কিন্তু প্রতি বছর পূজা এলেই মূর্তি ভাঙা চলে। যদি বলা হয় এ দেশে মূর্তি ভাঙা এখন একপ্রকার খেলায় পরিণত হয়েছে, তাহলে হয়তো ভুল হবে না। একটা সংবাদপত্রে দেখলাম, দু’বছর আগে কুমিল্লা শহরের নানুয়াদীঘির পাড়ে অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপ, মন্দির, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুরে করা ৫৪ মামলার মধ্যে ৪২টির বিচারকাজ এখনও শুরুই হয়নি। এ বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে সমাজে এসব অন্যায়গুলো আরও বেড়েছে। আমি মনে করি, যে কোনো সাম্প্রদায়িক হামলা ঠেকাতে প্রতিবেশীরা যদি এগিয়ে আসেন তাহলে হামলাকারীদের নিবৃত্ত করা সম্ভব হয়। এক সময় এখানে তা ছিল। কিন্তু এখন মানুষ মনে করছে, আমার ওপর তো আর হামলা হচ্ছে না, কী দরকার ঝামেলায় জড়ানোর! এটাই সমাজে সাম্প্রদায়িক শক্তির জন্য ক্রমবর্ধমান জায়গা করে দিচ্ছে।


পারিবারিক শিক্ষা বলতে যা আমরা বুঝি তাতেও সাম্প্রতিক সময়ে মারাত্মক পরিবর্তন ঘটেছে। ছোটবেলায় আমরা সত্যি সত্যিই বন্ধুত্ব করার ক্ষেত্রে কে হিন্দু, কে মুসলিম এ বিবেচনা করতাম না। এখন তো কে হিন্দু, কে মুসলিম এ কথাটাই আসে সব কিছুর আগে। পারিবারিক শিক্ষার দুর্বলতার কারণেই মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিচার করার বিষয়টা প্রবল হচ্ছে। ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে শ্রদ্ধা করার শিক্ষাটা পরিবারেই দিতে হয়; না হলে সাম্প্রদায়িকতা ঠেকানো যাবে না। লক্ষ্মীপুরে আমাদের বাসার পাশেই একটা মাদ্রাসা ছিল; সেখানকার শিক্ষকদের আমরা খুবই শ্রদ্ধা করতাম; আবার তাদেরও মধ্যে আমরা সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন পর্যন্ত দেখিনি। রোজার সময় আমরাও ইফতারি খাওয়ার অপেক্ষা করতাম; ঈদের সময়ও আমাদের মুসলিম বন্ধুদের সঙ্গে কোলাকুলি হতো, অনেকের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়াও করতাম। আবার মুসলিম বন্ধুরাও পূজায় আমাদের বাসায় আসত, খাওয়া-দাওয়া করত। সত্যিকার অর্থেই তখন ছিল ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। কিন্তু এখন তো পাল্টা পাল্টা স্লোগান তোলা হচ্ছে, ‘ধর্ম যার যার উৎসব তার তার’। এবং অমুসলিমদের উৎসবে মুসলিমদের যোগ দেওয়া ঠিক নয়– এমন ফতোয়া জোরেশোরে প্রচার করা হয়।


বিশেষত মুসলিম পরিবারগুলোতে সংস্কৃতি চর্চাও কমে গেছে বলে মনে হয়। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হতে পারে। কিছুদিন আগে রবীন্দ্র সম্মিলন পরিষদের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামে একটা সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছিল; সেখানে ৫০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে মাত্র দু’জন ছিল মুসলিম। এটা হয়তো ইদানীং বিভিন্ন ধর্মীয় জলসায় গান-বাজনা হারাম বলে নতুনভাবে যে প্রচারণা চলছে তারই ফল। কিন্তু এসব কি একজন মানুষকে ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে সহযোগিতা করে? আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাও সংস্কৃতি চর্চা করতে বা মুক্তবুদ্ধি নিয়ে বেড়ে উঠতে কাউকে উৎসাহিত করছে না। বরং এখানেও ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের প্রভাব শুধু পড়ছে না, বাড়ছে। স্কুলগুলোয় হয়তো আগের চেয়ে গানের বা চারুকলার শিক্ষক বেড়েছে; গান-নাচকেন্দ্রিক বিভিন্ন উৎসব বা প্রতিযোগিতাও হচ্ছে; কিন্তু চর্চা কি হচ্ছে? অথচ সংস্কৃতিমান হয়ে উঠতে বা উদারমনা হওয়ার ক্ষেত্রে এসবের চর্চাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।


আমি বরাবরই দেখেছি, নামাজের সময় পূজামণ্ডপে মাইক বা বাদ্য-বাজনা বন্ধ রাখা হয়, এটা কাউকে বলতে হয় না। কিন্তু এ বছর দেখলাম, পূজামণ্ডপে একেবারে নামাজের সময়সূচি টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা কি স্বতঃস্ফূর্ত উৎসব পালনের নমুনা? কুমিল্লার সরকারি দলের এক নেতাকে দেখলাম পূজা কমিটির লোকজনকে বলছেন, পূজার সময় কী খাওয়া যাবে, কী খাওয়া যাবে না– এমন নির্দেশনাই বা কেন? আরও দুঃখজনক হলো, এক সময় এসব ঘটনা ঘটলেই নাগরিক সমাজ বিশেষত সংস্কৃতিকর্মীদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ হতো; রাজনৈতিক দলগুলোও বিশেষ করে যারা নিজেদের উদারমনা ও প্রগতিশীল ভাবে– সোচ্চার হতো। এখন তেমন কিছুই আর দেখা যায় না।


যা হোক, এবারের পূজা এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রায় গোটা বিশ্বেই এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে এবং ইউরোপে যুদ্ধ চলছে, যে যুদ্ধে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ বিশেষত নারী ও শিশু মারা যাচ্ছে। আমরা সবসময় মা দুর্গাকে বলি অসুরবিনাশিনী; ওইসব অসুরদের বিনাশ ঘটবে– এমন কামনাই আমি করি এবারের দুর্গোৎসবে। 


রামেন্দু মজুমদার,  একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যব্যক্তিত্ব



সূত্র: সমকাল

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ