পূজার স্মৃতি এপার-ওপার - দাউদ হায়দার

পূজার স্মৃতি এপার-ওপার - দাউদ হায়দার


প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২৩ । ১৭:১৯ ।


বুদ্ধদেব বসুর একটি উপন্যাসে ডোভারলেনের পুজোর মহিমা কীর্তন পড়ে মনে এক হাউস জাগে। ঠিক করি পুজোর সময় কলকাতায় গেলে, নিশ্চয় ডোভারলেনের পুজোমণ্ডপে যাব। কবি বুদ্ধদেব বসুর নিবাস ছিল ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে। দোতলায় বাসা। দোতলার বাসঘরের দরজায়, প্রবেশঘরে, লেখা ‘কবিতাভবন।’ মনে হতে পারে গোটা বাড়িই বুদ্ধদেবের। না।


সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ অনেকের মনে পড়বে হয়তো। ডিটেকটিভের জেরায় নায়িকা বলেন: ‘বাসা।’ সমস্ত জেরা টেপরেকর্ডারে বন্দি। ঘরে ফিরে বারবার শোনেন ডিটেকটিভ। বাসা? আরে! এ তো পূর্ববঙ্গের বুলি। কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ভাড়াবাড়িকে বাড়ি বলেন, বাসা নয়। হত্যাকারী সেই নায়িকা ধরা পড়েন। বছর কয়েক আগে দুই লাইনের একটি হালকা পদ্য লিখেছিলুম: ‘গাছের ডালে পাখির বাসা/ দাউদ আমার ভালোবাসা।’


২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ তথা ডোভারলেনের দূরত্ব এক ফার্লংও নয়। মাঝখানে ট্রামলাইন। বুদ্ধদেব যখন ২০২ নম্বরে ছিলেন, ডোভারলেনের সামনে পেছনে যত্রতত্র বিল্ডিং হয়নি। অনেকটাই ফাঁকা। দোতলার ঘর থেকেই বুদ্ধদেব ডোভারলেনের পুজোমণ্ডপ দেখতে পেতেন।


ডোভারলেনের পুজোমণ্ডপ আহামরি কিছু নয়। হাফ কিলোমিটার দূরেই একডালিয়ার পুজো প্যান্ডেল। কলকাতার দশটির মধ্যে একটি। দুটোই দেখেছি। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৭ কলকাতায় ছিলুম। ১৯৭৮ থেকে (ভুল করতে পারি) কলকাতার কোন পুজো প্যান্ডেল শ্রেষ্ঠ, কেন, কী কারণে সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের পুরস্কার—সেসবের খবর রাখতাম। বিচারক ১২ জন। কেউ কারিগরির, কেউ শৈল্পিক, কেউ প্রতিমার নিপুণতার, কেউ সাজসজ্জার দিক—ইত্যাদি বিচার করতেন। বিচারককুলে সাহিত্যিক-সাংবাদিক-ভাস্করবিশারদ, কেউ নির্মাণ কৌশলী, কেউ অঙ্গসজ্জার, প্রমুখ।


কলকাতার পুজোর প্রতিমা, পুজো প্যাল্ডেল এখন ইউনেস্কোর হেরিটেজ তালিকাভুক্ত। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশী যুদ্ধের পরপরই রাজশাহীর প্রতাপশালী একজন জমিদার। (তখন হিন্দুরাই জমিদার) দুর্গাপুজো প্রথম শুরু করেন। অতঃপর ট্র্যাডিশন। কলকাতার বন্ধুদের বলতুম, ‘পাবনার পুজো, দুর্গাপ্রতিমার কাছে কিচ্ছু না। তুচ্ছ।’


আমাদের পাবনা দোহারপাড়ায়, সংলগ্ন আরিফপুরে কোনো হিন্দুর বাস ছিল না। পার্শ্ববর্তী মহেন্দুপুর, ব্রজেন্দ্রনাথপুর আরও কয়েকটি গ্রাম ও পাড়ায় হিন্দুদের বিস্তর বাড়িঘর। আব্বার কাছে অনেকে আসতেন। ওঁরা প্রজা। শোনা কথা, আব্বা নাকি জমিদার ছিলেন। হতেও পারে। পুকুরপাড়ে নাটমঞ্চ ছিল। বাড়ি কে আসতেন, কে যেতেন, কে হিন্দু, মুসলিম জানতেও চাইনি কখনও। আব্বাও বলতেন না। প্রত্যেকে ঘরোয়া। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ দেখেছি অগ্রজ জিয়ার বহু বন্ধু বাড়িতে নানা সময়ে। আকাশবাণী কলকাতার ডেপুটি নিউজ এডিটর প্রণবেশ সেন (বহুল প্রচারিত ‘সংবাদ পরিক্রমা’র লেখক। আকাশবাণীর পরে কলকাতা দূরদর্শনের সহকারী পরিচালক) একবার বলেন, ‘জিয়ার সঙ্গে তোদের দোহারপাড়ার বাড়িতে কতবার গিয়েছি। পুকুরপাড়ের ঘাটে বসে ডাবের জল খাওয়া ছিল এক নম্বর লোভ।’


গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বলেন, ‘তোদের জিলাপাড়ার বাড়িতে গিয়ে ঘুড়ি উড়িয়েছি।’ নায়িকা সুচিত্রা সেনের কথা : ‘তোমার দিদি রিজিয়ার সহপাঠিনী ছিলাম। জিলাপাড়ায় তোমাদের বাড়িতেও গিয়েছি।’ সুচিত্রার কন্যা মুনমুন সেনের সহপাঠি ছিলুম না। ছিলেন দুই ইয়ার সিনিয়র। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। সিনিয়র হলেও বন্ধুতা। অগ্রজ রশীদের পরানসখা চিত্তপ্রসাদকে পেতাম দোহারপাড়ার বাড়িতে সকালসন্ধ্যায়। ওঁর লোভ: ‘মাসিমার খেজুররসের নাড়ু, মোয়া।’ পরে জেনেছি ‘মাসিমা’ খালাম্মা। মায়ের বোন। চিত্তদা খোঁজ পেলেন দুলালের (রশীদ) ছোটভাই অন্নদাশঙ্কর রায়ের বালিগঞ্জের বাড়িতে পুত্রবৎ। এলেন। স্মৃতির বস্তা খুলে : ‘দুলালসহ মাসিমাদের নিয়ে রাধানগরের পুজোয় গিয়েছিলাম। রাধানগরে পুজোমণ্ডপের ধারেকাছে কলকাতা তুচ্ছ।’ আসলে নস্টালজিয়া। ঝালাই করি।


পাবনা শহরে দুটো বড়ো পুজো। অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী দীপাদের (একদা টেনিস চ্যাম্পিয়ন, কলকাতায়) বাড়ি কালাচাঁদপাড়ায়। দোহারপাড়া থেকে দূরে নয়। দীপার কথা: ‘আমাদের কালাচাঁদপাড়ার পুজো প্যান্ডেলই ছিল শ্রেষ্ঠ।’ কালাচাঁদপাড়া আর শয়তানপাড়া লাগোয়া। রাস্তার এপারওপার। ভারতবর্ষের কোনো রাজ্য, জেলা, গ্রাম, পাড়ায় আছে কিনা অজানা, একমাত্র পাবনা শহরেই, দূরত্বও বেশি নয়, দুই পাড়ার নাম ‘শয়তানপাড়া’ ও ‘সাধুপাড়া’। কোন পাড়ার কারা শয়তান বা সাধু আদমশুমারিতেও উল্লেখ নেই। দোহারপাড়া-কালাচাঁদপাড়ার মধ্যে ব্যবধান কয়েক মিনিটের। সেখানে পুলুদাকে পেতাম (সৌমিত্রর ডাকনাম। ‘শালা’ সম্বোধন করতেন। দীপাদির পাড়াতুতো!)। কালাচাঁদপাড়ায় নয়, মা-চাচিদের সঙ্গে রাধানগরের পুজোয় গিয়েছি। রিকশায়। মা-চাচি দুর্গা প্রতিমা একনজর দেখলেও উদ্দেশ্য পুজোর মেলায় সস্তায় শাড়ি, গহনা, বাসনপত্তর কেনা। আমাদের ভাইবোনদের অন্য লোভ। পুজোমণ্ডপে বাতাসা-খাগড়া-মিষ্টি। পুরোহিতের বিতরণ। পয়সা ছাড়া। বার্লিনে আগে ছিল একটি পুজো। এখন দুটো। ইউরোপের নানা শহরে চার/পাঁচটি পুজোতেও বাঙালির বিভক্ত। হোক। পাবনার রাধানগরের দুর্গাপুজো এখনও চোখে। দৃশ্যমান। দাউদ হায়দার, কবি



সূত্র: সমকাল

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ