নটরাজ ও কসমোলজি - অনিক কুমার সাহা

 

নটরাজ ও কসমোলজি - অনিক কুমার সাহা


মহেশ্বর শিবের অনেক স্বরূপের মধ্যে নটরাজ অন্যতম। যদিও নটরাজকে নৃত্যকলার প্রতীক হিসেবেই অনেকে মনে করে কিন্তু এর গভীরে নিহিত রয়েছে চমৎকার দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য।


নটরাজের সাথে কসমোলজির একটি চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। আমরা জানি মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভারসাম্যপূর্ণ ও পদ্ধতিগত চলমান কম্পন বা নড়াচড়াকেই নৃত্য বলে। নৃত্যরত অবস্থায় এই ভারসাম্য নষ্ট হলে নৃত্যভঙ্গ হয়। আমাদের মহাবিশ্বের প্রতিটি পার্টিকালও পদ্ধতিগতভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে অবিরাম নৃত্যরত অর্থাৎ চলমান রয়েছে। নৃত্যরত সে মহাবিশ্বের প্রতিকীরূপে নটরাজ শিবের নৃত্য এবং এই নৃত্য যখন থেমে যাবে তখন এই মহাবিশ্বের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে লয় বা ধ্বংসের কারণ হবে।


★ নটরাজের সাথে কসমোলজির কি সম্পর্ক?


সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফিজিক্স ল্যাব। এর নাম The European Organization for Nuclear Research (CERN)। এখানে নবগঠিত ফিজিক্স ল্যাবের সামনের খোলা জায়গায় স্থাপিত আছে বিশাল নটরাজ শিবের স্ট্যাচু। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে Indian Atomic Commission এর চেয়ারম্যান ড. অনিল কদোতকারের তত্ত্বাবধানে এই বিশাল মূর্তিতি উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। ২ মিটার উঁচু এই প্রতিমাটি ২০০৪ সালের ১৮ জুন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিজিক্স ল্যাবের সামনে উন্মোচন করা হয়। 


★ কিন্তু প্রশ্ন হলো ফিজিক্স ল্যাবে কেন মহাদেব শিবের প্রতিমা ?


নটরাজের সাথে মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও লয় তথা কসমোলজির গভীর দার্শনিক ও তাত্ত্বিক সম্পর্ক রয়েছে বিধায় নটরাজের বিশাল মূর্তি স্থাপিত হয়েছে CERN এর সামনে।


★ কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা?


মূর্তির পাশে একটি নেমপ্লেটে পদার্থ বিজ্ঞানী ফ্রিতজফ ক্যাপ্রা (Fritjof Capra) একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন নাটরাজের  তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে, 


"শত শত বছর আগে, ভারতীয় শিল্পীরা ব্রোঞ্জ নির্মিত শিবের নৃত্যমান চিত্র তৈরি করেছিলেন। আমাদের সময়ে, পদার্থবিদরা মহাজাগতিক নৃত্যগুলির নিদর্শন চিত্রিত করতে সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন যা মহাজাগতিক নৃত্যের রূপক এই প্রাচীন পৌরাণিক নটরাজ, ধর্মীয় শিল্প এবং আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের এক চমৎকার সাদৃশ্য। "


পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিটজফ ক্যাপরা পদার্থবিজ্ঞানের তাও-তে (Tao of Physics-পদার্থবিদ্যার দর্শন) আরও ব্যাখ্যা করেছেন:


"শিবের নৃত্য সব অস্তিত্বের ভিত্তির প্রতীক (basis of all existence)। একই সময়ে শিব আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বিশ্বের বহুবিধ রূপ মৌলিক, কিন্তু মায়াময় এবং কখনও পরিবর্তনশীল নয়। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান দেখিয়েছে যে সৃষ্টি ও ধ্বংসের ছন্দ কেবল ঋতুগুলির পরিবর্তনের মতো জীবন্ত প্রাণীদের জন্ম ও মৃত্যুর ক্ষেত্রেই প্রকাশ পায় না, বরং অজৈব ব্যাপারটিরও মূল বিষয়।"


কোয়ান্টাম ফিল্ড তত্ত্ব অনুসারে, -


সৃষ্টি ও ধ্বংসের নৃত্য মহাবিশ্বের অস্তিত্বের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এইভাবে প্রকাশ করেছে যে প্রতিটি উপাত্তিক কণা শুধুমাত্র একটি শক্তির নাচ সঞ্চালন করে না বরং এটি একটি শক্তি নাচও করে; স্পন্দিত করে সৃষ্টি এবং ধ্বংসকে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীদের জন্য, তখন শিবের নাচটি উপাত্ত বিষয়ক নৃত্য, সমস্ত অস্তিত্বের ভিত্তিতে এবং সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনা (Natural phenomena)।


আইডেন রান্ডল-কন্ডে (Aidan Randle-Conde) একজন পিএইচডি 'র ছাত্র যিনি এই ল্যাবে জব করেন। তিনি লিখেছেন:


"তাই দিনের আলোতে, যখন সিআরএনটি জীবনের সাথে জড়িত হয়, তখন নৃত্যরত শিব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে মহাবিশ্ব ক্রমাগত সবকিছুকে ঝাকুনি দিচ্ছে এবং নিজেও স্থির নয়। কিন্তু রাতের বেলায় গভীর প্রশ্নগুলোর উপর চিন্তা করার জন্য আমাদের বেশি সময় থাকে যখন শিব আক্ষরিক অর্থে আমাদের কাজের উপর দীর্ঘ ছায়া ফেলে যা প্লেটোর গুহায় ছায়ার মতো। শিব আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, আমরা এখনও মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রশ্নগুলির উত্তরটি জানি না। যেকোন সময় আলোর সাথে সংঘর্ষের সময় আমাদের মহাজাগতিক ভারসাম্য (cosmic balance) বিবেচনায় নিতে হবে।"


শিবের সৃষ্টি মূর্তিটি তন্দ্বার (Tandava) প্রতিপাদন করে এমন একটি নৃত্যকে ধারণ করে, সংরক্ষণ ও ধ্বংস (preservation and destruction) চক্রের উৎস বলে বিবেচিত নৃত্য। 


এই নৃত্যটি পাঁচটি রূপে বিদ্যমান, যা সৃষ্টি থেকে ধ্বংস পর্যন্ত মহাজাগতিক চক্র দেখায়।


  • সৃষ্টি '- সৃষ্টি, বিবর্তন
  • 'স্থিতি' - সংরক্ষণ, সমর্থন
  • 'সমহার' - ধ্বংস, বিবর্তন
  • 'তিরোভব' - বিভ্রম
  • 'অনুগ্রহ' - মুক্তি, স্বাধীনতা, অনুগ্রহ


মহাজগতেত সবকিছুই কম্পমান। এই কম্পনের সাথে এক হলেই মুক্তি।


⭕ কার্ল সাগন ও নটরাজঃ


কার্ল সাগন হলেন আমেরিকায় জন্ম নেওয়া একজন বিশ্ববিখ্যাত এস্ট্রোফিজিস্ট যিনি আজও বিখ্যাত হয়ে আছেন তার অসাধারণ সৃষ্টি Cosmos-a personal voyage এর জন্য। 


★ এস্ট্রোফিজিস্টের কাজ কি?


এস্ট্রোফিজিস্ট এমন একজন গবেষক যিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোকে পদার্থবিজ্ঞানের মূল্যায়ন এবং বিশ্লেষণ করেন এবং মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্রহ, নক্ষত্র, অন্যান্য ছায়াপথ এবং ভিন্ন ভিন্ন বস্তু নিয়ে গবেষণা করেন।


★ কার্ল সাগনকে চিনেন? 


১৯৮০ সালের দিকে কার্ল সাগনের রচনা ও পরিচালনায় আমেরিকার পিবিএস টেলিভিশনে পুরস্কারপ্রাপ্ত একটি টেলিভিশন সিরিজ প্রচারিত হতো "কসমস: আ পার্সোনাল ভয়েজ" নামে, যা আমেরিকান পাবলিক টেলিভিশনের ইতিহাসে সর্বাধিক দেখা সিরিজ হয়ে উঠেছিল। ৬০ টি ভিন্ন দেশে কমপক্ষে ৫০০ মিলিয়ন মানুষ শো'টি দেখেছিল। কার্ল সাগন তৎকালীন সময়ের ইতিহাসের একজন প্রখ্যাত এস্ট্রিফিজিস্ট ছিলেন।


"কসমস-আ পারসোনাল ভয়েজ" শো'টি করার সময় কার্ল সাগন সনাতন শাস্ত্র, সংস্কৃতি ও মন্দিরের খুব কাছাকাছি এসেছিলেন যা তার সফলতার পেছনে যথেষ্ট সহায়ক ছিলো।


কার্ল সাগন সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে "কসমস" নামে একটি বই লেখেন এবং সেখানে তিনি উল্লেখ করেন,


"হিন্দু ধর্মই পৃথিবীর একমাত্র মহান বিশ্বাস যেখানে সৃষ্টিতত্ত্বের বিশালতা, অসীমতা এবং জন্মমৃত্যু ও পুনর্জন্মের সঠিক সংখ্যা বহন করে।। এটিই একমাত্র ধর্ম যার মধ্যে দেওয়া সময়ের ধারণা আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিশ্বতত্ত্বের সাথে মিলে যায়। এই সময়ের চক্র আমাদের সাধারণ দিনরাত থেকে শুরু করে ৮.৬৪ বিলিয়ন বছর দীর্ঘ ব্রহ্মার দিন ও রাত পর্যন্ত চলে যা পৃথিবী বা সূর্যের বয়সের চেয়ে দীর্ঘ এবং বিগ ব্যাংয়ের প্রায় অর্ধেক সময়।"


অর্থাৎ সৃষ্টিতত্ত্ব, কাল বা সময় এবং জীবের জন্ম-মৃত্যু ও পুনঃজন্ম নিয়ে স্পষ্ট ধারণা তিনি সনাতন ধর্মমতেই পেয়েছিলেন।


সেই বিখ্যাত Cosmos- A personal voyage এর স্রষ্টা কার্ল সাগন তার বিখ্যাত টিভি শো-এর শ্যুটিং করেছিলেন ভারতের বিভিন্ন প্রাচীন শিবমন্দিরগুলোতে। তিনি নটরাজ শিবের সাথে তুলনামূলক Cosmos Dancing এর রূপক এঁকেছিলেন অর্থাৎ নটরাজেই তিনি সৃষ্টিতত্ত্বের মূলতত্ত্ব খুজে পেয়েছিলেন। তিনি নটরাজের নৃত্যকে মহাজাগতিক নৃত্য (Cosmic Dance) এর তুলনা করেছিলেন এবং এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছিলেন।। 


তিনি যখন ভারতের ধারাসুরামের এক চোলা মন্দির (শিবমন্দির) পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি একটি ব্রোঞ্জের নটরাজ মূর্তিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, 


"এই নটরাজ মূর্তি মহাবিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টিচক্রকে নির্দেশ করে।" 


অর্থাৎ সৃষ্টি ও লয়ের মধ্যবর্তী সময়ের যে সৃষ্টিচক্র তার সূত্র তিনি খুজে পেয়েছিলেন নটরাজ মূর্তিতে।


তিনি আরও বলেন, 


"এই নটরাজরূপী পরমেশ্বরের চার হাতের উপরের দিকে ডান হাতে যে ডমরু আছে সেটা সৃষ্টির শব্দ তথা Cosmic Sound কে নির্দেশ করে। উপরের দিকে বা-হাতে যে অগ্নিশিখাময় জিহবা রয়েছে সেটা নির্দেশ করছে যে বিলিয়ন বছর আগে সৃষ্ট এই জগতের বিনাশ নিশ্চিত এবং সৃষ্টি-লয়ের চক্র চলমান।"


এখানে স্পষ্ট যে, প্রখ্যাত এস্ট্রোফিজিস্ট কার্ল সাগন সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে সকল তত্ত্বের মূলতত্ত্ব খুজে পেয়েছিলেন ভারতের প্রাচীন মন্দিরগুলোতে এসে এবং নটরাজের মূর্তিতে।


কলমে: অনিক কুমার সাহা

© Swastika-স্বস্তিকা

সত্য ও সুন্দরের পথে স্বাগতম।।


সূত্র: ফেসবুক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ