আজও সংস্কৃতের ব্যবহার - কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

আজও সংস্কৃতের ব্যবহার - কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী


শ্রাবণী পূর্ণিমার বৈশ্বিক সৌভ্রাতৃত্বের দিনটিকে বিশ্ব সংস্কৃত দিবস হিসেবে পালন করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই এ শ্রাবণী পূর্ণিমাতিথি থেকেই বেদাদি শ্রাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ শুরু হতো; সেই বিষয়কে স্মরণে নিয়ে ১৯৬৯ সাল থেকেই এ দিনটি বিশ্ব সংস্কৃত দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। সংস্কৃত শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় ভাষা নয়, ভারতবর্ষের বাইরে স্বল্পব্যবহৃত হলেও এ ভাষাটি সারা বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হয়। আমরা না জেনে অজ্ঞাতসারে সংস্কৃতের অবদান এবং প্রয়োজনকে অস্বীকার করে ফেলছি অনেক সময়ে।কিছুদিন আগে পশ্চিমবাংলার একজন নামকরা সংস্কৃতের অধ্যাপকের সাথে সংস্কৃতের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা হচ্ছিল, তো তিনি কথাপ্রসঙ্গে যা বললেন তাতে হতভম্ব হওয়া ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না। তিনি বললেন- "কুশল সংস্কৃত কে পড়বে বা কেনই পড়বে! কেই বা চায় তার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যাক।"  এর পরে  অধ্যাপক মহাশয় ছেলেমেয়ে যে চাকুরিতে ভাল অবস্থানে আছে এর বিস্তৃত ফিরিস্তি দিলেন। আমি ভাবলাম, এই শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকের লেখা বই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি এবং ছাত্রদের পড়াচ্ছি। তার লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে, তার সাথে চট্টগ্রাম থেকে দেখা করতে এসেছি। অথচ এ মানুষটাই কিনা সংস্কৃতকে নিয়েছেন শুধুমাত্র একটা পেশা হিসেবে, আর পেশার খাতিরেই যতটুকুন লোকদেখানো ভালবাসা প্রয়োজন ততটুকুনই তারমধ্যে আছে ; এর বেশী নয়। 


ভারতের জনজীবনে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক প্রায় সকল ক্ষেত্রেই জানা বা অজানা বিভিন্ন ভাবে ছেয়ে আছে সংস্কৃতের ব্যবহার। ভারতের সরকারি বহু প্রতিষ্ঠানের লোগোতে আজ উজ্জ্বল হয়ে আছে সংস্কৃত ভাষা । 'লোগো' (Logo) হল এক সুনির্দিষ্ট প্রতীক। সাধারণত রাষ্ট্রীয়, বাণিজ্যিক, সামাজিক, ধর্মীয় সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য বোঝাতে লোগো ব্যবহৃত হয়। এতে  প্রতীক কিংবা চিহ্নে প্রতিষ্ঠানের নাম বা অংশবিশেষকে অত্যন্ত সুন্দর যৌক্তিক করে ফুটিয়ে তোলা হয়। যখন একজন সাধারণ ব্যক্তি লোগো প্রতীকটি দেখে, সে তখন প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে অবগত হয় কিংবা প্রতিষ্ঠানের স্বরূপ চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। লোগোর সাথেই যুক্ত থাকে, এক বা একাধিক বাক্য। যা লোগোকে প্রস্ফুটিত করে, তাকে বলে প্রতিষ্ঠানের 'মন্ত্র' বা 'motto ' বলে। ভারত এবং নেপালের রাষ্ট্রীয় প্রতীকে সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার ছাড়াও, দেশদুটিতে অন্যান্য বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও সংস্কৃত ব্যবহৃত । লোগোতে সংস্কৃত মন্ত্র এবং শ্লোকের ব্যবহারে প্রতিষ্ঠানগুলো উজ্জীবিত সুস্পষ্টীকৃত হয়েছে। লোগোতে সংস্কৃত বাক্যগুলো দেখলেই বোঝা যায় প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং স্বরূপ, কাউকে আর বলে দিতে হয় না।কথাটি বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বলা যায়:


১. ভারতের জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় স্তুতি "জনগণমন 'এবং "বন্দে মাতরম্" এর উপরে সংস্কৃতের প্রভাব অসীম। এ সংগীত দু'টি নামে বাংলা হলেও প্রায় সংস্কৃতই বলা চলে।

২. ভারতের সুপ্রীম কোর্টের মাথার উপরে মহাভারতের ভীষ্মপর্ব থেকে নেয়া, "যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ"-এ অসাধারণ সংস্কৃত বাক্যটি খোদিত আছে। যার সরল অর্থ হলো যেখানেই ধর্ম, সেখানেই জয়।মহাভারতের প্রধান শিক্ষাই হল - যথা ধর্ম, তথা জয়। তাই আমাদের সবারই উচিৎ সদা সত্যরূপ ধর্মের শরণে থাকা। এ শরণই পারে একমাত্র আমাদের জাগতিক অভ্যুদয় এবং মুক্তির পথে নিয়ে যেতে।

৩. ভারতের লোকসভার আদর্শ স্থির করা হয়েছে মহাভারতের "ধর্মচক্র-প্রবর্তনায়" -এ বাক্যটি। অর্থাৎ লোককল্যাণে ধর্মচক্র প্রবর্তিত হয়েছে। মহাভারত থেকেই এ ধর্মচক্রের বিষয়টি গৌতমবুদ্ধ নিয়েছেন। সারনাথের ঋষিপত্তন মৃগদাবে তাঁর পঞ্চবর্গীয় শিষ্য কৌন্ডন্য, বপ্প,ভদ্দীয়, মহানাম ও অসসজিতের কাছে তাঁর নবমত প্রচার করেন এবং ধর্ম রক্ষার্থে 'ধর্মচক্র' প্রবর্তন করেন।

৪. ভারতের কেন্দ্রীয় লোকসভা এবং পশ্চিম বাংলার বিধান সভা ভবনের দ্বারদেশে আছে মহাভারতের আরো একটি বিখ্যাত শ্লোক:

ন সা সভা যত্র ন সন্তি বৃদ্ধাঃ

ন তে বৃদ্ধা যে ন বদন্তি ধর্মম্।

নাসৌ ধর্মো যত্র ন সত্যমস্তি ন

তৎ সত্যং যচ্ছলেনানুবিদ্ধম।।

(মহাভারত:উদ্যোগপর্ব, ৩৫.৬১)

"যেখানে জ্ঞানবৃদ্ধগণ থাকেন না, তা সভাই নয়। তারা জ্ঞানবৃদ্ধ নন, যারা ধর্ম বলেন না। যা ধর্মই নয়, যার মধ্যে সত্য থাকে না। এবং তা সত্যই নয়, যা ছল প্রবঞ্চনায় যুক্ত।"

৫. অথর্ববেদের শৌনকীয় শাখার অঅন্তর্গত মুণ্ডক উপনিষদ (০৩. ০১. ০৬) থেকে নেওয়া ভারত প্রজাতন্ত্রের জাতীয় প্রতীকের সাথে যুক্ত হিরন্ময় বাক্যটি- " সত্যমেব জয়তে"।একমাত্র সত্যই জয়লাভ করে, মিথ্যা নয়। যদিও এ বেদবাক্যটি থাকা উচিৎ ছিল অশোক স্তম্ভের সিংহের মাথার উপরে ; কিন্তু দুঃখজনকভাবে আছে সিংহের পায়ের নিচে। বেদমন্ত্র পশুদের পায়ের নিচে, এটা বেদমন্ত্রের, বেদমাতার অপমান। 

৬. আকাশবাণীর আদর্শ গৃহীত হয়েছে: "বহুজনসুখায় বহুজনহিতায়" -এ অনন্য সর্বজনীন সংস্কৃত বাক্যটি।

৭. শিবস্তোত্র থেকে নেওয়া দূরদর্শনের -এর motto বা আদর্শ হলো- "সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্।"

৮.শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা থেকে নেয়া ভারতীয় জীবনবীমার এলআইসি (Life Insurance Corporation of India) এর motto এর আদর্শ হলো- "যোগক্ষেমং বহাম্যহম্"।যে অনন্য চিত্তে আমার স্মরণ নেয়, তার সে যা পেতে চায় এবং ক্যা পেয়েছে, তার সংরক্ষণ আমি নিজে স্বয়ং বহন করি। শ্রীমদ্ভগবদগীতার নবম অধ্যায়ের সম্পূর্ণ শ্লোকটি হল:

অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।

তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্।।

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৯.২২)

"যে সকল ভক্তগণ অনন্যচিত্ত হয়ে সর্বদা আমাকে উপাসনা করে; আমাতে নিত্য অনন্যচিত্ত সে সমস্ত ভক্তের যোগ ( প্রয়োজনীয় অলব্ধ বস্তুর সংস্থান) এবং ক্ষেম ( লব্ধ বস্তুর সংরক্ষণ) আমিই বহন করে থাকি।"

৯. ভারতীয় নৌসেনা Indian Navy - এর আদর্শ হলো কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় উপনিষদ থেকে নেওয়া motto "শং নো বরুণঃ"। হে জলের অধীশ্বর ভগবান বরুণ আমাদের শান্তি দিন।

১০. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায় বিশ্বরূপদর্শন যোগের চব্বিশতম শ্লোক থেকে নেয়া হয়েছে IAF (indian Air Force) -এর motto বা আদর্শ " নভঃ স্পৃশং দীপ্তম্"।হে ভগবান, আকাশ স্পর্শী তেজোময় আপনার রূপ।

১১. মহাভারত থেকে নেয়া হয়েছে- Research and Analysis Wing বা RAW এর আদর্শ " ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ"। একমাত্র ধর্মকে রক্ষা করলেই রক্ষা পাওয়া যাবে, নচেৎ নয়। ধর্ম যথাযথভাবে পালন করলে সত্যরূপ ধর্মই সর্বদা রক্ষা করে, আর ধর্মহীন উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তির বিনাশ সাধন করে। মহাভারতের বনপর্বে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ধর্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে ধর্মকে উদ্দেশ্য করে বলেন। সম্পূর্ণ শ্লোকটি হল:

ধর্ম এব হতো হন্তি ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ।

তস্মাদ্ধর্মং ন ত্যজামি মা নো ধর্মো হতো বধীৎ।।

(মহাভারত: বনপর্ব, ২৬৭.৯২)

" যে ব্যক্তি ধর্ম নষ্ট করে, ধর্মই তাকে সমূলে বিনষ্ট করে দেয়। পক্ষান্তরে যিনি ধর্মকে রক্ষা করেন, ধর্মই তাকে সর্বদা রক্ষা করেন। তাই আমি (ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির) ধর্মকে কখনও পরিত্যাগ করি না। কেন না, ধর্ম যদি আমার দ্বারা বিনষ্ট হয়, তবে সে ধর্মই আমাকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করে দিবে।"

১২. ভারতীয় ডাক বিভাগের আদর্শ স্থির করা হয়েছে অসাধারণ এক সর্বজনীন বাক্য দিয়ে- "অহর্নিশং সেবামহে"। দিবারাত্রি সেবা দিয়ে যাব নিরন্তর। 

১৩. ঋগ্বেদ থেকে নেয়া Intelligence Bureau এর motto বা আদর্শ হলো " জাগৃতং অহর্নিশং"। দিবারাত্রি সদা জাগ্রত।

১৪. Indian Coast Guard -এর motto বা আদর্শ হলো- " বয়ং রক্ষামঃ"। আমরা রক্ষা করব।

১৫. Defense Research and Development Organisation -এর motto বা আদর্শ হল-"বলস্য মূলং বিজ্ঞানম্। সকল বলের উৎস বিজ্ঞান।

১৬.  নেপাল রাষ্ট্রেরও জাতীয় প্রতীকে আছে  রামায়ণের স্বদেশপ্রেমের একটি বিখ্যাত শ্লোক। সেই বিখ্যাত শ্লোকটি রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ড থেকে নেয়া: "জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী"। অর্থাৎ, জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গের থেকেও শ্রেষ্ঠ। এ পৃথিবীখ্যাত হিরণ্ময় শ্লোকটি ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের মুখে রামায়ণে উচ্চারিত হয়েছে। অবশ্য শ্লোকটি রামায়ণের সকল সংস্করণে পাওয়া যায় না। 

১৭.শুধু ভারত-নেপালের ন্যায় হিন্দু অধ্যুষিত দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নয়, সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার বিমান বাহিনীর লোগোতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা: " স্বঃ ভূবন পক্ষঃ" অর্থাৎ মাতৃভূমির ডানা। ইন্দোনেশিয়ার নেভির লোগোতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা আছে : "জলেশ্বর জয়মহে";  অর্থাৎ সাগরে অপরাজেয়। শুধু বিমান বাহিনী বা নেভি নয়, ইন্দোনেশিয়ার সেনা বাহিনীর লোগোতেও সংস্কৃত ভাষায় লেখা রয়েছে: "কার্তিকা এক পক্ষী"।


অনেক সংস্কৃত ভাষা বিদ্বেষীরা বলে বেড়ান, সংস্কৃত হল মৃতভাষা। বর্তমানে এ ভাষার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই ভারতবর্ষে বা বাংলায়।ভারতের বামপন্থী কিছু বাংলার শিক্ষক, বাংলা থেকে সংস্কৃতকে বিদায় করার জন্যে তারা একরকম প্রায় আদাজল খেয়ে নেমেছেন। এদের অনেকেই স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় সংস্কৃত এবং বৃহত্তর এ ভূখণ্ডের সংস্কৃতির অপূরণীয় ক্ষতি করে যাচ্ছেন শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে। আমি তাদের সুবুদ্ধি প্রার্থনা করি। সংস্কৃত থেকে বাংলাভাষাকে বিদায় করলে, সংস্কৃত ভাষার কোন সামান্যতম  ক্ষতি হবে না। কিন্তু বাংলা ভাষা থেকে সংস্কৃত ভাষাকে বিদায় করলে বাংলা ভাষাই শেকড়হীন হয়ে যাবে। সংস্কৃত ভাষার অত্যন্ত আদরের কন্যা বাংলা।


 বাংলাভাষার অস্থিমজ্জা সহ সম্পূর্ণ শরীর জুড়ে আছে সংস্কৃত।অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলা ভাষার ৯০% উপরে আছে সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ এবং সংস্কৃত থেকে জাত অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব শব্দ। তাই সংস্কৃতকে অস্বীকার করার অর্থ হল, আদতে নিজেকে এবং নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা। 


---

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


সূত্র: লেখকের ফেসবুক পেজ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ