নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম, আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১: ৪০
খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি ও বাঙালি সংঘাতের রেশ পার্শ্ববর্তী জেলা রাঙামাটিতেও ছড়িয়েছে। সংঘর্ষ–সহিংসতায় পার্বত্য এই দুই জেলায় ৪ জন নিহত এবং অন্তত ৮০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গতকাল শুক্রবার দুই জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। বৃহস্পতিবারের সংঘাত, অগ্নিসংযোগ ও গোলাগুলির ঘটনার পর থেকে পাহাড়ে বসবাসকারী পাহাড়ি-বাঙালি উভয় সম্প্রদায় আতঙ্কের মধ্যে পড়েছে। গত রাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি থমথমে রয়েছে। দুই জেলায় সেনা, পুলিশ ও বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলে গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। আজ শনিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল দুই জেলা পরিদর্শন করবে জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে এবং পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী সব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
সংঘর্ষের সূত্রপাত গত বুধবার খাগড়াছড়ি সদরে মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্রে করে গণপিটুনিতে মো. মামুন (৩০) নামের এক বাঙালি যুবককে হত্যা করার জের ধরে। ওই দিন সেখানকার পাহাড়ি ও বাঙালির মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়।
পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে হত্যার প্রতিবাদে দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। বাঙালিদের অভিযোগ, মিছিলটি বোয়ালখালী বাজার অতিক্রম করার সময় পাহাড়িরা বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সংঘর্ষের এক পর্যায়ে দীঘিনালার লারমা স্কয়ারে বিভিন্ন দোকান ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়।
দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ বলেন,
আগুনে দীঘিনালা বাসস্টেশন ও লারমা স্কয়ার এলাকায় ১০২টি দোকান আগুনে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে পাহাড়িদের ৭৮টি ও বাঙালির সম্প্রদায়ের ২৪টি দোকান রয়েছে।
রাতে গোলাগুলি
দীঘিনালা উপজেলায় সংঘর্ষের জেরে খাগড়াছড়ি জেলা সদর, পানছড়ি ও আশপাশের এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার রাতে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় তিনজন নিহত হন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। নিহত ব্যক্তিরা ব্যক্তিরা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)।
খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রিপল বাপ্পি চাকমা প্রথম আলোকে জানান, বৃহস্পতিবার রাতে আহত অবস্থায় ওই হাসপাতালে ১৬ জনকে আনা হয়। তাঁরা বেশির ভাগই সদর উপজেলা থেকে এসেছেন। এর মধ্যে তিনজন মারা যান। বর্তমানে হাসপাতালে আরও পাঁচজন চিকিৎসাধীন।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে খাগড়াছড়ি শহরের নারানখাইয়া, স্বনির্ভর এলাকায় ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গভীর রাত পর্যন্ত গুলির শব্দ পাওয়া যায়। গোলাগুলির শব্দসহ ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বৃহস্পতিবার রাতে ছড়িয়ে পড়ে।
রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন জুম্ম ছাত্র–জনতা। এ সময় বিভিন্ন স্লোগান দেন তাঁরা। গতকাল সকালে, ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ |
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সহিদুজ্জামান গতকাল সকালে প্রথম আলোকে বলেন, রাতে গোলাগুলি হয়েছে। এ পর্যন্ত তিনজনের লাশ পাওয়া গেছে। মরদেহ হাসপাতালে রয়েছে। আহত হয়েছেন ১০ থেকে ১২ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসন জানায়, রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গতকাল বেলা দুইটার দিকে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। শুক্রবার রাত ৯টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকবে। জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় সেনা, পুলিশ ও বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।
গতকাল আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়, রাত সাড়ে ১০টায় সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি জোনের একটি টহল দল একজন মুমূর্ষু রোগীকে স্থানান্তরের সময় খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় পৌঁছালে অবস্থানরত উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফের (মূল) নেতৃত্বে বাধা সৃষ্টি করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর টহল দলের ওপর গুলি করে। আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। ওই গোলাগুলির ঘটনায় তিনজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হন।
রাঙামাটিতে সংঘর্ষ
আগের দিনের ঘটনার জের ধরে গতকাল খাগড়াছড়ির পাশাপাশি রাঙামাটিতেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। খাগড়াছড়িতে তিন পাহাড়ির মৃত্যু এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল সকালে রাঙামাটি জেলা সদরে ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে প্রতিবাদ মিছিল বের করেন পাহাড়িরা। মিছিলে ঢিল ছোড়াকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়সহ ৩০-৪০টি বাড়িঘর ও দোকানপাটে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। প্রথম আলোর রাঙামাটি প্রতিনিধি সাধন বিকাশ চাকমার মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন ধরনের অন্তত ৩০টি যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
সংঘর্ষে একজন নিহত এবং আহত হয়েছেন দুই পক্ষের অন্তত ৫৫ জন। নিহত ব্যক্তির নাম অনিক কুমার চাকমা। তিনি কর্ণফুলী ডিগ্রি কলেজের স্নাতকের ছাত্র। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁর মরদেহ রাঙামাটি সদর হাসপাতালে ছিল। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শওকত আকবর প্রথম আলোকে বলেন, বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ৫৬ জনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। এর মধ্যে একজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে তাঁর মৃত্যু হয় বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
আহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে। ১৯ জনকে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বাকিদের বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাঁদের শরীরে জখম ও পাথরের আঘাতসহ নানা ক্ষত রয়েছে বলে চিকিৎসকেরা জানান।
বেলা একটার দিকে রাঙামাটি পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে জেলা প্রশাসন। সেনাবাহিনী ও পুলিশের টহল জোরদার করা হয়।
রাঙামাটি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহ ইমরান প্রথম আলোকে বলেন,
সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। এ সময় প্রচুর গাড়ি ও দোকানপাট ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। ১৪৪ ধারা জারির পর থেকে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে। আতঙ্ক রয়েছে কিছু কিছু এলাকায়। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবির টহল রয়েছে।
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
রাঙামাটিতে ঘটনার জন্য পাহাড়ি ও বাঙালি দুই পক্ষ পরস্পরকে দায়ী করে চলেছে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) চট্টগ্রাম নগরের সাধারণ সম্পাদক অমিত চাকমা প্রথম আলোকে বলেন,
‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি-ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে নীতিগতভাবে আমাদেরও সমর্থন ছিল। আমাদের অনেক সদস্যও অংশগ্রহণ করেছে। খাগড়াছড়িতে হত্যা ও সহিংসতার প্রতিবাদে আয়োজিত মিছিলটিতে জেলা পরিষদের সামনে এবং বনরূপা বাজারে অতর্কিত হামলা করে বাঙালিরা। মিছিলে ঢিল ছোড়ে। এরপর মিছিলকারীদের ওপর তারা চড়াও হয়। পাহাড়িদের দোকানপাট ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ রাঙামাটি জেলার সাধারণ সম্পাদক মো. সোলায়মান ঘটনার জন্য পাহাড়িদের দায়ী করেন। তিনি বলেন,
পাহাড়িদের মিছিল থেকে বনরূপা বাজারে ব্যবসায়ীদের ওপর হামলা করা হয়। তারা মসজিদে ঢিল ছোড়ে। তারপর মুসল্লি ও ব্যবসায়ীরা মিলে প্রতিরোধ করেন। একপর্যায়ে বাঙালিরা জড়ো হয়ে এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে থাকেন। তখন বিক্ষুব্ধ লোকজন তাঁদের ধাওয়া করে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চলে আসে।
প্রতিবাদ, বিক্ষোভ
রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সংঘাত-সহিংসতার প্রতিবাদে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বান্দরবানসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী পাহাড় মোড়ে গতকাল সকালে প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন পাহাড়িরা। ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র জনতার’ ব্যানারে অনুষ্ঠিত কর্মসূচি থেকে তিন পার্বত্য জেলায় আজ শনিবার থেকে ‘সিএইচটি ব্লকেড’ নামে ৭২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
এই কর্মসূচির প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছে পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। গতকাল এক বিবৃতিতে এই সমর্থনের কথা জানিয়ে দলটি খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়িদের ওপর হামলা, হত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়।
এদিকে গত রাতে এক বিবৃতিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসরত সব নাগরিককে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন,
‘আইন কেউ নিজের হাতে তুলে নেবেন না। অপরাধীদের সঠিক তদন্তের মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করা হবে।’
সূত্র: প্রথম আলো
0 মন্তব্যসমূহ