হিন্দু সংস্কৃতির বিপরীতে মুসলিমদের আত্মসংকীর্ণতা - রহিম খন্দকার

হিন্দু সংস্কৃতির বিপরীতে মুসলিমদের আত্মসংকীর্ণতা - রহিম খন্দকার

অধিকাংশ  মধ্যবিত্ত হিন্দু অভিভাবক তার আদরের শিশু সন্তানটিকে পড়াশোনার পাশাপাশি গানের স্কুল,ছবি আঁকার ক্লাস কিংবা নাচের স্কুল বা তবলা শেখানোর মতো সৃজনশীল একাডেমিতে ভর্তি করায়। এর ফলে শিশুটি অল্পবয়স থেকে হয়ে ওঠে বিনয়ী, আত্মবিশ্বাসী, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সংযমী। গবেষণায় দেখা গেছে-মস্তিষ্কের একটি অংশের নাম সেরেব্রাম। যার দুটি ভাগ আছে বাম ও ডান। বা অংশ ভাষা গণিত যুক্তি ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত। অপরদিকে বা অংশ ছবি আঁকা, গান করা, তবলা শিখা, নাচ করার মতো আবেগি বিষয়গুলোর সাথে জড়িত। মস্তিষ্কের বা অংশটি চালনা করে দেহের ডান অংশকে আর ডান অংশ চালায় দেহের বা অংশকে। ফলে মস্তিষ্কের এক অংশ সক্রিয় থাকলে আরেক অংশও সক্রিও থাকে। এতে গণিত, ভাষা এবং যুক্তির ক্ষেত্রেও শিশুটির মস্তিষ্ক পারদর্শী হয়ে থাকে, নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়ানো উপায় হচ্ছে একে নতুন চ্যালেঞ্জ দেয়া, নতুন কিছু শিখা। শিশুদের গান শিখা, ছবি আঁকা, কিংবা তবলা বাজনোর মতো কাজ মস্তিষ্কের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায়। এগুলো শুধু শিক্ষার ব্যাপারই নয়, এগুলো শিশুর কল্পনাশক্তি বাড়ায়, শৃঙ্খলাপরায়ণ হয়। বুদ্ধির বিকাশ ঘটে এবং পরষ্পর বন্ধুভাবাপন্ন হয় ইত্যাদি অনেক কিছু ঘটতে থাকে। একটি উদাহরণ দিয়ে বলি- যেমন ছবি আঁকার ক্ষেত্রে কাগজের কোথায় কোন বস্তুটি আঁকতে হবে, কোন বস্তুটির আকার বড় বা ছোট হবে, কোথায় কি রং লাগাতে হবে কিংবা বাদ্যবাজানোর ক্ষেত্রে - হারমোনিয়ামে সুর মেলাতে কোন রিডের পর কোন রিড চাপতে হবে কন্ঠস্বর বাদ্যযন্ত্রের স্বরের সাথে কিভাবে মেলাতে হবে এই পরিমিত বোধগুলো ধীরে ধীরে ফুটে ওঠতে থাকে শিশুমনে। এছাড়াও সংগীত শিশু মস্তিষ্কে সুন্দর মনোভাব তৈরি করে। সংগীত মস্তিষ্ককে অসাধারণ উপায়ে উদ্দিপিত করে। আপনি যদি গান শোনার সময় কিংবা বাদ্যযন্ত্র বাজানোর সময় কারো মস্তিষ্কের চিত্র দেখেন তাহলে দেখা যাবে তার মস্তিষ্কের প্রায় সকল নিউরণ সক্রিয় হয়ে ওঠেছে। বাদ্যবাজবাজনা সাধারণ বোধশক্তি ও স্মৃতিকে শক্তিশালী করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগী সবার আগে যা বিরবির করে বলে তা হচ্ছে গান। শিশুটি যখন এমন একটি সুন্দর পরিবেশ ও শিল্পবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠতে থাকে যার ফলে শিশুটির কল্পনাশক্তির বৃদ্ধির পাশাপাশি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন চ্যালেঞ্জ কিংবা যেকোন কম্পিটিশনকে খুব সহজেই অবসার্ব করতে পারে।


অন্যদিকে মধ্যবিত্ত মুসলিম বাবা মা তার আদরের সন্তানটিকে মাদ্রাসায় ভর্তি করায় কিংবা একাডেমিক পড়ার পাশাপাশি বাড়িতে মাওলানা রেখে আরবি শিখায়, নিজের আখের গোছানোর কথা চিন্তা করে। মাওলানা সাহেব অবুঝ ফুটন্ত কলিকে শুধু আরবিই শিখায় না, কলিটি যেন সুস্থভাবে ফুটতে না পারে, কলিটির যেন ধীরে ধীরে পঁচন ধরে, কলিটি যেন প্রকৃতির সুন্দর মনোরম আলো বাতাসে ঠেস দিয়ে ছড়াতে না পারে তার বন্দোবস্ত করে দেন। শিশুটিকে শৈশব থেকে দেখানো হয়, জাহান্নামের আগুনের ভয়, শিখানো হয় ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি ঘৃণা, শুনানো হয় ভয়ঙ্কর ফেরেশতাদের গল্প, আজরাইল কিভাবে মৃত্যুর আগে ভয়ঙ্করভাবে জান কবজ করবে, শয়তান কিভাব তার মগজ কিংবা চোখে প্রসাব করে। এইসব অকেজো ও দানবীয় কু'কাহিনি শুনিয়ে শিশুটির ছোট্ট মস্তিষ্ককে করে তোলে আরো সংকীর্ণ ও ভীত। যার ফলে শিশুটির মনে ঘৃণা ও ভয়ের সঞ্চার হয়। শিশুটি ধীরে ধীরে দানবে রুপ নেয়, মানষিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হয়। বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুটি হয়ে ওঠে শিল্পবিদ্বেষী, নারী বিদ্বেষী, ভিন্ন জাতি বিদ্বেষী, স্ব ধর্মের প্রতি অহংবোধ শিশুটিকে করে তোলে অমানবিক ও পাষন্ড। আমরা দেখি একই সমাজে শিশুর দুটি ভিন্ন মানসিক রূপ। বড় হওয়ার সাথে সাথে তার হিন্দু প্রতিবেশী কিংবা বন্ধুটি যখন বড় কোনো পোষ্টে যায়, যোগ্যতা অনুযায়ী বড় কোনো চাকরী পায় তখন তার অযোগ্য মুসলিম প্রতিবেশীটি হিংসায় বিদ্বেষে ফুলে ফেপে ওঠে। সে তখন মনে করতে থাকে তার মতো তার হিন্দু বন্ধুটিও অযোগ্য, সেও হয়তো তার মতোই ঘৃণা বিদ্বেষের ভার নিয়েই বড় হয়েছে। তখন সে পুরোপুরি হিন্দু বিদ্বেষী কিংবা ভারত বিরোধী হয়ে পরে। নিজের অযোগ্যতাকে চাপা দিয়ে তখন সে সকল কিছুর মধ্যে ভারতের ষড়যন্ত্র কিংবা হিন্দু ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুজে বেড়ায়। বলা যেতে পারে ৪৭ এর দাঙ্গা, পাকিস্তান আমলে বেছে বেছে হিন্দু গণহত্যা, বর্তমান বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন কিংবা ভিন্ন মতের বা ধর্মের মানুষকে কুদৃষ্টিতে দেখার কারণ উল্লেখিত পরিচক্রটিই।


একজন প্রকৃত মুসলিম কিন্তু শুধু হিন্দু বিদ্বেষী না, সে সকল জাতি কিংবা ভিন্ন মতের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ নিয়ে বড় হয় শৈশব থেকেই। বলা যেতে পারে এটা তার পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা। প্রতিটি মুসলিম শিশু (স্যেক্যুলার পরিবার জন্ম নেয়া শিশু বাদে) শুনে বড় হয়, একমাত্র মুসলিম ছাড়া সকল জাতি তাদের শত্রু, সকলে তাদের ক্ষতি সাধন করতে চায়। যার ফলে মুসলিমরা জেনেটিক্যালি সহিংস অন্য সকল জাতি থেকে ভিন্ন আত্মঘাতী ও হিংস্র হয়ে ওঠে।


একজন বাঙালি মুসলিমের হিংস্রতা কতটা তা বিভিন্ন পেইজের কমেন্ট বক্সের কমেন্টগুলো দেখলেই বুঝা যায়। সরাসরি এক্সপেরিমেন্ট করার ইচ্ছে থাকলে তেমন কিছু নয়, তার ধর্ম নিয়ে সহজ দুএকটা প্রশ্ন করে দেখা যেতে পারে। এই বিদ্বেষপরায়ণতার আরেকটি ছোট্ট উদাহরণ হচ্ছে ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ে হলির উৎসবকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের আদিখ্যেতা। ঢাবির কিছু ছাত্রছাত্রী হলির উৎসব করেছে এর বিপরীতে এদেরও কিছু করা চাই। তাই ভালো মসজিদ থাকা সত্ত্বেও ভার্সিটির প্রাঙ্গণে লোক দেখানো নামাযের আয়োজন করে। এটা কি ভিন্ন ধর্মের প্রতি প্রতিহিংসা বা বিদ্বেষপরায়ণমূলক আচরণ নয়! নয়তো একদল যেকাজ করলো কেবল উৎসব উদযাপনের জন্য, আরেকদল কেনো একই কাজ ভিন্ন এঙ্গেলে করছে লোক দেখানোর জন্য!


মুসলমানদের এই আত্মসংকীর্ণতার শিক্ষা পুরোপুরি  ধর্মীয় বিধানের অন্তর্ভুক্ত। তাই যতদিন না মুসলিমরা তাদের ধর্মকে বাতিল করতে পারছে, ততদিন তাদের আত্মমুক্তি বা আত্মউন্নয়ন সম্ভব নয়। কবি জসীম উদ্দীন তার জীবনকথা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- অবিভক্ত বাংলায় যখন ছবি আঁকার ক্লাস হতো তখন হিন্দু ছাত্ররা জীবজন্তু ও মানুষের ছবি আঁকতে পারলেও মুসলিমরা কেবল ধর্মনাশের ভয়ে ফুললতাপাতা আঁকত। মুসলিমের বিশ্বাস  মানুষ কিংবা জীবজন্তু ছবি আঁকলে মৃত্যুর পর নাকি প্রাণ সঞ্চার করতে বলবেন মহান আল্লা। এরকম উদ্ভট ভয়গাথা যে ধর্ম শৈশব থেকে শিশুমনে ভুতের মতো তাড়া করে বেড়ায়, সে শিশুটির কিভাবে শিল্পের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। তখন সে হয়ে ওঠে পশুরুপি জন্তুমানব। কেননা পশুর যেমন শিল্পবোধ থাকেনা, সে জন্তুমানবটিও বেড়ে ওঠে শিল্পবিহীন জন্তুরুপে। ফলে একজন মুসলিম ছবি আঁকলেও, গানবাজনা করলেও কিংবা অভিনয় জগতে পা রাখলেও তার কাজের প্রতি সে মন থেকে কখনোই ভালোবাসা দেখাতে পারেনা। সবসময় তাকে তাড়া করে বেড়ায় এক দানবীয় ভয়, এই ভয় থেকেই জন্ম নেয় কাজের প্রতি ঘৃণা।


একটি ভ্রুণ যখন মাতৃগর্ভ বা জরায়ুর মধ্যে বেড়ে ওঠে তখন তার মধ্যে ঘৃণা নামক ভাইরাসটি প্রভাব ফেলতে পারেনা। শিশুটি যখন পৃথিবীর আলো বাতাসের মধ্যে ভূমিষ্ঠ হয় বা বেড়ে ওঠতে থাকে তখনও তার মধ্যে ঘৃণা বাসা বাধে না। কারণ শিশুটির মস্তিষ্ক তখনও ধীরে ধীরে ডেভেলপ হচ্ছে। জন্মের পর একটি শিশুর মস্তিষ্ক থাকে অপরিণিত অবস্থায়, পরিবেশ, প্রেক্ষাপট, বেড়ে ওঠার অভিগাথা, শেখার সুযোগ  এসব তাকে আস্তে আস্তে পরিণত করে। এসম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বলেন- এই বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে জন্মের পর থেকে চার থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত। এসময় শিশু যতো ভালোবাসা পাবে, যতো মমতা, মনোযোগ ও নতুন অভিজ্ঞতার সংস্পর্শে আসবে তত তার ব্রেন বিকশিত হবে। মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময়ে কোনো শিশুই জাতি ধর্ম বর্ণ নিয়ে বেড়ে ওঠে না। সে সময় সে কে বা কি করছে সে সেখানে সে বোধও তার মধ্যে থাকে না। ধীরে ধীরে যখন মস্তিষ্ক গঠিত হয়, সে মস্তিষ্কে নির্দিষ্ট কিছু স্বার্থ বা নির্দিষ্ট সংঙ্গা সেট করে দেয়া হয় তখনই সে হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী বা ধর্মবাদী অথবা কোমল শিশুর খোলস ছাড়িয়ে বেড়িয়ে আসে একটি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ হিসেবে।


আলাপ দীর্ঘ আর পোষ্ট বড় হয়ে যাচ্ছে, এ বিষয়টি নিয়ে বলার মুল কারণ হচ্ছে মর্ডান মুসলিমরা প্রশ্ন করেন প্রকৃতপক্ষে সত্যি যদি নাস্তিক হই অন্য ধর্মের সমালোচনা করি না কেনো?


এপ্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর নেই। এর ব্যাখ্যা জটিল। নাস্তিক কিংবা কোনো মানবিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ তাদের দলে লোক টেনে দল বড় করার চিন্তা করে না। নাস্তিকরা বিশ্বাস করে যেকোনো সুস্থ মতবাদে বিশ্বাস করা প্রত্যেকেরই গণতান্ত্রিক অধিকার। যেমনটা ধর্মের সমালোচনা করা একজন নাস্তিকের অধিকার ঠিক তেমনি ধর্মীয় কুযুক্তির সমালোচনা সহ্য করে ধর্মপালন করা একজন ধার্মিকের অধিকার। মুসলিমরা এই গণতন্ত্রবিরোধী। আমি তাদের নামাজ পড়ার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করলেও তারা আমার নামাজের কুযুক্তি ব্যাখ্যার বিরোধী। অন্য ধর্মের সমালোচনা কেনো করিনা? করি না মানে এই নয় অন্য ধর্মের নিকৃষ্ট অমানবিক প্রথাকে ভালোবাসি বা শ্রদ্ধা করি। করিনা তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হলো, ইসলাম ধর্ম অন্য ধর্মকে বাতিল করে দিয়েছে, এছাড়াও আমি যেহেতু বাংলাদেশের এক্সমুসলিম সেক্ষেত্রে মুসলিমদের আত্মউন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করবো সেটাই স্বাভাবিক। যেখানে নব্বই ভাগ মানুষ স্বাধীনভাবে কোনো বাধা ছাড়াই ধর্ম পালন করতে পারে, নব্বই ভাগের দেশের মাত্র দশ ভাগের সমালেচনা কতটা গ্রহণযোগ্য?


সূত্র: লেখকের ফেসবুক পোস্ট

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ