মেডিকেল ছাত্রী দ্রৌপদী । অভিশপ্ত হিন্দু উত্তরাধিকার (ব্রিটিশ) আইন । কি চাই ? কি চাইনা | সকল বিভ্রান্তির সমাপ্তি - ডা. অসীম দত্ত

মেডিকেল ছাত্রী দ্রৌপদী । অভিশপ্ত হিন্দু উত্তরাধিকার (ব্রিটিশ) আইন । কি চাই ? কি চাইনা | সকল বিভ্রান্তির সমাপ্তি - ডা. অসীম দত্ত


২১ বছর বয়সী “দ্রৌপদী” বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পাশের একটি শহরের যৌথ পরিবারের সদস্য ছিলো। বাবা-মা ২ বোনের তাদের ছিলো সুখের সংসার। ছোট বোন ছিলো স্কুলের নবম শ্রেনীর ছাত্রী আর “দ্রৌপদী” ছিলো ঢাকায় ভালো একটি বেসরকারি মেডিকেলের এমবিবিএস এর ৩য় বর্ষের ছাত্রী। দ্রৌপদীর বাবা-জ্যাঠাদের ছিলো প্রতিষ্ঠিত যৌথ ব্যবসা। এর মধ্যে দ্রৌপদীর বাবা একদিন গুরুতর সড়ক দুর্ঘটনায় ২ মাস বেসরকারি একটি হাসপাতালে আইসিইউ ও লাইফ সাপোর্টে থেকে মারা যান। হাসপাতালে তার বাবার চিকিৎসা বিল এসেছিলো প্রায় ৩৪ লাখ টাকার মতো। পরিবার থেকেই সবকিছু শোধ করা হয়েছিলো। বাবার শ্রাদ্ধ শেষ হলে দ্রৌপদী আবার পড়াশুনায় ফিরে আসে।


শোকে স্তব্ধ দ্রৌপদী ৩য় বর্ষের পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি বা অকৃতকার্য হয়। তার বাবা মেডিকেলে ভর্তির সময় এককালীন ১৬ লাখ টাকা পরিশোধ করেছিলেন। তারপরও দ্রৌপদীর মেডিকেল হোস্টেলে থাকা খওয়া ও মাসিক বেতন পরীক্ষার ফি সহ প্রতি মাসে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ লাগতো। কয়েকমাস পর তার জ্যাঠা খরচ দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তখন দ্রৌপদীর মা তার স্বামীর ব্যবসার ভাগ ও সম্পত্তির ভাগ নিয়ে কথা বললে শুরু হয় পারিবারিক অশান্তি! তার বাবার ভাগের সম্পত্তির বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা।


দ্রৌপদীর জ্যাঠার তিন জন পুত্র সন্তান আছে। তারাও (জ্যাঠাতো ভাইয়েরা) দ্রৌপদীদের কোন সম্পত্তির অধিকার দিতে নারাজ। দ্রৌপদীর ডাক্তারি পড়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিমিষে শেষ হয়ে যায়। অথচ তার ৩ জ্যাঠাতো ভাইদের সবাই উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। সবার বড় জ্যাঠাতো ভাই বুয়েট থেকে পাশ করে এখন আমেরিকায় গুগুলের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত এবং বিশ্বের আধুনিক সমাজে তার বসবাস; কিন্তু দ্রৌপদীরা যেন কোন সম্পত্তি না পায় সেজন্য সে তার পজিশন ও শক্তির সবটুকুই ব্যবহার করে যাচ্ছে। তাদের দাবী কাকার সম্পত্তির অধিকার শুধু ভাতিজা হিসেবে তাদের, কোনভাবেই দ্রৌপদীদের নয়। এভাবেই ৫ বছর আগে তার ডাক্তার হওয়ার আগেই পড়াশুনার সমাপ্তি হয়ে গিয়েছিলো। বাবার ভাগের কিছু সম্পত্তি বিক্রি করার অনুমতি চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে আজ ৫ বছরেও কোন সুরাহা হয়নি। এর মধ্যে অল্প বয়সেই ছোট বোনের বিয়ে দেয়। আর্থিক ও মানসিক এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছে দ্রৌপদীর পরিবার।


দ্রৌপদীর পরিবারের এই পরিণতির জন্য শুধু অভিশপ্ত হিন্দু উত্তারাধিকার (ব্রিটিশ) আইনের মারপ্যাঁচই দায়ী।


(এটা কোন গল্প নয়, পুরো ঘটনা সত্য। সে আমার খুবই পরিচিত। বাস্তব ঘটনা আরও অনেক কঠিন ও মর্মস্পর্শী। পরিচয় গোপন রেখে ভুক্তভূগীকে কল্পনায় আনতে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।)


১৯৪৬ সাল থাকে অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলার (পরে পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশ) হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বেশ আস্থার সঙ্কট নিয়ে বসবাস করছেন। ভূরাজনীতির নানা মারপ্যাঁচে ভারতে যেমন প্রায় ২০ কোটি মানুষ সংখ্যালঘু হয়ে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করছেন, তেমনি বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি হিন্দু জনসমষ্টিও দুর্বল নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে দিন অতিবাহিত করছেন। নির্যাতন- নিপীড়ন বাংলাদেশ ও ভারতের সংখ্যালঘুদের জন্য নিয়মিত ব্যাপার।


১৯৬৫ সালে হিন্দুদের দেশছাড়া করার আরেক অস্ত্র হাতে নেয় পাকিস্তান সরকার। আর তা হল “শত্রু সম্পত্তি আইন”। ২০০১ সালে এর নাম পরিবর্তন হয়ে “অর্পিত সম্পত্তি আইন” হলেও এই দুষ্টচক্র থেকে হিন্দুরা বেরিয়ে আসতে পারেনি। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র এই নিয়ে যত নাড়াচাড়া করছে তাতে দিনের পর দিন ১০০% হিন্দু মালিকাধীন এই সম্পত্তি আইনের নানান মারপ্যাঁচে আস্তে আস্তে অদৃশ্য ছায়ার মতো হারিয়ে যাচ্ছে।


১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে ৯৯% কৃষিনির্ভর অবিভক্ত ভারতে (পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, মায়ানমার ও বাংলাদেশ) হিন্দু উত্তারাধিকার আইন পাশ করা হয়। অবশ্য বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ জাতিগোষ্ঠীকেও একই আইনের আওতায় আনা হয়। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়া আর সবগুলো দেশ সেই আইন থেকে সরে এসে হিন্দু নারীদের সন্তান হিসেবে সম্পত্তির সমান ভাগ দিয়ে আইন হয়েছে; এবং কয়েক দশক ধরে তাঁরা সেটা ভোগও করছেন। তখন পর্যন্ত (১৯৩৭) এই উপমহাদেশের কোন নারী পুলিশ, সেনাবাহিনী বা কোন সরকারি কাজে (নার্স ছাড়া) নারীর অংশগ্রহণ ছিলোনা। মহাভারতে আমরা দেখেছি যে দ্রুপদ রাজার কন্যা দেবী অম্বা (শিখণ্ডী) শুধু নারী হওয়ার জন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ নেয়ার অনুমতি পাননি; যদিও ঐশ্বরিক ক্ষমতায় তিনি একদিনের জন্য পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে “শিখণ্ডী নামে” যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছিলেন। অথচ বর্তমানে হাজার হাজার নারী বীরত্বের ও সফলতার সাথে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীতে কাজ করছেন।


এই উপমহাদেশের মানুষদের গত ৭৬ বছরে নিজেদের ঠিকানা হিসেবে ২টি বা ৩টি দেশের নাম ব্যবহার করতে হয়েছে। যেমন আমার ঠাকুর দাদা “দেবেন্দ্র দত্তের” যখন জন্ম হয়েছিলো তখন তাঁর জন্মস্থানের নাম ছিলো “ব্রিটিশ ভারত”; আমার বাবা “পবিত্র দত্তের” যখন জন্ম হয়েছিলো তখন তাঁর জন্মভূমির নাম ছিলো “পাকিস্তান”; আবার আমার (অসীম দত্ত) যখন জন্ম হয় তখন আমার জন্মভূমির নাম হয় “বাংলাদেশ”। আমাদের প্রায় সবার ৩টি জেনারেশনের ঠিকানায় ৩টি দেশের নাম থাকার ইতিহাসটি অনেক বঞ্চনার ও উপেক্ষার।


তখনকার উত্তরাধিকার আইনে যে জিনিসটি প্রাধান্য দেয়া হয় তা হল, হিন্দু গৃহবধূ বা নারী যেহেতু সম্পত্তি রক্ষায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল তাই ঘুরিয়েফিরিয়ে পারিবারিক কোন পুরুষ সম্পর্কের আত্মীয় পরিজনকেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার করা হয়েছে। তখনকার শিক্ষিত হিন্দু জনসাধারণের ব্যাপক বুদ্ধি বিচার আর সমর্থনেই এই আইন হয়। ধর্মের নামে এই আইন হলেও এখানে হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্ত্র বেদের এবং মনুসংহিতা'কে অনুসরণ করা হয়নি; কারন পবিত্র বেদ ও মনুসংহিতায় স্পষ্টতই পুত্র কন্যাকে সবকিছুতেই সমান অধিকার দিয়েছে। ধর্মের মিথ্যা অজুহাতে হিন্দু নারীরা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখনও তা নারীদের ফিরিয়ে দেয়নি।


প্রায় শত বছরের এই আইন বাংলাদেশের হিন্দু জনসাধারণের মোটামুটি ভাবে হয়তো সুরক্ষা দিয়েছে। এই আইনের কারনে হিন্দু পরিবারে সম্পত্তি তুলনামূলক কম ভাগ হয়েছে। এখানে সম্পত্তি ভাগের মূল নিয়ম হল, বোন সাধারণত কোন সম্পত্তি পায়না; আবার বোনের যেই পরিবারে বিয়ে হয় সেই পরিবারেও তাঁর স্বামীর বোন কোন সম্পত্তি পায়না।


বর্তমান ২ সন্তান নীতিতে ২৫% পরিবারে হয় কন্যা সন্তান নেই এবং ২৫% পরিবারে পুত্র সন্তান নেই। তাই তাঁদের পারিবারিক আইনে নিজের কন্যা সন্তানের চেয়ে ভাইয়ের পুত্রদের (ভাতিজা) অধিকার সামনে চলে আসে। আইনের মারপ্যাঁচ শুরু হয়ে যায় যা আদালত পর্যন্ত গড়াতে হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আদালতের সুরাহা কোন সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তাই পুত্রহীন প্রায় ২৫% পরিবার কোন না কোন ভাবে নিদারুণ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ভারত সহ অন্যান্য দেশে হিন্দুদের সন্তান হিসেবে সমান অধিকার মেনে নিলেও বাংলাদেশের ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু জনসাধারণ এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। একই পরিবারের সকল সদস্যও সংস্কারের প্রশ্নে একমত হতে পারছেন না। অজানা এক আতংক তাঁদের এগোতে দিচ্ছেনা।


বর্তমান বিশ্বে আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মরিশাস, ফিজি, ত্রিনিদাদ-টোবাগো, জ্যামাইকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, গায়েনা, সোরিনাম, মায়ানমার সহ ১০০ টিরও বেশি দেশে হিন্দুরা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশে এমন আইন নেই যেখানে হিন্দু নারীদের আইন দিয়ে ভূমিহীন করে রেখেছে।


ব্রিটিশ ভারতের একটা খন্ড বর্তমান বাংলাদেশ... ভারত কিন্তু অভিশপ্ত এই ব্রিটিশ আইনকে বহুকাল আগেই বাতিল করে হিন্দু নারী পুরুষের আলোকে নয়, শুধু সন্তান হিসেবে সবার সমান অধিকার বিবেচনায় আইন করে তা বাস্তবায়ন করেছে।


দানপত্রের মাধ্যমে পিতা ও মাতা তাঁর সন্তানকে (পুত্র বা কন্যা) সম্পত্তি লিখে দিয়ে যেতে পারেন; কিন্তু সেটা দান হবে অধিকার নয়। অকাল মৃত্যু প্রাপ্ত পিতা কন্যাকে দানপত্র করে দেয়ার সুযোগটাই পান না। যার ভাই নেই বা যে কন্যা বিপদে পরছে তাঁরা খুব সহজেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হচ্ছেনা।


২০০৯ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র থেকে একটি আইনের খসড়া সামনে আসে, সেটা ছিলো সন্তান হিসেবে পুত্র ও কন্যা উভয়ে যেন সম্পত্তিতে সমান অধিকার পায় তা নিয়ে। তখন এর পক্ষে ও বিপক্ষে ব্যাপক আন্দোলন হয়। কিন্তু পুরুষ শক্তির কাছে নারী শক্তির পরাজয় হয় এবং সেই খসড়ারও মৃত্যু হয়। তারপর থেকে হিন্দুদের ছোট একটি অংশ হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সংস্কারে সরব হয়। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে নারীরা এই আন্দোলন শুরু করেন তাঁদের বেশিরভাগেরই হিন্দু নামের আড়ালে আরেকটি আরবি নাম আছে। মানে তাঁদের অতীতে অন্য ধর্মের ব্যাক্তির সাথে ধর্মান্তরের মাধ্যমে বিয়ে হয়েছিল, যদিও তাঁদের প্রায় কারোরই বিয়ে টিকেনি (তাঁরা তালাক প্রাপ্ত হয়েছেন)। দুই একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশে প্রায় সবগুলো ধর্মান্তরের ঘটনার পিছনেই প্রেম-বিয়েই একমাত্র কারন। এটা সত্য যে, তালাক প্রাপ্ত হয়ে তারা আবার নিজেদের অতীতে ত্যাগ করা হিন্দু নাম ধারন করে পিতার সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার লোভ নিয়ে এগোচ্ছিলেন।


হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত এমন সব ব্যাক্তিরা যখন হিন্দু পারিবারিক আইনের সংস্কারের দাবীতে এই আন্দোলন শুরু করে তখন প্রায় ৯৯% হিন্দু জনসাধারণ একে সন্দেহের চোখে দেখে। এইসব বিতর্কিত ব্যাক্তির অতি আগ্রহের কারনে সুন্দর ও সম্ভাবনাময় এই আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে সমালোচিত করে। তাতে করে সংস্কারের বিপক্ষের শক্তি হালে জল পায় ও সংঘটিত হয়ে তাঁদের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন পায়।


ধর্মান্তরিত ব্যাক্তিদের নিয়ে সংস্কার বিরোধীরা কেন আতংকিত?


এই আইনের একটা দিক হল, “পিতা হত্যাকারী এবং ধর্মান্তরিত সন্তান কোন উত্তরাধিকার পাবেনা”। ধর্মান্তর মানে সে তাঁর পিতা মাতা আত্মীয় ও ধর্ম ত্যাগ করেছেন সাথে তার হিন্দু নামও।


এই উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে কোন ব্যাক্তি যখন ধর্মান্তর হন তখন সামাজিকভাবে ও পারিবারিকভাবে ধর্মান্তরিত ব্যাক্তির অতীতের পরিবার নিদারুণ অপমান ও কষ্টের মধ্যদিয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় জীবনের বাকি দিনগুলো অতিবাহিত করেন। ধর্মান্তরিত ব্যাক্তির অবিবাহিত ভাইবোনদের সাথে অন্য কোন পরিবারের ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে চায়না। তাঁদের সাথে সামাজিক ভাবে আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের দূরত্ব তৈরি হয়। অনেক ধর্মান্তরিত ব্যাক্তির মা-বাবা অপমান ও কষ্ট সইতে না পেরে মানসিক চাপে হার্ট এটাকে মারা যায় বা আত্মহত্যা করেন; এমন উদাহরণ শতশত। এইসব অনেক পরিবারের বেশিরভাগই লোকচক্ষুর আড়ালে নতুন জায়গায় বসতি স্থাপন করে একঘরে জীবনযাপন করে। অনেকে আবার দেশান্তিত হয় চিরদিনের জন্য। তাছাড়া দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মান্তরিতদের প্রতি যেমন শর্তহীন সহযোগিতা ও সহানুভূতির ছায়া দৃশ্যমান, তেমনটা তার ছেড়ে আসা পরিবারের প্রতি দেখা যায়না। এসব নানান তিক্ত অভিজ্ঞতা ও আতংকের জন্যই হিন্দুরা সবসময়ই ধর্মান্তরিতদের শতভাগ এড়িয়ে চলে অভ্যস্ত।


আমি এটা বিশ্বাস করিনা যে হিন্দু ব্যাক্তিরা বোনের সম্পত্তির লোভে সংস্কারের বিরোধিতা করছেন। কারন তাঁরা যদি বোনকে সম্পত্তি দেন তো তাঁর স্ত্রী তো আবার তাঁর বাবার সম্পত্তি পাবেন। মানে সমান সমান। এটাও সত্য যে, আমার মতো যারা সংস্কার চাচ্ছেন তাঁরা শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি চাচ্ছেন এমনটা না। কারন কেউ যদি স্ত্রীর মাধ্যমে শ্বশুরের সম্পত্তির আশা করেন তো তাঁকে তাঁর বোনকে বাবার সম্পত্তির সমান ভাগ দেয়াটাও মেনে নিতে হবে। শুধু একটা সুন্দর ও আগের চেয়ে আরও সুরক্ষিত সংস্কারের মাধ্যমে হিন্দু তথা বাংলাদেশের সকল নারীর সন্তান হিসেবে সমান অধিকার চান।


সংস্কার বিরোধীরা কেন সংস্কার চান না?


এটা না চাওয়ার অন্যতম কারন তাঁদের আস্থাহীনতা। ভারত ভাগের পর গত ৭৬ বছরে বাংলাদেশের হিন্দুদের উপরে যে অত্যাচার ও নিপীড়ন হয়েছে তার উল্লেখযোগ্য কোন বিচার হয়নি। (যেমনটা ভারতের সংখ্যালঘুদের খেত্রেও তাই।) তাঁদের ভয় যে, সংস্কারের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত ব্যাক্তিদের পিতার সম্পত্তি পাওয়ার পথ সুগম হতে পারে। তাতে পুরো হিন্দু সমাজ নতুন এক সঙ্কটের মধ্যে পরবে। যেহেতু পিতা হত্যাকারী এবং ধর্মান্তরিত সন্তান আগে থেকেই পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায়না, সুতরাং সংস্করণেও এটা বহাল থাকবে এই ব্যাপারে সবাই একমত।


সম্পত্তিতে হিন্দু মহিলার অধিকার আইন, ১৯৩৭ অনুসারে বিধবা স্ত্রী তাঁর জীবদ্দশায় মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে পুত্রের সমান জীবনস্বত্ব পাবেন। মৃত ব্যক্তির পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র ও বিধবা স্ত্রী না থাকেন, তাহলে মৃত ব্যক্তির কন্যাদের মধ্যে অবিবাহিত কন্যা ও পরে পুত্রবতী কন্যা সম্পত্তি পাবেন। কিন্তু নানান শর্তের মারপ্যাঁচে আর আদালতের দীর্ঘসূত্রতায় এই অধিকার পাওয়া ও ভোগ করা অনেক কঠিন ব্যাপার; আধুনিক সময়ের বাস্তবতায় সম্ভবত তা অসম্ভব।


সরকার কি সংস্কারের মাধ্যমে এর সুরাহা করবে?


রাজনৈতিক সরকার কোনদিন এইসব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করেনা। যেমনটা আমরা ২০০৯ সালেও দেখেছি। সতীদাহ প্রথা বাতিলের আইন, বিধবা বিবাহ আইন… এইসব ব্রিটিশ শাসকরা করে গেছেন বলেই হয়েছে। মুসলমানদের বিয়ের ক্ষেত্রে ২য় বিয়ে করার ক্ষেত্রে অবশ্যই ১ম স্ত্রীর অনুমতি লাগবে… এই আইন কোন রাজনৈতিক সরকার করেনি; এই আইন করেছিলো কুখ্যাত স্বৈরশাসক “আইয়ুব খান”। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উপমহাদেশের মানুষ সবসময়ই সামাজিক পরিবর্তন কে সামাজিক বিপর্যয় মনে করে তার তীব্র বিরোধীতা করতে থাকে। যেমনটা সতীদাহ প্রথা বাতিল ও বিধবা বিবাহ প্রচলনের আইন করার সময়ও দেখা গেছে। তখনকার সময়ে ১০% মানুষও এই আইনের পক্ষে ছিলোনা। তাই আমার মনে হয়না হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের তেমন কোন সংস্কার হবে। ব্যাপক হিন্দু জনগোস্টি এই ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হলেই কেবল রাজনৈতিক সরকার এই আইন সংস্করণে হাত দিতে পারেন, নয়তো না।


সংস্কারের বিষয়ে আমি কি চাই?


ব্যাক্তিগতভাবে আমি ২০২৩ সালের আধুনিক পৃথিবীতে ধর্মের ভিত্তিতে উত্তরাধিকার চাইনা। এখন শুধু পিতার নয়, মাতার সম্পত্তিরও সঠিক উত্তরাধিকার আইন প্রয়োজন। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকে সন্তান হিসেবে পিতা-মাতার সম্পত্তির সমান অধিকার পাবে। শুধু হিন্দুদের জন্য এই আইন হোক সেটা আমি চাইনা। কোন ধর্মের ভিত্তিতেও চাইনা। কোন সন্তান নারী হওয়ার কারনে সম্পত্তিতে সরাসরি অধিকার পাবেনা বা সমান অধিকার পাবেনা; এটা নিকৃষ্ট ভাবনা এবং তা অমানবিক। যদি নারী সন্তান হিসেবে পিতা-মাতার সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকার পায়, তাহলে ছেলে-মেয়ে উভয়কেই বৃদ্ধ পিতা-মাতার দায়িত্ব নিতে হবে; সেটাও আইনে থাকা চাই। রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর পরিবর্তন আনতে হবে। রাষ্ট্র যেই বিবেচনায় সরকারি কর্মকর্তা কর্মচা্রী নারী-পুরুষের বেতন সমান হারে দিয়ে থাকেন, সেই বিবেচনায়ই পিতামাতার সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকার পাওয়া সন্তান হিসেবে একজন নারীর মৌলিক অধিকার।


যতদিন রাষ্ট্রের (সব ধর্মের মানুষের জন্য) এই আইন হচ্ছেনা; ততদিন হিন্দুদের জন্য শুধু ২টা আইন মূল আইনের সাথে যুক্ত হোক, তা হল-


  • ১/ “যদি কারোর পুত্র সন্তান না থাকে তাহলে তাঁর কন্যা পুত্রের মতো সরাসরি সম্পত্তির মালিক হয়ে যাবে।“
  • ২/ “বিধবা নারী পুত্র সন্তানের মতো সরাসরি স্বামীর সম্পত্তির ভাগ পাবেন”। এর মধ্যে “যদি” “অথবা” “কিন্তু” এর মতো কোন শর্ত থাকবেনা। সাথে সাথে আগের আইনের শতভাগ অপরিবর্তিত থাকবে।


আর, অতীতের মতোই পিতা হত্যাকারী ও ধর্মান্তরিত কোন ব্যাক্তি কোনভাবেই যেন পিতার সম্পত্তির ভাগ না পায় সেটা যেমন বহাল থাকবে; সাথে স্পেশাল এক্টে যদি ধর্মান্তরিত না হয়েও অন্য ধর্মের কোন ব্যাক্তির সাথে কোন সন্তানের বিয়ে হয় তাঁরাও পিতার বা মাতার সম্পত্তির কোন উত্তরাধিকার পাবেনা সেটা নিশ্চিত করতে হবে।


নারীদের জন্য পিতার সম্পত্তিতে কন্যার সমানাধিকার অতীব জরুরী। সন্তান হিসেবে এটা কন্যার মৌলিক অধিকার। তাই আসুন কন্যাদের পিতার সম্পত্তিতে সমানাধিকরণের এই আন্দোলনে আমরা সকলে শামিল হই। ভালো থাকুক আমাদের মা, বোন ও কন্যা। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল পিতা-মাতার কন্যা সন্তান।


ধন্যবাদ সবাইকে।


(-ডা. অসীম দত্ত – অনির্বাণ; ২৭ জুন ২০২৩)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ