জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভয়ে সংখ্যালঘুরা

সেমিনারে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, ছবি: প্রথম আলো
সেমিনারে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, ছবি: প্রথম আলো

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা, আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৩, ২১: ৫৬


গত ৪৮ বছরে সাম্প্রদায়িক শক্তি ও উগ্রবাদী গোষ্ঠী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে যতটা শক্তিশালী হয়েছে, এতটা শক্তিশালী তারা পাকিস্তান শাসনামলেও ছিল না। এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্ব ও পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে তারা (সংখ্যালঘুরা) ভয় পাচ্ছেন।


আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেল বেসরকারি সংস্থা ‘এমপাওয়ারমেন্ট থ্রো ল অব দ্য কমন পিপল’ (এলকপ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি’ শীর্ষক এক সেমিনারে আলোচক হিসেবে অংশ নিয়ে রানা দাশগুপ্ত এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিদেশি কূটনীতিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, এনজিও কর্মকর্তা, জাতিসংঘের কর্মকর্তা ও মানবাধিকারকর্মীরা অংশ নেন।


সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র জাতিগাষ্ঠীর জন্য সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব অঙ্গীকার করেছিলেন, তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি উল্লেখ করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ক্ষমতাসীন দলসহ প্রায় অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায় থাকলেও তাদের আপসকামী মনোভাবের কারণে সাম্প্রদায়িক শক্তি ও উগ্রবাদীরা আরও শক্তিশালী হয়েছে।


রানা দাশগুপ্ত বলেন, ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত (১৯৯৬ থেকে ২০০১ ছাড়া) রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ওপর তিনটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি ও উগ্রবাদী গোষ্ঠী প্রতিনিয়তই বলছে, তারা  ২০২৫ বা ২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুমুক্ত করবে। তাই তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দ্রুত সরকারি পদক্ষেপের দাবি জানান তিনি।


সেমিনারে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন এলকপের গবেষণা কর্মকর্তা আরেফিন মিজান। গবেষণাপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, ঐতিহাসিকভাবে সংখ্যালঘুরা হামলা নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন। ব্রিটিশদের ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতি, পাকিস্তানি শাসকদের ১৯৬৪ সালের হিন্দুবিরোধী দাঙ্গা এবং স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর থেকে এদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা চলছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটে। সে সময় নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতায় সারা দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৩৫৫ জনকে হত্যা করা হয়। ধর্ষণের শিকার হন ৩ হাজার ২৭০ জন। এসব ঘটনায় ২২১টি মামলা হয়। 


এগুলোর মধ্যে ১৯৪টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল ২৭টির।


সংখ্যালঘুদের ওপর সহিসংতার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে গবেষণায়। সেখানে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননাকর পোস্টকে ঘিরে ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক হামলায় ১৫টি মন্দির ও হিন্দুদের শতাধিক বাড়িঘর ভাংচুরের কথা উল্লেখ করা হয়। এসব ঘটনায় ৮টি মামলা হয়। এসব মামলায় একজন ইউপি চেয়ারম্যানসহ ১৩ জনের শাস্তি হয়েছে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালে দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লার একটি মন্দিরের কাছে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনাকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এতে সাতজন নিহত হন। এ ঘটনায় মামলা হয় ছয়টি। এতে ইকবাল হোসেন নামের এক অভিযুক্তের ১৬ মাসের কারাদণ্ড হয়। এ ছাড়া ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ মন্দির ও বসতিতে আগুন দেওয়া হয়।


গবেষণাপত্রে ১৯০১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সংখ্যালঘু জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়। সেখানে সংখ্যালঘুদের মোট সংখ্যা বাড়লেও মোট জনসংখ্যার তুলনায় তাদের হার কমার পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। গবেষণাপত্রে সংখ্যালঘুদের অধিকার ও সুরক্ষায় বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠনসহ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়।


সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন এলকপের চেয়ারম্যান ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। সংখ্যালঘু পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা স্বর্গেও নেই, আবার নরকেও নেই। সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।’


অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল রোজারিও, বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভেন থেরো সুনন্দপ্রিয় এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং আলোচক হিসেবে অংশ নেন। সমাপনী বক্তব্য দেন এলকপের নির্বাহী পরিচালক তাপস কান্তি বল।


সূত্র: প্রথম আলো

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ