শাহরিয়ার কবির বলেছেন "নির্বাচন বানচালে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে"

শাহরিয়ার কবির বলেছেন "নির্বাচন বানচালে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে"

স্টাফ রিপোর্টার, প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭ : ০৫ পি.এম.


রাজধানীর রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সেমিনার কক্ষে (দোতলায়) ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৩টায় অনুষ্ঠিত হয়। ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য প্রদান করেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী মানবাধিকার নেত্রী আরমা দত্ত এমপি, ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট-এর সভাপতি ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ-এর সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, বাংলাদেশ খ্রিষ্টান এসোসিয়েশন-এর সভাপতি মানবাধিকার নেতা নির্মল রোজারিও ও বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন-এর সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়।


অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আইটি সেল-এর সভাপতি শহীদসন্তান নাট্যজন আসিফ মুনীর। ‘নির্বাচন বানচালের জন্য বিএনপি আমেরিকাকে ডেকে আনছে’ মন্তব্য করে নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন,


‘আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের সাফল্য ও উন্নয়নের এই ধারা স্তব্ধ করে, যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার বন্ধ করে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ, সন্ত্রাসী, জঙ্গি রাষ্ট্র বানাবার জন্য জামায়াত-বিএনপির মতো ’৭১ ও ’৭৫-এর খুনিরা আবার মাঠে নেমেছে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা আন্দোলনের নামে তাণ্ডব করছে এবং গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়ে বিদেশী হস্তক্ষেপ ও আগ্রাসনের ক্ষেত্র তৈরি করছে।


শাহরিয়ার কবির আরো বলেন, 


‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট জনগণের মৌলিক অধিকার। আপনাদের কাছে আমাদের আবেদন যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, যারা ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে, যারা গণতন্ত্রের নামে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ, সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, যারা বাংলাদেশকে জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিল, যারা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বছরের পর বছর দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছিল তাদের দ্বারা প্রতারিত হবেন না। অতীতে আমরা দেখেছি নির্বাচনের প্রাক্কালে স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি কীভাবে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভোটারদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে তাদের ভোটদানে বিরত রাখে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় ৭০ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে পারেননি। তাদের হত্যা করা হয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে, গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে যাতে দেশের সকল নাগরিক শান্তিপূর্ণভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন তা সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে পূর্বাহ্নে নিশ্চিত করতে হবে। যে সব এলাকায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আবাস তুলনামূলকভাবে বেশি সে সব অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তিদের নিয়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করুন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার দায় একা শুধু সরকারের নয়, আমাদের সকলের।’


মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী মানবাধিকার নেত্রী আরমা দত্ত এমপি বলেন, 


‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর ভিত্তি করে। সংবিধানেও সেই অসাম্প্রদায়িক প্রতিফলন ঘটেছে। বাংলাদেশের যারা সংখ্যালঘু রয়েছেন আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারণ বিশ্বব্যাপী একটি ষড়যন্ত্র চলছে। আমি সংসদে এর আগেও বলেছি সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনও জরুরি। সামনের সময়ের জন্য আমাদের অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করতে হবে। নির্বাচনকালে যেন কোনরূপ সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা না ঘটে সে লক্ষে আমরা নির্মূল কমিটির নেতৃত্বে শীঘ্রই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করব।’


১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট-এর সভাপতি ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, 


‘সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়ে কেবল আপনারা সংখ্যালঘুরাই নন, বরং আমরা যারা প্রগতিশীল রয়েছি তারাও আপনাদের সুরক্ষার বিষয়ে অতীতে এবং এখনো সোচ্চার আছি। আমাদের তৎপরতার কারণে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০১ সালে ভীত হয়ে মিথ্যা মামলায় আমাকে এবং শাহরিয়ার কবিরকে হাজতবাস করিয়েছিল।’


তিনি আরো বলেন, 


‘আমাদের উচিত এখনই শেখ হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতা নিয়ে আসার জন্য কাজ আরম্ভ করা। অতীতে আপনারা যে নির্বাচনকালীন সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন সেই সহিংসতার সঠিক তথ্য প্রমাণ নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার এম্বাসিগুলোর সামনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করা এবং তাদেরকে জানিয়ে দেয়া যে, কারা আপনাদের ভোট দিতে দেয়নি এবং আপনাদের উপর নির্যাতন-সহিংসতা চালিয়েছে। আপনাদের উচিত, আপনাদের ভিতরের কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে সে বিভ্রান্তিগুলোকে দূর করা এবং যারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।’


তিনি আরো বলেন, 


‘সংখ্যালঘুরা পৃথিবীর সব জায়গায় নির্যাতিত হচ্ছেন কিন্তু নিজ ভূমিতে দাঁড়িয়েই তারা লড়াই করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনা যদি পুনরায় নির্বাচিত না হন তাহলে কেবল সংখ্যালঘুরাই নন, গ্রামের পর গ্রাম আওয়ামী লীগারদেরও দেশ ত্যাগ করতে হবে। সুতরাং আপনারা নির্বাচনের পূর্বেই প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলুন এবং আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে বিজয়ী করুন।’


নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ বলেন, 


‘যে কবিতা লেখে, গান গায় সে অন্যের উপর হামলা করতে পারে না, তবে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে। বিভিন্ন জেলাতে আমাদের একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড রয়েছে। নির্বাচনের পূর্বে স্কোয়াডের সদস্য ও অসাম্প্রদায়িক মানুষদের নিয়ে প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলুন। নির্বাচন আসলেই আমরা আতঙ্কিত হই। কিন্তু তখন আতঙ্কিত না হয়ে সমমনাদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।’


বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ-এর সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, 


‘২০১৮ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রচলিত ফোজদারী দন্ডবিধি অনুযায়ী যেহেতু সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের মতো সামাজিক দুর্যোগকালে সংঘটিত অপরাধের বিচার সম্ভব নয়, তাই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ভিকটিমদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি অপরাধীদের শাস্তির জন্য আমরা সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে ছিলাম। যা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। এখনও সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং দলিত ও হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরণের বৈষম্য, পীড়ন ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। এসব সমস্যা নিরসনের জন্য জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন এবং সংখ্যালঘু কল্যাণ মন্ত্রণালয় গঠনের জন্য আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এ দাবি পূরণের ঘোষণার পুনরায় দাবি জানাচ্ছি।’


বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশন-এর সভাপতি মানবাধিকার নেতা নির্মল রোজারিও বলেন,


‘নির্বাচন আসলে দেশের ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি, শংকা কাজ করতে থাকে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ মনে করে যে কোন জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচন মানেই হল নির্যাতন। তারা ভোট কেন্দ্রে গেলেও সমস্যা আবার না গেলেও সমস্যা। বিগত কয়েকটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের এই ধারণা হয়েছে। বিশেষভাবে ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে পরে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যে নির্যাতন নিষ্পেষন হয়েছিল তা ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। সেই দুঃস্বপ্নের কথা ভুলতে পারে না এখনো অনেকে। ২০০১ সালের নির্বাচন ছিল সংখ্যালঘুদের জন্য যেন এক অভিশাপ। ঐ নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের হিংসাত্মক তৎপরতায় দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, এমনকি শিক্ষকরা পর্যন্ত রেহাই পায়নি। প্রশাসনের অনৈতিক অনুকূল্য ও দলীয় ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে এ সময় এলাকায় ব্যাপক লুটতরাজের ঘটনা ঘটে। এ সময় অনেকেই ক্ষমতাসীন এবং প্রতিপক্ষের বাহিনী দ্বারা বর্বরোচিত হামলা এবং নির্যাতনে আহত হয়। ক্ষমতাসীন এবং প্রতিপক্ষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে এলাকা ছেড়ে যায় বহু সংখ্যালঘু পরিবার। বাসে অগ্নিসংযোগ, ধানের পালার আগুন, মন্দিরও পুড়িয়ে দেয়া, মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা, সংখ্যালঘু নারীদের উপর লোলুপ দৃষ্টি, ফলে শেষাবধী নারীদের উপর নির্যাতন কি হয়নি এই সময়কালে।’


বাংলাদেশের অপঃসৃয়মান ঐতিহ্য, অহিংস অসাম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল গৌরব ফিরে আসুক-এ আশাবাদ ব্যক্ত করে বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন-এর সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় বলেন, 


‘২০০১ সালের নির্বাচনকালীন (১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ অক্টোবর) সময়ে সারা দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মৌলবাদীরা। ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, হামলায় শিকার অসংখ্যজন। কয়েক স্থানে আদিবাসী ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপরও হামলা, নিযাতন করা হয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর বর্বর নির্যাতন চালায়। সে সব ভয়ংঙ্কর ঘটনা আজও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের তাড়া করে। সে সময়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু জ্ঞানজ্যোতি হত্যা এক আলোচিত ঘটনা। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ পল্লীতে নারকীয় হামলা আমরা এখনো ভুলতে পারি না। সব ঘটনার সাথে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি জড়িত। আমরা কেউ চাই না বাংলাদেশে সেই অপশক্তি পুনরায় ক্ষমতায় আসুক।’


সভায় প্রগতিশীল সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সমমনা দলগুলোর সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সম্মিলিত সংখ্যালঘু সুরক্ষা পরিষদ গঠন করার জন্য সকল বক্তারা আহ্বান জানান।


সূত্র: বাহান্ন নিউজ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ