হিন্দুরা হিন্দুদের যেভাবে ‘নওমুসলিম’ বানায়! - সুষুপ্ত পাঠক

হিন্দুরা হিন্দুদের যেভাবে ‘নওমুসলিম’ বানায়! - সুষুপ্ত পাঠক

প্রায় সাতশো বছর আগের কথা। খুলনার দক্ষিণ ডিহির ‘রায় চৌধুরী’ বংশের খুব সমাদর। বখতিয়ার খিলজি গৌড় আক্রমন করার পর মুসলিম শাসন এখানে ওখানে বিস্তার লাভ করার পর যখন একটু থিতিয়ে এসেছে প্রাথমিক উত্তেজনা ভয় কাটিয়ে তখন কোথাও কোথাও উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ হিন্দুরা রাজ দরবারে কাজ নিয়েছে। মুসলিম শাসকরাও স্থানীয়দের কিছু কিছু পদে বসিয়ে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে চেয়েছে। খুলনা যখন খানজাহান আলী শাসন করছেন তখনো চৌধুরীরা রাজ প্রশাসনে কাজ করছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখ করা যায় দক্ষিণা নারায়ণ ও নাগর নাথ। এই দুইজন ব্রাহ্মণ খানজাহান আলীর সময় রাজ দরবারে যুক্ত ছিলেন। দক্ষিণা নারায়ণের চার ছেলে কামদেব, জয়দেব, রতিদেব, শুকদেব। এরমধ্যে গোবিন্দলাল রায় নামের এক ব্রাহ্মণ খান জাহান আলীর হাতে ধর্মান্তরিত হয়ে ‘পীর আলী মুহাম্মদ তাহির’ নাম ধারণ করেন। জাত মারা হয়ে গোবিন্দ্রলাল স্বধর্মীয় হিন্দুদের কাছে এতটুকু সহানুভূতি পাননি। মুসলমানের সংস্পর্শে আসার জন্য সে আর হিন্দু নয়, তার পরিবার এখন হিন্দু সমাজ চ্যুত- এইরকম ফতোয়ায় গোবিন্দলাল শেষে মুসলিম হওয়ারই সিদ্ধান্ত নেন। গোবিন্দ্রলাল মুসলিম হোন এবং পুরস্কার স্বরূপ জাইগির লাভ করেন দক্ষিণ ডিহি। এই গ্রামের শাসক হিসেবে এসে নওমুসলিম তাহির হিন্দুদের জাত মেরে কথিত ‘জাতিচ্যুত’ করে মুসলিম বানানোর মিশনে নামে। তার নিজের পরিণতির প্রতিশোধ যেন। তাহিরের পুত্র হিন্দু থেকে গিয়েছিলো। তাকে ‘পীর আলীর ছেলে’ বলে সবাই খ্যাপাতো। এই ‘পীর আলী’ কালক্রমে ‘পীরালী’ হয়ে উঠে।  গোবিন্দ্রলাল রায় ওরফে মুহাম্মদ তাহিরের বংশধরদের প্রথম ‘পীরালী বামুন’ অভিশাপে পতিত হতে হয়। কেন অভিশাপ সেটা পরে বলছি। তবে এইসব কিছুই সম্ভব হয়েছিলো হিন্দু সমাজের কারণে।


দক্ষিণ ডিহির পূর্ব নাম ছিলো পয়গ্রাম। এখানেই তাহির জাইগির পান। একদিন রোজার দিনে তাহির তাকিয়া বসে একটা লেবুর ঘ্রাণ শুকছিলেন। তখন দক্ষিণা নারায়ণের দুই পুত্র সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কামদেব ও জয়দেব তাহিরকে বলল, হুজুর রোজা রেখে লেবুর ঘ্রাণ শুকলেন, আপনার তো আর রোজা নেই! কারণ ঘ্রাণেই অর্ধভোজন...।


তাহির অপমানিত হলেন। প্রচন্ড হিন্দু বিদ্বেষ তার বুকের ভেতর। বিগত জীবনে হিন্দুদের জাতপাতের শিকার তিনি। প্রতিশোধের পরিকল্পনা তখনই করতে শুরু করলেন। একদিন দরবারে আমন্ত্রিত অতিথিদের ডেকে ভোজেন আয়োজন করলেন তাহির। যথারীতি কামদেব জয়দেব উপস্থিত। ভরা মজলিশে তখন তাহিরের নির্দেশে গরুর মাংসের রান্না করা হাড়ি এনে রাখা হয়। মুহূর্তের মধ্যে ব্রাহ্মণরা নাকে কাপড় দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। তাহির কেবল কামদেব ও জয়দেবের হাত চেপে ধরে মাংসের ঘ্রাণ নিতে বাধ্য করেন। ঘ্রাণে অর্থভোজন! ব্যস, জাত মারা গেলো কামদেব জয়দেবের। গ্রামে এই দুই পরিবারকে হিন্দু সমাজ করলো একঘরে। এই ঘরের ছেলেমেয়ের সঙ্গে কেউ বিয়ে দিবে না। সামাজিক সম্পর্ক থেকে তাদের বঞ্চিত করা হলো। অগত্যা নিরুপায় হয়ে এই দুই ভাই মুসলিম হওয়া ছাড়া আর কোন পথ রইল না। ইসলাম গ্রহণ করে দুজনের নাম হলো যথাক্রমে কামাল উদ্দিন ও জামাল উদ্দিন। এই দু্ই ভাইয়ের বংশধরদেরও হিন্দুরা বয়কট করেছিলো। তাদের নাম হয়েছিলো ‘পীরালী বামুন’। এরা অচ্ছুত। এদের ছেলেমেয়ের বিয়ে হবে না। হাট বাজার হবে না। ইতিহাসে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার, সিঙ্গিয়ার মুস্তফী পরিবার, দক্ষিণডিহির রায় চৌধুরী পরিবার, খুলনার পিঠা ভোগের ঠাকুর পরিবারদের নাম বিশেষ করে পাওয়া যায় যারা অভিশপ্ত ‘পীরালী বামুন’ হয়ে চরম নিপীড়ণের শিকার হয়েছিলেন হিন্দুদের হাতে। ধর্য্য ধরে যদি এই লেখা পড়ে থাকেন তাহলে প্রাচীন পুঁথি থেকে কিছু লাইন তুলে দিচ্ছি যেখানে এই ইতিহাসের স্বপক্ষে ইতিহাসের সন্ধান পেয়ে যাবেন।


খান জাহান মহামান পাতশা নফর

যশোর সনন্দ লয়ে করিল সফর।।

তার মুখ্য মহাপাত্র মামুদ তাহির

মারিতে বামুন বেটা হইল হাজির।।

পূর্বেতে আছিল সেও কলিনের নাতি

মুসলমানী রুপে মজে হারাইল জাতি।।

পীর আলী নাম ধরে পীরাল্যা গ্রামে বাস।

যে গাঁয়েতে নবদ্বীপের হইল সর্বনাশ।।

সুবিধা পাইয়া তাহির হইল উজির

চেঙ্গুটিয়া পরগণায় হইল হাজির।।

আঙ্গায় বসে আছে উজীর তাহির।

কত প্রজা লয়ে ভেট করিছে হাজির।।

রোযার সেদিন পীর উপবাসী ছিল।

হেন কালে একজন নেবু এনে দিল।।

গন্ধামোদে চারিদিকে ভরপুর হইল।

বাহবা বাহবা বলে নাকেতে ধরিল।।

কামদেব জয়দেব পুত্র দুইজন।

বসেছিল সেইখানে বুদ্ধে বিচক্ষণ।।

কি করেন কি করেন বলিলা তাহিরে।

ঘ্রাণেতে অর্ধেক ভোজন শাস্ত্রের বিচারে

কথায় বিদ্রুপভাবি তাহির অস্থির।।

গোঁড়ামি ভাঙ্গিতে দোহের মনে কৈলা স্থির

দিন পরে মজলিশ করিল তাহির।

জয়দেব কামদেব হইল হাজির।।

দরবারের চারিদিকে ভোজের আয়োজন

শতশত বকরী আর গোমাংস রন্ধন।।

পলাভু লসুন গন্ধে সভা ভরপুর।

সেই সভায় ছিল আরও ব্রাহ্মণ  প্রচুর।।

নাকে বস্ত্র দিয়া সবে প্রমাদ গুণিল।

ফাঁকি দিয়া ছলে বলে কত পালাইল।

কামদেব জয়দেব করি সম্বোধন।

হাসিয়া কহিল ধুর্ত তাহির তখন।।

জারি জুরি চৌধুরি আর নাহি ঘাটে।

ঘ্রাণে অর্ধেক ভোজন শাস্তে আছে বটে।।

নাকে হাত দিলে আর ফাঁকি তো চলে না।

এখন ছেড়ে ঢং আমার সাথে কর খানাপিনা।।

উপায় না ভাবিয়া দোহে প্রমাদ গণিল।

হিতে বিপরীত দেখি শরম মরিল।।

পাকড়াও পাকড়াও হাক দিল পীর।

থতমত হয়ে দোহে হইল অস্থির।।

দুইজনে ধরি পীর খাওয়াইল গোস্ত।

পীরালি হইল তাঁরা হইল জাতি ভ্রষ্ট।।

কামাল জামাল নাম হইল দোহার।

ব্রাহ্মণ  সমাজে পড়ে গেল হাহাকার।।

তখন জাকিয়া দোহে আলী খানজাহান।

সিঙ্গির জায়গীর দিল করিতে বাখান।।


কামদেব ও জয়দেবের কিন্তু মুসলিম হয়ে লস হয়নি। তাদেরকে তাহির ও খানজাহান আলী জাইগির দেন ও প্রচুর ধন সম্পদের মালিক বানান। এরাই পরবর্তীদের কঠিন হিন্দু বিরোধী হয়ে উঠেন এবং মুসলিম বানানোর মিশনে নামেন। পুঁথিতে তাই আক্ষেপ উঠে এসেছে-


পীরাল্যা গ্রামেতে বৈসে যতেক যবন।

উচ্ছ্‌ন করিল নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ ।।

ব্রাহ্মণ  জবনে বাদ যুগে যুগে আছে।

বিষম পীরাল্যা গ্রাম নবদ্বীপের কাছে।।


 যদিও ধর্মান্তরের জন্য পুঁথিতে মুসলমানদের দোষ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে এখানে প্রধান দোষই হিন্দুদের। হিন্দুরা কেবলমাত্র মাংসের ঘ্রাণের জন্য দোষী করে, শুধু তাই নয়, একজনের জন্য পুরো জ্ঞাতি গোষ্ঠিকে সমাজচ্যুত করে যে প্রধান দোষটা করলো সেটা স্বীকার করা হয়নি। রবীন্দ্রনাখ ঠাকুরদের পূর্ব পদবী ছিলো ‘কুশারী’। তাদের পূর্ব পুরুষ ঠিক এভাবেই মুসলমান শাসকদের হাতে কথিত জাত হারা হয়ে হিন্দুদের দ্বারা চরম নিপীড়ণের শিকার হয়ে দেশছেড়ে ভাগ্যান্বেষী হয়ে কোলকাতায় এসে উঠেন। এখানে তথাকথিত নিন্মজাতের হিন্দুদের পুজারী ঠাকুর হিসেবে জীবিকা নেন। এখান থেকেই এই বংশের পদবী ‘ঠাকুর’ হয়ে যায়। কুশারী পদবী সচেতনভাবেই গোপন করা হয়েছিলো হিন্দুদের ভয়েই পাছে তারা পরিচয় পেয়ে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয়!


এই হচ্ছে ইতিহাস! এই ইতিহাস নিয়ে হিন্দুরা গর্ব করলেও আমি অবাক হব না। কারণ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ব্রাহ্মণ কায়স্ত নামের তথাকথিত হিন্দু বড় জাতের হাস্যকর গর্ব বজায় রয়েছে। ভারতে বড়দিনে খ্রিস্টানদের উপর এতবড় হামলাটা করা হয়েছে কারণ খ্রিস্টান মিশনারীরা কথিত দলিতদের ধর্মান্তরিত করে সামাজিক অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়েছে। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করেছে। যুগের পর যুগ যারা সমাজে হিন্দুদের বর্ণ প্রথার শিকার হয়েছে তারা আজ ধর্মত্যাগ করায় হিন্দুত্ববাদীরা ফুঁসে উঠেছে। মুসলিম শাসনে একটি হিন্দুও ধর্মত্যাগ করত না যদি না হিন্দুরা ন্যুনতম মানবিক আচরণ করত। একজনকে জাত মারা গেছে রব উঠাতে পারলে তাকে গ্রাম ছাড়া না করা পর্যন্ত হিন্দুদের বিনোদন শেষ হতো না। মুসলমানের হাতে প্রতারিত জাতহার হিন্দুদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে বিদ্রুপে ছড়া কেটে কিভাবে কৌতুক করা হতো গ্রামীণ পুঁথিতে ধরা পড়েছে-


“মোসলমানের গোস্ত ভাতে

 জাত গেল তোর পথে পথে।”


 ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা হিন্দুদের ধর্মান্তরের আরেকটি ইতিহাস রচিত করতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে!



[তথ্যসূত্র: সেরা মুসলিম মনীষীদের জীবনকথা-১, নাসির হেলাল, সুহৃদ প্রকাশন,/ রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর বাড়ীর ইতিকথা, সৈয়দা মকসুদা হালিম/ যশোহর খুলনার ইতিহাস. ১ম খন্ড, শ্রী সতীশ চন্দ্র মিত্র/সুন্দরবনের ইতিহাস, ২য় খন্ড, এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)]


সূত্র

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ