মানুষ কতো কতোভাবে তারই পাশের মানুষকে অপর করতে থাকে। ধর্মীয় লিঙ্গীয় জাতিগত ভাষাগত অঞ্চল ইত্যাদি নানা পরিচয় সামনে এনে বুঝে না বুঝে মানুষ নিজের চারপাশে বিভাজন তৈরি করে, নিজেও বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। ভেতরে বিষ, বিদ্বেষ, হিংসা তাকে পোড়ায়, অন্যকেও। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তা চলতে থাকে। সমাজে তৈরি হয় বিষবাষ্প। এই বিভাজনে- বিষে লাভ আছে ক্ষুদ্র কিছু গোষ্ঠীর, কিন্তু ক্ষতি সর্বজনের। আসলে বৈষম্য যেখানে সেখানে মনোযোগ না দিয়ে, বৈচিত্রকে শত্রু ভেবে, মানুষ কীভাবে নিজেকেই ক্ষতবিক্ষত করে তারই কিছু চিত্র এই লেখায়। এই লেখা বিভাজনের যন্ত্রণার সাথে সাথে মানুষের মানুষ হিসেবে সংহতির আকুতি প্রকাশ করে।
কতগুলো কথা। কতগুলো ঘটনা। মস্তিষ্কের ভাঁজে প্রথম ছাপ ফেলেছিল ঊনিশশো পঁচাত্তর সালে, যখন থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের মাধ্যমে পরিবারের বাইরের জগতের সাথে পরিচয়ের সূত্রপাত হয়। তারপর থেকে চলমান। মুছে যেতে পারতো। কিন্তু আটকে পড়েছে,পুষ্টি পেয়েছে, বড়ো হয়েছে,তাজা হয়েছে। কারণ এদের নাড়াচাড়া করার সুযোগ হয় প্রায়ই। তাই সবকিছু না হলেও অনেক কিছু মনে রয়ে গেছে। সম্প্রতিও যেহেতু একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, ধারণা করা যায় আরো বেশকিছুকাল এভাবেই চলবে। ঘটনা আর কথাগুলো স্পষ্ট। ভাবও নিশ্চয় ছিল। আছে অনেক। যেগুলো অস্পষ্ট, ঠিক বাক্যে আসেনা। এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কটা মাত্র ক’দিনের এবং বাংলাদেশের, তাই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে।
কিন্তু এই বাক্য আর ভাবগুলোই সারা পৃথিবী জুড়ে নানা দেশে, নানা ভাষায়, নানা ধর্মে, নানা গোষ্ঠীতে, নানা মানুষের মস্তিষ্কে বহুসময় ধরে পুষ্টি পাচ্ছে। এখানে যিনি বা যারা বাক্যগুলোর বক্তা অন্য কোথাও তিনি বা তারা হয়তো শ্রোতার মস্তিষ্ক কিংবা অন্য কোনোভাবে একই ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবেশী দেশে ঘটে চলা ঘটনাগুলো এর উদাহরণ হতে পারে।পারস্পরিক চেহারা হয়তো আলাদা কিন্তু বহুবছর ধরে শক্ত করে বুনে যাচ্ছে বিভাজনের জাল যার শিকড় বহু গভীরে, বহু ছড়িয়ে বিছিয়ে আছে। হ্যাঁচকা টানে উল্টো চালে সহসা উপড়ে ফেলার নয়। সময়ের সাথে সাথে কিছু কার্যকারণ জানতে শেখা, বুঝতে পারার ফলে, ব্যক্তি কিংবা ঘটনা বিশেষ আলাদা করে নাড়া দেয়না আর। মাঝে মাঝে কৌতুক বোধও হয়। কিন্তু বোঝার চেষ্টা চলমান। তাই ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়ার বাইরে গিয়ে এই বিভাজনের ছবিকে দেখতে চাওয়া।
১৯৭৫ সাল পরবর্তী সময়। নার্সারি ক্লাশের শিশুটির কানের দুল এর ক্ষততে লাল রঙের ওষুধ লাগানো দেখে অ্যাসেম্বলিতে অন্য দুই শিশুর কথোপকথন; ‘হিন্দুদের এরকম খারাপ জিনিস হয়’। এছাড়া, বহু জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন, ‘পূজায় ইন্ডিয়া যাবে না? কেনো তোমাদের বাড়ি ইন্ডিয়া না? তোমাদের আত্মীয় থাকেনা ওখানে? যাবেনা কেনো?’`তোমরা কচ্ছপ খাও? ছিঃ! তোমরা গরু খাওনা কেনো?’ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের সিদ্ধান্ত, `হিন্দুরা এক ক্লাসে যাও মুসলমানরা এক ক্লাসে যাও।’
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে হিন্দুদের ভূমিকা প্রসঙ্গে শিক্ষক জানতে চাইলেন, `ক্লাশে হিন্দু কে আছে?’ সমস্ত ক্লাশ ঘুরে তাকালো হাতে গোনা কয়েকজন ছাত্রের দিকে।
রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো তথাকথিত পাগল; সিঁদুর টিপ পড়া নারী দেখলেই যার চিৎকার ‘হিন্দু হিন্দু। এই সিঁদুর পরছিস কেন?’
১৯৯০ সাল। ‘ও, তোমাকে তো ঈদ মোবারক বলা যাবে না।’‘পয়লা বৈশাখে তোমরা কী করো? তোমাদের কোনো পূজা হয়?’
মুমূর্ষু রোগীর স্বামী শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের হাতের শাঁখার দিকে তাকিয়ে বলছে নিচু গলায়, ‘হিন্দু হিন্দু’ ।
১৯৯১ সাল। স্বাধীন বাংলাদেশের বিশতম বছর । চট্টগ্রাম শহর। রাত আনুমানিক তিনটা। আতঙ্কগ্রস্ত একজন মা দুই মেয়ে আর ছোট ছেলেকে নিয়ে আলো বন্ধ করে বসে আছেন। বাবা নোয়াখালী। সেখানেও অবস্থা খারাপ শোনা গেছে। রাস্তার পাশে বাসা। বাইরে হিংস্র চিৎকার, গেটে প্রচণ্ড ধাক্কা। কাছেই জে.এম.সেন হল ভাঙার আওয়াজ। জন্মের পর থেকে শুনে আসা মুক্তিযুদ্ধের গল্পে পাকিস্তান বাহিনীর হামলার সাথে মিল পাওয়া যাচ্ছিল “নিজের” দেশে বসে। শুরুতে যদিও ধারণা ছিল, ইন্ডিয়াতে মসজিদ ভেঙেছে এদেশের হিন্দুরাতো কিছু করেনি। পরদিন মুসলমান বন্ধু পরিবার খোঁজ খবর নিলেন, আশ্বাস দিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে সংখ্যালঘুকে আশ্রয় দেওয়ার মানসিক শক্তিটা কোনো কোনো সময় দেখা যায়, যদিও অন্য অনেক সমস্যায় তারাও একই ভাবে বিপর্যস্ত।
১৯৯৪ সাল। ফরেনসিক মেডিসিন ভাইভা বোর্ড। অধ্যাপক প্রশ্ন করলেন,‘female deadbody হিন্দু না মুসলমান কীভাবে চেনা যাবে?’! পরীক্ষার্থী অনেক ভেবেও জবাব দিতে পারেনি। আকাশ পাতাল ভেবেও তার উত্তর পেলনা। বই এর কোন পাতায় ছিলকি? কোনো ক্লাশে পড়ানো হয়েছিল কি? অধ্যাপক বিরক্ত হয়ে নিজেই উত্তর দিয়ে বললেন, ‘পিউবিক হেয়ার শেভ না থাকলে হিন্দু’।
২০০১ পরবর্তী সময়। চকবাজার সোয়ারী ঘাট- ‘হিন্দুর মাইয়া এই সকালে জুতা মোজা পইড়া কই যায়?’ শিশু বিভাগে চিকিৎসক সহকর্মীর কাছে ঈদের ডিউটি রোস্টার চাওয়ার উত্তরে কৌতুকের ছলে বলা, ‘ওটা মালাউনরা করবে’। চিকিৎসক সহপাঠী বলেন, ‘আপনি গরু খান না? আরে কী বলেন!! আপনাদের একজনতো আমাদের বাসায় এসে চেয়ে খায়। এত পছন্দ করে। একটু খেয়ে দেখতে পারেন।’ একজন চিকিৎসক সহপাঠী, একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী অন্য সহপাঠীকে পহেলা বৈশাখে শাড়ি কিনেছেন শুনে: ‘তুমি একটা রিলিজিয়ন এ বিশ্বাস করো তোমার তো পয়লা বৈশাখ পালন করা উচিত নয়।’
২০০৬ সাল পরবর্তী দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠের অধ্যাপক; ‘তুমি আর অমুক (দু’জনই জন্মসূত্রে হিন্দু) পাশ করাতে বিশেষ করে বেশি খুশি হয়েছি।’ ২০০৮ পরবর্তী প্রখ্যাত অধ্যাপক, ‘কিছু মনে করোনা তোমাদের হিন্দুরা এমনিতে একটু বেশি সিনসিয়ার।’ প্রশংসা না কৌতুক সহজে বোধগম্য নয়।একজন নারী সহকর্মীর শিশু সন্তান নামের পদবী পড়ে অবাক হয়ে জানতে চাইলো ‘এটাতো হিন্দুদের নাম। তুমি হিন্দু?’ ‘হ্যাঁ’ বলাতে আবারও জিজ্ঞেস করলো ‘হিন্দু?’ তারপর হতবাক হয়ে চুপ করে তাকিয়ে রইল। হসপিটাল এর কর্মচারী (তাকে সবাই একটু বোকা হিসেবে জানে): ‘ম্যাডাম কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতাম। আপনি হিন্দু না মুসলমান?’ অপারেশন থিয়েটারে নারী রোগীর anesthesia দেয়ার পর শরীরের প্রাইভেসি প্রসঙ্গে একজন নারী চিকিৎসক জানালেন যে, তিনি বিদেশে গিয়ে দেখেছেন ওরা হিন্দু দেশ, তারপরও ‘ফিমেল পেশেন্ট-এর প্রাইভেসি মেইনটেইন করে’।
২০১৭ পরবর্তী সময়েও চিকিৎসকের সহকারীর প্রশ্ন; ‘ম্যাডাম আপনি হিন্দু না মুসলমান?’
হিন্দুদের সম্পত্তি দখল নিয়ে কোনো একজন হিন্দু নারীর এক বিদেশি রাষ্ট্র প্রধানের কাছে অভিযোগ বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করতে গিয়ে একজনের মন্তব্য এরকম, ‘হিন্দুরা এদেশে খারাপ কিসে আছে! হিন্দুগুলো এত টালবাহানা করে কেনো। অমুকতো ঠিকই প্রফেসর হয়ে বসে আছে। সেটা তো বলেনা।’
প্রখ্যাত অধ্যাপক: কোরআনের বাংলা অনুবাদ উপহার দিয়ে বলে, ‘পড়। ভালো লাগলে গ্রহণ করলে!’
বুদ্ধি হওয়া থেকে ধর্মীয় এই বিভাজন একটা ক্ষোভ, অসহায়ত্ব, বিতৃষ্ণা কখনো কখনো অভিমান এরও জন্ম দেয়। বাংলাদেশ নিজের দেশ। মানচিত্রের এই অংশে বসবাস জানা মতে কম করে হলেও হাজার বছর। বংশলতিকা দেখেই সময়ের হিসাব পাওয়া যায। এক স্বাধীনতার বিপ্লবে ফাঁসিতে পূর্ব পুরুষ, আর এক স্বাধীনতার যুদ্ধে ঘর বাড়ি আগুনে ছারখার। বাড়ি ছারখার হয় কিন্তু মাটি? পাহাড়ে-জঙ্গলে-প্রান্তরে-নদীর তীরে পালিয়ে নিজের প্রাণ মান বাঁচিয়ে, বুকের দুধ কম পাওয়ায় টিউবওয়েলের পানি খাইয়ে অসম্ভব ঝুঁকিতে এদেশের মাটিতেই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন মা, যেমন করে তাঁর শিশুটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন মুসলমান মা। তাহলে ইন্ডিয়ার সাথে যুক্ততা কোথায়। সংযোগ ইতিহাসে, সংযোগ রাজনীতিতে। কোনো শিশু ইতিহাস আর রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই বুঝতে বুঝতে চলা।
বুদ্ধি হওয়া থেকে ধর্মীয় এই বিভাজন একটা ক্ষোভ, অসহায়ত্ব, বিতৃষ্ণা কখনো কখনো অভিমান এরও জন্ম দেয়। বাংলাদেশ নিজের দেশ। মানচিত্রের এই অংশে বসবাস জানা মতে কম করে হলেও হাজার বছর। বংশলতিকা দেখেই সময়ের হিসাব পাওয়া যায। এক স্বাধীনতার বিপ্লবে ফাঁসিতে পূর্ব পুরুষ, আর এক স্বাধীনতার যুদ্ধে ঘর বাড়ি আগুনে ছারখার। বাড়ি ছারখার হয় কিন্তু মাটি?
হাঁটতে শেখা বাংলাদেশের মাটির উপর যেখানে হাজার বছর ধরে বাস সেই মাটি ছেড়ে কোথায় ঠিকানা? জান আর মানের ভয় দুই মায়ের কারো বিন্দুমাত্র কম ছিলনা। প্রতিরাতে মুসলমান বাবার চেয়ে হিন্দু বাবা কম ভয় পাননি। মুসলমান বাবার মত নিজের পরিবারকে বাঁচানোর জন্য তিনিও ভারত যাবার কথা কম ভাবেননি। কিন্তু নিজের ঠিকানা ছেড়ে পরের করুণায় বাঁচতে চাননি। প্রতিদিন মৃত্যুর জন্য তৈরি ছিলেন এদেশে বাঁচবেন বলে। তাহলে ইন্ডিয়া কী করে ঠিকানা হয়? কী করে আবারও সংশয় আর আশঙ্কা নিয়েই বাঁচতে হয় নিজের ভিটায়, নিজের দেশে। কাউকে আবার ভিটা ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়। কোনো একটা দেশে একজন মানুষ ভালো থাকবে, যোগ্যতা অনুযায়ী পরীক্ষা পাশ করবে, অধ্যাপক হবে, সেনা প্রধান হবে,রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও বসতে পারে দেশটা যদি নিজের হয়। সংখ্যালঘু ছাত্রের পাশের খবর বা প্রফেসর হওয়ার খবর উল্লেখযোগ্য বিষয় হলে বা উষ্মা প্রকাশের বিষয় হলে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে ভালো থাকা পাশ করা বিশেষ কেনো? তখন এটাই বুঝে নিতে হয় সংখ্যাই নির্ধারণ করবে দেশের অধিকার কার ভাগে কতটুকু।
আমাদের “দেশের নাম কী? “বাংলাদেশ”। কথা বলতে শেখার পর থেকে সদম্ভ উচ্চারণ। স্কুলে যাবার পর দম্ভটায় আঘাত আসতে শুরু করলো। ” আমাদের” শব্দটার জোর কম মনে হতে থাকল । নার্সারি ক্লাস থেকেই সংখ্যালঘু পরিবারে জন্ম নেয়া শিশুটি বুঝতে শুরু করলো সে খানিকটা আলাদা। হিন্দু মুসলমান বিষয়গুলো সে বয়সে তেমন করে বুঝতে পারার কথা নয়। কিন্তু এটা অভিজ্ঞতা হতে থাকলো যে সে আর তার মতো নামের মানুষরা কম। অন্যরা সংখ্যায় বেশী। অনেক বন্ধুরা তার হাতে হাত ধরে হাঁটলেও ওরা সংখ্যা বেশীদের দলে যারা স্কুল এসেম্বলিতে কানের দুলের ক্ষততে লাল রঙের murcurochrom দেখে পাশের শিশুকে বলে, ‘হিন্দুদের এরকম হয়’। পরিবারে জানানোর পর শিখতে হলো যে চুপ করে থাকতে হয়,কিছু বলতে নেই। সেই বয়স থেকে শুরু মানসিক একটা সংকোচনের। পরিবার সাহস দিতে পারেনি, বুঝিয়ে বলতে পারেনি। তার কারণ ছিল নিশ্চয় ।
যখন কোনো পরিবারের মাকে নিজের শাখা সিঁদুর লুকিয়ে বাঁচতে হয়েছে যুদ্ধকালীন সময়ে, যুদ্ধের ক্ষত না শুকাতেই স্বাধীন হওয়া “নিজের” দেশে আড়ষ্ট হয়ে চলতে হয়েছে, টিপ পড়লে তিরস্কারের শিকার হতে হয়েছে সেই পরিবার যদি আত্মবিশ্বাস দিতে না পারে তাহলে খুব অবাক হবার কিছু নেই হয়তো। বাবার বিনয় শক্তির বদলে কখনো বা ভয় বলে যদি ভুল হতে চায় তাহলে সেই ভয়ের বিস্তৃতি শিশুর মধ্যে কিছু হতেই পারে। নার্সারি ক্লাশের সেই শিশুটিই পঞ্চাশ পরবর্তী বয়সে এসেও অনেক পরবর্তী প্রজন্মের শিশুর কাছে যখন জানতে পারে সংখ্যালঘু হওয়ায় তাকে খেলায় নেয়নি সংখ্যাগুরু অন্য শিশুরা তখন প্রত্যাখ্যাত শিশুটিকে বুঝতে সাহায্য করা একটা প্রস্তুতির বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ আর কোনো মানসিক সংকোচন কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু অপর শিশুদেরও সঠিক মানসিক বিকাশ জরুরি কারণ সময় সামনের দিকে যাচ্ছে।
যখন কোনো পরিবারের মাকে নিজের শাখা সিঁদুর লুকিয়ে বাঁচতে হয়েছে যুদ্ধকালীন সময়ে, যুদ্ধের ক্ষত না শুকাতেই স্বাধীন হওয়া “নিজের” দেশে আড়ষ্ট হয়ে চলতে হয়েছে, টিপ পড়লে তিরস্কারের শিকার হতে হয়েছে সেই পরিবার যদি আত্মবিশ্বাস দিতে না পারে তাহলে খুব অবাক হবার কিছু নেই হয়তো।
হিন্দু মুসলমান এই সব শিশুর জন্ম বাংলাদেশের জন্মের সাথে সাথে যে দেশের জন্ম হিন্দু মুসলমান সবার রক্তে, সবার জন্য। এই শিশুদের গর্ব ভরে “আমরা” শেখার কথা ছিল । কিন্তু তাদের সেটা শিখতে দেয়া হয়নি। শিশুরা ভাগ হয়ে গেছে “আমরা” আর “ওরা’ তে। সংখ্যাগুরু মুসলমানের দেশের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা বহন করতে হয়েছে “সংখ্যাগুরু” শিশুদের আর পাশাপাশি “সংখ্যালঘু” শিশুরা হয়েছে অপর। স্বাধীন দেশে “আমরা” হবার ক্ষেত্রে সংখ্যা প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে পড়ল। সংখ্যা হয়ে গেলো একটা শক্তি। তার সাথে অন্তর্নিহিতভাবে যোগ হলো শ্রেষ্ঠত্বের মনস্তত্ত্ব। অপর পিঠে স্বভাবতই নিকৃষ্টকে হেয় করার মনস্তত্ত্ব যা মাঝে মাঝেই আক্রমণ, কৌতুক এমনকি প্রশংসা করতে গিয়েও বেরিয়ে পড়ে অজান্তেই।
অথচ এই সংখ্যা শুধুই একটা বিশ্বাসের ধারার উপর ভিত্তি করে। তাই সংখ্যাগুরু পরিবারের সংখ্যাগুরু “কাজের বুয়া”র এক টেবিলে খাবার খাওয়ার দৃশ্যটা বিরল। যেমন বিরল সংখ্যালঘু পরিবারের সংখ্যালঘু “পুরাতন ভৃত্য”র এক সাথে বসে খাওয়া। এই সংখ্যাগুরু বা লঘুদের ভেতর অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক-লিঙ্গভিত্তিক অজস্র সংখ্যালঘু রয়েছে ধর্ম যাদের গুরুত্ব সমান করতে পারেনি আজ পর্যন্ত। পারার কথা নয়, পারা উদ্দেশ্যও নয়। আর এখনো পর্যন্ত তাদের সেটা জানা হয়ে ওঠেনি, অজানা রাখার আয়োজন অব্যাহত বলে। তবে মনস্তত্ত্বের উত্তরাধিকার বিভিন্নভাবে প্রবাহমান। তাই সমাজের ভাষায় যে “পাগল”, যে জেনে বুঝে হিসাব করে কথা বলেনা সেও সিঁদুরের টিপ দেখে তিরস্কার করে ওঠে। কারণ এই টিপ তার সংখ্যাগুরু মনস্তত্ত্বে নাড়া দেয়। ঘটনাটি স্বাধীন বাংলাদেশের শিশু সময়ের। কিন্তু মাত্র ক’দিন আগেও, বলা চলে পরিণত বাংলাদেশে টিপ নিয়ে মোটামুটি ওই ঘটনারই একটা মঞ্চায়ন পাওয়া গেলো। পার্থক্য এটি শুধুই টিপ, সিঁদুরের নয়। স্থান: চট্টগ্রাম এর বদলে ঢাকা। সময়: ২০২২ সাল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর। পাগলের ভূমিকায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন যে পরবর্তীতে নিজেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বলার চেষ্টা করেছে। যিনি টিপ পড়েছিলেন তিনি কোন বিশ্বাসে বিশ্বাসী সেটা যদিও জানা নেই।
চারপাশের ধারণায় যে বোকা, যাকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি চলে তারও আপাত নির্দোষ প্রশ্ন নিশ্চিত হবার বাসনায়; যদিও এতে তার কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। রোগের চিকিৎসা নিতে এসে চিকিৎসক কোন জাতের তাও মনের কোথাও আলোড়ন তোলে অজান্তেই। নারীদের ঘরের বাইরে চলাচল এখনো পর্যন্ত বিশেষ। আর যদি বোঝা যায় যে, সে সংখ্যালঘু নারী; তাহলেতো বিশেষভাবে বিশেষ। একজন কর্মজীবী মানুষ যদি নারী আর ধর্মীয় সংখ্যালঘু হন তাহলে সংখ্যাগুরু নারীদের মতোই অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাগ-এর বৈষম্য আর পিতৃতান্ত্রিক শিকল বয়ে চলার বোঝার উপর শাকের আঁটি হিসেবে জুটে যায় কৌতুক বিদ্রুপ। সংখ্যাগুরু পরিবারের একটি শিশুর কাছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন মানুষ মানুষের মত দেখতে বিরল কোনো প্রজাতি হয়ে দাঁড়ায়। তার শিশুমনে অনেক প্রশ্ন আসে নিশ্চয়। সেই প্রশ্নের উত্তর সে কীভাবে কার কাছে পাচ্ছে, কীভাবে খুঁজছে তার উপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতের গতিপথ। তার জন্য পথের চিহ্ন রেখে যাওয়া জরুরি ।
নারীদের ঘরের বাইরে চলাচল এখনো পর্যন্ত বিশেষ। আর যদি বোঝা যায় যে, সে সংখ্যালঘু নারী; তাহলেতো বিশেষভাবে বিশেষ। একজন কর্মজীবী মানুষ যদি নারী আর ধর্মীয় সংখ্যালঘু হন তাহলে সংখ্যাগুরু নারীদের মতোই অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাগ-এর বৈষম্য আর পিতৃতান্ত্রিক শিকল বয়ে চলার বোঝার উপর শাকের আঁটি হিসেবে জুটে যায় কৌতুক বিদ্রুপ। সংখ্যাগুরু পরিবারের একটি শিশুর কাছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন মানুষ মানুষের মত দেখতে বিরল কোনো প্রজাতি হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিদিন বিভিন্নভাবে বুঝতে বুঝতে চলা যে আমরা আর ওরা আলাদা। কখনো সশব্দে, কখনো নিঃশব্দে। কখনো ভঙ্গিতে কখনো ঘৃণায়, এমনকি কখনো ভালোবাসায়ও। বিভাজন খুব নিপুণভাবে করেছে ধর্ম। সারাদিন সবাই এক ক্লাশে পড়াশোনা করলেও ধর্ম ক্লাশে হিন্দুরা আর মুসলমানরা আলাদা। পঞ্চাশ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ধর্ম ভাগ হবার পর হিন্দু ধর্মের ক্লাশটা খুব ফাঁকা; দুর্বল। মাত্র পাঁচ ছয় জন। শিক্ষকদের আচরণে কোনো পক্ষপাতিত্ব না থাকলেও অনেকসময় পারিবারিক-সামাজিক পরিবেশের এই পরোক্ষ কিন্তু স্পষ্ট বিষয়গুলো শিশুদের পরবর্তী বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে। ধর্মগুলোর জন্ম ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতায়। একটা বিশ্বাসের আলোচনা অন্য কোনো বিশ্বাসে বিশ্বাসী শুনলে মহা অধর্ম হয়ে যাবার কথা নয় বরং ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত করে ধর্মকে সবাই জানতে পারাটাই মঙ্গলজনক যদি সেখানে কোনো লুকোছাপার বা উদেশ্য সিদ্ধির আয়োজন না থাকে। শিশুকাল থেকেই এধরনের চর্চার প্রসঙ্গ তোলার সময় হয়েছে হয়তো যখন ধর্ম পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত। তাতে পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়বে বৈ কমবেনা। প্রত্যেকে প্রত্যেকের ভালো মন্দ, মিল অমিল স্পষ্ট করে দেখতে পাবে, আজকের সময়ে এসে শ্রেষ্ঠত্বের যুদ্ধটা অপ্রয়োজনীয় মনে হবে। খোলা চোখে দেখা যাবে কার যুদ্ধ কে করছে, কেন করছে ।
পাঠ্যসূচিতে ইতিহাস সমাজবিজ্ঞান বিভিন্ন বিষয়ে হিন্দু মুসলমান শব্দগুলো থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। দেখা যায়, ইতিহাসের সূত্র ধরে শিক্ষক কখনো বা ক্লাশে সংখ্যালঘু শিশুটিকে চিহ্নিত করে নিয়ে পুরো ক্লাশকে ঐতিহাসিক সেই বৈরিতার মঞ্চে তুলে দিচ্ছেন যেখানে সময় শতবছর গড়িয়ে গেছে, পাল্টে গেছে বৈরিতার ধরন-ধারণ। প্রেক্ষাপট তুলে ধরার পরিবর্তে গলাগলি করে হাতে হাত ধরে হাঁটা ছোট ছোট মানুষগুলোর মধ্যে বুনে দিচ্ছেন বিভাজনের বীজ বা আগেই চারপাশ থেকে বুনে দেয়া বীজের শিকড়ে পুষ্টি যোগাচ্ছেন। প্রচলিত অর্থে শিক্ষক হলেই যে সব সামাজিক মনস্তত্ত্বের বাইরে থাকবেন তাতো নয়। তাই স্নাতক পর্যায়ে এসেও চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠদানের ক্ষেত্রে “মৃত নারিদেহকে”ও খুবই অপ্রাসঙ্গিকভাবে ধর্ম দিয়ে ভাগ করতে চান একজন চিকিৎসক শিক্ষক। যদিও মৃত পুরুষ দেহের কোনো ধর্মীয় পার্থক্যের বিষয়ে জানতে চাননি তিনি। লক্ষণীয় যে, পরীক্ষার্থী একজন সংখ্যালঘু নারী অর্থাৎ ধর্মকে সামনে রেখে নারীকেই অপ্রয়োজনীয় বিব্রত করা। সময়ের সাথে এগিয়ে গিয়ে আগাছা উপড়ে ফেলে ফুল ফল ফলানোর কথা শিক্ষকের তার আগে আগাছা চিনতে শেখা জরুরি নিজেরই। হয়তো অন্যরকম এক উত্তরাধিকারের জায়গা থেকে এধরনের আচরণ।
দেখা যায়, ইতিহাসের সূত্র ধরে শিক্ষক কখনো বা ক্লাশে সংখ্যালঘু শিশুটিকে চিহ্নিত করে নিয়ে পুরো ক্লাশকে ঐতিহাসিক সেই বৈরিতার মঞ্চে তুলে দিচ্ছেন যেখানে সময় শতবছর গড়িয়ে গেছে, পাল্টে গেছে বৈরিতার ধরন-ধারণ। প্রেক্ষাপট তুলে ধরার পরিবর্তে গলাগলি করে হাতে হাত ধরে হাঁটা ছোট ছোট মানুষগুলোর মধ্যে বুনে দিচ্ছেন বিভাজনের বীজ বা আগেই চারপাশ থেকে বুনে দেয়া বীজের শিকড়ে পুষ্টি যোগাচ্ছেন।
এর সাথে মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলোর কিছুটা তুলনা করা যায় যেখানে জীবিত পুরুষের শরীরের চিহ্ন দেখে ধর্মবিশ্বাস বোঝার ঘটনা খুব সাধারণ ছিল যদিও এসব চিহ্নের অন্য অর্থও হতে পারে। যুদ্ধ শিশুকে সজ্ঞানে মেনে নেয়া সম্ভব না হলেও যুদ্ধের মনস্তত্ত্ব অজান্তেই বয়ে চলেছে। তবে যুদ্ধে নারী শুধুই নারী দেহ, সেখানে সংখ্যাতে কিছু আসে যায়না। আক্রান্ত বা আক্রমণকারী দুই পক্ষের কাছেই। তাই কোনো নারীই তখন নিরাপদ নয় গুরু লঘু যাই হোক। আর যুদ্ধ শেষে বীরাঙ্গনাকে বুকে নিতেও অসুবিধা হয় সংখ্যা যাই বলুক। তেমনি নারী নাগরিক হিসেবে, গুরু লঘু হিসেবে উপাত্তে সংখ্যা যোগ করে ঠিকই তবে প্রতিদিন একই সমাজ কাঠামোর মধ্যেই তার জীবন। ধর্মবিশ্বাসের ধারা কোনো উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দেয়না, আলাদা কোনো সম্মানও ধার্য করেনা। যদিও পার্শ্ববর্তী ‘হিন্দু’ সংখ্যাগুরুর দেশে অপারেশন থিয়েটারে নারী শরীরের সম্মাননজনক আব্রু রাখাকে বিশেষ মনে হয় আমাদের দেশের একজন নারী চিকিৎসকের কাছে, যেখানে তিনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে শুধুই একজন সংখ্যাগুরুর প্রতিনিধি। যদিওবা এ ধরনের মনস্তত্ত্ব অন্তত “মুক্ত” দেশে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত প্রায় হবার আশা করা যেত কিন্তু তা অন্তর্লীন বয়ে চলেছে আজও।
তবে যুদ্ধে নারী শুধুই নারী দেহ, সেখানে সংখ্যাতে কিছু আসে যায়না। আক্রান্ত বা আক্রমণকারী দুই পক্ষের কাছেই। তাই কোনো নারীই তখন নিরাপদ নয় গুরু লঘু যাই হোক। আর যুদ্ধ শেষে বীরাঙ্গনাকে বুকে নিতেও অসুবিধা হয় সংখ্যা যাই বলুক।
সব মানুষ একই আকাশের তলায়, একই আলো বাতাস পানি নিয়ে বাঁচলেও, ভৌগোলিক অবস্থা-অবস্থানের গতিশীলতার কারণে এই আলো-বাতাস-পানির ধরনও এক থাকেনা। বিভিন্ন উপাদানের যোগ বিয়োগ হয়। তাও সেটা আলো বাতাস পানিই থাকে। তেমনি অঞ্চল ভেদে খাদ্যের প্রাপ্যতা, উৎপাদনের ধরন, গোষ্ঠীগত অভ্যাসের ধারাবাহিকতা, ইত্যাদি কারণে খাদ্যাভ্যাসও বিভিন্ন হতে পারে। কিন্তু আমিষ শর্করা স্নেহ সাথে লবণ আর পানি; এইই তো খাদ্যের উপাদান। আজকের সময়ে এসে যদি এভাবে ভাবা যায় যে সব খাদ্যের মৌলিক উপাদান জৈবরসায়নের ভাষায় কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন তাহলে ভুল কিছু ভাবা হবে না বোধ হয়। যেমন, জল বা পানি বা ওয়াটার হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের যৌগ। অন্তত স্কুল পর্যন্ত বিজ্ঞান পড়লেই এটা জানা যায়। আর যারা নিজের আগ্রহে জেনে নেন তাদের কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ধর্ম খাদ্যের সাথে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত। মাঝে মাঝে এই যুক্ততা নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মত এতটাই স্বাভাবিক মনে হয় যে, এই বিষয়ে চিন্তা আসাটাই অস্বাভাবিক হয়ে যায়। তথাকথিত বিজ্ঞান পড়া মানুষও যেখানে এভাবে ভাবতে রাজী থাকেননা সেখানে সাধারণ মানুষের পক্ষে খুব কঠিন হবারই কথা।
প্রতিদিনকার আমিষের যোগান মাছ মাংস ডিম থেকেই আসে ধর্ম নির্বিশেষে সব পরিবারে এবং অবশ্যই সামর্থের সাথে সঙ্গতি রেখে। মাছ নিয়ে ধর্মের সাথে তেমন কোনো বিরোধ আছে বলে জানা হয়নি কিন্তু কিছু প্রাণীর মাংস খাওয়া আর না খাওয়া নিয়ে স্পর্শকাতর আলাপ বা ঘটনার অবতারণা একটি সাধারণ বিষয় যা দেশ কাল ভেদে বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের অভিজ্ঞতায় থাকে যা অনেকসময় পার্শ্ববর্তী দেশে হানাহানি পর্যন্ত গড়ায়। এদেশে বিষয়টি ঠাট্টা কৌতুক থেকে শুরু করে, মানসিক চাপ সৃষ্টি করা, জাত যাবার বা ধর্মান্তরকরণের ভয় দেখানো; এগুলোতেই সীমাবদ্ধ। আবার সাধারণ উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বা নিমন্ত্রিত হয়ে আলাদা পরিবেশনায় সম্মানিত বোধ করার বদলে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও কম নয়। এই আলাদা পরিবেশন সাধারণ অর্থে ভালোবাসা আর সম্মান। তবে একটু ভেবে দেখলে বিযুক্ত রেখে ভালোবাসা। পার্থক্যকে সাময়িক ভাবেও দূরে না রেখে স্পষ্ট রেখেই এক হওয়া নাকি পার্থক্যকেই প্রাধান্য দেয়ার মনস্তত্ত্ব। এই কারণেই হয়তো ধর্মীয় উৎসবে নিমন্ত্রণ আপ্যায়নে আন্তরিকতার কোনো অভাব দৃশ্যমান না হলেও উৎসবের শুভেচ্ছা জানাতে কখনো কখনো ভেতর থেকে বাধা আসে। এটা খুব ঠিক যে এগুলো কোনো পরিকল্পিত বিষয় নয় স্বতস্ফূর্ত। বহুকাল ধরে চলে আসা অনেকটা রীতি হয়ে গেছে যা নিয়ে সাধারণ মানুষ খুব একটা ভাবার দরকার মনে করেনা। তথাকথিত শক্তিমান এর কাছে শক্তিহীন এর এতটা সূক্ষ্ম মনস্তাত্বিক বিপর্যয়ের গুরুত্ব থাকার কথা নয় যেখানে অনেক বেশী অসম্মান অবলীলায় হয়ে যায়।
পাশ্চাত্যের লিপস্টিক এ সমস্যা দেখা যায়না, সমস্যা শুধু টিপ-এ। এর সাথে সিঁদুরের একটা সম্পর্ক আছে বলে আর সিঁদুরের সাথে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর সম্পর্ক আছে বলে। কেউ বলেনা লিপস্টিক খ্রিস্টান দেশের, পান খেয়ে ঠোঁট রাঙাও। যুদ্ধ পরবর্তী টিপ মনস্তত্ত্ব নিশ্চিন্তে চলমান অবশ্য পাশ্চাত্যে টিপ এর ব্যবহার থাকলে বা টিপ কোম্পানি ব্যবসা সফল হলে কী হতো বলা মুশকিল। তাই দেখা যায় এদেশের সংখ্যালঘুদের ভারত যাবার কথা বলা হলেও ভারতের পোশাক প্রসাধনীর বড়ো বাজার বাংলাদেশ। সংখ্যালঘুর সংখ্যা যেহেতু কম আর অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল সংখ্যালঘুর সংখ্যা আরো কম কাজেই শুধু তাদের আশায় বাজার চলার কথা নয়। আজকের বাজার ব্যবস্থায় বিভিন্ন দেশের পণ্য হাতের কাছে পাওয়া যাবে যার সামর্থ্য আছে সে কিনবে এটাই হবার কথা। ধর্ম এখানে কোনো বাধা হবার কথা নয়, হয়ওনি।
পাশ্চাত্যের লিপস্টিক এ সমস্যা দেখা যায়না, সমস্যা শুধু টিপ-এ। এর সাথে সিঁদুরের একটা সম্পর্ক আছে বলে আর সিঁদুরের সাথে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর সম্পর্ক আছে বলে। কেউ বলেনা লিপস্টিক খ্রিস্টান দেশের, পান খেয়ে ঠোঁট রাঙাও।
যেকোনো প্রতিক্রিয়ার পর ভাবার সময় কারো হাতে নেই। সাধারণ জনগণের কথা নয় কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তথাকথিত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীতে এধরনের চিন্তার অভাব নেই। এটা ঠিক যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেশাজীবী বানায়, মানুষ নয়- সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু সবার ক্ষেত্রেই। সিঁদুর একটি প্রসাধন রং, মাংস যে প্রাণীরই হোক প্রোটিন আর বিশ্বাস পরিবার থেকে গোষ্ঠী থেকে বেড়ে ওঠার সূত্রে পাওয়া যা মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর মধ্যে বর্ধিত হয়, পুষ্ট হয়, বিস্তৃত হয়। কতটা মজবুত হবে নির্ভর করে চর্চা কী রকম তার উপর। বাইরের একটা রং আর খাদ্যের একটা প্রোটিন মস্তিষ্কের ভেতরের একটা বিশ্বাসে কোনো পরিবর্তন করতে পারার কথা নয়। পরিবর্তন করতে পারে জানার চেষ্টা বুদ্ধি যুক্তি। আর এর মধ্য দিয়ে সৃষ্ট জ্ঞান অবশ্য পরিবর্তনশীল কারণ নতুন জ্ঞান যুক্ত হতেই থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একজন সংখ্যালঘু নারী বা পুরুষ যখন ধর্মান্তরিত হয়ে থাকেন নিজের পছন্দ বা অন্য কোনো কারণে তখন পদবী পরিবর্তন, কখনোবা পোশাকে কিছু পরিবর্তন, খাদ্যে শুধু একটি পদের যোগ হতে পারে হয়তো আর তিনি ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ করেন ভিন্ন পদ্ধতিতে। এইই তো যা। ভেতরের সামাজিক জৈবিক সংবেদনশীল মানুষটি যেমন, তেমনই থাকে।
একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায় একজন মুসলমান সিঁদুর পড়লেও রাতারাতি হিন্দু হয়ে যাওয়া বা বিশ্বাস নষ্ট হবার সম্ভাবনা যেমন হাস্যকর, একজন হিন্দু নিষিদ্ধ মাংস খেলেই মস্তিষ্ক থেকে হিন্দুত্ব বিলুপ্ত হওয়া বা জাত যাওয়া তেমনি অবান্তর যদি সজ্ঞানে বিশ্বাস থেকে সরে আসা না হয়। এমনটি ভাবাও একটি বিশ্বাস। এই বিশ্বাস এত গভীর যা অস্বস্তি জাগায়, রাগ সৃষ্টি করে, জাতিচ্যূত বা ধর্ম নষ্ট হবার ভয় পায়, ভয় দেখায়, হিংসা আনে, আঘাত দেয়। ধর্ম বিশ্বাস বলতে ঈশ্বর সম্পর্কে বিশ্বাস। কিন্ত আচার, খাদ্যাভ্যাস আর উৎসবই প্রধান হতে দেখা যায়। ধর্মগুলো বিভিন্নভাবে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের বিপক্ষে বলতে চেয়েছে। যদিও শেষপর্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিষয়গুলোই সামনে চলে আসে। তার ফলেই মনে হয় একত্রিত করার চেয়ে বিভাজিত করেছে বেশি। বিভাজন যত বেশি থাকবে মনস্তত্ত্বে প্রচ্ছন্ন থাকবে সংখ্যার শক্তি, প্রাচীন গোষ্ঠীপ্রথার মত। তাই বাহুবলে, কৌশলে শুরুর সময়গুলোর মত ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোয় এখনো পর্যন্ত সংখ্যা বাড়ানোর একটা চেষ্টা থাকে। কখনো সজ্ঞানে কখনো অজান্তেই। যিনি বই পড়েন তিনিই জানেন ধর্মীয় গ্রন্থসহ যেকোনো বই উপহার ভালো উপহার, যে জানতে চায় তার জানার কোনো বাছবিচার থাকার কথা নয়। কিন্তু উপহারের সাথে সেই ধর্মে আগ্রহী করে তোলার ইচ্ছা তেমনই একটি কৌশল বলা চলে।
থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্বরকে পাশ্চাত্যের বা খ্রিস্টানদের উৎসব হিসেবে খুব অস্বস্তি না হলেও বাংলা নববর্ষকে হিন্দুদের পূজার দিন মনে হয় ঐতিহাসিক বিদ্বেষের সূত্র ধরে বা রাজনৈতিক পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের চিহ্ন হিসেবে। যদিও পাশ্চাত্যে এদেশের যেকোনো মানুষ প্রথমে বাংলাদেশী। বাংলা ভাষাকে নিজের করে রাখতে যে দেশে রক্তক্ষয়ের প্রয়োজন হয়েছিল, বাংলাভাষাকে উদ্ধারের পথ ধরে যে দেশ শেষ পর্যন্ত স্বাধীন আর বাংলাদেশ যার নাম সে দেশে বাংলা নববর্ষ ঠিক জাতীয় উৎসব নয়। সেখানে বহু সীমা বেঁধে দেয়া আছে নিরাপত্তার নামে যেনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো উৎসব উদযাপনের দিন ছাড়া অন্য কোন সময় এদেশে ঘটে না। অনেকটা গিলতে না পারা ফেলতে না পারার মত। একসময় যে মনস্তত্বকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র তা স্বাধীন দেশে পুষ্টি পেয়েছে আর পাচ্ছে বলে মনে হয়।
আজকাল বুটিক আর বাজারের কারণে কেনাকাটার জন্য হলেও বৈশাখ পালিত হয় অনেক বেশি। কাজেই বাজার রাজী থাকলে সব রাজী। একই কারণে হ্যালোইন উৎসবও ঢুকে যাচ্ছে বাংলাদেশে, যাকে আমেরিকার উৎসব বা বিধর্মীর উৎসব বলে মনে হচ্ছেনা যা কিনা প্রাচীন সমাজের ভুত চতুর্দশী তিথির মত একটা উৎসব যেখানে মৃতকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা হয়। সত্যিকার অর্থে বর্তমানে এসব উৎসব বা (বাংলা বা ইংরেজি) বর্ষ উদযাপনের যে ধরন সেটা আসলে ধর্ম নির্বিশেষে মুষ্টিমেয় সংখ্যক সচ্ছল বাংলাদেশীর জন্য, যাদের ক্ষেত্রে ধর্ম কোনো বাধা নয়। ব্যতিক্রম তো আছেই। বর্ষ উদযাপনের বিষয়টি ধর্মের সাথে সম্পর্কিত যদি কোনো ভাবে হয়ও তাহলে ইংরেজী বাংলা দু’টোই বর্জন করে সাধারণ নাগরিকদের হিজরী নববর্ষে উৎসব করার কথা ছিল। আবারও একটা ভাষার সাথে সম্পর্কিত হচ্ছে যে ভাষা এদেশে প্রচলিত নয়। তেমন উৎসব দেখা যায়নি আজ পর্যন্ত। তাই অস্বস্তির মূল কোথায় ভেবে দেখা প্রয়োজন।
ধর্মীয় বিভাজন মানুষকে দেশ ছাপিয়ে অন্য কোথাও সম্পর্কিত করে। একদিকে যেমন একটি সংখ্যালঘুকে ভারতীয় মনে করা হয় অন্যদিকে এদেশের কিছু হিন্দু বা মুসলমান উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত একটা মোহে ভোগে ভারত বা ইরান-পারস্য আদিবাস হবার। বাংলাদেশী হওয়াটা যেনো কোনো কাজের কথা নয়। হিন্দু মুসলমান সবাই ভারতবাসী ছিল একসময় এটা যেমন ভুল নয় আবার এখানে ইরান পারস্যবাসীর বংশধর থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই এলাকায় বহু দেশের বহু মানুষের যাতায়াত ঘটেছে যাদের অনেকেই স্থায়ীভাবে রয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখন সবাই বাংলাদেশি তাতে তো সন্দেহ নেই। মূল খুঁজে চলে যেতে গেলে অনেকেরই দেশ ত্যাগ করতে হবে, তবে দেশ ত্যাগ করে সেই ‘নিজ’ দেশে কতটা আপ্যায়ন একজন বাংলাদেশীর জন্য অপেক্ষায় থাকবে সেটা বোধহয় অনিশ্চিত।
‘হিন্দুরা খারাপ কী আছে’– যাদের এই বক্তব্য, তাদের চারপাশের সংখ্যালঘুরা সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে “ভালো” থাকার কথা, ভালই আছে এতে সন্দেহ নেই; যেমনটি তারা (বক্তা) ভালো আছে। কিন্তু সংখ্যাগুরুর মনস্তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে উৎসব পণ্ড করা, ঘর বাড়িতে আগুন লাগানো, সহায় সম্পদের ক্ষতি, হয়রানি, ভীতির সৃষ্টি, দখল ঘটনাগুলো যে মিথ্যা নয় তার জন্য বেশি দূর যেতে হয়না। কিন্তু যাদের সাথে হয় ভালো থাকা মানুষদের জন্য তারা দূরের মানুষ। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে বসতভিটাসহ শত শতাংশ জমি আর একজন দখল করে নেবার ফলে যিনি বাস্তুচ্যুত “গরীব” এবং এরপরও দখলদারের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর হুমকি পান তিনি বা তার মত অজস্র সংখ্যাগুরুরা কীধরনের ভালো আছে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ যেখানে দখলদার কোনো সংখ্যালঘু নয়। তাহলে একটি দেশে ভালো থাকা বা না থাকা আসলে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু বা লঘু হবার সাথে শেষ পর্যন্ত সম্পর্কিত হচ্ছেনা। ভালো থাকার জন্য যখন কেউ অন্য দেশে অভিবাসন নেবার ইচ্ছা করে গুরু লঘু যেই হোক দেশ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় চিন্তা প্রাধান্য পেতে দেখা যায় না, আর্থসামাজিক নিরাপত্তার দিকটিই বিবেচ্য হয়। বিষয়টি শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বের মানুষের জন্য প্রযোজ্য অভিবাসিত দেশে গিয়ে যতই ধর্মীয় জোট বাঁধা হোক। তাহলে চাক্ষুষ যে জীবন তাতে ধর্মের ব্যবহারিক মূল্য স্পষ্ট নয়।
প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীদের একসাথে খাওয়া দাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, দুঃখ সুখের আদান প্রদান করতে, ভরসার জায়গা হতে ধর্মীয় বিশ্বাস কোনো বাধা সৃষ্টি করেনা কারণ দৈনন্দিন জীবন যাপন এই অঞ্চলের আচার আচরণ অভ্যাস মত এই সমাজের মধ্যে। ধর্ম সেখানে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আনেনি। বরং এভাবে ভাবা যায় হয়তো যে, সব ধর্মই সময়ের সাথে অঞ্চলভেদে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। ধর্মগুলোর শুরুর পর্যায়ে কেউই আর ফেরত যেতে চাইবেনা বলেই মনে হয়। চাইলেও সম্ভব নয়। সেই অর্থে ধর্ম মেনে চলার অর্থই যার যার সুবিধা মত মেনে চলা। ধ্রুব কিছু নয় যদিও ধর্মকে ধ্রুব বলার একটা চেষ্টা করা হয় চেহারা পুরো পাল্টে যাবার পরও।
বিশ্বাসগত পার্থক্য থাকা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয় কিন্তু পার্থক্য যখন মানুষ দেখতে দেয়না তখনই সমস্যা তৈরি হয আর সেই সুযোগে জায়গা করে নেয় বিভাজন। সেই বিভাজনের ফসল তোলে অন্য কেউ যা সাধারণের বোধবুদ্ধির বাইরে। এই পর্যায়ে পার্থক্যকে ছাপিয়ে যাওয়া খুব সহজ কোনো বিষয় নয়। সচেতনভাবে একে দূরে রাখার জন্য এর কার্যকারণ জানা জরুরি, আর না জানা বা জানতে চেষ্টা না করা বা উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি না হবার কারণেই পার্থক্যকে মৌলিক মনে হয়। জানা বোঝা সম্ভব হলে একে বৈচিত্র্য মনে হওয়াই স্বাভাবিক হয়তো। একজন পুরুষের পরিচয় জানতে গিয়ে প্রথমেই আসে তিনি কী করেন অর্থাৎ জীবন ধারণের জন্য অর্থ আয় করেন কীভাবে, অর্থনৈতিক অবস্থা কী রকম, তারপর তিনি কোন ধর্মে বিশ্বাসী, কোন রাজনৈতিক মতাবলম্বী, তিনি কোন দেশের, কোন এলাকার। নারী হলে এইসব কিছু ছাপিয়ে বড় প্রশ্ন হয় তিনি বিবাহিত কিনা! হলে তার স্বামী বিষয়ক পরিচয় আর না হলে পিতৃপরিচয় জানার উৎসাহের ঘাটতি পড়েনা। নারী বিষয়ে উত্তরগুলো জানা থাকলে ভালো, না জানলে তেমন কিছু আসে যায়না, সংখ্যা গুরু বা লঘু যাই হোক। নারী এমনিতেই মানুষের মধ্যে মহিলা হিসেবে বিভাজিত হয়ে আছে; যদিও গোষ্ঠী হয়নি। এতগুলো বিভাজনের নিচে চাপা পড়ে থাকা টুকরো টুকরো মানুষের ভেতর আসল মানুষটাকে শুধু অবয়ব দেখে চিনতে হয় অনেকসময়। মানুষ হওয়াটা গৌণ হয়ে পড়ে।
তাতে অবশ্য মানুষের গল্প থেমে থাকে না। ’৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের সময় একুশ বছরের সন্ধ্যা আর তার শিশুকন্যাকে নিজের মেয়ে আর নাতনি সাজিয়ে মিলিটারির লাঠির বাড়ি খেয়ে ট্রেনে করে নিরাপদ এলাকায় নিয়ে যান নুরুন্নবী ওরফে নবীজ্যাঠা। নুরু ছাফা ওরফে নূরুভাই মুকুন্দ কাকাকে বাড়ির পিছনে পাকের ঘরে লুকিয়ে রাখে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। সেখানেই শেষ নয়। ’৯১ সালে জাকারিয়া সাহেব চক্রবর্তী পরিবারকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেন। এরপরও চলমান। হিন্দু অধ্যাপকের বদলির প্রতিবাদে মুসলমান কলেজ ছাত্ররা ক্লাশ বর্জন করে আর বিভাগের পিয়ন কেঁদে গামছা ভিজিয়ে ফেলে, অধ্যাপক তাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পান না। মুসলমান অধ্যাপক হিন্দু শিক্ষার্থীর মানোন্নয়ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিজ উদ্যোগে করেন। এগুলো সামান্য উদাহরণ। হিন্দু সহকর্মী মুসলমান সহকর্মীর নামাজ ইফতারের ব্যবস্থা করেন আবার হিন্দু প্রিয় বন্ধুর সুখ অসুখ নিয়ে মুসলমান বন্ধু ব্যতিব্যস্ত হয়ে যান; এধরনের গল্প দেশে বিদেশে, বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীতে শত হাজার নয়, লক্ষ কোটি হয়তো। এ গল্প পুরোনো হবার নয়। তাই ২০২২ সালেও চায়ের দোকানদার বাবা দোকান বন্ধ করে নিয়ে আসতে পারেনি বলে রিক্সাচালক সুধীরকাকার কোলে করে ডাক্তার দেখাতে আসে দুইবছর বয়সী আসমা। নয় মাসের দুর্গার মা বাবা গার্মেন্টস শ্রমিক তাই দিনের বেলা তহুরা চাচীর সাথে থাকে আর তিনিই নিয়ে আসেন ডাক্তার দেখাতে। নামে সামান্য পার্থক্য ছাড়া বোঝার আর কী উপায় কোলের শিশুটি জন্মসূত্রে কোন ধর্মের মানুষ যার মধ্যে এখনো বিশ্বাসের চারা গজায়নি, মুখে বুলি ফুটেনি।
’৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের সময় একুশ বছরের সন্ধ্যা আর তার শিশুকন্যাকে নিজের মেয়ে আর নাতনি সাজিয়ে মিলিটারির লাঠির বাড়ি খেয়ে ট্রেনে করে নিরাপদ এলাকায় নিয়ে যান নুরুন্নবী ওরফে নবীজ্যাঠা। নুরু ছাফা ওরফে নূরুভাই মুকুন্দ কাকাকে বাড়ির পিছনে পাকের ঘরে লুকিয়ে রাখে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। সেখানেই শেষ নয়। ’৯১ সালে জাকারিয়া সাহেব চক্রবর্তী পরিবারকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেন।
জীবনযাত্রা বর্তমানের আর আদর্শ, বিশ্বাস হাজার বছর আগের। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বহু রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যখন যেতে হয় তখন সংস্কৃতিতে মনস্তত্ত্বে তার ছাপ পড়বেই। এর ফলে একটা দ্বন্দ্বের জায়গায় পৌঁছে যাওয়াটাই স্বাভাবিক যদি এই মনস্তত্ত্বকে প্রতিনিয়ত চাঙ্গা রাখা হয়। তাই দুর্বল সময়ে সামান্য প্ররোচনায় প্রচণ্ড আঘাত, অপর পিঠে অসামান্য সহযোগিতা চলে পাশাপাশি।
এই গুরু লঘু ধর্মের ভেতরেও বিভাজন। সাধারণভাবে জাতিভেদ, বর্ণপ্রথা হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্য। সর্বোচ্চ বর্ণ ব্রাহ্মণ। তার মধ্যে আবার শ্রেণিবিভাগ আছে। বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে পারস্পরিক আদানপ্রদান, আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ, সম্পর্ক নিয়ে বহু জটিলতা রয়েছে। উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণদের মধ্যে নিম্ন বর্ণের ব্রাহ্মণের সাথে পারিবারিক বৈবাহিক সম্পর্ককে সামাজিকভাবে নিকৃষ্ট মনে করা হতো, এখন সহজ প্রাপ্য নয় বলে সম্পর্ক হলেও তাতে অস্বস্তি থাকে। তেমনি অন্যান্য বর্ণেও ভাগ। এমনকি যে শুদ্র বর্ণকে সবার নিচে রাখা হয়েছে তার মধ্যেও শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। কাজেই রাজনৈতিক প্রয়োজনে এক হবার ভান বিভিন্ন সময় প্রয়োজন হলেও মনস্তত্ত্বের দিক থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও এক নয়। মানুষকে বিভক্ত করে রাখার সুকৌশলী পরিকল্পনা, হাজার বছরেও যার ধার ভোঁতা হয়ে যায়নি।
কাজেই রাজনৈতিক প্রয়োজনে এক হবার ভান বিভিন্ন সময় প্রয়োজন হলেও মনস্তত্ত্বের দিক থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও এক নয়। মানুষকে বিভক্ত করে রাখার সুকৌশলী পরিকল্পনা, হাজার বছরেও যার ধার ভোঁতা হয়ে যায়নি।
মুসলমানদের মধ্যে জাতিভেদ না থাকলেও সুস্পষ্ট বিভাজন আছে বলে মনে হয়। আশরাফ, আতরাফ শব্দগুলো লক্ষণীয়। এছাড়া নেতৃত্ব, ধর্মের ব্যাখ্যা, আচার আচরণ নিয়ে মতভেদের কারণে সৃষ্ট বহু সম্প্রদায় রয়েছে। এদের মাঝে মতবাদের শ্রেষ্ঠত্ব বা Political correctness নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা যায় যা কখনো কখনো বাকবিতণ্ডায় পরিণত হয়। এই এলাকায় পারস্পরিক এই রেষারেষি হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার মত না হলেও বিশ্বে এর ফলে ধ্বংসযজ্ঞের উদাহরণ মেলে তার পিছনের কারণ যাই হোক। এই এলাকায় সংখ্যাগুরু লঘুর দ্বন্দ্ব হিন্দু মুসলমান ঘিরে। মুসলমান বৌদ্ধ বা মুসলমান খ্রিস্টান বা মুসলমান মুসলমান নয়। কারণ, ঐতিহাসিক ভুরাজনৈতিক।
দেখা যায় ধর্মের উদ্দেশ্যে বা ঈশ্বরের প্রসঙ্গেও একই ধর্মীয় গোষ্ঠী ঠিক এক হতে পারেনি। প্রত্যেকের শ্রেষ্ঠত্ব দরকার। সবাই ঈশ্বরকে টুকরো টুকরো করে যার যার টুকরিতে ভরে নিয়েছে আলাদা করে যার যার মতো শ্রদ্ধা ভক্তি আবেদন নিবেদন করার জন্যে। ‘ঈশ্বর সর্বব্যাপী’, ‘মানুষের ভেতরেই ঈশ্বর’ বলার পাশাপাশি। তাই প্রত্যেক পাড়ায় কয়েকটা করে মসজিদ। কয়েকটা করে বারোয়ারি দুর্গা পূজা। প্রার্থনার স্থান সংকুলান যখন মূল সমস্যা নয় তারপরও কেনো এত বিভাজন – ভাবার বিষয়। দেখা যাচ্ছে একসাথে হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ধর্মমতে ঈশ্বর বিশ্বাসও যথেষ্ট নয়।
শুধু ধর্মীয় বিভাজনই শেষ নয়। এটা শুনে বড়ো হওয়া যে চট্টগ্রামের বাইরের মানুষ বিদেশী। তখন আবার হিন্দু মুসলমান সবার একই চিন্তা। একটা অনিশ্চয়তা। বিয়েশাদী তারা নিজ এলাকায় দিতে চায়। আবার চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার মধ্যেও অবিশ্বাস বৈরিতা আছে। অন্য বিভাগেও থাকতে পারে। বাংলাদেশের ভেতর চট্টগ্রাম নোয়াখালী বরিশাল আবার চট্টগ্রাম এর ভেতর পটিয়া হাটহাজারী রাউজান এরকম। এক এলাকা নিয়ে আর এক এলাকার কৌতুক বক্রতার কমতি নেই। এগুলো আপাতত নির্দোষ মনে হলেও বিভিন্ন সামাজিক পারিবারিক সম্পর্কে চাপ সৃষ্টি করে বলে ধারণা। ঢাকায় বাস করলেও চট্টগ্রামের লোকজন চট্টগ্রাম সমিতিতে নাম লেখায়। বছরের ক’টা মিলনমেলায় মেজবানে ঢাকাবাসি চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ নিজেদের সমান গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে পারে কারণ ওই সময়টায় তারা শুধুই চট্টগ্রামের, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক যে বিভেদই থাকুক। সেদিন তারা ঢাকায় অভিবাসিত সংখ্যালঘু চট্টগ্রামের লোক নয়।
বাংলাদেশের ভেতর চট্টগ্রাম নোয়াখালী বরিশাল আবার চট্টগ্রাম এর ভেতর পটিয়া হাটহাজারী রাউজান এরকম। এক এলাকা নিয়ে আর এক এলাকার কৌতুক বক্রতার কমতি নেই। এগুলো আপাতত নির্দোষ মনে হলেও বিভিন্ন সামাজিক পারিবারিক সম্পর্কে চাপ সৃষ্টি করে বলে ধারণা।
আঞ্চলিকতা খুব মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা নেই তাই আপাতত বহুবছর আগের এমবিবিএস ফাইনাল পরীক্ষায় সার্জারি মৌখিক পরীক্ষার বোর্ড এর এক টুকরো চিত্র…। সার্জারির অধ্যাপক জানতে চাইলেন বাড়ি কোথায়। বাড়ি চট্টগ্রাম শুনে বললেন ‘ও তোমরা নাকি কলা ডুবিয়ে চা খাও?’ বলে তিনি তার সামনে চা এর কাপে কমলার কোয়া ডুবিয়ে খেলেন। হয়তো কৌতুক করে সহজ করা।
গত কয়েকবছর একটি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকার সুবাদে ভর্তি পরীক্ষার সময় ক্যাম্পাস-এ যাবার সুযোগ হয়েছে । বাংলাদেশকে টুকরো টুকরো করে এলাকা ভিত্তিক অজস্র ছাত্র সংগঠন স্টল নিয়ে তাদের এলাকার ভর্তি প্রাথীদের সহযোগিতার জন্য তৈরি থাকতে দেখা যায়। প্রশ্ন জাগে কোনো এলাকার প্রার্থী যদি সংখ্যালঘু হয় অর্থাৎ সংখ্যায় নগণ্য হয়, তার এলাকার সংগঠন যদি না থাকে তাকে সাহায্যের হাত বাড়াবে কে? এত বড় পরিসরে নিজেকে না দেখতে পেয়ে সে যদি হতাশ হয়ে পড়ে ভয় পায় কী বলার আছে। এটাও জানা হয়নি প্রত্যেকটা সংগঠন আবার রাজনৈতিকভাবে কয় টুকরো।
ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, চিকিৎসক, শিক্ষক অর্থাৎ বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যে সংগঠন থাকাটাই স্বাভাবিক কিন্তু সেখানেও রয়েছে ভাগ। একই পেশার মানুষগুলোর উদ্দেশ্য মোটামুটি কাছাকাছি হবারই কথা কিন্তু বিভক্ত হয়ে আলাদা করে উদ্দেশ্য সাধন করতে বা সাময়িক সুবিধা পেতে চাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এই ভাগগুলোর মধ্যে রেষারেষি তীব্র পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া কোনো বিরল ঘটনা নয়।
শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে অজস্র ভাগে বিভক্ত কতগুলো মানুষ। যারা নিজেদের ভালো মন্দ নিয়ে এক অর্থে একা দৌড়ে চলেছে। একসাথে ভালো থাকা, নিরাপদ থাকা, পার্থক্য সত্ত্বেও যার যার প্রাপ্য গুরুত্ব নিয়ে সম্মানে বাঁচা, বিষয়গুলো কী আর কোথায় কীভাবে সম্পর্কিত, খুঁজে পাওয়া দরকার।
শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে অজস্র ভাগে বিভক্ত কতগুলো মানুষ। যারা নিজেদের ভালো মন্দ নিয়ে এক অর্থে একা দৌড়ে চলেছে। একসাথে ভালো থাকা, নিরাপদ থাকা, পার্থক্য সত্ত্বেও যার যার প্রাপ্য গুরুত্ব নিয়ে সম্মানে বাঁচা, বিষয়গুলো কী আর কোথায় কীভাবে সম্পর্কিত, খুঁজে পাওয়া দরকার। এরপরও বিভাজনকে ঠেলে ফেলা হয়তো কষ্টসাধ্য, সময় সাপেক্ষ। তবে দুঃসাধ্য নয় মনে হয়।
বনানী চক্রবর্তী: শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। ইমেইল: cbanani24@gmail.com
সূত্র: সর্বজনকথা
0 মন্তব্যসমূহ