প্রকাশক ভোলানাথ সেনের ‘ইসলাম অবমাননার’ ইতিহাস - সুষুপ্ত পাঠক

প্রকাশক ভোলানাথ সেনের ‘ইসলাম অবমাননার’ ইতিহাস - সুষুপ্ত পাঠক


হযরত মুহাম্মদের ভূয়ষী প্রশংসা করে স্কুল পাঠ্য বই রচনা করে লেখক প্রকাশক ভোলানাথ সেন খুন হয়েছিলেন মুসলমানদের হাতে। পূর্ববঙ্গের ঢাকার একজন জমিদার স্কুল পাঠ্য বইটি দেখে তীব্র অনুভূতিতে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মুসলিম সমাজে এই নিয়ে জনমত তৈরি করেন। তিনি কোলকাতায় এসে দুইজন পাঞ্জাবী মুসলমান যুবক আবদুল্লাহ খান ও আমীর আহমেদকে ভোলানাথ সেনকে খুন করতে উদ্বুদ্ধ করেন। কোলকাতার বিখ্যাত বইয়ের দোকান ‘সেন ব্রাদার্স’ এর মালিক ছিলেন এই ভোলানাথ সেন। তিনি ‘প্রাচীন কাহিনী’ নামের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর শিশু পাঠ্য হিসেবে ভোলানাথ সেনের লেখা বইটি সরকার স্কুল পাঠ্য হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছিলো। সেখানে বুদ্ধ, যীশু, কৃষ্ণ যেমন ছিলো, তেমন করে হরযত মুহাম্মদের উপরও লেখা ছিলো। সুখ্যাতি করে সেই লেখায় ভোলানাথ সেন একটি ছবি ছেপে ছিলেন শুধু। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত একটি ছবি যেখানে মুহাম্মদ জিবরাইলের কাছ থেকে কুরআন নিচ্ছেন এমন একটি ছবি লেখার সঙ্গে ছাপেন। শুধুমাত্র এই ছবি ছাপার কারণে মুসলিম সমাজে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ১৯৩১ সালের ৭ মে তারিখে ঐ দুই পাঞ্জাবী মুসলিম যুবক কোলকাতার সেন ব্রাদার্স বইয়ের দোকানে এসে এলোপাতারি কুপিয়ে খুন করে যান ভোলানাথ সেনকে। দোকানের আরো দুই কর্মচারীও খুনিদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। তারাও খুন হোন।


আলীপুর জেলখানায় এই দুই যুবককে দেখতে, তাদের শ্রদ্ধা জানাতে মুসলমান নারী পুরুষের ভীড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছিলো। বিপ্লবী নগেন্দ্রনাথ দত্ত তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, আমরা যখন স্বদেশী করে আলীপুরে বন্দী তখন এই দুই যুবককে দেখতে মুসলমানরা জেলখানায় ভীড় করে। মুসলিম সমাজে এই দুই যুবক পরে শহীদের মর্যাদা পায় যখন আদালতের রায়ে তাদের ফাঁসি হয়েছিলো।


মুসলিম কমিউনিটিতে কি ধরণের ধর্মীয় দর্শন চর্চা হয় সেটি চিন্তা করুন। অবিভক্ত ভারতবর্ষে বই লিখে খুন হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। ১৯২৯ সালে ‘রঙ্গীলা রসূল’ নামের বই লিখেও খুন হন প্রকাশক। সীতাকে নিয়ে পাঞ্জাবে মুসলমানরা একটি নোংরা বই লিখে। সেই বইয়ের পাল্টা জবাব হিসেবে ‘রঙ্গীলা রসূল’ বইটি লেখা হয়। সেই বইয়ের প্রকাশক রাজপালের নামে মামলা হয়। খেয়াল রাখতে হবে সীতাকে নিয়ে লেখা বই নিয়ে কোন হিন্দু আদালতে যাননি। ভারতীয় পেনাল কোর্ডের ১৫৩ ধারা অনুযায়ী রাজপাল কোন অন্যায় করেননি বই প্রকাশ করে। রাজপালকে এভাবে আটকাতে না পেরে অন্য পথ বেছে নেয়া হয়। মুসলিম কমিউনিটি রাজপালকে হত্যা করতে কোন মুসলমানে নেই- এরকম আহ্ববান শোনা যায় মসজিদগুলি থেকে। লাহোরের একটি মসজিদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ১৯ বছরের যুবক ইলমুদ্দিন তখন সেখানে মাওলানা সৈয়দ আতাউল্লাহ শাহ বুখারীর জ্বালাময়ী ভাষণ শুনছিলেন। সেই ভাষণ শুনে ইলমুদ্দিন উদ্বুদ্ধ হয়ে খুন করে ফেলে প্রকাশক রাজপালকে। এই খুনকে মুসলিম সমাজ গর্ব ভরে উল্লাস করতে থাকে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বোম্বে থেকে উড়ে আসেন বিনা ফিতে ইলমুদ্দিনের মামলা লড়তে। ইলমুদ্দিন আদালতে বলেন তিনি অনুতপ্ত নন। ঠান্ডা মাথায় ইসলামের শত্রুকে তিনি খুন করে গর্বিত। রায়ে তার ফাঁসি হয়। কিন্তু ইংরেজ সরকার তাকে লাহোরে কবর দিতে ভয় হয় মুসলিম সেন্টিমেন্ট সামাল দেয়া যাবে কিনা ভেবে। ইলমুদ্দিনের লাশ কবর দেয়া হয় লাহারোর অনেক দূরে। কিন্তু কবি আল্লাম ইকবাল ইংরেজ সরকারকে বুঝাতে সক্ষম হোন পরিস্থিতি তিনি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার গ্যারান্টি নিচ্ছেন। তখন ১৪ দিন পর ইলমুদ্দিনের লাশ কবর থেকে তুলে ফের লাহোরে নিয়ে গিয়ে জানাজা দিয়ে কবর দেয়া হয়। ইলমুদ্দিনের সেই জানাজায় ২ লক্ষ মুসলমান যোগ দিয়েছিলো। ইলমুদ্দিনের নামে রাস্তাঘাটের নামকরণ করা হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর।


এই হচ্ছে মুসলিম কমিউনিটির অবস্থা। বাংলাদেশে যখন ব্লগারদেরকে জিহাদীরা কুপিয়ে খুন করছিলো তখন সেখানকার মুসলিম সাহিত্যিকরা ব্লগারদের লেখাকেই দোষী করে খুনগুলোকে জাস্টিফাই শুরু করে। আইএস বধূ খ্যাত বাংলাদেশী বংশদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক শামীমা বেগমের মানবাধিকার রক্ষার দাবীতে তারাই সরব হয়েছে। এই যে ইকবাল হোসেন নামের একজনের পরিচয় পাওয়া গেলো আর তাতে কুরআন অবমানরার আগুনে জল পড়ে গেলো সেটাও প্রত্যাশিত। যারা ভারতের হাত আবিস্কার করেছে, হিন্দুত্ববাদীদের হাত আবিস্কার করেছে সেটা তারা করেছে এটা জেনেবুঝেই যে ঘটনার পেছনে একজন মুসলিম সেটা তারা সহজাত অভিজ্ঞতা থেকেই জানত। ইলমুদ্দিনের ঘটনায় তার লাশকে জানাজা পড়াতে ইলমুদ্দিনের বাবা কবি ইকবালকে অনুরোধ জানালে তিনি জবাবে বলেছিলেন, আমি একজন পাপী বান্দা, ইসলামের এই বীরের জানাজা পড়ানোর কোন যোগ্যতা আমার নেই। কবি ইকবাল ভন্ড ছিলেন না। তিনি ইলমুদ্দিনকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু একালের ফারুক ওয়াসিফ, জাকির তালুকদার, নিঝুম মজুমদারদের সেই সাহস নেই। তারা ভারত র বিজেপির হাত আবিস্কার করে কৌশলে ইকবালদের বাঁচাতে চান। তাদের কাছে প্রত্যাশা তারা যেন কবি ইকবালের মত ভূমিকা নেন। ভন্ডামী ছেড়ে যেটাই করুন প্রকাশ্যে করুন।



লিংক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ