দিল্লীর যে এলাকায় কুতুব মিনার অবস্থিত সেই জায়গাটির নাম 'মেহেরৌলি'। 'মেহেরৌলি' শব্দটি এসেছে 'মিহিরওয়ালি' থেকে। মিহির হলেন সম্রাট বিক্রমাদিত্যের (৩৮০-৪১৩ খৃঃ) রাজসভার নবরত্নের এক রত্ন। বরাহমিহির ছিলেন জ্যোর্তিবিদ। মিহিরওয়ালি বলতে বোঝায় বরাহমিহিরের শিষ্য বা অনুগামীগণ।
আজ যেখানে কুতুব মিনার দাঁড়িয়ে আছে, ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় তার চারপাশে অনেক বিধ্বস্ত দালানকোঠা রয়েছে। পুরো অঞ্চলটা এককালে জ্যোর্তিবিদ্যা চর্চা ও গবেষণার কেন্দ্র ছিল এবং বরাহমিহিরের অনুগামীরা সেখানে পঠন-পাঠন এবং গবেষণা করত এবং কুতুব মিনার ছিল “পর্যবেক্ষণ স্তম্ভ” বা “Observation Tower”।
সুলতান হয়ে দিল্লীতে পা দিয়েই কুতুবউদ্দীন বুতপরস্তির পরাকাষ্ঠা মন্দিরগুলি ধ্বংস করে। নিয়মমাফিক ভাঙ্গা মন্দিরের মাল মশলা দিয়ে কাছেই 'কুতুব-উল-ইসলাম' মসজিদ তৈরী করে, এই মসজিদের গায়ে কুতুবউদ্দীনের যে শিলালিপি আছে, তাতে এইসব ঘটনার কথা লেখা আছে। [The History and Culture of Indian People, R.C. Mazumdar]
John Marshall এবং আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের মতে, নামাজের আগে আজান দেওয়ার জন্যই কুতুবউদ্দীন এই মিনার তৈরী করেন। এই বক্তব্যের কোনও সঙ্গতি নেই, কারণ-
- ১) মসজিদ থেকে মিনারের যে দূরত্ব, আজান দেওয়ার জন্য এতদূরে কোনও মিনার কেউ তৈরী করেন না।
- ২) কুতুব মসজিদ বানিয়ে ছিলেন কিন্তু মিনার শেষ করতে পারেননি। অতএব আজানের জন্য মিনার এই যুক্তি টেকে না।
- ৩) মসজিদের থেকে মিনার অনেক মূল্যবান এবং আকর্ষণীয় হয় না। কুতুব-উল-ইসলাম মসজিদের চেয়ে কুতুব মিনার অনেক বেশী আকর্ষণীয় ও মূল্যবান।
- ৪) ১৮৭১ সালে ভারতে স্থাপিত হয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, যার প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয় স্যার আলেকজান্ডার কানিংহামকে। আর তার সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করা হয় আর্চিবল্ড কার্লাইল ও জোসেফ বেগলারকে।
তারপর পাটনা শুরু হয় একে একে সমীক্ষার কাজ। ক্রমান্বয়ে পাটনা, গয়া, মুঙ্গের, ভাগলপুর, সাঁওতাল পরগনা, মানভূম, সিংভূম, রাণীগঞ্জ, বর্ধমান, বাঁকুড়া, হুগলি, বুন্দেলখণ্ড, মালব, খাজুরাহো, ছত্তিশগড়, উড়িষ্যা, ভারহুত, জব্বলপুর, ভেড়াঘাট, তেওয়ার, নাগপুর, রায়পুর, অমরকণ্টক, দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা চালিয়ে বহু তথ্য সামনে আনেন বেগলার।
এরপর ১৮৭১-৭২ খ্রিস্টাব্দে কানিংহাম তাঁর দুই সহকারি বেগলার ও কার্লাইলকে যথাক্রমে দিল্লি ও আগ্রায় সমীক্ষা চালানোর দায়িত্ব দেন। সেইমতো দিল্লির মেহরৌলীর বিখ্যাত লৌহস্তম্ভটির নিচের অংশে খোঁড়াখু়ঁড়ির মাধ্যমে সমীক্ষা শুরু হয়। সে সময় কুতুবমিনার এলাকার মাটির তলা থেকে তারা উদ্ধার করেন দুটি লক্ষ্মী মূর্তি। যা রীতিমতো আশ্চর্যজনক ; কেননা মুসলমান শাসক দ্বারা নির্মিত কুতুবমিনারের মাটির তলায় লক্ষ্মীমূর্তি কী করে এলো!!
যাই হোক, কিন্তু আরও আশ্চর্যের বিষয় হল- কুতুব উদ্দীনের এত বড় কীর্তির কথা তার সমসাময়িক ঐতিহাসিক হাসান নিজামীর লেখা তাজ-উল-মাসির এবং মিনহাস-উস-সিরাজের লেখা ‘তাবাকৎ-ই-নাসিরি’তে কোনও উল্লেখ নেই। কুতুব উদ্দীনের নামের সঙ্গে এই মিনার জুড়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে, কুতুব উদ্দীনের মারা যাওয়ার ২০০ বছর পরে। শাসম-ই-সিরাজ নামক এক মুসলিম লিপিকার এই কান্ডটি ঘটান। (Islamic havoc in Indian History, P. N. Oak, A. Ghosh 5740 W. Little York, Houston Texas, U. S. A. Page-120)
পন্ডিত কেদারনাথ প্রভাকর দ্বারা সম্পাদিত 'বরাহ মিহির স্মৃতিগ্রন্থ' নামক বইতে কুতুব মিনারের প্রকৃত পরিচয় এবং আরও অনেক তথ্য আছে। এই বইয়ের ১৫৭ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য (৩৮০-৪১৩ খৃঃ) খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে এই স্তম্ভের নির্মাণ করেন। সম্রাট বিক্রমাদিত্য নির্মিত যে লৌহস্তম্ভটি কুতুব মিনারের পাশে আছে, তার গায়ে সংস্কৃত ও ব্রাহ্মী অক্ষরে লেখা একটি লিপি আছে। ঐ লিপিতে কুতুব মিনারকে বলা হয়েছে 'প্রপাংশু বিষ্ণুধ্বজ'।
এরকম ভারতীয় ইতিহাসকে বিকৃতিকরণের অজস্র প্রমাণ বর্তমান।
তথ্যসূত্র-
- "১৫০ বছর ধরে ভুল ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে" ~ অমলেশ মিশ্র
0 মন্তব্যসমূহ