‘আমাদের ইতিহাস কালো হয়ে গেছে’

মুসলিমদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত রামু সীমা বৌদ্ধ বিহার
মুসলিমদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত রামু সীমা বৌদ্ধ বিহার

 Published: 29 Oct 2012 08:46 AM BdST Updated: 29 Oct 2012 08:46 AM BdST


এক মাস পর রামুতে গিয়েও সেই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের চিহ্ন এবং বৌদ্ধদের চোখে আতঙ্ক দেখেছেন শামীমা বিনতে রহমান। পুরাকীর্তির নিদর্শন হারানোর ক্ষতিটাও ধরা পড়েছে প্রত্নতত্ত্বের সাবেক এই শিক্ষার্থীর চোখে।


শামীমা বিনতে রহমান

রামু থেকে ফিরে


ঢাকা, অক্টোবর ২৯ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)-


রামুর চৌমুহনী মোড়ে একটি ট্রাফিক পুলিশ বক্সকে মাঝখানে রেখে চার দিকে চারটি রাস্তা চলে গেছে। বামের সাদা চিং-লাল মন্দিরের দিক থেকে যে রাস্তা এসে মোড়ের সঙ্গে মিলেছে, তার একটু ডানে গিয়ে হাতের বাঁয়ে বড়ুয়া পাড়ার রাস্তা। এখানে প্রায় ৪০০ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পরিবার আর শহরের সবচেয়ে বড় আর পুরনো বিহার সীমা বৌদ্ধ বিহার।


এসব রাস্তার ভৌগোলিক বর্ননায় কোনো পরিবর্তন ঘটেনি গত কিছুদিনে। তবে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ছয়টি মন্দির ও বিহার এবং নয়টি বাড়ি পুরো জ্বালিয়ে দেয়ার পর এবং শ’ দেড়েক বাড়ি আর ছয়টি মন্দিরে লুটপাট-ভাংচুরের পর এখন ওই ভৌগোলিক বিস্তারে স্থাপনা বিন্যাসে পরিবর্তন আসছে ব্যাপক। আশংকা, অবিশ্বাসও উঠেছে চরমে।


ঘটনার ২৫ দিন পর রামুতে গিয়ে দেখা গেল, পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া সব বাড়ি, মন্দির একই রকম আছে। শুধু বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) চারটি ঘর বানিয়ে দিয়েছে, যাতে ঝুলছে ‘বিজিবি কর্তৃক নির্মিত’ সাইনবোর্ড।


সেনাবাহিনী মন্দির নির্মাণেরও দায়িত্ব নিয়েছে, তবে এখনো কোনো মন্দির কর্তৃপক্ষই পুননির্মাণের উদ্যোগ নেয়নি। সবগুলো মন্দিরেই তাদের পাহারা আছে। বিজিবি আর সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প আছে সেখানে।


বৌদ্ধ সম্প্রদায় ঠিক করেছে, ২৯ অক্টোবর (সোমবার) প্রবারণা পূর্ণিমায় বাঁকখালি নদীতে প্রতি বছরের মতো ফানুস এবার আর ওড়ানো হবে না।


ঘটনার পর মাস গড়ালেও প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি কর্তাব্যক্তিদের আশ্বাসেও ভয় পুরোপুরি কাটেনি বৌদ্ধদের।


অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনায় থানায় হওয়া ১৫টি মামলায় গ্রেপ্তারের আতঙ্কে রয়েছেন এলাকার সাধারণ মুসলমানরা।


শুধু ফেইসবুকে একটি ছবিকে কেন্দ্র করে ওই হামলা- এটা মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই। এর পেছনে অন্য আরো কারণ রয়েছে বলে তাদের সন্দেহ, যদিও কী কারণ, তাও স্পষ্ট বুঝতে পারছেন না।


স্থানীয় নাট্যকর্মী সুনীল কান্তি শুধু বললেন, 

“দ্যাখেন, এতো বড় একটা হামলা হইল, মানুষ কিন্তু খুন হয় নাই। সত্যি সত্যি রায়টে তো মানুষ খুন করে ফেলে। আমার মনে হয়, আরো ভয়ঙ্কর কিছু হবে, এইটা তার আগের অবস্থা।”


'পোড়া ইতিহাস’


সীমা বৌদ্ধ বিহারের সামনে দাঁড়ালে এক মাস পরও মনে হয় ধ্বংসস্তূপ। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া কাঠের খুঁটিগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, নিচে কাঠকয়লার সঙ্গে থালা-বাটি, টিফিন ক্যারিয়ার, নীল রঙের বালতি, গেরুয়া রঙের কাপড়ের পোড়া অংশ। অবশ্য এর মধ্যেও ভক্তদের পূজা থেমে নেই।


মন্দির থেকে দাপ্তরিক কাগজে ক্ষয়ক্ষতির যে তথ্য দেয়া হয়ে- তাতে বলা হয়েছে, একটি দুই তলা কাঠের বিহার আগুনে পুরো ভস্মীভূত; একটি করে ভিক্ষু সীমা, বোধি ঘর, ধাতু মন্দির পুড়ে গেছে; সংরক্ষিত থাকা ২ হাজার বছরের পুরনো গৌতম বুদ্ধের চুল, একই সময়ের ভিক্ষু সংঘের দাঁত আগুনে নষ্ট, তালপাতায় লেখা ২ হাজার বছরের পুরনো প্রাচীন বিদ্যালিপি, পাণ্ডুলিপি ও পুঁথি আগুনে পুরোটাই পুড়েছে; পুড়ে গেছে বার্মিজ, বাংলা, সিংহলী ও ইংরেজি ভাষায় লেখা ত্রিপিটক।


প্রধানমন্ত্রী রামু ঘুরে আশ্বাস দিয়ে গেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির আবার উঠে দাঁড়াবে। কিন্তু তাতে কী মিলবে পুরার্কীর্তিগুলো, প্রশ্ন ৮৩ বছর বয়সি সীমা বৌদ্ধ বিহারের প্রধান সত্যপ্রিয় মহাথেরোর।


“এই বিহার তো আর পাওয়া যাবে না। ১০০ কোটি টাকা দিলেও কি আপনি পাবেন আড়াই হাজার বছর পুরানা তালপাতায় লেখা ত্রিপিটক, বুদ্ধের চুল, প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো ইতিহাসের নিদর্শন? আমি কাকে বোঝাই, কী করে বোঝাই যে আমার সব শেষ হয়ে গেছে, আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে।”


আ ক ম যাকারিয়া তার বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ বইতে রামুর সবচে পুরানা বৌদ্ধ বিহার হিসাবে উল্লেখ করেছেন রামু সদর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রামকোট বিহার ও বনাশ্রমকে। এর সময়কাল ধরা হয়েছে আনুমানিক ২ হাজার ৩০০ বছর।


সেদিনের হামলায় এই বিহারের তেমন একটা ক্ষতি না হলেও যেসব মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে অর্পণচরণ ছাড়া বাকি সবগুলোই শতবর্ষ পার করা। সীমা বৌদ্ধ বিহার ৩০০ বছরের বেশি পুরনো। কাঠের তৈরি এ বিহারগুলার মূল বৈশিষ্ট্য হলো- নির্মাণের ক্ষেত্রে এসব বিহারে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন ও জাপানের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ নির্মাণশৈলী অনুসরণ করা হয়েছে।


সত্যপ্রিয় মহাথেরো বললেন, 

“কেবল আমাদের ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে এমন না, ত্রিলোকের গুরুকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। ওরা আগুন দিয়ে ইতিহাসকে কালো করে ফেলেছে। এমন কালো যে- ওই সময় সম্পর্কে জানার উৎস আর পড়া যাবে না।”


আতঙ্ক এখনো


অপর্ণচরণ মন্দিরের জন্য জমি দিয়েছিল যে পরিবার- সেই পরিবারের সদস্য ৭২ বছর বয়সী অনীল বড়ুয়া সীমা মন্দিরের মেঝেতে বসে বলেন, “এখন শুধু ভয় লাগে। শুধু কান্না আসে। মন্দিরের দিকে তাকালেই চোখে পানি আসে। আমার ছেলে মেয়ে আর নাতী-নাতনীদের জন্য অনেক ভয় হয়। ওদের কী হবে?


“আমরা তো অন্য কোথাও যাব না। এটা তো আমার দেশ। একটা কুকুর ডাক দিলেও ভয় লাগে আর মনে হয়, পরের দিনের সকালটা দেখতে পারব তো?”


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৯ সেপ্টেম্বরের সেই হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কোনো বৌদ্ধই রামু ছেড়ে কোথাও যাননি। কিন্তু হামলার পর মাস গড়ালেও ‘চিহ্নিত’ কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় আতঙ্ক চেপে বসেছে বৌদ্ধদের মনে।


সুবল বড়ুয়া নামে ৮০ বছর বয়সী একজন বললেন, 

“এখন পর্যন্ত চিহ্ণিত একজনও গ্রেপ্তার হয়নি। এ কীসের আলামত!”


‘নারায়ে তাকবীর’ স্লোগান দিয়ে বৌদ্ধ মন্দির ও বসতিতে হামলার মিছিলে মুক্তাদির, হাফেজ, জাহাঙ্গির, সেলিম, সাদ্দামসহ ১০/১৫ জনকে চেনার কথা ওই এলাকার অনেকেই জানিয়েছেন। এর মধ্যে মুক্তাদির অবশ্য গ্রেপ্তার হয়েছেন, সেই সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত আড়াইশ জনকে।


চৌমুহনীর মোড়ে ৬০ থেকে ৮০ বছর বয়সীদের আড্ডায় কলিমুল্লাহ নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন,

 “এখানকার কিছু খারাপ মোসলমান ফোলাহাইন যুক্ত থাইকতে ফারে, ওই দুষ্টুগুনারে আগে ধরি ফালান দরকার। বিনাদোষীদের এন ধরন লাইগছে বেশি। ইয়ান ঠিক ন করে।”


‘উদ্দেশ্য কী’


শুধু ফেইসবুকের একটি ছবিকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ বসতিতে এমন তাণ্ডব- তা বিশ্বাস করতে মন সায় দেয় না ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেরই। যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, সবাই এক বাক্যে বলেছেন- স্থানীয় মুসলমানরা হিংসা বা ক্ষোভে এ ঘটনা ঘটাননি।


ধর্মগুরু সত্যপ্রিয় মহাথেরো বলেন, 

“হামলাকারীরা কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রোল, গান পাউডার ব্যবহার করেছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই আমার। এখন আমার প্রশ্ন, ওরা এসব পেল কোত্থেকে? আমার ৮৩ বছর বয়সে আমি কখনো কল্পনাও করতে পারি না, মুসলমানরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই কাজ করতে পারে।”


মন্দিরগুলোর কাছের এক বাড়ির বাসিন্দা নিপু বড়ুয়া বলেন, 

“ভয়ে বের হতে পারিরন। জানালা দিয়ে দেখেছি তারা বিটুমিনের ড্রাম নিয়া এসেছে, ড্রাম ভর্তি পেট্রোল নিয়ে এসেছে। চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গ্যাছে সাদাচিং, লাল চিং। ইটের বলে অপর্ণচরণ মন্দিরে শুধু টিন পুড়ে গ্যাছে, কিন্তু বিল্ডিং পোড়িনি।”


এরপর তিনি নাম প্রকাশ না করে এক মুসলিম ছেলের কথা বলেন, পরে অন্যদের কাছ থেকে জানা যায়, তার নাম দেলোয়ার।


“তার বাপ মুসলিম, মা বড়ুয়া। তাকে আমি পড়াশুনা শিখিয়েছি। সে নিয়মিত মন্দিরে আসা যাওয়া করত। আমার নিজের চোখে দেখলাম, সে সোনালি রঙের বড় বজ্রাসনে বসা বুদ্ধ মুর্তির চোখ থেকে দামি পাথরগুলো খুলে নিয়েছে।”


প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু জানান, মন্দিরে থাকা ৪০০ বুদ্ধ মুর্তির মধ্যে ২০০টি অষ্টধাতু, শ্বেত পাথর, ব্রোঞ্জ ও পিতলের তৈরি। ওই ২০০টিই লুট হয়ে গেছে।


স্থানীয় শিক্ষক সুমত বড়ুয়া বলেছেন, 

“মিছিলে মুক্তাদির, হাফেজ, জাহাঙ্গির, সেলিম, সাদ্দামসহ ১০/১৫ জনকে চিনছি আমি। বাকি কাউরেই চিনি নাই। এদের বেশিরভাগ মাদ্রাসার ছাত্র।”


কক্সবাজার থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে রামু উপজেলার উত্তরে চকোরিয়া ও কক্সবাজার সদর; দক্ষিণে উখিয়া আর পূর্বে বান্দরবান পার্বত্য জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি।


এই নাইক্ষ্যংছড়ির সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত, যা ইয়াবাসহ নানা রকমের মাদকের রুট হিসাবে ব্যাপকভাবে পরিচিত।


চৌমুহনীর মোড়ের ব্যবসায়ী নিতিশ বড়ুয়া বলেন, 

“আপনার কি মনে হয় না, র্মূতি চুরি করে বিক্রি করা একটা বড় উদ্দেশ্য। দ্যাখেন, যখন ক্লাস ফোরে পড়তাম, সমাজ বইতে পড়েছিলাম রামু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর রবার বাগানের জন্য বিখ্যাত। আসলেও তাই। আমি কখনোই ভাবিনি, আমি বড়ুয়া আর মুক্তাদির মুসলমান।”


“মুসলমানের ঈদ আর আমাদের পূজায় কোনো পার্থক্য নেই। ওরাও আমাদের পূজায় মানত করে। আমার মনে হয়, এখানকার কিছু দুষ্টু মুসলমানকে কেউ ব্যবহার করেছে। উদ্দেশ্য দামি মুর্তি আর মূর্তিতে থাকা দামি পাথর চুরি করা।”


নাট্যকর্মী সুনীল আবার অনেকগুলো ঘটনা তুলে ধরে তার সূত্র মেলানোর কথা বলেন।


“ওই দিন প্রশাসনের সবাই এতো ব্যস্ত ছিল কেন? কেন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তিন ঘণ্টা ছিলেন গর্জনিয়াতে মিটিং করতে? গর্জনিয়া তো নাইক্ষ্যংছড়ির কাছের ইউনিয়ন। ওই খানে নেজামে ইসলাম, হিলফুল ফজুল খুবই সক্রিয়। কাউয়ার খোপ, কচ্ছপিয়া, খুনিয়াপালং, এসব ইউনিয়নে ইসলামী ছাত্র শিবির, ইসলামী ঐক্যজোট খুবই সক্রিয়। এদের কারা সাপোর্ট দ্যায়।”


ধর্মীয় অস্থিতিশীলতা তৈরি করে কেউ স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে সন্দেহ সুনীলের।


“মাঝখানে আমরা ভাগ হয়ে গেলাম। আমরা এখন মুসলমানদের সন্দেহ করি আর ভয় পাই।”


মিছিলে মাদ্রাসার এতো ছাত্রকে জড়ো করা হল কীভাবে- তা নিয়েও প্রশ্ন অনেকের।


একজন বললেন, 

“আচ্ছা বলতে পারেন, সেইদিন ইউএনওকে কেন ফেয়ারওয়েল প্রোগ্রামে থাকতে হবে; এমপি সাহেব, যিনি কারণ ছাড়া রামু শহরে আসেন না, সেদিন কেন দলবল নিয়ে এলেন?”


ঘটনার শুরু যেভাবে


বড়ুয়া পাড়ার প্রদীপ বড়ুয়া জানান, ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিনি শোনেন মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফকে অবমাননা করে একটি ছবি সবাইকে দেখাচ্ছে মুক্তাদির নামের একজন।


মুক্তাদিরের এক বন্ধু নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাদা চিং মন্দিরের রাস্তায় আরেকজনের কাছে তিনিও ওই ফেইসবুকের ছবির কথা শোনেন। এরপর চৌমুহনীর মোড় থেকে মোটামুটি আধা কিলোমিটার কম দূরত্বে ফারুক কম্পিউটার অ্যান্ড টেলিকম সেন্টোরে গিয়ে দেখতে পান কিছু মানুষের জটলা।


মুক্তাদির ‘খুব ব্যস্ত’ থাকায় সে সময় তার সঙ্গে আর কথা বলতে পারেননি বলে জানালেন সেই বন্ধু।


লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ওই যুবক জানতে পারেন, তাদের চেনা উত্তম কুমার নামের এক যুবকের ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেই নাকি ওই ছবি এসেছে। যদিও পরে দেখা যায় উত্তম নিজে ওই ছবি ফেইসবুকে তোলেননি।


“ফেইসবুক কী জিনিশ আমি জানি না। এইখানে ছবির কি হয়, আমি তখন জানতাম না। ভাবলাম, উত্তমের শ্বশুরবাড়িতো আমাদের বাড়ির কাছেই। তার কাছে গিয়েই জিজ্ঞেস করি।”


উত্তমের শ্বশুরবাড়ির দিকে যাওয়ার সময়ই ৮/১০ জনের প্রথম মিছিলটি দেখতে পান মুক্তাদিরের সেই বন্ধু। দেখতে পান দেলোয়ার, হাফেজ, সাদ্দাম, মুক্তাদিরসহ বেশ কয়েকজনকে, যাদের কণ্ঠে ছিল নারায়ে শ্লোগান।


বড়ুয়া পাড়ার একদম শুরুর দিকেই ঘর ছিল ৫০ বছর বয়সী মিন্থি বড়ুয়ার, যিনি এখন থাকেন বিজিবির টাঙিয়ে দেয়া তাঁবুতে। ২৯ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে তিনি প্রথম মিছিলের শব্দ শুনতে পান। এরপর সাড়ে ১০টার দিকে আসে দ্বিতীয় মিছিল। এবার ঘরের চালে শুরু হয় ঢিল মারা। রাত সাড়ে ১২টার দিকে হামলাকারীরা পেট্রোল ঢেলে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়।


স্থানীয় বাসিন্দা সুমত বড়ুয়া জানান, সাদা চিং-লাল চিং মন্দিরের রাস্তায় প্রথম মিছিলে তিনি লোক দেখেছেন ৮ থেকে ১০ জন। দ্বিতীয় মিছিলে ছিল একশ কম। আর তৃতীয় মিছিল, যেটা রাত সাড়ে ১২টায় শুরু হয়, সেখানে হাজার হাজার মানুষ দেখেছেন তিনি।


“ওরা এসেছে ট্রাকে ট্রাকে। মিছিলে ওই একই শ্লোগান, হাতে লাঠি, রাম দা, কিরিচ।”


প্রদীপ বড়ুয়া বলেন, 

“৩ নম্বর মিছিলের পর যখন আগুন ধরায়া দিল, একই সঙ্গে পাথর মারতে থাকলো, আমি তখন আশপাশের মহিলা, বাচ্চা কাচ্চা নিয়া ঘরের সাথের পুকুরে লাফ দিয়া চুপ করি থাকি। ঘরের দরজায় আমার পালা দুই শুকর বাঁধি রাখি, ভয়ে যাতে আমার ঘর পুড়াইতে না পারে।”


ওই হামলার আগে চৌমুহনী মোড়ে এক ‘সম্প্রীতি সমাবেশ’ হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতা, উপজেলা চেয়ারম্যান, প্রেসক্লাবের সভাপতি নুরুল ইসলাম সেলিম, ওসি নজিবুল ইসলাম ওই সমাবেশে কথা বলেন বলে জানান কানন বড়ুয়া নামের স্থানীয় আরেক বাসিন্দা।


সীমা বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষু প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, 

“রাত সাড়ে ১২টার পর আমাদের এখানে আগুন দেয়। ওই আগুনের ধোঁয়া কাল ছিল না। পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিনের ধোঁয়া কালো হয়, ওই ধোঁয়া কালো ছিল না, কিন্তু সব পুড়ে কালো কালো হয়ে যাচ্ছিল। আমি কয়েকবার থানার ওসিকে ফোন করেছি। এক পর্যায়ে তার ফোন বন্ধ পাই।”


খোলা আকাশের নিচে, কয়লা হয়ে পুড়ে থাকা দীর্ঘদিনের ব্যবহৃত পোড়া গৃহ সামগ্রীর মাঝে হাঁটু ভাজ করে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে মিন্থি বড়ুয়া বলেন, 

“গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ দি গ্যাছে, মাসে তিন হাজার টাকা কিস্তি দিয়ন লাইগবো। অনও ঘরই তুলতাম পারি ন।“


বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এসবিআর/এমআই/১৪৩০ ঘ.


সূত্র: বিডিনিউজ২৪

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ