২৯শে মে ২০২৫
অতীতে স্বামী বিবেকানন্দ জানিয়েছিলেন যে, প্রাচীন ভারতে একটাসময়ে সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ধর্মের রূপ বদলে গিয়েছিল এবং এক এক যুগে এক একধরণের নিয়ম প্রচলিত হয়েছিল। তখন নতুন পরিবেশের সঙ্গে সংগতি রেখেই নতুন বিধান তৈরি করা হয়েছিল বা নতুন বিধান তৈরি করবার প্রয়োজন হয়েছিল। বেদান্তে যা কিছু বলা হয়েছে, সেসব শাশ্বত সত্য হলেও স্মৃতি সম্পর্কে কিন্তু একথা বলা সম্ভব নয়। তাই যাঁরা গোঁড়া, যাঁরা সনাতন হিন্দুধর্মের দোহাই দিয়ে সমাজ সংস্কারের পথরোধ করতে চান, তাঁরা সত্যের এই আপেক্ষিকতাকে বুঝতে পারেন না। তাঁরা ভুলে যান যে, সামাজিক রীতিনীতির সংস্কারের অর্থ ধর্মকে অস্বীকার করা নয়। অতীতের কোন একসময়ে এই ভারতেই গরুর মাংস না খেলে ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব বজায় থাকত না। বেদে পাওয়া যায় যে—তখন বাড়িতে কোন সন্ন্যাসী, রাজা বা কোন বিশিষ্ট অতিথি এলে তাঁর সম্মানে সবথেকে ভালো ষাঁড়টিকেই কাটা হত। কিন্তু পরে চাষবাসের প্রচলন হলে গোহত্যা অন্যায় বলে মনে করা হয়েছিল; কারণ, গরু কৃষিকাজের পক্ষে অত্যাবশ্যক। একারণেই তখন গোহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, তিনি তাঁর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থের ৪৭নং পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন—
“আধুনিক বৈষ্ণব পড়েছেন কিছু ফাঁপরে, তাঁদের ঠাকুর রাম বা কৃষ্ণ মদ-মাংস দিব্যি ওড়াচ্ছেন, রামায়ণ-মহাভারতে রয়েছে। সীতাদেবী গঙ্গাকে মাংস, ভাত আর হাজার কলসী মদ মানছেন।”
অতীতে যেসব রীতিনীতি প্রচলিত ছিল, সামাজিক পরিবর্তনের ফলেই পরবর্তীসময়ে সেগুলিকে অন্যায় ও বর্বরোচিত বলে মনে করা হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সমাজের চেহারা বদলে গেলে রীতিনীতির ও নিয়মের পরিবর্তন দরকার হয়ে পড়ে, নাহলে সমাজ বাঁচতে পারে না। (স্বামী বিবেকানন্দের ইংরেজি রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, পৃ- ১৭৪) সাধারণ দৃষ্টিতে গোহত্যা নিয়ে স্বামীজীর উপরোক্ত মন্তব্যটি চমকে দেওয়ার মত হলেও, ইতিহাসগতভাবে তিনি ভুল কিছুই লেখেননি বলে দেখা যায়। কারণ, প্রাচীন ভারতে প্রচলিত থাকা সংস্কৃত ভাষায় ‘গোঘ্ন’ বলে একটা শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়। এই শব্দটির অর্থ হল—গোহত্যাকারী। একইসাথে অতীতে এই শব্দটিকে আবার অতিথি শব্দের একটি প্রতিশব্দরূপেও ব্যবহার করা হত। অর্থাৎ—প্রাচীন ভারতে কোন অতিথি গৃহে এলে তাঁকে গোহত্যা করে আপ্যায়ন করা হত। ঋগ্বেদের যুগের ভারতে আর্যদের কাছে গোরু খুব মূল্যবান একটি অর্থনৈতিক সম্পদ ছিল। তখন বিত্তবানদের—‘গোমত’ এবং গোষ্ঠীপতিদের—‘গোপ’ বা ‘গোপতি’ নামে ডাকা হত। গোরু নিয়ে তখন আর্যদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষও হত। এই সংঘর্ষকে—‘গভিষ্টি’, ‘গব্যু’ বা ‘গবেষণ’ নাম দেওয়া হয়েছিল। প্রাচীন পৌরাণিক উপাখ্যানগুলিতে গোরুর দেবত্ব ও এসবের সঙ্গে জড়িত অনেক অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরাতত্ত্ববিদরা মহেঞ্জোদারোর সিলে ভীমকায় ষাঁড় বা বৃষের চিত্র পেয়েছেন। অথর্ববেদের দশম কাণ্ডে অবধনীয় গোরুর গৌরবগাথা বর্ণনা করা হয়েছিল বলে দেখা যায়। এথেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রাচীন ভারতে গোরুকে অবধ্য বলে মানা হত। তখন গোরুকে যে শুধু ‘অগ্ন’ বলা হয়েছিল, তা নয়; বেদে গোরুকে আরও অনেক গৌরবজনক নামে ডাকা হয়েছিল বলে দেখা যায়। ঋগ্বেদে চারবার ‘অগ্ন’ ও ‘অম্লা’ কথাগুলি ব্যবহৃত হয়েছিল। এছাড়া অথর্ববেদে স্ত্রীলিঙ্গ ও পুংলিঙ্গ অর্থে এই শব্দদুটি আরও ৪০ বার উল্লেখ করা হয়েছিল। এছাড়া প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে—গৌ, উস্র, ধেনু, সুদুগ্ধা, বৃষ—ইত্যাদি মিলিয়ে গোরুর মোট ২১টি সমার্থক শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়। বিভিন্ন শব্দরূপ ও সমার্থক মিলিয়ে ঋগ্বেদে গোরু শব্দটি প্রায় ৭০০ বার উল্লেখিত হয়েছে বলে দেখা যায়।
বৈদিকযুগের ভারতে পশুপালন ও কৃষিভিত্তিক সমাজের কেন্দ্রে গোরুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা ছিল। গোরুই সেযুগের মুদ্রা ছিল। তখন গোরুর বিনিময়েই কেনাকাটা করা হত। গোরুই সেকালের অর্থনীতি ছিল। ঋগ্বেদের একজায়গায় পাওয়া যায় যে, ‘পণি’ বলে একদল মানুষ ইন্দ্রের গোরু চুরি করবার ফলে ইন্দ্ৰ তাঁদের উপরে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে সরমা নামের একটি কুকুরকে পাঠিয়ে সেই পণিদের ধমক দিয়ে বলেছিলেন যে—‘গোরু ফেরত দাও। নাহলে ইন্দ্র এসে তোমাদের মজা দেখিয়ে দেবে।’ এথেকে বোঝা যায় যে, ইন্দ্র—যিনি ঋগ্বেদের প্রধান দেবতা ছিলেন, তাঁর মত মহাশক্তিধরও তখন গোরু ছাড়া শক্তিহীন ছিলেন। বৈদিক যুগের ভারতীয়রা গোরুকে শুধুমাত্র যে একটা পশু হিসাবেই দেখতেন—তা কিন্তু নয়। তৎকালীন যুগের সমাজ, অর্থনীতি ও ধর্মেও গোরুর একটা বিরাট জায়গা ছিল। গোরুই তখন সম্পদশালীর মাপকাঠি ছিল। একারণেই গোরুকে বৈদিকসাহিত্যে অনেক গৌরবজনক বিশেষণে অভিহিত করা হয়েছিল। যেমন ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের পঞ্চমসূক্তে অগ্নিকে বলা হয়েছিল—“বৃষভশ্চ ধেনুঃ”; অর্থাৎ—তিনি বৃষ ও গাভী দুই-ই। আবার ঋগ্বেদের নবম মণ্ডলের ৭২নং সূক্তে সোমকে বলা হয়েছিল—“প্রিয়ঃ পতিগৰ্বাৎ”; অর্থাৎ—গাভীর স্বামীস্বরূপ (Lord of Cows)।
ঋগ্বেদের অন্যত্র সূর্যকে এক উজ্জ্বল বর্ণধারী বৃষ বা ষাঁড় বলা হয়েছিল, এবং ইন্দ্রকে সুদুগ্ধা ধেনুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, গোদুগ্ধকে উজ্জ্বল রশ্মির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। গোরুকে রুদ্রের মা, বসুদের দুহিতা ও আদিত্যের ভগ্নী বলে অভিহিত করে আহ্লাদ করে—‘অদিতি’, ‘ঋত’, ‘বাক’—এরকম বিভিন্ন নামে ডাকা হয়েছিল। এছাড়া বৃহস্পতিকে বলা হয়েছিল ‘গোপতি’, এবং মরুৎকে বলা হয়েছিল ‘গোবন্ধু’। প্রাচীন ভারতে গোরু যে অবধ্য ছিল, এবিষয়ে প্রথম ও অকাট্য ঐতিহাসিক প্রমাণ হল যে—ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১৬৪ নং সূক্তের ৪০নং ঋকে গোরুকে ‘অগ্ন’, অর্থাৎ—‘অবধনীয়’ বলা হয়েছিল। কিন্তু একইসাথে একথাও উল্লেখ্য যে, ঋগ্বেদের ৪৩নং ঋকে বৃষ মাংস ভক্ষণের কথাও পাওয়া যায়। এছাড়া ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলের ২৯নং সূক্তের ৮নং ঋকে মহিষের মাংস ভক্ষণের কথা রয়েছে বলে দেখা যায়। কিন্তু, অন্যদিকে অথর্ববেদের দ্বাদশ কাণ্ডের চতুর্থ ও পঞ্চম সূক্তে গোবধের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় বক্তব্য রাখা হয়েছিল, এবং একথাও বলা হয়েছিল যে, কেউ গোবধ করলে তিনি—‘মৃত্যু পাশেমু বধ্যতাম’—হবেন। এছাড়াও ওই একই সূক্তেরই ২২নং ঋকে গোরুকে আবার ‘অঘ্না’ বলা হয়েছিল।
বস্তুতঃ গোরু নিয়ে ঋগ্বেদে দু’ধরণের তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেগুলোর মধ্যে একটি ধরন হল যে, সেখানে গোরুকে—‘অঘ্নেয়’—নামে উল্লেখ করা হয়েছিল। ঋগ্বেদের ‘অঘ্নেয়’ শব্দটির অর্থ হল—যাকে হত্যা করা অনুচিত। অনেকেই এটা থেকে যে যুক্তি বের করেছেন, সেটা হল যে, প্রাচীন ভারতে প্রথম থেকেই গোহত্যা সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল; এবং তখন গোমাংস ভক্ষণ করা তো দূরের কথা, গোহত্যাও করা যেত না। কিন্তু এই তথ্যটি ইতিহাসগতভাবে সঠিক নয়। কারণ, ইতিহাস বলে যে, বৈদিকযুগেও এমন কোন নিষেধাজ্ঞা কিন্তু প্রচলিত ছিল না। কারণ, শতপথ ব্রাহ্মণের (তৃতীয়; ১:২: ২১) দুটি জায়গায় প্রাণী উৎসর্গ ও গোমাংস ভক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছিল—
‘অর্ধ্বেয়ু তখন তাঁকে গৃহাভ্যন্তরে নিয়ে এল। তাঁকে বলা হল সে যেন গাভী ও ষাঁড়ের মাংস না খায়। কারণ গাভী ও ষাঁড় পৃথিবীতে অনেক উপকার করে। দেবতারা বললেন—গাভী ও ষাঁড় জগতের অনেক উপকার করে, তাই গাভী ও ষাঁড় যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে। এজন্য সে গাভী ও ষাঁড়ের মাংস খেতে ইচ্ছুক।’
ঋগ্বেদ থেকে একথাও জানা যায় যে, আর্যরা খাদ্য হিসাবে গোহত্যা করতেন এবং গোমাংসকে তাঁরা উত্তম খাদ্য হিসাবে বিবেচনা করতেন। একথার ঐতিহাসিক প্রমাণস্বরূপ বলা চলে যে, ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৮৫:১৪নং শ্লোকে ইন্দ্র বলেছিলেন—
‘তাঁরা ১৫/২০ টি গোরুর মাংস রান্না করেছে।’
অন্যদিকে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৭২:৬নং শ্লোকে তরবারি বা কুঠার দিয়ে গোহত্যা করবার উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া অপস্তম্ভ ধর্মসূত্রের ১৪, ১৫ ও ২৯ নং শ্লোকে বলা হয়েছিল
—‘গাভী এবং ষাঁড় হচ্ছে পবিত্র। সুতরাং তাদের মাংস অবশ্য ভক্ষ্য।’
আপস্তম্ভ ধর্মশাস্ত্রের একটি পরিচ্ছেদে—মানুষের কি ধরণের খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণ করা উচিত বা অনুচিত, এসবের একটি তালিকা পাওয়া যায়। এই সূত্রটিতে—এক ক্ষুরবিশিষ্ট উট, শূকর, শরভ ও গায়ল নামের একধরণের পশুর মাংস ভক্ষণ করাকে মানুষের জন্য নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে বলে দেখা যায়। কিন্তু এরপরেই ঋষি বলেছিলেন যে, গোরু ও ষাঁড়ের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ নয়। অন্যদিকে আপস্তম্ভ ওই একই অধ্যায়েই মানুষকে পেঁয়াজ, রসুন, মাশরুম এবং মুরগি ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছিলেন।
প্রাচীন ভারতে প্রচলিত থাকা সংস্কৃত ভাষায়—‘গো-সঙ্খ্য’—বলে একটি প্রাচীন শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শব্দটির অর্থ হল—‘গো পরীক্ষক’। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, প্রাচীন ভারতে কেন গোরুকে পরীক্ষা করবার প্রয়োজন হত? কারণ, তখন কোন গোরু বা ষাঁড় বা বলদকে কর্তন করবার আগে সেটার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নেওয়া হত। অর্থাৎ—সেযুগে সব গোরুকে চোখ বুঝে ভক্ষণ করা যেত না; ভক্ষণযোগ্য গরু নিরোগ শরীরের হওয়াই বাঞ্চনীয় ছিল।
ডাঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রণীত ‘Beef in Ancient’ ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় লিখিত ‘জাতি গঠনে বাধা’ গ্রন্থ দুটি থেকে জানা যায় যে, বৌদ্ধযুগের আগে হিন্দুরা প্রচুর গোমাংস ভক্ষণ করতেন। উভয় গ্রন্থ থেকেই জানা যায় যে, বৌদ্ধযুগের আগে ভারতে গোহত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ মোটেই নিষিদ্ধ ছিল না। বরং তখন মধু ও গোমাংস না খাওয়ালে অতিথি আপ্যায়নই অপূর্ণ থেকে যেত। একারণেই সেযুগের অতিথির আরেকটি নাম ছিল—‘গোঘ্ন’। আবার রামপ্রসাদের গুরু কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তাঁর ‘বৃহৎতন্ত্রসার’ গ্রন্থে অষ্টবিধ মহামাংসের মধ্যে প্রথমেই গোমাংসের কথা উল্লেখ করেছিলেন বলে দেখা যায়। বৈদিকযুগের ভারতে প্রচলিত থাকা বিভিন্ন যজ্ঞে দেবতাদের উদ্দেশ্যে যে পশুবলি উৎসর্গ করা হত বলে প্রাচীন গ্রন্থগুলি থেকে জানা যায়, সেখানে অন্যান্য পশুদের সঙ্গে গোরুর কথাও অনেকবার উল্লেখ করা হয়েছিল বলে দেখা যায়। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৬৯নং সূক্তটির দেবতার নামই হচ্ছে—‘গাবঃ’। কিন্তু এখানেও একজায়গায় বলা হয়েছিল যে, গোরুরা দেবতাদের যজ্ঞের প্রয়োজনে নিজেদের শরীর সমর্পণ করে থাকে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলেরই ৮৬নং সূক্তে ইন্দ্র বড়াই করে নিজের স্ত্রী ইন্দ্রাণীকে বলেছিলেন—
‘আমি পনেরো বা বিশটি বৃষের মাংস একাই খেতে পারি।’
আবার অষ্টম মণ্ডলের ৪১নং সূক্তে ঋগ্বেদের আরেক মুখ্য দেবতা অগ্নিকে ঘিয়ের সঙ্গে যেসব মাংস আহুতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল বলে দেখা যায়, সেসবের মধ্যে—অশ্ব, ঋষভ (বলদ), উক্ষ (ষাঁড়), মেষ এবং ভশা—হল প্রধান। এই ভশা শব্দটি যে গোরু—এবিষয়ে কোনো সন্দেহ না থাকলেও, এই শব্দটি দিয়ে কোন ধরণের গোরুকে বোঝানো হয়েছিল, এনিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। অনেক পণ্ডিতের মতে ভশা হল—বন্ধ্যা বা দুগ্ধবতী নয় এমন গোরু। যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতায় অশ্বমেধ যজ্ঞের শেষে যেসব প্রাণীকে উৎসর্গ করবার কথা পাওয়া যায়, সেই তালিকায় গোরুও রয়েছে বলে দেখা যায়। এছাড়া যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণে রাজসূয় ও বাজপেয় যজ্ঞের অন্তর্গত—‘গোসভ’—নামের যে অংশটি পাওয়া যায়, সেখানেও একইকথা লেখা রয়েছে বলে দেখা যায়। তাছাড়া, সেযুগে প্রচলিত থাকা আরও অন্যান্য যজ্ঞের, যথা—অগ্নিষ্টোম, দর্শপূর্ণমাস, চতুর্মাস্য, সৌত্ৰামণি—যজ্ঞের ‘পশুবন্ধ’ অংশে গোরু বা বৃষ উৎসর্গ করবার উল্লেখ পাওয়া যায়। এসব ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, প্রাচীন ভারতে প্রচলিত থাকা বিভিন্ন যজ্ঞে অন্যান্য পশুর সঙ্গে ঘোড়া, গোরু, বলদ এবং ষাঁড়ের বলি দেওয়ার রীতিও প্রচলিত ছিল। তবে বৈদিকযুগে শুধুমাত্র যে যজ্ঞের উপলক্ষ্যেই গোমাংস ও অন্যান্য পশুমাংস খাওয়া প্রচলিত ছিল—তা কিন্তু নয়। প্রাচীন ভারতে ‘গবাময়ন’ নামের একটি সামাজিক অনুষ্ঠানও প্রচলিত ছিল, যে অনুষ্ঠানের শেষে মিত্রবরুণ ও অন্যান্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে বন্ধ্যা গোরু উৎসর্গ করা হত। এছাড়াও সেযুগে মধুপর্কের প্রচলন ছিল। তখন অতিথিরা কারো বাড়িতে গেলে তাঁদের অর্ঘ বা মধুপর্ক খেতে দেওয়ার নিয়মও প্রচলিত ছিল। অনেক পণ্ডিতের মতে প্রাচীনকালে মধুপর্কে দই-মধুর সঙ্গে গোমাংস দেওয়া হত। আপস্তম্ব, সাখ্যায়ণ, গোভিল, খাদির, পারস্কার, হিরণ্যকেশী প্রমুখ ঋষিদের রচিত গৃহ্যসূত্রে মধুপর্কে গোমাংসের স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। এমনকি সেযুগের শ্রাদ্ধে পিতৃপুরুষকে তৃপ্ত করতেও যে গোমাংস দেওয়া হত, একথার উল্লেখও প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে পাওয়া যায়। অতীতে গবেষক পাণ্ডুরঙ্গ কাণ তাঁর ‘History of Dharmasastra’ গ্রন্থে এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। বলি দেওয়া পশুটি যজ্ঞের পুরোহিতদের মধ্যে কাদের, কিভাবে ও কোন ভগ্নাংশে ভাগ করে দেওয়া হবে—এপ্রসঙ্গে ঐতরেয় ব্রাহ্মণের সপ্তম অধ্যায়ে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। তৈত্তিরীয় সংহিতাতে বলির পশুর শরীর কেমনভাবে কাটা হবে—এসম্পর্কে বিবরণ দেওয়া হয়েছে বলে দেখা যায়। অথর্ববেদের গোপথ ব্রাহ্মণে ‘সমিতার’, অর্থাৎ—সেযুগে যিনি পশু বলি দিতেন, তিনি কিভাবে ছত্রিশ ভাগে পশুটি কাটবেন, এই হিসাব দেওয়া হয়েছে বলে দেখা যায়। তখন যজ্ঞে যে পশু বলি বা উৎসর্গ করা হত, সেটাকে মানুষের খাদ্য হিসাবেও ব্যবহার করা হত। সেযুগে প্রচলিত থাকা যজ্ঞগুলিতে উৎসর্গকৃত পশু যে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হত, একথা শতপথ ব্রাহ্মণের তৃতীয় ও পঞ্চম খণ্ডে—“পশ্বে বৈ অনুম” এবং “অন্নম বৈ পশ্বঃ”—বলে উল্লেখ করা হয়েছিল বলে দেখা যায়। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের তৃতীয় অধ্যায়ের একটি শ্লোকে তো স্পষ্টভাবেই লেখা হয়েছিল—“অথো অন্নং বৈ গৌঃ।” অতএব গোমাংস তখন মানুষের খাদ্য বলেই বিবেচিত হত। এছাড়া শতপথ ব্রাহ্মণের তৃতীয় কাণ্ডে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য জানিয়েছিলে যে, তিনি—‘গোমাংস খেতে ভালোবাসেন, যদি সেটা অংসল (নরম) হয়।’
সুতরাং, প্রাচীন ভারতে যজ্ঞের মাংস যে ভক্ষণ করা হত এবং গোমাংস যে সেযুগের মানুষের কাছে খাদ্যবিশেষ ছিল, প্রাচীন শাস্ত্রগুলি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে এবিষয়ে আর কোনো প্রশ্নচিহ্ন থাকে না। বৃহদারণ্যক উপনিষদে তো স্পষ্টভাবেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে—কেউ যদি জ্ঞানী, সর্ববেদবিদ ও দীর্ঘ পরমায়ুযুক্ত সন্তান চান, তাহলে সেই দম্পতিকে ঘি দিয়ে বৃষমাংস রেঁধে খেতে হবে। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ থেকে—‘পঞ্চশারদীয় সেবা’—নামে সেযুগে প্রচলিত থাকা একটি ভোজন অনুষ্ঠানের কথা জানতে পারা যায়, যেটির বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তাতে—১৭টি পাঁচ বছরের কম বয়ষ্ক গোবৎস কেটে রান্না করে অতিথিদের পরিবেশন করা হত। ঋগ্বেদ সংহিতার ‘বিবাহসূক্ত’ অংশেও কন্যার বিবাহ উপলক্ষ্যে সমাগত অতিথি-অভ্যাগতদের গোমাংস পরিবেশন করবার জন্য একাধিক গোরু বলি দেওয়ার বিধান দেখতে পাওয়া যায়। (১০:৮৫:১৩) ধর্মশাস্ত্র ছাড়াও প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যেও গোমাংস ভক্ষণের কথা পাওয়া যায়। সাহিত্যকে একাধারে যেমন সমাজের দর্পণ বলা হয়ে থাকে, তেমনি সাহিত্যকে সমকালীন ইতিহাসের অঙ্গও বলা হয়। বাল্মীকির রামায়ণে রামচন্দ্রের যে খাদ্যতালিকার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়, তাতে তিন প্রকারের মদের (আসব) নাম উল্লেখ করা হয়েছে বলে দেখা যায়। যথা—(১) গৌড়ী: এটি গুড় থেকে তৈরি করা হত; (২) পৌষ্টি: এটি পিঠে পচিয়ে তৈরি করা হত; এবং (৩) মাধ্বী: এটি মধু থেকে তৈরি করা হত। তখন এইসব মদের সঙ্গে অনুপান হিসেবে শূলপক্ক গোবৎসের মাংস থাকত। প্রসঙ্গতঃ এখানে ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’ নাটকের চতুর্থ অঙ্ক থেকে বাল্মীকির দুই শিষ্যের মধ্যে একটি কথপোকথনের উল্লেখ করা যেতে পারে। তাতে দেখা যায় যে, একদিন বশিষ্ঠ ঋষি বাল্মীকির আশ্রমে যাওয়ার পরে বাল্মীকির এক শিষ্য অন্য একজন শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—‘এই দাড়িওয়ালা বুড়োটা কে রে, বাঘ নাকি? উনি এসেই মেটে রঙের বেচারা বাছুরটিকে খেয়ে ফেললেন।’ তখন অন্য শিষ্যটি তাঁর সতীর্থকে শাস্ত্র মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন—‘সমাংস মধুপর্ক দিয়ে অতিথি সৎকার করতে হয়, এটা ধর্মশাস্ত্রে লেখা রয়েছে।’
বরাহমিহিরের ‘ভরতসংহিতা’ গ্রন্থে বিভিন্ন পশুর মাংসের পাশাপাশি গোমাংসের উল্লেখও পাওয়া যায়। মহাভারতের বনপর্বে বলা হয়েছিল যে, রাজা রন্তিদেবের হেঁশেলে রোজ ২,০০০ গোরু রান্না করা হত। মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যের পূর্বমেঘ পর্বের ৪৬ নং শ্লোকে যক্ষ মেঘকে বলেছিলেন—‘গো-নিধনের রক্তে যিনি নদী বইয়েছিলেন, সেই রন্তিদেবকে তোমার যাত্রাপথে যোগ্য সম্মান দিও।’ এছাড়া প্রাচীন তামিল সাহিত্যের প্রায় দু’হাজার বছর পুরোনো সঙ্গম সাহিত্য—‘অকানানুরু’—নামক গ্রন্থের ২৪৯ ও ২৬৫ নং পদদুটিতে একদল দস্যুর মোটাসোটা বাছুরের মাংস খাওয়ার বিবরণ দেখতে পাওয়া যায়।
অতীতে ডঃ বি. আর. আম্বেদকর তাঁর ‘Why Did The Brahmins Give Up Beef-Eating’ গ্রন্থে বেদ-স্মৃতি-পুরাণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণরা প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে গোমাংস ভক্ষণ করতেন, আর এজন্যই তখন ব্রাহ্মণদের ‘গোঘ্ন’ বলা হত। গোঘ্ন শব্দের অর্থ হল—গোহত্যাকারী। তাঁর মতে—তখন কসাইকে গোমাংসের অংশ থেকে বঞ্চিত করবার জন্য ব্রাহ্মণরা নিজেরাই নিজেদের হাতে গোরু হত্যা করতেন। মহভারতের অনুশাসন পর্বের ৮৮তম অধ্যায়ে দেখা যায় যে, পিতামহ ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে এই উপদেশ দিয়েছিলেন যে—শ্রাদ্ধাদির কাজে অতিথিদের গোমাংস ভক্ষণ করালে পূর্বপুরুষরা একবছর তৃপ্ত থাকতে পারেন। এছাড়া মহাভারতে একথাও পাওয়া যায় যে, বিরাট রাজার গোশালায় প্রয়োজনে অজস্র গোহত্যা করা হত। আগেই বলা হয়েছে যে, বাল্মীকি রামায়ণে গোমাংসের সঙ্গে মদ্যপান করবার উল্লেখ পাওয়া যায়। একারণেই অতীতে হুইলার প্রমুখ সাহেবরা রামায়ণের যুগের ভারতে যে গোমাংস ভক্ষণের ব্যবস্থা ছিল, নিজেদের লেখায় একথা উল্লেখ করতে কোন দ্বিধা করেননি। তবে পৌরাণিকযুগের ভারতে গোমাংস ভক্ষণের প্রত্যক্ষ এবং বিস্তারিত প্রমাণ রামায়ণের তুলনায় মহাভারতে অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। দুটি উদাহরণ নিম্নরূপ—
- (১) “বশিষ্ঠ মুনি মদ্য ও গোমাংস প্রভৃতি দিয়া বিশ্বামিত্রকে তাঁহার সেনাগণের সহিত ভোজন করাইয়াছিলেন।”
- (২) “ভরদ্বাজ মুনি ভরতকে গোমাংসাদি দিয়া পরিতুষ্ট সহকারে ভোজন করাইয়াছিলেন এবং তৎকালে বিশ্বামিত্রের যজ্ঞে ব্রাহ্মণেরা দশ সহস্র গোভক্ষণ করিয়াছিলেন।”
বেদব্যাস বিরচিত মহাভারতের শান্তিপর্বে (১২:২৬৬) পাওয়া যায় যে, ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে জানিয়েছিলেন যে—রাজা বিচষ্য গো-মেধ যজ্ঞে একদিকে অসংখ্য গোরুর আর্তনাদ এবং ছিন্ন দেহ, আর অন্যদিকে ব্রাহ্মণদের নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করে অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন। মহর্ষি পাণিনি বিধান দিয়েছিলেন যে, বাড়িতে অতিথি এলে গো-মাংস দিয়ে যেন তাঁর আপ্যায়ন করা হয়। কৃষ্ণ যজুর্বেদের মৈত্ৰায়ণীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত মানবগৃহ্যসূত্রের ২৮ নং পৃষ্ঠায় স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছিল যে—‘বাড়িতে অতিথি এলে তাঁকে আপ্যায়ন করবার জন্য গোরুর মাংস দিতে হবে এবং তখন অতিথির সঙ্গে আরও চারজন ব্রাহ্মণকে গোমাংস ভোজনে আমন্ত্রণ জানানো গৃহস্থের কর্তব্য।’ গান্ধীজি তাঁর ‘হিন্দুধর্ম’ গ্রন্থে বলেছিলেন—“I know there are scholars who tell us that cow sacrifice is mentioned in the Vedas. … read a sentence in our Sanskrit text-book to the effect that Brahmins of old (period) used to eat beef.” (Hindu Dharma, M. K. Gandhi, New Delhi, 1991, p- 120) অর্থাৎ—‘আমি জানি কিছু সংখ্যক পণ্ডিত আমাদের বলেছেন যে, বেদে গো-উৎসর্গ করবার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমি আমাদের সংস্কৃত বইতে এইধরণের বাক্য পড়েছি যে, আগে ব্রাহ্মণরা গো-মাংস ভক্ষণ করতেন।’
বৃহদারণ্যকোপনিষদ গ্রন্থে বিধান দেওয়া হয়েছিল—‘কোনো ব্যক্তি যদি এমন পুত্র লাভে ইচ্ছুক হন, যে পুত্র প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও সভাসমিতিতে আদৃত, যাঁর বক্তব্য শ্ৰতিসুখকর, এবং যে সর্ববেদে পারদর্শী ও দীর্ঘায়ু হবে, তাহলে তিনি যেন বাছুর অথবা বড়ো বৃষের মাংসের সঙ্গে ঘি দিয়ে ভাত রান্না করে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে আহার করেন।’ (বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ৬/8/১৮) প্রাচীন ভারতে প্রচলিত থাকা বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রেও গো-মাংস ভক্ষণের সমর্থনে বক্তব্য পাওয়া যায়। যেমন—বশিষ্ঠস্মৃতি গ্রন্থে বলা হয়েছিল—‘ব্রাহ্মণ, রাজা, অভ্যাগতদের জন্য বড়ো ষাঁড় কিংবা বড়ো পাঁঠার মাংস রান্না করে আতিথেয়তা করাই বিধেয়।’ (বশিষ্ঠস্মৃতি, ৪/৮) অন্যদিকে মনু কোনো কোনো প্রাণীর মাংস খেতে নিষেধ করলেও, এই তালিকার মধ্যেও কিন্তু গোরুকে পাওয়া যায় না। কারণ, মনু বিশেষ বিধান ছাড়া কোন একক্ষুর বিশিষ্ট প্রাণীর মাংস ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছিলেন। (মনুস্মৃতি, ৫/১২) বলাই বাহুল্য যে, গোরু একক্ষুর বিশিষ্ট প্রাণীর মধ্যে পড়ে না। অন্যদিকে, মনু একথাও জানিয়েছিলেন যে—যেসব প্রাণীর শুধু একপাটি দাঁত রয়েছে, তাঁদের মাংস মানুষের জন্য ভক্ষণযোগ্য। (মনুস্মৃতি, ৫/১৮) এখানেই শেষ নয়, মনুস্মৃতি গ্রন্থে বলা হয়েছিল যে—অতিথিদের খেতে দেওয়ার জন্য, পোষ্যদের প্রতিপালন করবার জন্য, অথবা ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য প্রয়োজনে যে কোনো ধরণের মাংসই বিধিসম্মত। (মনুস্মৃতি, ৫/২২) চাণক্য বা কৌটিল্য তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে গোমাংস সম্পর্কে যেসব বিধানগুলি দিয়েছিলেন, সেগুলি নিম্নরূপ—
- (১) গোপালকেরা মাংসের জন্য ছাপ দেওয়া গোরুর মাংস কাঁচা অথবা শুকিয়ে বিক্রি করতে পারেন। (অর্থশাস্ত্র, ২/২৯/১২৯)
- (২) মাংসের জন্য ছাপ মারা গোরু ছাড়া অন্য কোনো শ্রেণীর গোরু হত্যা করা নিষিদ্ধ। (অর্থশাস্ত্র, ২/২৬/১২২)
- (৩) রাজ্যের গবাদি পশুর তত্ত্বাবধায়কের পদে একজন সরকারি কর্মচারী নিযুক্ত থাকবেন। তিনি গোরুদের ছাপ দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করবেন। যথা—দুগ্ধবতী গাভী, হালটানা বা গাড়িটানা বলদ, প্রজননের উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত ষাঁড় এবং মাংসের জোগানের জন্য অন্যান্য গোরুসমূহ। (অর্থশাস্ত্র ২/২৯/১২৯)
গোমাংস বিষয়ে প্রাচীন গৃহ্যসূত্রগুলির সুরও প্রায় একই বলেই দেখতে পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্গত গৃহ্যসূত্রগুলিতে গোরু বলি এবং গোমাংস ভক্ষণের বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বলে দেখা যায়। সেযুগের অধিকাংশ গৃহ্যসূত্রেই ব্রাহ্মণ, আচার্য, জামাই বা জামাতা, রাজা, স্নাতক, গৃহস্থের প্রিয় অতিথি, অথবা যে কোনো অতিথির জন্য মধুপর্ক অনুষ্ঠানের বিধান দেখতে পাওয়া যায়, আর সেইসব অনুষ্ঠানে তখন গোমাংস পরিবেশন করাই সাধারণ বিধান ও রীতি ছিল। বিভিন্ন প্রাচীন পুরাণেও গোরুর মাংস ভক্ষণ এবং সেই মাংস বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের পরিবেশন করবার স্পষ্ট নির্দেশ ও প্রশংসা দেখতে পাওয়া যায়। বিষ্ণুপুরাণে তো—গোরু, শূকর, গণ্ডার, ছাগ, ভেড়া প্রভৃতি বিভিন্ন পশুর মাংস খাইয়ে ব্রাহ্মণদের হবিষ্য করবার বিধান দিয়ে একইসঙ্গে কোন ধরণের মাংস ব্রাহ্মণদের ভক্ষণ করালে পিতৃপুরুষেরা কতদিন পর্যন্ত পরিতৃপ্ত থাকবেন—এসবের একটা পরিসংখ্যানও পাওয়া যায়। বিষ্ণুপুরাণ অনুসারে—ব্রাহ্মণদের গোমাংস খাইয়ে হবিষ্য করালে পিতৃগণ ১১ মাস পর্যন্ত তৃপ্ত থাকেন, আর তাঁদের এই তৃপ্ত থাকবার স্থায়িত্বকালই সবথেকে বেশি দীর্ঘ। (বিষ্ণুপুরাণ, ৩/১৬) প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত দুই আয়ুর্বেদাচার্য—চরক এবং সুশ্রুত তো গোরুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন বলে দেখা যায়। চরক বলেছিলেন যে—গোমাংস বাত, নাক ফোলা, জ্বর, শুকনো কাশি, অত্যাগ্নি (অতিরিক্ত ক্ষুধা বা গরম), কৃশতা প্রভৃতি অসুখের প্রতিকারে বিশেষ উপকারী। (চরকসংহিতা, ১/২৭/৭৯) অন্যদিকে সুশ্রুতও একই সুরে জানিয়েছিলেন যে—গোমাংস পবিত্র এবং ঠান্ডা বলে এটি হাঁপানি, সর্দিকাশি, দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, অতি ক্ষুধা এবং বায়ু বিভ্রাটের নিরাময় করে। (সুশ্রুতসংহিতা, ১/৪৬/৪৭) সুতরাং, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও শাস্ত্রগুলি বিশ্লেষণ করলে একথাই পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারা যায় যে, প্রাচীন ভারতে কোন একসময়ে ব্রাহ্মণ সমেত অন্যদের মধ্যে গোমাংস ভক্ষণ বেশ ভালোভাবেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু এরপরে যে প্রশ্নটা থেকে যায়, সেটা হল যে—হিন্দুদের কোন প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে বা আইনগ্রন্থে গোমাংস ভক্ষণ করাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা না হলেও, পরবর্তীসময়ে হিন্দুরা, বিশেষতঃ ব্রাহ্মণরা কেন গোমাংস ভক্ষণ করাকে পরিত্যাগ করেছিলেন?
ইতিহাস থেকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে প্রথমেই একথা জানবার প্রয়োজন রয়েছে যে, অতীতের কোন একসময়ে হিন্দুদের বিভিন্ন শ্রেণীর খাদ্যাভ্যাস তাঁদের গোষ্ঠী অনুসারে স্থিরীকৃত করা হয়েছিল। তখন হিন্দুদের গোষ্ঠীবিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের খাদ্যাভ্যাসও বদলে গিয়েছিল। একটি গোষ্ঠী হয়েছিল শিবভক্ত শৈব, এবং অন্যটি হয়েছিল বিষ্ণুভক্ত বৈষ্ণব। একটি গোষ্ঠী হয়েছিল মাংসাহারী আমিষভোজী এবং অন্যটি হয়েছিল শাকাহারী নিরামিষভোজী। আরেকটু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করলে মাংসাহারী আমিষভোজী গোষ্ঠীকে দুটি উপবিভাগে ভাগ করা যেতে পারে—
- (১) যাঁরা মাংস ভক্ষণ করলেও গোমাংস ভক্ষণ করে না; এবং
- (২) যাঁরা গোমাংসসহ সবধরণের মাংসই ভক্ষণ করে থাকেন।
অনুরূপভাবে প্রাচীন ভারতের হিন্দুসমাজকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
যথা—(১) ব্রাহ্মণ, (২) অ-ব্রাহ্মণ এবং (৩) অস্পৃশ্য।
অতীত থেকেই ব্রাহ্মণদের মধ্যে একটা শ্রেণী রয়েছেন যাঁরা পুরোপুরিভাবে নিরামিষভোজী। ভারতীয় ব্রাহ্মণদের সাধারণতঃ দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়ে থাকে, যথা—পঞ্চ দ্রাবিড় ও পঞ্চ গৌড়। পঞ্চ দ্রাবিড়েরা মূলতঃ নিরামিষভোজী হলেও পঞ্চ গৌড়রা কিন্তু পুরোপুরি আমিষভোজী। অন্যদিকে—অতীত থেকেই অব্রাহ্মণরা মাংসভোজী হলেও বর্তমানে তাঁদের মধ্যে সিংহভাগই গোমাংস ভক্ষণ করেন না। তবে তথাকথিত অস্পৃশ্যরা গোমাংসসহ সবধরণের মাংসই ভক্ষণ করে থাকেন, অতীতেও করতেন। এখন প্রশ্ন হল যে, অতীতে যাঁরা মাংসভোজী ছিলেন, তাঁরাও কেন গোমাংস ভক্ষণ করা ত্যাগ করেছিলেন? প্রাচীন ভারতে শুধু গোমাংস নয়, যে কোন ধরণের পশু মাংস ভক্ষণের উপরে বিধিনিষেধের ঐতিহাসিক প্রমাণ সর্বপ্রথম বৌদ্ধ-সম্রাট অশোকের বিধানে পাওয়া যায়। ভারতবর্ষের ইতিহাসের সাথে যাঁরা পরিচিত রয়েছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই জানেন যে—প্রাচীন ভারতে কোন একসময়ে হিন্দুধর্মের উপরে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। ঐতিহাসিকেরা বিভিন্ন স্তম্ভের ও পর্বতের গায়ে সম্রাট অশোকের ঘোষিত এমন নির্দেশও পেয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছিল
—‘এইসব নির্দেশ মহামান্য রাজার আদেশে লিখিত হয়েছে। রাজধানীর মধ্যে কেউ কোনো প্রাণীকে বলি দিতে পারবে না, বা কোনো পবিত্র ভোজ দিতে পারবে না। কারণ মহামান্য রাজার কাছে এসব আপত্তিকর।’
তবে কোন কোন ক্ষেত্রে মহামান্য রাজা অশোক এমনসব ভোজকে আপত্তিকর বলে মনে করতেন না, এসবের উল্লেখও তাঁর কয়েকটি নির্দেশে পাওয়া যায়। যেমন—
‘পূর্বে মহামান্য রাজার রসুই ঘরে হাজার হাজার প্রাণী রান্নার জন্য হত্যা করা হত। কিন্তু যখন এই পবিত্র নির্দেশ ঘোষিত হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল সারাদিনে কেবলমাত্র তিনটি প্রাণী খাদ্যের উদ্দেশে হত্যা করা যেতে পারে। যেমন—দুটি ময়ূর ও একটি হরিণ, অবশ্য যদি প্রয়োজন হয়। এখন থেকে এই তিনটি প্রাণীও হত্যা করা যাবে না।’
সম্রাট অশোক তাঁর দীর্ঘ রাজত্বকালে বিশেষ করে যেসব প্রাণীদের হত্যা ও ভক্ষণ করাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছিলেন, সেসবের একটা তালিকাও ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়। এই তালিকাভুক্ত প্রাণীগুলি ছিল—টিয়া পাখি, হরবোলা পাখি, হাড়গিলা পাখি, পাতিহাঁস, মণ্ডিমুখ, গেলটাস, বাদুড়, বড়ো পিঁপড়ে, মেয়ে কচ্ছপ, অস্থিহীন মাছ, বেদবেয়াক, গঙ্গাপুপুটক, শঙ্কর মাছ, নদী কচ্ছপ, সজারু, কাঠবিড়ালি, বড় শিংওয়ালা হরিণ, ষাঁড়, বানর, গণ্ডার, ঘুঘু, পায়রা, সব প্রজাতির চতুষ্পদ প্রাণী, ভেড়ী, গাভী ইত্যাদি। এছাড়া তিনি নিম্নের নির্দেশগুলিও দিয়েছিলেন—
(১) মোরগকে খাসি করা যাবে না। (২) জীবন্ত প্রাণীসহ ভূষি পোড়ানো চলবে না। (৩) জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে প্রাণী হত্যা করা যাবে না। (৪) কোনো প্রাণীকে দিয়ে অন্য কোনো প্রাণীকে হত্যা করা যাবে না। (৫) তিষ্যা মাসের পূর্ণিমা, প্রথম পক্ষের চতুর্দশ ও পঞ্চদশ দিবসে, দ্বিতীয় পক্ষের প্রথমদিনে মাছ ধরা বা বিক্রয় করা যাবে না। এইসব দিনে অন্য প্রাণীও হত্যা করা যাবে না। (৬) পক্ষের অষ্টম, চতুর্দশ ও পঞ্চদশ দিবসে এবং তিষ্য ও পুনর্বাসা দিবসে এবং উৎসবের দিনে ষাঁড়, পাঁঠা বা শূকরের মুণ্ড ছেদন করা যাবে না। (৭) তিষ্যা, পুনর্বাসা, পূর্ণিমার দিনে কোনো ঘোড়া এবং ষাঁড়কে গরম লৌহ বা জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ড দ্বারা দাগানো যাবে না।
অন্যদিকে মনু কিন্তু গোমাংস ভক্ষণের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি বলেই দেখা যায়। মনুসংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ের অষ্টাদশ শ্লোকে তিনি বলেছিলেন—
“শ্বাবিধং শল্যকং গোধাং খঙ্গকূর্মশশাংস্তথা।
ভক্ষ্যান্ পঞ্চনখেহুরনুষ্ঠাংশ্চৈকতোদতঃ॥”
অর্থাৎ—সজারু, গোসাপ, কচ্ছপ ও খরগোশ প্রভৃতি পঞ্চনখরবিশিষ্ট প্রাণীগুলিকে ভক্ষণ করা যেতে পারে। একইসাথে তিনি একথাও জানিয়েছিলেন যে, উষ্ট্র বা উট ছাড়া একপাটি দন্তবিশিষ্ট যেকোন গৃহপালিত প্রাণীর মাংস ভোজন করা যেতে পারে। বলাই বাহুল্য যে—গোরু, মোষ—এগুলো সবই একপাটি দন্তবিশিষ্ট প্রাণী। অতীতে আলোচ্য প্রসঙ্গে ডঃ বি. আর. আম্বেদকর বলেছিলেন—
“এই যে গোমাংস ভক্ষণ বন্ধ হল এবং গো-পুজো শুরু হল, এটা অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট অব্রাহ্মণদের দ্বারা উৎকৃষ্ট ব্রাহ্মণকে অনুকরণ ছাড়া আর কিছু নয়। … অব্রাহ্মণদের জীবনে একটা বিপ্লব ঘটে গেল। গোমাংস ত্যাগ করা একটা বিপ্লব বইকি। যদি অব্রাহ্মণরা একটা বিপ্লব করত, তবে ব্রাহ্মণরা দুটি বিপ্লব করতেন। একটি বিপ্লব হল গোমাংস ত্যাগ, দ্বিতীয়টি হল মাংস ত্যাগ করে একেবার নিরামিষাশী হয়ে যাওয়া।”
এরপরেই তিনি বলেছিলেন যে, অতীতে—
“ব্রাহ্মণরা ছিলেন সবথেকে বড়ো গোমাংস ভক্ষণকারী। অব্রাহ্মণরা তখন গোমাংস ভক্ষণ করলেও তাঁরা সবদিন গোমাংস পেতেন না। গোরু মূল্যবান সম্পদ ছিল এবং হত্যার জন্য গোরু পাওয়া অব্রাহ্মণদের পক্ষে সবসময় সম্ভব হত না। এটি তাঁদের পক্ষে তখনই সম্ভব হত যখন কোনো বিশেষ ধরণের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দেবদেবীর তুষ্টি সাধনার্থে তাঁরা গোরু উৎসর্গ করতে বাধ্য হতেন। কিন্তু ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে এটা অন্যরকম ছিলেন। তাঁরা পুরোহিত ছিলেন। সে সময়ে এত বেশি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হত যে, এমন কোনো দিন থাকত না যেদিন কোনো গোরু উৎসর্গের অনুষ্ঠান করা হত না। ব্রাহ্মণদের পক্ষে তখন প্রতিদিনই ছিল গোমাংস লাভের দিন। তাই ব্রাহ্মণরাই তখন সবথেকে অধিক গোমাংসভোজী ছিলেন। ব্রাহ্মণদের যজ্ঞ ছিল নিরীহ প্রাণীহত্যার একটা বাহানামাত্র। আসলে যজ্ঞ ব্রাহ্মণদের গোমাংসের ক্ষুধা মেটানোর একটা ধর্মীয় কলাকৌশলমাত্র ছিল।”
সেযুগে যে খুব নিষ্ঠুরভাবে হোতার নির্দেশে যজ্ঞের নামে গো-হত্যা করা হত, এই নিষ্ঠুর হত্যার বর্ণনা ঐতরেয়ব্রাহ্মণ গ্রন্থেই পাওয়া যায়। ঐতরেয়ব্রাহ্মণের বর্ণনা অনুসারে, প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণরা যে শুধু গোমাংস ভক্ষণ করতেন—সেটা কিন্তু নয়, একাজের জন্য তাঁরা নিজেরাই গো-হত্যা করতেন।
পশু হত্যা বা মাংসের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ সম্রাট অশোকের নিষেধাজ্ঞাকে যে ব্রাহ্মণরা মেনে নিয়েছিলেন বলে কোন ঐতিহাসিকই মনে করেন না। তবে মনুর কয়েকটি নির্দেশের জন্য ব্রাহ্মণরা শেষপর্যন্ত গোমাংস ভক্ষণ করা থেকে বিরত হয়েছিলেন বলে পণ্ডিতরা অনুমান করে থাকেন। যেমন—মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতির পঞ্চম অধ্যায়ের ৪৬নং শ্লোকে মনু বলেছিলেন
—‘যিনি প্রাণীদের বন্ধন ও বধের দ্বারা ক্লেশ দিতে চান না, তিনি সকলের হিতকামী, তিনি অনন্ত সুখ ভোগ করেন।’
৪৭নং শ্লোকে তিনি বলেছিলেন—
‘যিনি কাউকে হত্যা করেন না, তিনি যা কিছু ধ্যান করেন বা যা কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান করেন এবং যে বিষয়ে মনঃসংযোগ করেন, তাতেই সিদ্ধিলাভ করেন।’
৪৮নং শ্লোকে তিনি বলেছিলেন—
‘প্ৰাণীহত্যা না করে মাংস পাওয়া যায় না। প্রাণীহত্যা স্বর্গলাভের কারণ হতে পারে না। সুতরাং মাংসাহার ত্যাগ করো।’
৪৯নং শ্লোকে তিনি বলেছিলেন—
‘মাংসের উৎস প্রাণীবধ ও বন্ধন যন্ত্রণার কথা বিবেচনা করলে সকল প্রকার মাংস ভক্ষণ থেকে নিবৃত্ত থাকতে হয়।’
কিন্তু মনুর উপরোক্ত বক্তব্যগুলিকে তাঁর নির্দেশ না বলে উপদেশ বললেই উচিত ব্যাখ্যা করা হয়। উপদেশ মানা বা না মানাটা ঐচ্ছিক ব্যাপার, এটা কখনো বাধ্যতামূলক হতে পারে না। আবার মনু যে যজ্ঞে পশু উৎসর্গ করে সেই পশুর মাংস ভক্ষণ করবার বিরোধী ছিলেন না, একথার ঐতিহাসিক প্রমাণও তাঁর গ্রন্থেই পাওয়া যায়। যেমন—মনু তাঁর গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ের ২৮নং শ্লোকে বলেছিলেন—
‘পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে সবই প্রজাপতি জীবের অন্নস্বরূপ সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং স্থাবর-জঙ্গম সবই জীবের খাদ্য।’
২৯নং শ্লোকে তিনি আরও পরিষ্কার করে বলেছিলেন—
‘স্থাবর-জঙ্গম সবই জঙ্গমদের খাদ্য। দন্তহীন প্রাণী দন্তবান প্রাণীদের খাদ্য। হস্তহীন প্রাণীরা হস্তবান প্রাণীদের খাদ্য এবং ভীরু প্রাণীরা বলবান প্রাণীদের খাদ্য।’
৩০নং শ্লোকে তিনি জানিয়েছিলেন—
‘ভক্ষ্য জীবকে প্রত্যহ ভক্ষণ করলে ভোক্তার কোনো পাপ হয় না। কারণ ঈশ্বর কোনো কোনো প্রাণীকে ভোজ্য এবং কোনো কোনো প্রাণীকে ভোক্তা করে সৃষ্টি করেছেন।’
মনুসংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ের ৩১নং শ্লোকে তিনি বলেছিলেন—
‘যজ্ঞের প্রসাদস্বরূপ যে মাংস, সেটা বৈধ। আর প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে যে মাংস ভক্ষণ করে তাঁকে রাক্ষসাচার বলা যায়।’
৩৯নং শ্লোকে তিনি জানিয়েছিলেন—
‘যজ্ঞের নিমিত্ত ব্রহ্মা পশুদের সৃষ্টি করেছেন। সমগ্র বিশ্বের কল্যাণের জন্য যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সুতরাং যজ্ঞে পশুবধকে হত্যা বলা চলে না, বা সেকাজে কোনো পাপ হয় না।’
৪২নং শ্লোকে তিনি বলেছিলেন—
‘বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ কর্তৃক মধুপর্ক বা যজ্ঞ প্রভৃতি কার্যে যেসব প্রাণী বধ করা হয় তাতে নিজের এবং প্রাণীর উভয়েরই কল্যাণ সাধিত হয়।’
এখানেই শেষ নয়, মনু পরিষ্কারভাবেই জানিয়েছিলেন যে—
‘যজ্ঞ প্রভৃতি পবিত্র অনুষ্ঠানে যে ব্যক্তি মাংস ভক্ষণ করেন না, তিনি পরবর্তী সময়ে ২১ বার পশুরূপে জন্মগ্রহণ করবেন। (৫:৩৫)
সুতরাং—মনু তাঁর মনুসংহিতা গ্রন্থের কোথাও মাংস ভক্ষণ করাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছিলেন, এমন কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এমনকি মনুসংহিতার একাদশ অধ্যায়ের ৫৫নং শ্লোকে তিনি যেসব মহাপাপগুলির কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেগুলির মধ্যেও গোহত্যা পাওয়া যায় না। এই শ্লোকে তিনি জানিয়েছিলেন—
‘ব্রাহ্মণ হত্যা, সুরাপান, ব্রাহ্মণের স্বর্ণহরণ, গুরুপত্নী গমন এবং এইসব পাপে পাপীদের সংসর্গ হল মহাপাপ।’
এরপরে ৬০নং শ্লোকে তিনি গোহত্যাকে নিন্দাজনক বললেও, এটা কোন জঘন্য অপরাধ নয় জানিয়ে বলেছিলে—
‘গোহত্যা, অযাজ্য যাজন, পরস্ত্রীগমন, আত্মবিক্রয়, গুরু-পিতা-মাতা-পুত্র ত্যাগ, বেদ অধ্যায়ন না করা এবং অগ্নিত্যাগ—এগুলি লঘুপাপ।’
সুতরাং প্রাচীন ধর্মীয় শাস্ত্রগুলি থেকে ব্রাহ্মণ তথা হিন্দুদের গোমাংস ভক্ষণ না করবার পক্ষে কোনো ঐতিহাসিক সমর্থন পাওয়া যায় না। তাহলে পরবর্তীসময়ে হিন্দুসমাজে গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ হয়েছিল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ডঃ আম্বেদকর বলেছিলেন—
“দুটি ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। গোরুকে দেবতারূপে গণ্য করবার অন্যতম কারণ হল ‘অদ্বৈত দর্শন’। এই দর্শনে বলা হয়েছে যে, সমস্ত বিশ্বই পরমাত্মার প্রকাশ। ফলে সমস্ত প্রাণীর মধ্যেই তাঁর অস্তিত্ব বিদ্যমান। এই মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথমতঃ, এটার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। যে বেদান্তসূত্র সমস্ত প্রাণীকে এক বলে বর্ণনা করেছে, তা কিন্তু যজ্ঞের বলি হিসাবে প্রাণী হত্যা বন্ধ করতে বলেনি। দ্বিতীয়তঃ, যদি এই পরিবর্তন অদ্বৈত দর্শনকে উপলব্ধি করে হত, তাহলে শুধুমাত্র গোরুর ক্ষেত্রে নয়, তা সব প্রাণীর ক্ষেত্রেই কার্যকর হত। অন্য একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যা প্রথমটির চেয়ে অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। এটা হল আত্মার দেহান্তরের দর্শন। এই দর্শনটা ঘটনার সঙ্গে তেমন মেলে না। বৃহদারণ্যক উপনিষদ আত্মার দেহান্তর গ্রহণের দর্শনের প্রবক্তা। এতে বলা হয়েছে যে, যদি কেউ জ্ঞানীপুত্র লাভ করতে ইচ্ছুক হয়, তবে সে ষাঁড়ের মাংস চাল ও ঘি সহযোগে রান্না করবে। এই মতবাদটা যা উপনিষদে প্রচার করা হয়েছে তা ৪০০ বছর ধরে অর্থাৎ মনুস্মৃতি কার্যকরী হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ব্রাহ্মণ সমাজে কোনোধরণের প্রভাব ফেলতে পারেনি।”
অন্যদিকে স্বামী বিবেকানন্দ আবার প্রাচীন ভারতে গোহত্যা বা গোমাংস ভক্ষণ বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক কারণের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে জানিয়েছিলেন—
“কালক্রমে দেখা গেল যে আমরা যেহেতু কৃষিজীবী জাতি, অতএব সবচেয়ে ভালো ষাঁড়গুলিকে মেরে ফেলা জাতিকে হত্যা করারই সমার্থক। সুতরাং, এইসব প্রথা বন্ধ করা হল এবং গো-হত্যার বিরুদ্ধে একটি মত গড়ে উঠল”
তবে ঐতিহাসিকদের মতে, তখন এই আর্থিক কারণের সঙ্গে সম্ভবতঃ কিছু সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণও যুক্ত হয়েছিল। কারণ—প্রথমতঃ, ভারতের ইতিহাস অনুসারে প্রাচীন যুগের শেষভাগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্ম এবং অনেক ক্ষেত্রেই জৈনধর্ম ব্যাপকভাবে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছিল। বৌদ্ধধর্মে এবং জৈনধর্মে সবধরণের প্রাণীহত্যাকে নিষিদ্ধ এবং সর্বজীবে অহিংসাকে শ্রেষ্ঠ নীতি বলে গণ্য করবার কারণে তখন এবিষয়টি হিন্দুদের কাছে একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছিল, এবং এই চ্যালেঞ্জের ফলে সমগ্র হিন্দুদের সামনে অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ, তখন এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে গিয়ে তৎকালীন হিন্দুসমাজকে অনেকক্ষেত্রেই অনেক কিছুর সঙ্গেই আপস করতে হয়েছিল। বিবেকানন্দ বর্ণিত আর্থিক কারণের যুক্ত হয়ে এই সাংস্কৃতিক কারণও তখন সম্ভবতঃ গো-হত্যা এবং গো-মাংস ভক্ষণের উপরে নিষেধাজ্ঞায় শক্তি সঞ্চারিত করেছিল। এভাবেই গো-হত্যা এবং গো-মাংস ভক্ষণ বন্ধের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণগুলি ক্রমে ক্রমে দানা বেঁধে উঠে মিথ্যা ধর্মীয়তার আবরণে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। কালে কালে গোরু—গো-মাতা এবং তেত্রিশ কোটি দেবতার অধিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল এবং গোরুর মলমূত্র হিন্দুদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পবিত্র উপকরণে পরিণত হওয়ার ফলে হিন্দুসমাজে গোরুর গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছিল।
মহাভারত রচিত হওয়ার একেবারে শেষপর্যায়ের সময়কার ভারতে গোরুর একটা অর্থনৈতিক পুনর্মূল্যায়ন আরম্ভ হয়েছিল। একারণেই, আনুমানিক খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে মহাভারতে সংযোজিত অনুশাসনপর্বে সমকালীন অর্থব্যবস্থায় গোরুর বিশেষ গুরুত্বের নিরিখে একটি খাদ্যদ্রব্য হিসাবে সেটার মূল্যের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ধন বা ক্যাপিটাল হিসাবে অধিকতর মূল্যের স্বীকৃতির ঐতিহাসিক ইঙ্গিত দেখতে পাওয়া যায়। গবেষকদের মতে, এসময় থেকেই গোরুর বিশেষ অর্থনৈতিক উপযোগিতা এবং দীর্ঘমেয়াদি ধন হিসাবে এই জীবটির গুরুত্ব ক্রমে ক্রমে সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করতে শুরু করেছিল। এরপরে এই আর্থিক প্রয়োজনকে স্বীকার করে নিয়ে ধর্মীয় তত্ত্বের আধারে সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিল। কারণ—সাধারণ মানুষকে স্বর্গ বা নরকের লোভ বা ভয় না দেখালে সেযুগে গোরুর মত সহজলভ্য এবং পুষ্টিকর খাদ্যের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলাটা কিছুতেই সম্ভব হত না। এপ্রসঙ্গে ডঃ আম্বেদকর বলেছিলেন—
“আমার মনে হয় এটা একটা কৌশল ছিল, যেটার দ্বারা ব্রাহ্মণরা গোমাংস ত্যাগ করে একেবারে নিরামিষাশী হয়ে গিয়েছিলেন এবং গোরুর পুজো করতে আরম্ভ করে দিয়েছিলেন। গোরুকে পুজোর আসল রহস্য হল, ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্যে গোমাংস খাওয়া তো দূরের কথা, গোরুকে পুজো করতে আরম্ভ করেছিলেন। বৌদ্ধ মতবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের লড়াই ভারতের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। … ভারতে ৪০০ বছর ধরে এই দুটি মতবাদের মধ্যে প্রাধান্য লাভ করবার জন্য যে লড়াইটা চলেছিল সেটা সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতির যথেষ্ট পরিবর্তন করে দিয়েছিল। … একসময়ে বৌদ্ধ মতবাদ ভারতের বেশিরভাগ মানুষের ধর্ম ছিল। এটা শত শত বছর ধরে জনগণের ধর্ম হিসাবে ভারতে প্রচলিত ছিল। এটা ব্রাহ্মণ্যধর্মকে এমনভাবে আক্রমণ করেছিল, যা আগে কখনো ঘটেনি। ব্রাহ্মণ্যধর্ম তখন ব্যাপকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছিল এবং নিজের আত্মরক্ষা করবার জন্য এই ধর্মকে তখন সর্বশক্তি দিয়ে লড়তে হচ্ছিল। বৌদ্ধধর্মের দ্রুত প্রসারের ফলে ব্রাহ্মণ্যধর্ম তখন কি রাজসভায় কি জনসাধারণের কাছে—সর্বত্র মর্যাদাচ্যুত হয়ে পড়েছিল। পরাজয়ের তীব্র যন্ত্রণা তাঁরা প্রতিমুহূর্তে অনুভব করছিল। কিভাবে নিজেদের শক্তি ও মর্যাদা ফিরে পাওয়া সম্ভব, সেটার জন্য বিভিন্ন প্রকারের পথ খোঁজা শুরু হয়েছিল।”
এই পথ কেমন ছিল, একথা জানাতে গিয়ে ডাঃ আম্বেদকর বলেছিলেন—
“বুদ্ধের মৃত্যুর পরে তাঁর অনুগামীরা তাঁর মূর্তিস্থাপন ও স্তূপ তৈরি করতে আরম্ভ করেন। তখন ব্রাহ্মণরাও তাঁদের অনুসরণ করতে শুরু করলেন। তাঁরা মন্দির তৈরি করতে শুরু করলেন এবং সেগুলির মধ্যে শিব, বিষ্ণু, রাম ও কৃষ্ণের মূর্তি স্থাপন করতে থাকলেন। এইভাবে তাঁরা বৌদ্ধমূর্তির ভক্তদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করেছিলেন। এর আগে হিন্দুদের কোনো মন্দির বা দেবদেবীর মূর্তি ছিল না। বৌদ্ধদের অনুকরণে ব্রাহ্মণরা এগুলি করতে শুরু করেছিলেন। বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের যজ্ঞ এবং গোহত্যা পরিত্যাগ করেছিলেন। কারণ, গোরু সেযুগের জনগণের জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রাণী ছিল। ফলে তখনকার জনসাধারণ ব্রাহ্মণদের প্রবলভাবে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলেন। … ফলে বৌদ্ধধর্মের প্লাবন থেকে আত্মরক্ষা করবার জন্য ব্রাহ্মণরা শেষপর্যন্ত যজ্ঞ এবং গোহত্যা দুটি রীতিকেই সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেছিলেন। … ব্রাহ্মণদের গোমাংস খাওয়া বন্ধ করবার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সেযুগের সমাজে যে ধরণের সম্মান লাভ করেছিলেন, তাঁরাও যেন সেটা পেতে পারেন।”
সূত্র: ফেসবুক
######
0 Comments