বাংলার পাঠশালায় মুসলমান পড়ুয়া – রানা চক্রবর্তী

বাংলাদেশের মধ্যযুগীয় স্কুলের ছবি
বাংলাদেশের মধ্যযুগীয় স্কুলের ছবি, উৎস: অজানা
 

9 June 2025


বর্তমানে প্রায়শঃই একটা অভিযোগ করা হয় যে, অতীতে মুসলমান ঘরের সন্তানদের নাকি হিন্দু ঘরের সন্তানদের সাথে পাঠশালায় পঠন-পাঠন করতে দেওয়া হত না, বা মুসলমান ঘরের সন্তানরা পাঠশালায় যেতেন না। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, বাংলায় আধুনিক শিক্ষার যুগ শুরু হওয়ার আগে এদেশে পাঠশালা, টোল, মাদ্রাসা, মক্তব—এগুলিই মূল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। এসবের মধ্যে আবার টোল ও মক্তব তখন উচ্চ-শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ছিল। তবে এখনকার মত সেযুগে সর্বত্র এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। বস্তুতঃ খৃষ্টীয় সতেরো-আঠারো শতকের আগে বাংলায় রচিত কোন পুঁথিতেই মাদ্রসা তো দূরের কথা, তেমনভাবে পাঠশালার উল্লেখ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। অথচ খৃষ্টীয় সতেরো-আঠারো শতকে যেসব পুঁথি লিপি হয়েছিল, বা যেসব বাংলা কাব্য রচিত হয়েছিল, সেসবে পাঠশালার উল্লেখের কোন অভাব নেই বলেই দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি তখনকার বাংলার মুসলমান ঘরের ছেলেমেয়েরাও যে পাঠশালাতেই পড়তে যেতেন, একথার ঐতিহাসিক নজির—দৌলত উজির বাহরাম খাঁ বিরচিত ‘লায়লী-মজনু’ কাব্যেই পাওয়া যায়। দৌলত উজির তাঁর কাব্যের একজায়গায় লিখেছিলেন— 


“সেই উদ্যানে গিয়া কএস সুমতি।

গুরুপদ ভজিয়া পড়এ প্রতিনিধি॥

সুন্দর বালকগণ অতি সুরচিত।

একস্থানে সভানে পড় এ আনন্দিত॥

সেই পাঠশালাতে পড়এ কত বালা।

সুচরিতা সুললিতা নির্মূলা উজ্জলা॥

সে সব সুন্দরী মধ্যে এক অকুমারী

মর্ত্যেত নামিছে যেন স্বর্গ বিদ্যাধরী॥”


এই একই কাব্যের অন্য একটি পাঠে আবার—‘সেই উদ্যানে গিয়া কএস সুমতি’–এর জায়গায়—‘দে উদ্যানে চৌয়াড়িতে কএচ সুমতি’—পাওয়া যায়। অতীতে বাহরাম খাঁর ‘লায়লী-মজনু’ কাব্যের সম্পাদক ডঃ আহমদ শরীফ জানিয়েছিলেন যে, এই কাব্যের পুঁথিটি খুব সম্ভবতঃ ১৮২৯ সালে তৎকালীন বাংলার পেশাদার লিপিকার কালিদাস নন্দী লিপি করেছিলেন। অন্যদিকে যদিও ডঃ সুখময় মুখোপাধ্যায়—দৌলত উজির—মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে, অর্থাৎ—১৬৫৮ থেকে ১৭০৭ সালের মধ্যেই ‘লায়লী-মজনু’ কাব্যটি রচনা করেছিলেন বলে সিদ্ধান্ত করেছিলেন, কিন্তু তবুও ডঃ আহমদ শরীফ অবশ্য দাবি করেছিলেন যে, ১৫৪৩ থেকে ১৫৫৩ সালের মধ্যে এটি রচিত হয়েছিল। যদি ডঃ শরীফের দাবি ঠিক হয়, তাহলে একথাই বলতে হয় যে, শুধু সতেরো-আঠারো শতক থেকে নয়, এমনকি এর ঢের আগে থেকেই বাংলার মুসলমান ঘরের সন্তানরা পাঠশালায় শিক্ষালাভ করতেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ পাওয়া যায়।


যাই হোক, শুধু বাহরাম খাঁর কাব্য নয়, অতীতের বাংলার পাঠশালা শিক্ষায় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই যে যোগ দিতেন, এর স্বপক্ষে আরো অনেক প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। যেমন—‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থের লেখক সতীশচন্দ্র মিত্র তাঁর গ্রন্থের একজায়গায় জানিয়েছিলেন, অতীতে—


“পাঠশালায় পড়োগণ ‘সিদ্ধিরম্ভ’ বলিয়া পাঠ আরম্ভ করিত, এবং নামতা, শতকিয়া, কড়াকিয়া, গণ্ডাবুড়ির হিসাব, কাঠাকালি, বিষাকালি, মণকষা প্রভৃতি মুখে মুখে অভ্যাস করিত। পাঠান আমলের শেষ ভাগ হইতে মুসলমানেরা গুরুগিরিতে বিশেষ দক্ষ হইয়াছিলেন। তখন হিন্দুর বাড়িতেও মুসলমান গুরু রাখিবার প্রথা আরম্ভ হইয়াছিল। বুড়ন পরগণা নিবাসী পীরালি মুসলমান গুরুমহাশয়গণ বুড়ানীর খাঁ সাহেব নামে হিন্দুর পাঠশালায় শিক্ষকতা করিয়া ছাত্রবর্গের ভয় ভক্তি আকর্ষণ করিতেন।”


তবে পাঠান আমলের শেষভাগে না হলেও মুঘল আমলের বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সকলেই যে পাঠশালা শিক্ষায় অংশ নিতেন—এবিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন মতবিরোধ দেখতে পাওয়া যায় না। অতীতে এপ্রসঙ্গে ডঃ পঞ্চানন মণ্ডল লিখেছিলেন যে, তখনকার—


“পাঠশালায় বাঙ্গলা-শিক্ষা সাধারণত ব্রাহ্মণেতর জাতির ছেলেরাই গ্রহণ করিত। মুসলমান ছেলেরাও এই পাঠশালায় পড়িতে পাইত।”


একথার উদাহরণ দিতে গিয়ে ডঃ পঞ্চানন মণ্ডল তাঁর ‘চিঠিপত্রে সমাজচিত্র’ নামক গ্রন্থের একজায়গায় জানিয়েছিলেন—


“সেখ কালাচাঁদ সনাতন সরকারের পাঠশালায় নিজের দুই ছেলে সেখ ফজলু হোসেন ও তসুরখদ হোসেনকে ভর্তি করিবার উদ্দেশ্যে গুরুমহাশয়ের নিকট একরার-পত্র লিখিতেছেন।”


এরপরে তিনি জানিয়েছিলেন যে, আসলে এই পাঠশালার গুরু সনাতন সরকার ও সেখ কালাচাঁদের মধ্যে তখন একটি চুক্তি হয়েছিল যে, আট আনা মাস মাইনা মায় খোরপোষ বাবদ মোট ছাব্বিশ টাকার বিনিময়ে ১২৬৬ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাস থেকে ১২৬৭ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসের মধ্যে এই দুই ছেলেকে—


“পাটহরফ খাতাসোহী ও হিসাব নিকাশী কৰ্ম্মে তৈআর করিআ দিবো।”


তবে যদি—


“উক্ত ছাত্রদির্গেক ত্বআর না করিআ দিতে পারি তবে আপনার টাকা ফিরৎ দিবো।”


অবশ্য যদি—


“আপনার পুত্রুদীগর সাভালি করিআ কামাঞী করে এবং অন্ন কোন উজর হয় তবে আমি মহাসয়কে মোং কোলকাতা তক্ চিটা লিখিআ জানাইবো টাকার উপর আমার একরার ত্বক মাহীনে লৈইবো কিম্বে এই কর্মে আমার গাফিলি হয় তবে আমি এই চুক্তীর টাকায় বাদ দীব।”


গবেষকদের মতে, অতীতের বাংলার পাঠশালা শিক্ষায় মুসলমান ঘরের সন্তানদের অংশগ্রহণের এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক দলিল তো বটেই, একইসাথে তখনকার পাঠশালার গুরুমহাশয়ের দায়িত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যও বটে। কিন্তু তখনকার শিক্ষক ও অভিভাবকের মধ্যে এধরণের একটি চুক্তিপত্র দেখে—এযুগের মত সেযুগেও শিক্ষা যে একটা পণ্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিল—একথা ভাবা মোটেও ঠিক হবে না। তবে তখনকার পাঠশালা শিক্ষা যে আর প্রাচীনকালের গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বস্তুতঃ ইতিহাস থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, খুব সম্ভবতঃ বৌদ্ধ আমল থেকেই এদেশে বেতনের বিনিময়ে শিক্ষার প্রচলন ঘটে গিয়েছিল। আর মধ্যযুগের বাংলার পাঠশালা শিক্ষাও মূলতঃ পড়ুয়াদের বেতন বা সিধার উপরে নির্ভর করেই টিকে ছিল। তবে তখনকার বাংলার টোল-চতুষ্পাঠীগুলি কিন্তু প্রধানতঃ জমিদার বা ধনীদের দানের উপরেই নির্ভরশীল ছিল।


প্রসঙ্গতঃ একথাও স্মরণীয় যে, খৃষ্টীয় সতেরো-আঠারো শতকেই বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য মুসলমান কবিদের বাংলা কাব্যগুলি রচিত হয়েছিল। তাই সেযুগের বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বাংলা লেখাপড়ার প্রচলন না থাকলে এমন কিছু ঘটে যে সম্ভব হত না, একথা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। বস্তুতঃ দৌলত উজির ছাড়াও মধ্যযুগের বাংলার অন্যান্য মুসলমান কবিদের লেখা বাংলা কাব্যেও পাঠশালার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন—খৃষ্টীয় সতেরো শতকে সুকুর মামুদ তাঁর কাব্যে গোপীচন্দ্রের শিক্ষা সম্পর্কে লিখেছিলেন—


“প্রাতঃকালে স্নান করি হস্তে লইলাম খড়ি।

পড়িবার কারণে যাই দ্বিজ গুরুর বাড়ী॥

এই রূপে শাস্ত্র পড়ি গুরু পাঠশালে।

উদয় হইল গুরু আমার কপালে॥”


তাই সতেরো-আঠারো শতকে বাংলা পাঠশালা শিক্ষা যে পুরোপুরিভাব বিকাশলাভ এবং বেশ ভালো মতোই বিস্তারলাভ করতে পেরেছিল—এবিষয়ে গবেষকদের কোন সন্দেহ নেই। এমনকি এরপরে খৃষ্টীয় আঠারো-ঊনিশ শতকে লেখা ও তখনকার পাঠশালায় পড়ানো হত—এমন অনেক বিষয়ের পুঁথির সন্ধানও ঐতিহাসিকেরা পেয়েছেন।


সূত্র: ফেসবুক

Post a Comment

0 Comments