সাধারণ মানুষ যেমন ধরণের বানর ও হনুমানের সাথে পরিচিত, রামায়ণ মহাকাব্যে বর্ণিত বাঁদর বা হনুমানের সাথে তাদের কোন মিল দেখতে পাওয়া যায় না। সাধারণভাবে বাঁদর, হনুমান, শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং ইত্যাদি সবই বানর জাতীয় জীব হলেও, কখনোই একধরণের জীব নয়। বরং প্রত্যেকটি বাঁদর জাতীয় জীবের মধ্যে আকৃতি, চারিত্রিক ও শারীরিক পার্থক্য রয়েছে। এমনকি এসব জীবের সব ক’টির বুদ্ধিমত্তাও এক নয়। কথাতেই বলে— মুখপোড়া হনুমান আর লালমুখো বাঁদর। যাই হোক, রামায়ণে একাধিক উল্লেখযোগ্য বানর চরিত্র থাকলেও, তাঁদের মধ্যে— বালী ও সুগ্রীব হলেন প্রধান। বিভিন্ন পৌরাণিক গ্রন্থে বিশ্বকর্মাকেও বানর জাতীয় বলা হয়েছিল বলে দেখা যায়। সেই সূত্র ধরেই রামায়ণে বিশ্বকর্মার— নল —নামের এক পুত্রের সন্ধান পাওয়া যায়, যিনি আবার স্থাপত্যবিদ্যার কাজে বেশ দক্ষ ছিলেন। লক্ষ্যণীয় যে, এঁদের সবাইকে রামায়ণে কিন্তু ‘বানর’ বলেই পরিচয় দেওয়া হয়েছে; কোথাও বলা হয়নি যে— এঁরা বাঁদর। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, রামায়ণের বানর কি আদতে শাখামৃগর সাথে, অর্থাৎ— যে বাঁদরের সাথে মানুষ পরিচিত, সেই বাঁদরের সাথে কি অভিন্ন? রামায়ণে এই বানরের যে শারীরিক পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে তাঁদের অর্ধ-মানব অর্ধ-পশু গোছের কিছু একটা মনে হয়; তাঁদের মুখের গড়ন মানুষের মত নয়। তাঁদের ল্যাজ রয়েছে। যদিও তাঁরা মানুষের মতোই কথা বলতেন বলে দেখা যায়; শুধু কথা বলা কেন, বুদ্ধিমত্তায় এবং কাজেকর্মে তাঁরা মানুষের থেকে কোন অংশে কম কিছু ছিলেন না বলেই দেখা যায়। রামায়ণ নিয়ে গবেষণা করা অনেকেই এই বানরদের আদিম মানুষের একধরণের প্রজাতি বলে চিহ্নিত করেছিলেন বলেই দেখা যায়। তাঁদের এই তত্ত্বকে কিন্তু পুরোপুরিভাবে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ— প্রাচীন ভারতে নানা জাতি প্রজাতির মানুষ বসবাস করতেন, তাঁদের দেখতে আলাদা ছিল, তাঁদের আকৃতিও আলাদা ছিল। এমনকি এযুগেও ভারতের সর্বত্র বাস করা মানুষের শারীরিক ও মুখের গড়ন এক নয়। সুতরাং, এটা হওয়া অসম্ভব নয় যে, প্রাচীনযুগের ভারতে এমনতর কোন মনুষ্য জাতি থাকলেও পরে হয়ত সেটা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। হয়ত তাঁরা মানুষের মতোই ছিল, হয়ত তাঁদের ল্যাজ ছিল না, কিন্তু মুখের গড়ন ও শারীরিক বৈশিষ্ট্য আলাদা হওয়ার কারণে তাঁদের শাখামৃগের মত করেই কল্পনা করা হয়েছিল।
তবে বিভিন্ন পুরাণশাস্ত্রাদি ঘেঁটে এই বানর সম্পর্কে যে কথা জানা যায়, সেটা হল যে— অতীতে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলের সুন্দরী অপ্সরা এবং দাক্ষিণাত্যের সুন্দরী নারীদের সঙ্গে দেবসম্প্রদায়ের পুরুষদের অবাধ যৌনমিলনের ফলেই দেব-ঔরসজাত বানর জাতীয়রা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এর ফলে আর্য-অনার্য সংমিশ্রণে সৃষ্ট এইসব বানরপ্রজাতিরা বিভিন্ন দেহবর্ণ লাভ করেছিলেন। এই কারণেই, রামায়ণের বর্ণনা অনুসারে সুগ্রীব ও অন্যান্য বানরদের গায়ের রং হেমপিঙ্গল ছিল বলে জানা যায়। অবশ্য জিনগত কারণে কিছু বানর কৃষ্ণবর্ণেরও ছিলেন। বাল্মীকি তাঁর রচিত রামায়ণে ১০৮০ বার ‘বানর’ শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন বলে দেখা যায়। এছাড়া সমগ্র রামায়ণে তিনি ৪২০ বার বানরদের— ‘কপি’ —বলে এবং ৫৪০ বার— ‘হরি’ —বলে সম্বোধন করেছিলেন। ছদ্মবেশ ধারণে পটু হওয়ার কারণে রামায়ণে বানরদের ‘কামরূপীন’ও বলা হয়েছিল। রামায়ণের যুগে— হেমপিঙ্গল ও কৃষ্ণকায় —এই দুই রঙেরই বানর ছিলেন। কৃষ্ণকায় বানরদের বাল্মীকি— ‘গোলাঙ্গুলা’ —বলেছিলেন। রামায়ণের বিশ্লেষকদের মতে— আর্যদেবতাদের আনুকূল্যেই আর্য-অনার্য মিশ্রণে বানরদের জন্ম হয়েছিল। রামায়ণে এপ্রসঙ্গে বলা হয়েছিল যে, রাবণের সঙ্গে রামচন্দ্রের যুদ্ধের কাজে লাগানোর জন্যই ব্রহ্মা বানরদের নিয়ে সহায়ক বাহিনী তৈরি করেছিলেন। রামায়ণে উল্লেখিত বানরেরা কিন্তু কখনোই শাখামৃগ ছিলেন না। গবেষকদের মতে, এঁরা আসলে প্রাচীন ভারতের টোটেমীয় বানর সম্প্রদায় ছিলেন।
এখানে কিছু আগে, রামায়ণের বানরদের সৃষ্টির পিছনে যে আর্য-অনার্য মিলনের কথা বলা হয়েছে, মনুসংহিতার সাক্ষ্য থেকেও একথার প্রমাণ পাওয়া যায়। মনুসংহিতাতেও এইধরণের বিচিত্র যৌনসম্পর্কের ফলে সন্তান জন্মের উল্লেখ রয়েছে বলে দেখা যায়। মনু তাঁর গ্রন্থে এইধরণের প্রচুর উদাহরণ দিয়েছিলেন ও সেগুলির বিভিন্ন নামকরণও করেছিলেন। যেমন—
- চণ্ডাল পুরুষের সঙ্গে নিষাদ স্ত্রীর যৌনমিলনের ফলে সন্তানকে তিনি বলেছিলেন— ‘অন্ত্যাবসায়ী’;
- বৈদেহক ও কারাবরের মিলনজাত সন্তানকে বলেছিলেন— ‘অন্ধ্র’;
- ব্রাহ্মণ পুরুষ ও বৈশ্য স্ত্রীর মিলনজাত সন্তানকে বলেছিলেন— ‘অন্বষ্ঠ’;
- ব্রাহ্মণ পুরুষ ও অম্বষ্ঠ স্ত্রীর মিলনজাত সন্তানকে বলেছিলেন— ‘আভীর’;
- শূদ্র ও বৈশ্যার সন্তানকে বলেছিলেন— ‘আয়োগব’;
- ব্রাত্য ব্রাহ্মণ ও সবর্ণা স্ত্রীর সন্তানকে বলেছিলেন— ‘আবষ্য’;
- ব্রাহ্মণ পুরুষ ও উগ্র স্ত্রীর সন্তানকে বলেছিলেন— ‘আবৃত’;
- ক্ষত্রিয় পুরুষ ও শূদ্রার সন্তানকে বলেছিলেন— ‘উগ্র’;
- শূদ্র পুরুষ ও ক্ষত্রিয় স্ত্রীর সন্তানকে বলেছিলেন— ‘ক্ষত্তা’;
- চুচুক পুরুষ ও ব্রাহ্মণ স্ত্রীর সন্তানকে বলেছিলেন— ‘তক্ষক’ ইত্যাদি।
তাই অনুরূপভাবে আর্য পুরুষ ও অনার্য স্ত্রীর অথবা অনার্য পুরুষ ও আর্য স্ত্রীর মিলনজাত সন্তানকে বাল্মীকি ‘বানর’ বললে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। এতেও বোঝা যায় যে, রামায়ণের বানরেরা এযুগের মানুষের পরিচিত শাখামৃগ ছিলেন না। বিশ্লেষকদের মতে আর্যরাই আসলে তাঁদের ‘বানর’ নামকরণ করেছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, পুরাণ অনুসারে দেবতাদের প্রখ্যাত স্থপতি বিশ্বকর্মা কিন্তু বানর জাতির কৃতিপুরুষ। কেউ কেউ আবার বলেন যে, অনার্যদের (প্রাচীন শাস্ত্রে ও পুরাণে যাঁদের রাক্ষস, দানব ইত্যাদি বলা হয়েছে) স্থপতি ময়দানবও নাকি বিশ্বকর্মারই পুত্র। তাহলে বিশ্বকর্মার দু’জন পুত্র; তাঁরা হলেন— ময়দানব ও নল। বিশ্বকর্মার মত তাঁরা দু’জনেই স্বনামধন্য স্থপতি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে অনার্য বানর প্রজাতির বিশ্বকর্মা যেমন আর্যদের কুক্ষিগত হয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনভাবেই অনার্য পশুপতিও আর্যদের কৈলাশপতি হয়ে গিয়েছিলেন।
রামায়ণে বানর জাতির বাসস্থানের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাল্মীকি বলেছিলেন—
“অন্যে ঋক্ষবতঃ প্রস্থানুপতস্তুঃ সহস্রশঃ।
অন্যে নানাবিধাচ্ছৈলান্ কাননানি চ ভেজিরে।”
অর্থাৎ— বহু সহস্র বানর ঋক্ষবা পর্বতের উপত্যকায় বসবাস করতে শুরু করলেন, এবং বাকিরা নানা পর্বতে ও কাননে আশ্রয় নিলেন। এই ঋক্ষবান পর্বত কোন কল্পিত জায়গা নয়, গবেষকদের মতে এটা হল তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে অবস্থিত বিন্ধ্য পর্বতমালার পশ্চিমাংশ।
রামায়ণে বানরজাতির স্বতন্ত্র গোষ্ঠী ও গোষ্ঠীপতিদের পরিচয়ও পাওয়া যায়। বাল্মীকি লিখেছিলেন—
“সূর্যপুত্রং চ সুগ্রীবং শত্রুপক্ষং চ বালিনম্।
ভ্রাতরাবুপতস্তুস্তে সর্বে চ হরিযুথপাঃ।
নলং নীলং হনুমন্তমন্যাংচ হরিযুথপান্।”
এবারে হনুমানের প্রসঙ্গে আসা যাক। গবেষকদের মতে— হনুমান নামটি এসেছে হনু (চোয়াল) এবং মান (বিশিষ্ট বা কদাকার) শব্দদ্বয় থেকে; অর্থাৎ— হনুমান শব্দটির প্রকৃত অর্থ হল— কদাকার চোয়ালবিশিষ্ট। আবার অন্য একটি সূত্র অনুসারে, হনুমান নামটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘হন’ (হত্যা) এবং ‘মানা’ (গ) থেকে; অর্থাৎ— যাঁর গর্ব হত হয়েছে। রামায়ণে উল্লেখিত রামের সহযোদ্ধারা সকলেই বানর হলেও সেখানে ভাল্লুক জাম্ববান এবং হনুমানের কথাও রয়েছে। ইনি হলেন বীর হনুমান, যিনি বজরংবলি নাম খ্যাত। ইনি সর্বশাস্ত্রবিদ, রাজনীতিজ্ঞ ও রণনিপুণ ছিলেন। ১৯১১ সালে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক এফ. ই. পাজ্জিটার হনুমানের আসল পরিচয় খুঁজতে গিয়ে দেখেছিলেন যে— ঋগ্বেদের বৃষাকপি ও রামায়ণের হনুমন্ত (হনুমান)— উভয়েই গোদাবরী নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। হনুমান যে আদতে দাক্ষিণাত্যের মানুষ ছিলেন, বর্তমানে গবেষক মহলে সেকথা সুস্বীকৃত; এবং ঋগ্বেদের বৃষাকপিও যে সেই একই দেশের ব্যক্তি ছিলেন— সেকথাও গবেষক মহলে সুসংগতভাবে অনুমতি। অধিকাংশ গবেষকই মনে করেন যে, এই দু’জনের মধ্যে কোনো একটা সংশ্রব রয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, আজও গোদাবরী তীরে বৃষাকপি তীর্থ রয়েছে আর হনুমানের কৃপাতেই সেই জায়গা তীর্থরূপে গণ্য হয়েছে। বৃষাকপি একটি নামবাচক শব্দ হলেও— বৃষ ও কপি —এই শব্দ দুটি থেকেই এটির উৎপত্তি হয়েছে। শুধু শব্দার্থের দিক থেকে বৃষকপির অর্থ হয়— পুরুষ বানর। কিন্তু বৃষাকপিকে যদি দাক্ষিণাত্যবাসী বলা যায়, তাহলে এই যৌগিক শব্দটি কোনো দুটি দ্রাবিড়ীয় শব্দের সংস্কৃতানুবাদ— হনুমান —হয়ে দাঁড়ায়। বৃষকপি যেহেতু দাক্ষিণাত্যবাসী ছিলেন, তাহলে— হনুমান —এই সংস্কৃত নামটিও কোনো দ্রাবিড়ীয় নামের সংস্কৃতানুবাদ হওয়া সম্ভব। সংস্কৃত ‘হনুমান’ শব্দের অর্থ হল— হনু-বিশিষ্ট। কিন্তু এমন অর্থ দিয়ে শব্দটিকে আসলে সংস্কৃত শব্দ বলে বোঝাই যায় না। কিন্তু রামায়ণের কাহিনী অনুসারে এটি মূলতঃ কোনো দ্রাবিড়ীয় শব্দের সংস্কৃতরূপও যে হতে পারে, একথা অনুমান করা যেতে পারে। রামায়ণে কিষ্কিন্ধ্যাকে হনুমান ও বানরদের দেশ বলা হয়েছে। গবেষকদের মতে অতীতে এই অঞ্চলটি গোদাবরীর দক্ষিণ-পশ্চিমে কিছুটা দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এবং বর্তমানে এই জায়গাটি কর্ণাটি ভাষার দেশের দক্ষিণে এবং তামিল ভাষার দেশের উত্তরে অবস্থিত বলে দেখা যায়। অতএব উক্ত দুই ভাষা থেকেও এই নামের উৎপত্তির মূল পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয়।
সংস্কৃত ‘বৃষা’ শব্দের অর্থ হল— পুরুষ, দ্রাবিড়ীয় ভাষায় সাধারণতঃ ‘আণ’ শব্দের সঙ্গে এটির মিল পাওয়া যায়। এছাড়া কর্ণাটী, তামিল ও মালয় ভাষাতেও এই ‘আণ’ শব্দটি রয়েছে। তবে তেলগু ভাষায় এই শব্দটির পরিবর্তে ‘মগ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ‘আণ’ শব্দটি অন্য শব্দের আগে বসে সেটার পুংলিঙ্গকে নির্দেশ করে। কর্ণাটী, তামিল, তেলগু ও মালয় ভাষায় ‘কপি’–বাচক দুটি শব্দ দেখা যায়; যথা— কুরঙ্গু ও মণ্ডি। এগুলির মধ্যে শুধুমাত্র তামিল ভাষায় কুরুঙ্গু শব্দের মাধ্যমে কপি বোঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু অন্য তিন ভাষায় এটার অর্থ হল— হরিণ। আবার মালয় ভাষায় কুরুঙ্গু শব্দের দ্বারা হরিণ ও কুরম্ন শব্দের দ্বারা বানরকে বোঝানো হয়ে থাকে। তামিল ভাষায় মণ্ডি শব্দের দ্বারা বানর, বিশেষতঃ বানরীকে বোঝানো হয়। অন্যদিকে মালয় ভাষায় আবার কৃষ্ণমুখ বানরকে বোঝানোর জন্য মণ্ডি শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কর্ণাটীতে মানুষ বা ব্যক্তিকে বোঝানোর জন্য মণ্ডি শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তেলগুতে এটি কোন একক শব্দ নয়, এখানে অন্য শব্দযোগে মণ্ডি শব্দের অর্থে ব্যক্তিকে বোঝানো হয়ে থাকে। কর্ণাটী ও তেলগুতে— কোটি ও তিস্মা —শব্দের দ্বারা বানর বোঝানো হলেও, তামিল ও মালয় ভাষায় এর কোন সমশব্দ নেই। অতএব দ্রাবিড়ীয় ভাষায় বানরার্থ— মণ্ডি —শব্দটিই সবথেকে প্রাচীন শব্দ বলে বোধ হয়। অতীতে এই সমস্ত সাদৃশ্য উপস্থাপন করে পুরাতাত্ত্বিক পাজ্জিটার জানিয়েছিলেন যে— যদি এসব কথা গ্রহণীর হয়, তাহলে— ‘আণ মণ্ডি’ —শব্দটি বৃষাকপি শব্দবোধক হতে পারে। তিনি আরো জানিয়েছিলেন যে, আণমণ্ডির শব্দার্থ করে সেটার সংস্কৃতানুবাদ বৃষাকপি হওয়া সম্ভব। তারপরে আণমণ্ডি–কে সংস্কৃত করে নিলে সহজেই সেটা হনুমান হয়ে যায়। কারণ— সুদূর অতীতে আর্যরা যখনই কোন দ্রাবিড়ীয় শব্দকে সংস্কৃত করে নিয়েছিলেন, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা সংস্কৃত শব্দটির মধ্যে ‘হ’ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবেই আণমণ্ডি→ অনমন্ত→ হনুমন্ত হয়েছে। এরপরে নিজের অনুমানের উপরে ভিত্তি করে পাজ্জিটার জানিয়েছিলেন যে— বৃষাকপি→ আণমণ্ডি→ হনুমন্ত যদি ঠিক হয়, তাহলে একথা বলতে হয় যে, ঋগ্বেদের আগেই দাক্ষিণাত্যে এর বিস্তৃতি ঘটেছিল। বস্তুতঃ, ঐতিহাসিকদের মতে বানরপুজো কিন্তু আসলে দাক্ষিণাত্যের সম্পত্তি এবং সেখানকার সমস্ত দেশেই ঋগ্বেদ সংগ্রহের আগেই বানর স্তুতিমন্ত্র রচিত হয়ে গিয়েছিল।
বিভিন্ন পুরাণ ও রামায়ণের বিভিন্ন সংস্করণে হনুমানকে নিয়ে প্রচুর অলৌকিক কাহিনী দেখতে পাওয়া যায়। সেগুলোর বেশিরভাগই ইতিহাসের দিক থেকে গ্রাহ্য নয়। তবে সবই যে অবাস্তব, সেকথাও বলা চলে না। হনুমানের সাথে জড়িত কিছু কিছু কাহিনীতে বাস্তবতাও রয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, হনুমানের জন্ম নিয়ে চারটি ভিন্ন পৌরাণিক গল্পের সন্ধান পাওয়া যায়। সেগুলোর মধ্যে কোনোটায় তিনি পবন বা বায়ুর ঔরসজাত হলেও, কোনো গল্পে তিনি আবার শিবের ঔরসজাত। বস্তুতঃ হনুমানের জন্মের পিছনে শিবের দাঁড়িপাল্লাই বেশি ভারী বলে দেখা যায়। তাহলে হনুমানকে কি বানর বলা চলে? কারণ, সেক্ষেত্রে তিনি বানর হলে ভীমকেও সেটাই হতে হয়; তিনিও পবনপুত্র। কিন্তু ভীম যে বানর ছিলেন, এমন কথা কোথাও পাওয়া যায় না। তবে হনুমানের জন্মকাহিনীতে যতই ভিন্নতা থাকুক না কেন, তাঁর পিতা পৃথক পৃথক হলেও মা কিন্তু একই ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল নাম অঞ্জনা, তিনি কেশরীর স্ত্রী ছিলেন। বিভিন্ন গ্রন্থে হনুমানকে অনেকক্ষেত্রে ‘কেশরীনন্দন’ বলা হলেও তিনি কিন্তু আদৌ কেশরীর ঔরসজাত সন্তান ছিলেন না। কিন্তু, একইসাথে যে প্রশ্নটা এখানে খোঁচা মেরে যায়, সেটা হল যে— হনুমানের জন্মের সাথে যে শিবের সম্বন্ধে দেখা যায়, সেই শিব কে ছিলেন? একই ব্যক্তি, নাকি পৃথক কেউ? অনার্য পশুপতি শিব? নাকি কৈলাশপতি শিব? পশুপতি শিব আর কৈলাশপতি শিব কি এক ব্যক্তি ছিলেন? এপ্রসঙ্গে অতীতে প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র মিত্র বলেছিলে—
“শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, ইন্দ্র ইত্যাদি দেবপ্রধানদের পদবিমাত্র ছিল। এক দেবতার উত্তরাধিকারী গদিপ্রাপ্ত পরবর্তী দেবতাও ওই পদবি দ্বারা পরিচিত হতেন। শিবকে শাসন করতে হত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল এবং হিমালয়ের বেশিতম প্রদেশগুলি। কোনো মানুষের পক্ষেই এত বড়ো সাম্রাজ্য একা শাসন করা সম্ভব ছিল না। শিবের প্রতিনিধি শাসক বা দেবতা থাকতেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং তাঁরাও ‘শিব’ উপাধি দ্বারাই পরিচিত ছিলেন।”
রামায়ণে বলা হয়েছে যে, হনুমান গন্ধমাধন পর্বত উৎপাটন করেছিলেন। এই গল্পটা নিঃসন্দেহে কাল্পনিক, কিন্তু গন্ধমাদন পর্বত কাল্পনিক নয়। গন্ধমাদন পর্বত ছিল সেই জায়গা, যেখানে উদ্ভিদ থেকে নির্গত গন্ধ সমস্ত অঞ্চলকে সুবাসিত করে রাখত; এটা একটা ঔষধি পর্বত ছিল। এখানে গন্ধ + মাদন, অর্থাৎ— যা গন্ধে মাদয়িত (মত্ত) করে। মহাকবি বাল্মীকি এই পর্বতকে ঔষধি পর্বত বলেছিলেন। তাঁর বর্ণনানুসারে এই পর্বতাঞ্চলে যেসব ঔষধি বৃক্ষলতা পাওয়া যেত, সেগুলি ছিল—
- (১) মৃতসঞ্জীবনী (যা মৃতপ্রায় ব্যক্তিকে পুনর্জীবন দান করে),
- (২) বিশল্যকরণী (যা শরীর থেকে ক্লেদ, কালিমা, টক্সিন দূর করে),
- (৩) সুবর্ণকরণী (যা দেহকে স্বাস্থ্যজ্জ্বল ও লাবণ্যময় করে), এবং
- (৪) সন্ধানকরণী (যা ভগ্ন অস্থিকে সংযুক্ত করে)।
এসব ভেষজ আজও ভারতে পাওয়া যায়, এগুলোর কোনোটাই কাল্পনিক নয়। অন্যদিকে অভিধান মতে গন্ধমাদন শব্দের অর্থ হল— গন্ধক (Sulphur), এবং পর্বত শব্দের অপর একটি অর্থ হল— একধরণের শাক বা উদ্ভিদ। ওই সময়ে বিশল্যকরণী, গন্ধক এবং শাকবিশেষের সংমিশ্রণে যে ওষুধ তৈরি করা হত, সেটা ক্ষতরোগের মহৌষধি বলে বিখ্যাত ছিল। কারো মতে হিমালয় সন্নিহিত আলপাইন সদৃশ অরণ্য এবং কৈলাস ও স্বর্ণাভ ঋষভ পর্বতের প্রায় ১০০ যোজন বা আট মাইল জুড়ে এই পর্বতটি বিস্তৃত; আবার কোনো কোনো পণ্ডিত জানিয়েছেন যে— গন্ধমাদন হল যমকোটিপত্তন থেকে নীল ও নিষধ পর্বত পর্যন্ত মাল্যবান পর্বত। আবার কারো মতে রোমকপত্তন থেকে নীল ও নিষধ পর্বত পর্যন্ত এটির অবস্থান। এছাড়া কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে— এই পর্বত ইলাবৃত বর্ষ ও ভদ্রাশ্ব বর্ষের সীমাপর্বত এবং মেরুর পূর্বে অবস্থিত। মনোনীত সেন জানিয়েছিলেন যে, রামায়ণে উল্লেখিত গন্ধমাদন পর্বত আসলে কারাকোরাম পর্বত। বীরেন্দ্র মিত্র বলেছিলেন—
“গন্ধমাদন পর্বত গাড়োয়াল হিমালয়ের একটি বৃহদংশের নাম। রুদ্র হিমালয় এবং কৈলাস পর্বতমালার অংশীভূত। এই পর্বতে মন্দাকিনী প্রবাহিত। মন্দাকিনী নেমেছে কেদার অঞ্চল ছুঁয়ে।”
এই হল গন্ধমাদন পর্বতের সত্যতা, বাকি সবকিছু কাল্পনিক। এই একইরকমভাবে হনুমানের সূর্যকে গিলে ফেলা, স্বর্ণ লঙ্কা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া, লম্বা লাফ দিয়ে লঙ্কায় পৌঁছে যাওয়া (সিংহভাগ গবেষকের মতে, রামায়ণের লঙ্কা আর বর্তমান শ্রীলঙ্কা এক নয়), নিজের বুক চিরে রামকে রাম-সীতার যুগলমূর্তি দেখানো (বাল্মীকি এমন কিছু লেখেননি, এটা তুলসীদাসের সৃষ্টি)— ইত্যাদি বিভিন্ন কার্যক্রমও কাল্পনিক।
এবারে রামায়ণের এমন একটি সংস্করণের কথা বলা যাক, যেটিতে স্বয়ং হনুমানকেই রামায়ণের রচয়িতা বলা হয়েছে। এই রামায়ণের নাম হল— ‘হনুমদ রামায়ণ’। কিংবদন্তী অনুসারে এটি সৃষ্টির কাহিনী এরকম—
রাবণবধের পরে হনুমান আধ্যাত্মজীবন যাপনের উদ্দেশ্যে হিমালয়ে গমন করেছিলেন। সেখানে তিনি পর্বতগাত্রে নখের আঁচড় কেটে তাঁর নিজস্ব রামায়ণ লিখতে শুরু করেছিলেন। সেই রামায়ণে তিনি রামের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছিলেন। ওই রামায়ণ রচনা হয়ে যাওয়ার পরে হনুমান চেয়েছিলেন যে, বাল্মীকি তাঁর রামায়ণ সম্পর্কে মন্তব্য করুন। সেইমত মহর্ষি বাল্মীকিকে তিনি হিমালয়ে তাঁর রামায়ণ পড়বার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বাল্মীকি তাঁর আমন্ত্রণ গ্রহণ করে সেখানে গেলেও হনুমানের রামায়ণ পড়ে বেশ ভেঙে পড়েছিলেন। তখন হনুমান তাঁর সেই বিষাদের কারণ জানতে চাইলে মহর্ষি তাঁকে জানিয়েছিলেন যে, তিনিও রামকথা লিখছেন; কিন্তু হনুমানের রচনা এতটাই প্রাণবন্ত যে, তাঁর কীর্তি এর কাছে ম্লান হয়ে যাবে। এরপরে উদারচেতা মহাবলি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিজের রচনাকে বাতিল করে দিয়েছিলেন এবং তাঁর দ্বারা খোদিত প্রস্তরখণ্ডগুলিকে তিনি একে একে নদীতে নিক্ষেপ করেছিলেন। বাল্মীকি হনুমানের সেই উদারতায় অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে নিজের আশ্রমে ফিরে গিয়েছিলেন।
হনুমদ রামায়ণের গল্প এভাবেই শেষ হলেও ঘটনাক্রম কিন্তু সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। অন্য আরেকটি সূত্র থেকে জানা যায় যে, সেই ঘটনার বহুকাল পরে মহাকবি কালিদাস নাকি ‘হনুমদ রামায়ণ’–এর একটি প্রস্তর খুঁজে পেয়েছিলেন। এরপরে তিনি উজ্জয়িনী নগরের এক প্রকাশ্য জায়গায় সেই প্রস্তরলিপিটা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। হনুমান যে লিপিতে তাঁর রামকথা লিখেছিলেন, সেটি একটি অতি প্রাচীন এবং কালিদাসের যুগে অবলুপ্ত লিপি ছিল। তাই কালিদাস চেয়েছিলেন যে, তাঁর সহনাগরিক পণ্ডিতরা সেই লিপির পাঠোদ্ধার করতে তাঁকে সাহায্য করুন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেউ সেকাজ করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। অনেক পণ্ডিতের মতে ওই লিপিটিই পরে কালিদাসকে তাঁর ‘রঘুবংশম’ কাব্য লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল। যদিও এই তথ্যের পিছনে কোন ঐতিহাসিক সত্যতা পাওয়া যায় না।
রামায়ণে বর্ণিত বানর ও হনুমানের বিভিন্ন অলৌকিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন—
“রামায়ণ বা মহাভারতের উল্লিখিত বানর বা হনুমান সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত কিংবা প্রাইমেট অন্তর্গত কোনো জাতি নয়। প্রাইমেট অন্তর্গত কোনো প্রাণী হলে এই ধরনের কর্মকাণ্ড করে ফেলা সম্পূর্ণতই অবাস্তব। রামায়ণের বানর-হনুমানেরা একপ্রকার প্রজাতির মানুষ। দাক্ষিণাত্যে বানর, রাক্ষস, নাগ ইত্যাদি প্রজাতি মানুষের আধিপত্য ছিল। এরা খুব হিংস্র ও শক্তিশালী ছিল। আর্যাবর্তের অনেক আর্যরা বিন্ধ্যপর্বতকে পিছনে রেখে দাক্ষিণাত্য অতিক্রম করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। এমনই এ অসফল ব্যক্তি হলেন অগস্ত্য। অগস্ত্য দাক্ষিণাত্যে পৌঁছেছিলেন, কিন্তু আর ফিরে আসতে পারেননি। একেই বলে অগস্ত্য যাত্রা! রামের পক্ষেই কেবল দাক্ষিণাত্যে পৌঁছোনো সম্ভব হয়েছিল। তার কারণ রামের বিচক্ষণতা, প্রাজ্ঞতা, আস্থাভাজন এবং বীরতা। … পরবর্তীতে এইসব বানর, রাক্ষস-খোক্ষস, দানো-দৈত্য, নাগজাতিরা হয়তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে কোনো কারণে, অথবা আজও আছে অন্য রূপে। প্রাচীন ভারতে এরকম অনেক প্রজাতির জীব ছিল, যাঁরা আজ লুপ্ত। প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, সভ্য মানুষের অসভ্য আচরণ আর নৃশংস মনোভাব, তদুপরি পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে ৫০০-রও বেশি প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও পাখি লুপ্ত হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ৯০ বছরের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির আরও ১২ শতাংশ প্রাণী লুপ্ত হয়ে যাবে। আজও এরকম অনেক প্রজাতির মানবগোষ্ঠী আছেন এ ভারতে, যারা বিলুপ্তির পথে। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, তাঁরা নিজেদের মতো করে বেঁচে আছে, তাঁরা বিপন্ন। কালের নিয়মে একদিন পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। সভ্য মানুষের আগ্রাসনে দাক্ষিণাত্যের বহু আদিম প্রজাতির মানবগোষ্ঠী লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায়। এই মুহূর্তে জাবোয়া ও আওয়া উপজাতিরা বিলুপ্তির পথে অপেক্ষারত।”
ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে— ‘বন’ শব্দের সঙ্গে ইক প্রত্যয় যোগে যেমন ‘বান’ শব্দটি হয় (যথা বানপ্রস্থ), তেমনি ‘বান’ শব্দের সঙ্গে ‘নর’ শব্দের সন্ধি করলে বনে বসবাসকারী মানুষ, অর্থাৎ বানর হতে পারে। রামায়ণে থাকা লঙ্কার বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, সেখানকার তথাকথিত রাক্ষসেরা প্রকৃতপক্ষে সুসভ্য এবং নগরবাসী অনার্য ছিলেন। অর্থাৎ— সেযুগের উত্তর ভারতীয় জনপদগুলি থেকে আর্যরা দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে শুরু করবার পরে প্রথমে বনাঞ্চলের আদিবাসী এবং পরে আরও দক্ষিণে গিয়ে সুসভ্য নগরবাসী অনার্যদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, নারদ বিবৃত রামকথায় হনুমান-বানরদের কোনো উল্লেখ ছিল না; কিন্তু মহাকবি বাল্মীকি তাঁর মহাকাব্যে যুদ্ধের প্রয়োজনে এই চরিত্রগুলি কল্পনা করেছিলেন। যেহেতু রাম-লক্ষ্মণ তখন কোন রাজা ছিলেন না, তাই তাঁদের সঙ্গে কোন সেনাবাহিনীও ছিল না। অতএব সসৈন্য রাবণের সঙ্গে সৈন্যহীন রামের যুদ্ধ সম্পন্ন করাবার জন্যই বানরদের মত কাল্পনিক ভাড়াটে সৈন্যদের প্রয়োজন হয়েছিল। নিজের কাহিনীর প্রয়োজনেই বাল্মীকি এই সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু বানরের পক্ষে যেহেতু যুদ্ধ করা সম্ভব নয়, সেহেতু বাল্মীকি তাঁর রামায়ণে বানরদের প্রায় সব ক্রিয়াকর্মই অলৌকিক পথে করিয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য যে, বাল্মীকির পরবর্তী কবিরা এবং পুরাণ রচয়িতারা সেই অলৌকিকতাগুলিকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তোলবার জন্য বানরদের উপরে ‘দেবত্ব’ আরোপ করেছিলেন। আরও লক্ষ্যণীয় যে, রামায়ণ ও রামের যুগে যুদ্ধাস্ত্র বলতে একমাত্র তীর-ধনুকই মানুষের সম্বল ছিল। রাম ও রাবণ উভয়েই যুদ্ধে তীর-ধনুকের ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু শুধুমাত্র বানরসেনাই সেই যুদ্ধে গদা ব্যবহার করেছিল।
এবারে রামায়ণ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের অভিমত দেখা যাক। ১৯০০ সালের ৩১শে জানুয়ারি তারিখে প্রদত্ত একটি ভাষণে স্বামী বিবেকানন্দ রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনীকে খুব পরিষ্কারভাবেই বহিরাগত আর্যদের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন এবং বানরদের তিনি সেই বনবাসী আদিমজাতি বলে চিহ্নিত করেছিলেন, যাঁদের সঙ্গে আর্যদের কোনো যোগাযোগই ছিল না। একইসাথে সেদিন তিনি একথাও জানিয়েছিলেন যে, সেই বনবাসী আদিমজাতির মধ্যে যেসব মানুষ খুবই বলশালী ছিলেন, আর্যরা তাঁদেরই রাক্ষস বলেছিলেন। আর রামায়ণের বানরসেনা প্রসঙ্গে স্বামীজীর বক্তব্য ছিল—
“The Aryans did not know who the inhabitants of these wild forests were. In those days the forest tribes were called ‘Monkey’ and some of the so-called ‘Monkey’, if unusually strong and powerful, were called ‘demons’.”
এবারে হনুমানের ল্যাজের প্রসঙ্গে আসা যাক। এর সাথে মুণ্ডা জাতির যোগ রয়েছে। কিরকম যোগ? রামায়ণের কাহিনীর সাথে নিজেদের জড়িয়ে নিয়ে মুণ্ডা উপজাতিরা দুটি দাবি করে থাকেন—
- (১) তাঁরা হলেন হনুমানের বংশধর। তাঁদের মতে— রামায়ণে উল্লেখিত বানর বা হনুমানের যে ল্যাজ, সেটা আসলে কোন বায়োলজিক্যাল ল্যাজ নয়; সেটা আসলে ধুতি বা নেংটির বাড়তি খুঁট। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মুণ্ডারা আজও তাঁদের ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে নিজেদের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে ল্যাজ বের করে ধুতি পরেন।
- (২) তাঁরা হলেন রাবণের বংশধর। তাঁদের এই দাবি মেনে নিলে বলতে হয় যে— রাবণ ও হনুমান আসলে একই গোত্রের জাতি! তাঁদের এই দাবি অনুসারে রোমিলা থাপার, অতুল সুর প্রমুখরা জানিয়েছিলেন যে— অতীতে এঁরা সেই বিন্ধ্যপর্বত অঞ্চলেরই মানুষ ছিলেন, যাঁদের মধ্যে একদল বনে বাস করত বলে বন-নর (বানর), আর অন্য একদল গর্জনশীল ঝর্ণা বা সরব নদী মোহনার কাছে বা কিংবা দ্বীপে বাস করত বলে রাবণ বলে পরিচিত হয়েছিল।
তবে শুধুমাত্র দাক্ষিণাত্যের বানর প্রজাতিদের মধ্যেই ল্যাজপ্রীতি ছিল— সেটা কিন্তু নয়। অতীতের শিক্ষিত মিশরীয়রা ছাড়াও প্রাচীনকালের বেশকিছু আদিম জনগোষ্ঠীও ল্যাজ-সজ্জার প্রতি আকৃষ্ট ছিল। অতীতের বিশাখাপত্তনমের বাসিন্দাদের মধ্যে সবরজাতির মানুষেরাও তাঁদের পোশাকের সঙ্গে ল্যাজ ব্যবহার করতেন। এছাড়া প্রাচীনযুগের বেশকিছু অরণ্যবাসী আদিমজাতিদের মধ্যেও ল্যাজপ্রীতি বর্তমান ছিল। গবেষকদের মতে— খুব সম্ভবতঃ অরণ্যে বসবাসকারী অন্যান্য প্রাণীদের ল্যাজ দেখেই তাঁরাও আসল না থাকায় নকল ল্যাজ লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এবং এটাই পরে তাঁদের ল্যাজপ্রীতির কারণ হয়ে উঠেছিল। এছাড়াও অতীতের কোনো কোনো গবেষক জানিয়েছিলেন যে, অতীতের কোন একসময়ে অভিষেককালে কোনো কোনো ভারতীয় রাজপরিবারে ল্যাজ— ভূষণধারণের প্রথা হিসাবে অবশ্যপালনীয় ছিল। আন্দামানের একটি আদিমগোষ্ঠীদের মধ্যেও নিজেদের পিছনে নকল ল্যাজ লাগানোর অভ্যাস ছিল।
এবারে প্রশ্ন হল যে, বাল্মীকি রামায়ণ যে সময়ে রচিত হয়েছিল, সেযুগের ভারতে কোন ধরণের বানর-মানুষ থাকবার সম্ভাবনা ছিল কি? এই প্রশ্নের উত্তরে অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন—
“রামায়ণ যে সময় রচিত হয়েছে, সে সময় বা তার আশেপাশে সময়ে কোনো বানর-মানুষ থাকার সম্ভাবনা নেই। দেখে নেওয়া যেতে পারে নৃতাত্ত্বিক রিপোর্ট–জিঞ্জিই হল বানর-মানুষ। জিঞ্জি, মানে জিঞ্জানথ্রোপাস (পূর্ব আফ্রিকার মানুষ)। ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ Dr. Louis Leakey ও তাঁর স্ত্রী Mary পূর্ব আফ্রিকার একটি হ্রদের বুক থেকে একটি খুলির জীবাশ্ম আবিষ্কার করলেন। নাম দিলেন জিঞ্জানথ্রোপাস। এই প্রজাতি ২০,০০,০০০ বছর আগে পৃথিবীতে বাস করত। জিঞ্জানথ্রোপাসের সমসাময়িক অস্ট্রেলোপিথিকাস, এ প্রজাতি দক্ষিণ আফ্রিকার বানর-মানুষ। এরপর কেটে যায় কুয়াশাচ্ছন্ন ১০,০০,০০০ বছর। এই লক্ষ বছরের মধ্যে আমরা আর কোনো বানর-মানুষ পাচ্ছি না। এরপর যাদের সন্ধান পাওয়া গেল, তাঁরা সিনানথ্রোপাস বা পিকিং মানুষ। এরপর পাই হোমোনিয়ানডার্থাল মানবগোষ্ঠী। প্রায় ৫,০০,০০০ বছর আগে এঁদের ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকায় আবির্ভূত হয়েছিল। এরা কিন্তু বানর-মানুষ নয়। অর্থাৎ অনেককাল আগেই বানর-মানুষের ইতি হয়ে গিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫,০০০ বছর আগেই এই নিয়ানডারথাল মানুষরা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। এর পরবর্তীকালের নিয়ানডারথাল মানুষদের কোনো কঙ্কাল আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অপরদিকে ১০,০০,০০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বুকে কেটে গেছে চার-চারটি তুষার যুগ, শেষ হয় খ্রিস্টজন্মের ১৩,০০০ বছর আগে। নিয়ানডারথাল মানুষদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সময় এ পৃথিবীতে আবির্ভাব হয় ক্রোম্যাগনন মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ক্রোম্যাগনন মানুষই নাকি আমাদের আমাদের পূর্বপুরুষ। হিন্দু শাস্ত্রকারেরা বলেন রাম জন্মেছিলেন ৫০০০ বছর বছর আগে। অতএব রামায়ণে উল্লিখিত যে বানরজাতির কথা বর্ণিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণ কল্পকথা। বানর-মানুষের অস্তিত্ব ২০,০০,০০০ আগেই খতম হয়ে যায়। ৫০০০ বছর আগে তা কল্পনাই করা যায়, বাস্তবিক নয়।”
বাল্মীকি রামায়ণে বানর ও হনুমান প্রসঙ্গে পণ্ডিত নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর বক্তব্য হল—
“এরা মোটেই আমাদের দৃষ্ট-ত বানরদের মতো ছিল না। তাদের বুদ্ধি, হৃদয় ক্ষমতা এবং চেহারার যে পরিচয় খোদ রামায়ণ থেকেই মেলে তাতে বোঝা যায়, এরা মানুষই ছিল, তবে অবশ্যই অনার্য সম্প্রদায়ভুক্ত। প্রথম কথা, প্রাচীন সংস্কৃতে ‘বা’ শব্দটি উপমার্থে ব্যবহৃত হত এবং ভাষাগত দিক দিয়ে বানর মানে দাঁড়ায় নরের মতে, মানুষের মতো। … দেবতাদের ঔরসে এইসব বানরদের জন্ম দিয়ে বাল্মীকি নিজের জন্য অদ্ভুত এক বৈজ্ঞানিক ফাঁপর তৈরি করেছেন। এতে প্রমাণিত হয় এঁরা আক্ষরিক অর্থে বানর ছিলেন না। যদি লেজের কথা বলেন, তা হলে প্রথমে মনে রাখতে হবে— বালীর বৌ তারা, সুগ্রীবের বৌ রুমা কিংবা অন্য কোনো বানরীর লেজের কথা ভুলেও উচ্চারণ করেননি। তবে হ্যাঁ, বালী, সুগ্রীব, হনুমান অথবা কাপড়চোপড়-পরা রামায়ণের সব বানরেরাই একটা করে লেজ নিজের দেহে লাগিয়ে নিতেন। সুন্দরকাণ্ডে হনুমান যখন সমুদ্র পার হওয়ার জন্য বিরাট এক লম্ফ দিলেন, তখন তাঁর পশ্চাৎদেশে লাগানো লেজটি গোরুড়ের মুখে লটকানো সাপের মতো লাগছিল— তস্য লাঙ্গুলম্ আবিদ্ধ অতিবেগস্য পৃষ্ঠতঃ দদৃশে গরুড়েনের হ্রিয়মানো মহোরগঃ। ‘আবিদ্ধ’, ‘সমাবিদ্ধ’ —এইসব শব্দগুলি তো ‘আটকানো’, ‘লাগানো’ অর্থেই সংস্কৃতে ব্যবহৃত হয়। যদি-বা পণ্ডিতেরা শব্দের নানার্থ ভাবনায় ‘আবিদ্ধ’ শব্দের অন্য মনে করেন, তা হলে বলি বাল্মীকি রাবণের মুখ দিয়েই পরিষ্কার জানিয়েছেন যে রামায়ণী বানরদের লেজটা হল সম্মানের এবং সৌন্দর্যের প্রতীক।”
অতএব এই ল্যাজ বানর-হনুমানদের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিল না; বরং সেটা তাঁদের কাছে সম্মানের এবং সৌন্দর্যের প্রতীক ছিল। এই কারণেই রাবণ হনুমানের ল্যাজে আগুন ধরানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। আসলে এটা করে তিনি হনুমানের সাথে রামেরও সম্মানহানী করতে চেয়েছিলেন।
একই প্রসঙ্গে বীরেন্দ্র মিত্রও জানিয়েছিলেন—
“বাল্মীকি রামায়ণে চতুস্পদ এবং সহজাত লাঙ্গুলধারী বানর-বানরীর উল্লেখ নেই। বরং বানরজাতি কর্তৃক লাঙ্গুল শোভা ধারণের অর্থাৎ লাঙ্গুল সজ্জা গ্রহণের স্বীকৃতিই চোখে পড়ে। মানুষের বানরত্ব ঘটেছে মুনিদের বানানো প্রক্ষিপ্ত কল্পকাহিনির মধ্যে। মহাকাব্যে যদিও স্পষ্টতই বলা হয়েছে, ‘দেবগণ ভগবান স্বয়ম্ভর আদেশ শিরোধার্য করিরা বানররূপী পুত্র সকল উৎপাদন করিতে লাগিলেন।’ —কথকঠাকুররা কায়দা করে সেই ‘বানররূপী’ বা ‘বানর রূপসজ্জাধারী’ দেবপুত্রদের ‘কিলকিলা’ রবকারী বৃক্ষশাখাবাসী বানরে সরাসরি রূপান্তরিত করে গেলেন। একটি সুশিক্ষিত মানবজাতিকে অবমাননা এমন নজির বিস্ময়কর। .. যাত্রাপালাগানে এবং নব নব রামায়ণকথায় বেদজ্ঞ, রাজনীতিপ্রাজ্ঞ, প্রখর বুদ্ধিবিদ্যাসম্পন্ন এক দক্ষিণী মহাবীর একটি অতিপ্রাকৃত হনুমানরূপেই চিত্রিত হয়ে আছেন।”
পরিশেষে জাম্ববানের কথায় আসা যাক, রামায়ণে যিনি হলেন ভাল্লুক। এই প্রবন্ধের শুরুতে প্রদত্ত বাল্মীকির শ্লোকে— ‘ঋক্ষ’ —শব্দটি পাওয়া যায়। গবেষকদের মতে— ঋক্ষ ও ভাল্লুক সম্প্রদায় সম্ভবতঃ একই গোত্রীয়। রামায়ণে সুগ্রীবের বানরসেনাদের মধ্যে জ্ঞানবৃদ্ধ জাম্ববানকে দেখা যায়। এই ভাল্লুক সম্প্রদায়ের রাজা জাম্ববান ঋক্ষরাজ ছিলেন। মহাভারতের জাম্ববান-কন্যা জাম্ববতীকে কৃষ্ণ বিবাহ করেছিলেন। জাম্ববতীর প্রথম পুত্র ছিলেন শাম্ব। রামায়ণে জাম্ববান রাম-সহায়ক বানররাজ সুগ্রীবের মন্ত্রী ও সেনাপতি ছিলেন। এই জাম্ববান ভাল্লুক সম্প্রদায়দের আদিনিবাস হিমালয় হলেও, পরে ব্রহ্মার আদেশে তাঁরা দাক্ষিণাত্যে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। এই ভাল্লুক আসলে একটি আদিম গোষ্ঠীর টোটেম। প্রাচীন ভারতে এরকম বিভিন্ন টোটেমি জাতি ছিল। তবে শুধু ভারতে নয়, অতীতে সারা পৃথিবীতেই টোটেমী অস্তিত্ব ছিল। তখন সাধারণতঃ কোন জন্তু-জানোয়ারের নামেই টোটেমী-পরিচিত হত। আর সেই টোটেম নামেই পরম্পরায় গোষ্ঠীর নাম বজায় থাকত। এরকমভাবেই প্রাচীন ভারতে ভারতে সর্প টোটেম (নাগ), ঋক্ষ টোটেম (ভাল্লুক), কপি টোটেম (বানর), সারমেয় টোটেম (কুকুর), মহিষ টোটেম, শৃগাল টোটেম ইত্যাদির অস্তিত্ব ছিল।
সূত্র: লেখকের ফেসবুক
0 মন্তব্যসমূহ