নালন্দায় তুর্ক-আফগান হানাদারির প্রমাণ: ত্রয়োদশ শতকের ভিক্ষু ধর্মস্বামীর বয়ানে - তমাল দাশগুপ্ত

নালন্দায় তুর্ক-আফগান হানাদারির প্রমাণ: ত্রয়োদশ শতকের ভিক্ষু ধর্মস্বামীর বয়ানে - তমাল দাশগুপ্ত

নালন্দা সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ স্বাভাবিক, অতি প্রাচীন স্থান, বুদ্ধ ও মহাবীরের সময়েও নালন্দা গ্রাম ছিল। গুপ্তযুগে প্রথম নথিবদ্ধ উত্থান ঘটে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের, যদিও সম্ভবত মৌর্য যুগ থেকেই এখানে বৌদ্ধ বিহার ছিল। এক সময় ভারতের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এই নালন্দা। এর তিনটি লাইব্রেরি ছিল, তার মধ্যে একটি ছিল নয় তলা উঁচু।


বখতিয়ার জ্বালিয়ে দিয়েছিল, এই মর্মে অনেক ইতিহাসবিদই মত প্রকাশ করেছেন এককালে। কিন্তু 'তবকাত ই নাসিরি', যেটা বখতিয়ার খিলজির বৃহৎ বঙ্গে আগমনের ষাট বছর পরে মিনহাজ লিখে গেছেন, তাতে বৃহত্তম মহাবিহারটি (ওদন্তপুরী বৌদ্ধ বিহার, ইতিহাসবিদরা সবাই একমত, যে এটাই বখতিয়ার নিজের হাতে ধ্বংস করেন) ধ্বংসের উল্লেখ থাকলেও নালন্দার নির্দিষ্ট কোনও উল্লেখ নেই। প্রসঙ্গত এই ওদন্তপুরী বিহারের ওপরেই সেযুগের মুসলিম শাসনের কেন্দ্র, বিহার শরীফ গড়ে তোলা হয়। তার খুব কাছেই নালন্দা সে তুলনায় মুসলমান কর্তৃক অব্যবহৃত থেকেছে, এজন্য ১৯৬৩ সালে Antiquarian Remains of Bihar নামক একটি গ্রন্থে সন্দেহ প্রকাশ করা হয় যে নালন্দা সম্ভবত বখতিয়ার আগমনকালে ক্ষয়িষ্ণু ছিল, অথবা আগের মত সমৃদ্ধ ছিল না, ফলে খিলজির নেতৃত্বে মুসলমান হানাদার খুব কাছের ওদন্তপুরী বিহারে হামলা চালিয়ে গেলেও নালন্দায় হামলা করে নি, করার প্রয়োজন বোধ করে নি। 


একথা সত্যি যে পালযুগে একের পর এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা হয়েছে, ফলে নালন্দা সেভাবে আর একচ্ছত্র নয়, বরং এযুগে সবথেকে বিখ্যাত ছিল বিক্রমশীলা-সহ পালপৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি।

 

কিন্তু নালন্দা যে তুরস্ক আগ্রাসনে ক্ষতিগ্রস্ত, তার প্রমাণ বিদ্যমান। বখতিয়ার নিজে হাতে করেছিল কিনা, সেটা কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু তার হানাদার বাহিনীর হাতে নালন্দা আক্রান্ত হয়েছিল, সে ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং সোহরাওয়ার্দী নিজ হাতে করেন নি, কিন্তু তাঁর দায়িত্ব অপরিসীম।


তুর্ক-আফগান হানাদারির প্রমাণ পাই আমরা ধর্মস্বামীর বয়ানে। 


ধর্মস্বামী (Chos-rje-dpal, উচ্চারণ হয় ছোই জে পাল, তিব্বতী ভাষায়) নামক একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ১২৩৫ খ্রিষ্টাব্দে আসেন নালন্দায়।


তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়, এখানে প্রথম যুগেই ইসলামিক হানাদারদের আক্রমণ হয়েছিল, কিন্তু সে হামলায় নালন্দা সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়নি, তার ভগ্নাবশেষ ভাঙা হাটের বিষণ্নতা নিয়ে কোনওমতে টিঁকে ছিল। ধর্মস্বামীর বর্ণনা থেকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি জানা যায়:


এই সময় মগধের রাজা বুদ্ধসেন, পাঁচশ সৈন্য নিয়ে অরণ্যের মধ্যে পালিয়ে আছেন, পুনরায় তুরস্ক আক্রমণ হবে এরকম গুজব রটেছে। বোঝা যাচ্ছে প্রায়ই হানাদারি হত।


এযুগের মুসলমান হানাদার মূলত ডাকাত। রাহাজানি করত। সাম্রাজ্যবিস্তার করতে নয়, লুটপাট করতে আগ্রহী। একবার পরিব্রাজক ধর্মস্বামীর কাছে আর কিছু না পেয়ে তার ভিক্ষাপাত্র কেড়ে নেয় দুজন তুরস্ক। অবশেষে সমীপে একজন বৌদ্ধ যুবক এক পণ (আশি কড়ি) দিয়ে তুরস্কদের হাত থেকে ধর্মস্বামীকে রক্ষা করেন।


গয়ায় হীনযানী বৌদ্ধদের একটি বৃহৎ মন্দির ছিল, সেখানে তারা মহাযান বজ্রযান ও সহজযানের কাউকে ঢুকতে দিত না। তারা ধর্মস্বামীর কাছে প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থ দেখে সেটিকে ত্যাগ করতে বলে। এই হীনযানধর্মীরা মূলত সিংহল থেকে আগত।


কিন্তু রাজগীর অঞ্চলে তন্ত্রযানের প্রবল প্রভাব দেখেন ধর্মস্বামী। তিনি নালন্দায় যাওয়ার পূর্বে একটি কালীমন্দিরে যান, সেখানে পশুবলি দেখেন।


ধর্মস্বামী নালন্দায় এসে দেখেন, যে মহাবিহার একদা সাতটি মন্দির, চোদ্দটি বৃহৎ বিহার এবং চুরাশি ক্ষুদ্র বিহারের সমষ্টি ছিল, তা তুরস্ক আক্রমণে বর্তমানে বিধ্বস্ত। নিভন্ত অবস্থায় কোনওমতে টিঁকে আছে।


ধানাবা এবং ঘুনাবা (এই নাম মূল পালি বা সংস্কৃতে কি ছিল, জানি না) নামে নালন্দার ভেতরে দুটি বিহারভবন এখনও বাসযোগ্য অবস্থায়, ধর্মস্বামী বলেন। 

রাহুলশ্রী ভদ্র হচ্ছেন এই সময় নালন্দার একমাত্র আচার্য। 


নালন্দায় এখন মোটে সত্তরজন ভিক্ষু পঠন পাঠন করেন। এদের খরচ দেন বুদ্ধসেন (সেনদের সঙ্গে সম্পর্কিত? নিশ্চিত জানা যাচ্ছে না) এবং ওদন্তপুরী/বিহার শরীফ অঞ্চলের একজন ধনী ব্রাহ্মণ, জয়দেব।


নালন্দার বিখ্যাত গ্রন্থাগার সম্পর্কে ধর্মস্বামী একেবারে নীরব। তিনি নালন্দা বা বুদ্ধগয়া কোথাও কোনও গ্রন্থ পান নি। নেপাল থেকে তিনি গ্রন্থ সংগ্রহ করেন, সেটা দেখে বোঝা যায় যে এই সময় বিহারে আর কোনও লাইব্রেরি অবশিষ্ট নেই। 


নালন্দায় চারজনের উপাসনা হত: লোকনাথ, মঞ্জুশ্রী, জ্ঞাননাথ বা মহাকাল (ইনিই নালন্দার অধিষ্ঠাতা দেবতা বলে জানা যাচ্ছে) এবং তারা। 


নালন্দা শব্দের একটি ব্যুৎপত্তি হল নাল বা মৃণাল (যা জ্ঞানের প্রতীক) যিনি দান করেন। জ্ঞাননাথ কাজেই নালন্দার দেবতা।


নালন্দা বসবাসকালে আর একবার তুরস্ক আক্রমণের আশঙ্কা ওঠায় রাহুলশ্রী এবং ধর্মপাল এই জ্ঞাননাথের মন্দিরে আশ্রয় নেন। 


এই জ্ঞাননাথ সম্পর্কে একটি জনশ্রুতি উল্লেখ করেছেন ধর্মপাল।  তুরস্ক হানাদারির প্রথম যুগে একজন সৈন্য মন্দিরের পাথর ভেঙে দিয়ে মন্দিরের ভেতরে অধিষ্ঠিত মহাকাল মূর্তিকে নোংরা আবর্জনায় স্নান করিয়ে কাফেরদের দেবতাকে উপহাস করার পরে ওদন্তপুরী ফিরে গিয়েই কোলিক রোগে দ্রুত মৃত্যুমুখে পতিত হয়, এবং পরের দিন মন্দিরে পুনরায় জ্ঞাননাথের মূর্তিটি আগের মত অবস্থায় দেখা যায়। এরপর থেকে নাকি নালন্দায় আক্রমণ সেভাবে আর হয়নি।


তিনশ তুর্কি এই সময় নালন্দায় এলেও ধর্মস্বামী ও রাহুলশ্রীভদ্রকে খুঁজে পায় নি।


১২৩৬ সালে ধর্মস্বামী নালন্দা ত্যাগ করে নেপালের দিকে চলে যান। নালন্দা সম্পর্কে তাঁর বর্ণনা এখানেই শেষ। এ বর্ণনা ত্রয়োদশ শতকে একদা জগদ্বিখ্যাত এই বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা বুঝতে সাহায্য করে।


ধর্মস্বামীর নালন্দা ভ্রমণ নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসে ১৯৫৮ সালে এ এস অলটেকার একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন ধর্মস্বামীকে নিয়ে। ধর্মস্বামীর মূল গ্রন্থটি রাহুল সাংকৃত্যায়ন সংগ্রহ করেছিলেন।


বলা দরকার, বখতিয়ার বা তুর্ক-আফগান বা ইসলামিক হানাদারদের আড়াল করতে একরকম ইতিহাসবিকৃতি ঘটছে। বৌদ্ধবিহারগুলো যে তারা ধ্বংস করেছেন, লিপিবদ্ধ প্রমাণ বিদ্যমান। 


গৌড়ীয় সেনা নালন্দায় আক্রমণ চালায়, এই মর্মে (ইঙ্গিত শশাঙ্কের দিকে) একটা ডিস্টার্বিং ইতিহাসবিকৃতি ডান ও বাম দুদিক থেকেই করা হচ্ছে। এ সম্পর্কে সতর্ক থাকা দরকার। আজ আমি দুটি হিন্দুত্ববাদী ইউটিউব সম্প্রচার দেখলাম, দুটিরই অনেক লক্ষ ভিউ হয়েছে। দুটিতেই দেখলাম যে বখতিয়ার জ্বালিয়েছে এ দাবির সঙ্গে সঙ্গে গৌড়ের উল্লেখ আছে, নালন্দা আগে কবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেই তথ্য দিতে গিয়ে এই দাবি করা হয়েছে যে গৌড়ীয়রা আক্রমণ করেছিল। 


আবার একটি সেকুলার বা ইসলাম-অ্যাপোলজিস্ট ইউটিউব ভিডিও দেখছি, যেখানে দাবি করেছে বখতিয়ার পোড়ায় নি, ব্রাহ্মণরা পুড়িয়ে দিয়েছিল ( একটি অষ্টাদশ শতকের তিব্বতী গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে দুজন ব্রাহ্মণ/তীর্থিক নালন্দায় আগুন দিতে গিয়েছিল) কিন্তু সেখানেও দেখলাম গৌড়ীয়রা আক্রমণ করে এবং হর্ষ তারপর নালন্দা পুনঃসংস্কার করেন, এই ফলস ন্যারেটিভ ছড়ানো হয়েছে।


একচক্ষু হরিণ হলে বাঙালি কিন্তু ডান বাম দুদিক দিয়েই মরবে। শশাঙ্ক বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষ উপড়ে ফেলেন সত্য। কিন্তু তিনি নালন্দা বা অন্য কোনও বৌদ্ধ বিহারের কোনও ক্ষতি করেছেন, এই ইতিহাস হিউয়েন সাং বা অন্য কেউ লিখে যান নি। এটা নিছক রটনা। কিন্তু গোয়েবলস বলে গেছেন, এক মিথ্যা বারবার বললে সেটা সত্যি বলে লোকে বিশ্বাস করতে শুরু করে। অতএব আমাদের সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়।


একথা সত্যি, বখতিয়ার মৃত ১২০৬ সালে। ১২৩৫ সালের আগে নালন্দা সম্পর্কে আর কোনও বিবরণ নেই। তবে জ্ঞাননাথের মন্দির সম্পর্কে ধর্মস্বামী কর্তৃক নথিবদ্ধ জনশ্রুতি দেখলে মনে হয়, এই মহাকাল মন্দির বখতিয়ারের সময় বখতিয়ারের কোনও সহযোগী কর্তৃক আক্রান্ত হয়, এবং সে ব্যক্তির আশ্চর্য মৃত্যুর পরে কুসংস্কারবশত তুরস্ক সৈন্য নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর সেভাবে আক্রমণ করে নি, ফলে ধংসস্তূপের মধ্যে এখানে পঠন পাঠন পুনরায় শুরু হয়। বিহারভবনগুলি যে ইসলামিক হানাদারির ফলে ধ্বংস হয়েছিল সেটা ধর্মস্বামী নিজেই বলে গেছেন।


ওদন্তপুরী যিনি ধ্বংস করেছেন, এবং সেখানে হেডকোয়ার্টার (বিহার শরীফ) বানিয়েছেন, তিনি নালন্দায় অনুরূপ কিছু স্ট্রাকচার কেন বানালেন না? সম্ভবত জ্ঞাননাথের ভয়ে।


ভালো কথা। সেন রাজারা একটিও বৌদ্ধ বিহারে আক্রমণ করেছেন, এমন কোনও প্রমাণ আমি আজ পর্যন্ত পাইনি, যদিও এই মর্মে আর একটি ইতিহাসবিকৃতি ইতিউতি প্রায়ই চোখে আসে। শৈব শশাঙ্ক বা বৈষ্ণব লক্ষ্মণসেন, কেউই নালন্দা আক্রমণ করেন নি, কোথাও কোনও নথিবদ্ধ প্রমাণ নেই। 


নালন্দার শেষ দশায় বুদ্ধসেন নামে এক রাজা এবং জয়দেব নামে এক ব্রাহ্মণ নালন্দার খরচ দিচ্ছেন, সেটিও লক্ষণীয়। 


© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta 

* নালন্দার ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ