নাম সুপ্রিয়া (ছদ্মনাম), কৈশোরের চমৎকার রঙিন সময় পার করছে মেয়েটি। এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করার পর, বাবার কাছে তার প্রথম আবদার ছিলো একটা ভালো স্মার্টফোন। একমাত্র মেয়ে, তাই বাবাও ছোটকাল হতে কোনদিন তার আবদার অপূর্ণ রাখেনি। নিয়ে দিলো চমৎকার একটি দামী স্মার্টফোন।
ঘরের পাশে থাকা গৃহমন্ডপে প্রতিদিন পূজা-অর্চনা করে দিন কাটাতো সুপ্রিয়া। কুলবিগ্রহের প্রতি এতটাই ভক্তি ছিলো যে, সে বিগ্রহসেবা না হওয়া পর্যন্ত অন্নগ্রহণ করতো না। সম্প্রতি মহল্লার মোড়ে একটা নতুন রাধাগোবিন্দের মন্দির হলো। এখন সপ্তাহে দু তিনদিন অন্তর, সন্ধ্যার কীর্তন দেখতে নিত্য যাতায়াত। অবসর সময়ে ধর্মীয় কাজে মেয়ের এরুপ মনোভাব দেখে দিদা, দাদু, বাবা মা সবাই প্রসন্ন। সেই সাথে বাবা মার সাথে ছোটকাল হতে পূজা-পার্বণ, উৎসবে তো নিত্য গমন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, তাকে করেছে সংষ্কৃতিমনা।
যথারীতি, কলেজের ভর্তি সম্পন্ন হওয়ার পর, নতুন পরিবেশে, নতুন জায়গায় একটা আড়ষ্ট ভাব নিয়ে শহরতলীর সে ষোড়শী মেয়েটা প্রথম বন্ধু পেলো এক মেয়ের। নাম তার জুঁই। জুঁই একটু চঞ্চল, বাচাল ও মিশুক স্বভাবের। বিপরীতে সুপ্রিয়া লাজুক ও অতি আবেগী। তবুও, দুই বিপরীত স্বভাবের বন্ধুর বন্ধুত্বটা অতি অল্প সময়ে মিশে যেতে সময় লাগেনি। সুপ্রিয়ার অবসর সময় যেখানে মন্দিরে যাওয়া আর বাড়িতে আল্পনার কাজে কাটতো, সেখানে জুঁইয়ের চিন্তা সবসময় ক্লাস ফাঁকি দিয়ে, ঘরে মাকে মিথ্যা বলে, কোচিং মিস দেওয়া আর পার্কে, রেস্টুরেন্টে সময় কাটানো। কলেজে উঠার পর জুঁইয়ের সে বিন্দাস লাইফের স্বাধীনতা আরো সুগম হলো।
কলেজে উঠার ১ সপ্তাহ পর যে জড়তা সুপ্রিয়ার ছিলো,তা অনেকটাই কেটে গেছে। হঠাৎ, সেদিন ক্লাস শেষ হওয়ার পর,বের হওয়ার সময় এক ছেলে তাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিগ্যেস করলো, "তুমি কি জুঁইয়ের বন্ধু??" ইতস্তত অবস্থায় সুপ্রিয়া হা জবাবে মাথা নেড়ে, খুব দ্রুত নেমে গেলো। ছেলেটা তার এরুপ লাজুকতা দেখে হালকা হেসে চলে গেলো।
এরপর, সেদিন রাতে হঠাৎ সুপ্রিয়ার whatsapp এ এলো অজ্ঞাত এক মেসেজ।
"এত ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।আমি বাঘও না, ভাল্লুক ও না। তোমার ক্লাসমেট।😊 আমার নাম অর্ক। সেকশন ২ এর New 11th।"
সেদিন কলেজে সুপ্রিয়া কিছুটা ভয় পেয়েছে, কথাটা সত্য। তবে, নিজের দূর্বলতা তো আর ওকে বোঝানো যাবেনা। তাই, নিজের দিক হতে সেফ জোনে মেসেজের আদান প্রদান শুরু করলো। এরপর যথাবিহিত সে চ্যাট সন্ধ্যা হতে রাত পর্যন্ত গড়ালো। একরাতের চ্যাটের পরই অর্ক ছেলেটা তার জন্ম ঠিকুজি সব জেনে নিলো।
পরদিন, কলেজ ছুটির পর, অর্ক আইসক্রীম নিয়ে সুপ্রিয়ার সামনে হাজির। বললো, 'আইসক্রিম তোমার পছন্দ, "না" বলতে পারবে না।' গতকাল অর্কের প্রথম ডাকের পর দ্রুত প্রস্থান করা সুপ্রিয়া আজ, এক অজানা মোহে প্রস্থান তো করতে পারলোই না, উল্টো, না বলারও সাহস হলোনা। একরাতের মধ্যে অপরিচিতের শংকা অনেকটাই কেটে গেলো পাড়াতলীর ছাপোষা পরিবারে বেড়ে উঠা সুপ্রিয়ার। আইসক্রিম দুটো দুজনে খেতে খেতে অনেক কথাবার্তাই বললো। কিশোর বয়সের রঙিন চোখে সকল কিছুই এখন সুপ্রিয়ার কাছে রঙিন ও বর্নিল-ফ্যান্টাসীময়।
ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে আলাপ, দেখা সাক্ষাৎ বাড়তে লাগলো। বাবার ঠিক করা গৃহের টিউটরটা ভালো পড়াতে পারেনা বলে, বিদায় দিয়ে, সুপ্রিয়া অর্কের সাথে কোচিং-এ যাওয়া শুরু করলো। অর্কের সাথে সারাদিন কাটাতে পারাটা এখন সুপ্রিয়ার একটা নেশার মতো। কলেজ ফাঁকি দিয়ে পার্কে সময় কাটানো, বিকেলের কোচিং শেষে, শপিংমলে ঘোরাঘুরি করার মতো দুঃসাহস এখন সুপ্রিয়ার কাছে অনেকটাই নরমাল। গৃহে শিল্পকলা ও ভগবানসেবায় মেতে থাকা মেয়েটা এখন অনেকটাই স্মার্টফোনসেবায় ব্যস্ত থাকে। আচার-আচরণে লাজুকতায় থাকা সে মেয়েটা, এখন অনেকটাই সাহসী ও প্রতিবাদী স্বরে, মধ্যবিত্ত পিতা মাতার কাছে চাহিদার বায়নার ডালা নিয়ে বসে।
দাদু দিদা লক্ষ করলেন, তাদের সে লাজুক নাতনীটা এখন আর বৈষ্ণব মন্দিরে সন্ধ্যার পর গিয়ে, তাদের জন্য প্রসাদ নিয়ে আসেনা।
এরই মধ্যে একদিন, সুপ্রিয়ার ব্যাগ হতে পরে যাওয়া একটা রেস্টুরেন্টের ক্যাশ মেমোর টোকেন পায়। যার মধ্যে লেখা ছিলো, "বিফ রোল"। ভাই ব্যাপারটা তার বোনকে দেখালে, সে অতিদ্রুত তাকে ধমক দিয়ে টোকেনটি সরিয়ে ফেললো। ছোট ভাইটি ব্যাপারটা তখনও বুঝতে না পেরে, সরে গেলো। এরপর, সারারাত ফোনে কার সাথে রাগান্বিত স্বরে কথা বললো, সে তাও বুঝলো না।
মূলত, রোলস অর্ডার করে, দুজনে খাওয়ার পর, সেদিন বিলটা সুপ্রিয়াই দিয়েছিলো। তাকে প্রতিনিয়তই এই রেস্টুরেন্টে অর্ক নিয়ে আসে, তাই এতদিন তার বিশ্বাস ছিলো, এত ভালো রোল, ভালো রেস্টুরেন্ট কখনোই অর্ক ভুল করে তাকে আনবেনা। কিন্তু, সেদিনের টোকেনের আইটেম নাম দেখেই, সে অর্কের সাথে ঝগড়া শুরু করলো। এবং প্রায় ১ বছর পর সেদিনই সুপ্রিয়া জানতে পারলো, অর্ক চৌধুরী শুধু হিন্দু ছেলের নাম নয়, মুসলিমেরও হয়।
২য় বর্ষে সবে উঠেছে। এমনই একদিন, সুপ্রিয়া মাকে বললো, সে আজ সন্ধ্যায় মন্দিরে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলো। মা কন্যার পুনশ্চ ১ বছর পর এরুপ সদিচ্ছা দেখে তাকে অনুমতি দিলো। সন্ধ্যায় বের হওয়ার পর, সন্ধ্যা গড়ালো, রাত হলো। মেয়ের গৃহে ফিরে না আসা দেখে, মা উদভ্রান্তের মতো ছুটলো মন্দিরে। গিয়ে দেখে সেখানের ঠাকুরের শয্যা শেষ হয়েছে আজ আরো ১ ঘন্টা আগে। প্রধান ঠাকুরকে ব্যাপারটা খুলে বললে, ঠাকুর বলে, সে আজ আসেনি, তবে ২,৩ মাস আগে আসতো, ১ ছেলে আর ১ মেয়েকে নিয়ে। মায়ের বুঝতে বাকী রইলো না, মেয়েটা জুঁই। সাথে সাথে ফোন দিলে, জুঁই বলে, গত সপ্তাহে ফোন দিয়ে সুপ্রিয়ার সাথে তার কথা কাটাকাটি হয়। সে শুধু বারবার বলছে, আমি নাকি তার জীবন শেষ করে দিলাম। অথচ, আমি কোন কিছুই বুঝতে পারছিনা। এরপর, সুপ্রিয়ার মা তাকে, কোন ছেলেটার সাথে মন্দিরে আসতে তোমরা আস্ক করলে, জুই উত্তর দেয়, তার নাম অর্ক। আমাদের ক্লাসমেট। সুপ্রিয়া, ওর সাথে একই কোচিংয়ে পড়তো। হতবিহ্বল মা অতি দ্রুত ঘরে এসে সুপ্রিয়ার বাবাকে ফোন দেয়। এরপর, সুপ্রিয়ার ঘরে গিয়ে চিরকুট পায়,
"মা-বাবা,আমাকে ক্ষমা করে দিও। যেখানেই থাকি, আমি ভালো ও সুস্থ থাকবো। আমার জন্য কষ্ট করোনা।"
অবশেষে, একটা লাভ জিহাদ মিশন সফলতার মুখ দেখলো, কিশোর অর্ক চৌধুরীর হাত ধরে।
সেদিনের,বিফ রোলস ঘটনার পর, সুপ্রিয়া অনেকটাই ভেঙে গিয়ে অর্ককে জিগ্যেস করে, সে একাজ কিভাবে করতে পারলো। সে যে একজন মুসলিম, কখনো তাকে বলেনি কেনো?
প্রত্যাুত্তরে অর্কের ভাষা ছিলো,
"আমি কখনো কি এ কথা বলেছি, আমি হিন্দু? তুমিও কি জানতে চেয়েছো? অথচ আমায় তুমি মিথ্যা দোষারোপ করে নিজের অপরাগতা ঢাকার চেষ্টা করছো। আমি কখনো কি বলেছি,তুমি আমার সাথে বিফ রোলস খাও?? বরং, তুমি দিনের পর দিন, অত্যন্ত সুস্বাদু বলে, আমায় সেখানে নিয়ে যেতে। আর, খাদ্যের সাথে ধর্মের সম্পর্ক কি? তোমরা তো এমন নও যে, কোন মাংসই খাওনা। আর সবচেয়ে বড় কথা। একটা রেস্টুরেন্টের তুচ্ছ ঘটনার জন্য, আমাদের সম্পর্কের মধ্যে বিচ্ছেদ আনার কোন মানে হয়না।"
এরপর কয়েকটা দিন যোগাযোগ বন্ধ থাকলেও,সুপ্রিয়া এতটাই দূর্বল ছিলো যে, সে তাকে ছাড়া কোন কিছু ভাবতেই পারছেনা। এরপর, সে তার দিক থেকে পুনঃ যোগাযোগ করলে, অর্ক বলে,
"তুমি আমার কাছে চলে আসো। আমি এখন মেসে থাকি। একটা বাসা নিয়ে তুমি আর আমি একসাথে থাকবো। আর আমার বাবা মা, আমাদের এ সম্পর্কটা জানেন, এবং মেনে নিবেন। কিন্তু তোমার বাবা মা কখনোই যেহেতু মেনে নিবেনা, সেহেতু তুমি আমার বাসায় চলে আসো। একসাথেই থাকবো।"
অতি আবেগী ভালোবাসায় অন্ধ সুপ্রিয়া আগপিছ, ভূত-ভবিষ্যৎ না ভেবে, গৃহত্যাগ করলো অতঃপর।
এরপর, অর্কের বন্ধু সার্কেল, তাদের বিবাহ সম্পন্ন করে, তাদের একটা নতুন বাসাতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলো।
সম্পূর্ণ ঘটনাটা বলার পর আপনাদের কাছে প্রশ্ন রইলো,
আজকের এ ঘটনার জন্য,
- ১. সুপ্রিয়ার পিতা মাতার কি করণীয় ছিলো?
- ২. এ ঘটনায় হিন্দুসমাজে থাকা মঠ মন্দিরগুলোর দায়িত্বের কি কোন অবহেলা ছিলো?
- ৩. গল্পে জুঁই নামক একটা ছোট্ট চরিত্রের ভূমিকা কি ছিলো? তাকেও কি কাঠগড়ায় দাঁড়ানো যায়?
- ৪. সুপ্রিয়ার ১ম দিন সত্য জানার পর, কি করণীয় ছিলো?
- ৫. অর্ক চৌধুরী ওরফে, দাওয়া'তে অমুসলিম এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তৃণমূল সদস্য, অর্ক চৌধুরীর পিছনে এ কাজের জন্য যতটা আর্থিক ও সামাজিক ও পারিবারিক সাপোর্ট আছে, সেসব overcome করার জন্য আমাদের কাছে কি আছে?
- ৬. তাকে সত্য জানানোর পর মেন্টালি সাপোর্ট, মনিটরিং করার জন্য বাংলাদেশে কি কোন সংগঠন আছে? থাকলে, তার নাম কি??
0 মন্তব্যসমূহ