আলোচ্য প্রসঙ্গে আলোকপাত করবার জন্য প্রথমেই প্রাকৃত ভাষার উৎপত্তির বিষয়ে প্রাচীন ভারতের দু’জন পণ্ডিতের বক্তব্যকে এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। হেমচন্দ্র নামের একজন প্রাকৃত বৈয়াকরণ বলেছিলেন —
“প্রকৃতি সংস্কৃতং তত্র ভবঃ তত আগতং বা প্রাকৃতং।”
অর্থাৎ — ‘সংস্কৃতই হচ্ছে প্রকৃতি বা মূল। তার থেকে যা এসেছে বা উৎপন্ন হয়েছে সেটাই হল প্রাকৃত।’
তাঁর মতোই ‘প্রাকৃতচন্দ্রিকা’ গ্রন্থের রচয়িতা কৃষ্ণ পণ্ডিতও বলেছিলেন —
“প্রকৃতি সংস্কৃতিং তত্র ভবত্ত্বাতৎ প্রাকৃতং স্মৃতম্।
তদ্ভবং তৎসমং দেশীত্যেবমেতত্রিধা মতং॥
(প্রাকৃতচন্দ্রিকা, ১।৪।)
অর্থাৎ — ‘সংস্কৃতই প্রকৃতি; সেটা আবার — সংস্কৃতসম (তৎসম), সংস্কৃতভব (তদ্ভব), এবং দেশি — এই তিন রকমের।’
এঁরা ছাড়াও অন্যান্য প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতেরাও জানিয়েছিলেন যে, সংস্কৃত ভাষা আগে এসেছে, এবং তারপরে প্রাকৃত ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বিদেশী পণ্ডিতেরা তাঁদের সেই মতকে স্বীকার করতে রাজি হননি। জার্মান পণ্ডিত ওয়েবার বলেছিলেন যে, সংস্কৃত ভাষা প্রাচীন ভারতের সমস্ত মানুষের কথ্যভাষা ছিল — এটা কিছুতেই হওয়া সম্ভব নয়। বস্তুতঃ, সংস্কৃত ভাষার গঠন এবং বাঁধুনিকে লক্ষ্য করে তিনি অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, অতীতে এই ভাষাটি বিদ্বানের ভাষা বলে পরিচিত ছিল। অতীতের কোন একটা সময়ে বৈদিক ভাষাই সুগঠিত হয়ে, শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে, বৈয়াকরণের হাতে পরিমার্জিত হয়ে তারপরে সংস্কৃত ভাষায় পরিণত হয়েছিল। অন্যদিকে বৈদিক ভাষাই একটা সময়ে মানুষের মধ্যে প্রকৃতিগত এবং অনিয়তবেগে প্রবাহিত হয়ে প্রাকৃতভাষার সৃষ্টি করেছিল। ওয়েবার আরো জানিয়েছিলেন যে, প্রাচীন ভারতের বৈদিক ভাষাই সাধারণ মানুষের মুখে মুখে পরিবর্তিত হতে হতে শেষপর্যন্ত প্রাকৃত ভাষার রূপ নিয়েছিল। তাহলে শেষপর্যন্ত ওয়েবারের অভিমতানুসারে যেটা দাঁড়ায়, সেটা হল যে — প্রাচীন ভারতে বৈদিক ভাষার দুটি রূপ ছিল, — একটি ছিল ভাষাটির শিষ্ট মার্জিত ও পরিচ্ছন্ন রূপ, যেটার নাম হল সংস্কৃত; অন্যটি ছিল লৌকিক ধারায় প্রবাহিত বৈদিক ভাষার সহজতর সরলতর রূপ — সেটাই ছিল প্রাকৃতভাষা। তিনি বলেছিলেন যে, সেই কারণেই সংস্কৃতের তুলনায় প্রাকৃতভাষার নিয়মবন্ধন অনেকটা শিথিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। সেজন্যই প্রাকৃতভাষার মত অনিয়ম সংস্কৃত ভাষায় দেখতে পাওয়া যায় না, কিন্তু সেটাই আবার বৈদিক ভাষায় দেখতে পাওয়া যায়।
কিন্তু জার্মান অধ্যাপক ঔফ্রেকট, অধ্যাপক ওয়েবারের অভিমতের, অর্থাৎ — প্রাকৃত ভাষা বৈদিক ভাষার সমসাময়িক এবং বৈদিকভাষা থেকেই সেটির সৃষ্টি হয়েছে, — এই অভিমতের বিরোধিতা করেছিলেন। এই বিষয়ে তাঁর মত ছিল যে, প্রাচীন ভারতের সমস্ত মানুষই ঋগ্বেদের ভাষায় কথা বলতেন, — এটা কিছুতেই হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, প্রথমদিকে আর্যরা শুধুমাত্র পাঞ্জাব অঞ্চলেই তাঁদের আদিনিবাস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন পাঞ্জাবের আশেপাশে যে সমস্ত অনার্য জাতিগুলি বাস করত, শুধুমাত্র তাঁরা বা তাঁদের বংশধরেরাই লৌকিক সহজ বৈদিক ভাষা ব্যবহার করতেন, এবং কালক্রমে সেটাই প্রাকৃত ভাষায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন ভারতের অন্যত্র যেসব অনার্যজাতিরা বাস করতেন, যেমন ধরা যাক — দক্ষিণ ভারতে কিংবা পূর্ব ভারতে, — তাঁরা সম্ভবতঃ বৈদিক ভাষার কাছে ঋণী ছিলেন না। প্রথম থেকেই তাঁদের নিজস্ব একটা ভাষা নিশ্চই ছিল, এবং আর্যদের ভারতের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করবার আগে থেকেই তাঁরা সেসব ভাষার প্রচলন তাঁদের নিজেদের অঞ্চলে নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। পরে সেইসব অঞ্চলেও যখন আর্যদের অধিকার বিস্তৃত হয়েছিল, তখন তাঁরাও বৈদিক ভাষার অধিকারে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। একইসাথে আর্যরাও ধীরে ধীরে অনার্য ঘরের কন্যাদের স্ত্রী, উপ-স্ত্রী এবং দাসী হিসাবে গ্রহণ করবার পরে — আর্যগৃহেও অনার্যভাষা প্রবেশ করতে শুরু করেছিল। শেষে রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে অনার্যরাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বসেছিলেন, এবং তাঁদের প্রভাবে সেযুগের সাধারণ মানুষের চলিত ভাষা, অর্থাৎ — প্রাকৃত ভাষা প্রাধান্য পেয়েছিল। বেদের ভাষা, ব্রাহ্মণের ভাষা, রামায়ণ-মহাভারতের ভাষা এবং সমকালীন অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রের ভাষা — পণ্ডিতমণ্ডলী ছাড়া সেযুগের জনসাধারণের মুখে কখনই অবিকৃতভাবে বরাবর প্রচলিত ছিল না। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, অধ্যাপক ঔফ্রেকট–এর মতে প্রাকৃত ভাষা দু’ভাবে গঠিত হয়েছিল —
- (১) বৈদিক ভাষার সরলতর রূপ থেকে, এবং
- (২) আর্যদের আগে থেকে যে সমস্ত অনার্যজাতিরা ভারতে বাস করতেন তাঁদের ভাষাগুলি থেকে শব্দসংগ্রহ করে।
কিন্তু অধ্যাপক ল্যাসেন বলেছিলেন যে, বৈদিক ভাষা কোনো সময়েই ভারতের জনসাধারণের কথিত ভাষা ছিল না — এটা সঠিক তথ্য নয়। তিনি জানিয়েছিলেন যে, অতীতের কোনো না কোনো সময়ে বৈদিকই ভারতের জনসাধারণের কথিত ভাষা ছিল। পরে সেই লৌকিকভাবে কথিত বৈদিক ভাষাকে পাণিনি সংস্কৃত ভাষার রূপ দেন, অর্থাৎ — পাণিনি সংস্কৃতকে একটি নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ করে মার্জিত রূপ দিয়েছিলেন। সংস্কৃত ভাষা গঠিত হওয়ার পরেও লৌকিকভাবে ব্যবহৃত যে বৈদিকভাষা প্রচলিত থেকে গিয়েছিল, সেটাই তখন দিনে দিনে আরো সহজতর ও সরলতর রূপ গ্রহণ করে শেষপর্যন্ত প্রাকৃত ভাষায় পরিণত হয়েছিল। এছাড়া তিনি, — সংস্কৃত এবং প্রাকৃত ভাষা যে একই সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিল — এই অভিমতকে স্বীকার করেননি। আর্যরা উত্তর ভারতে বিস্তৃতি লাভ করবার পরে, অর্থাৎ — সেই অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসে বৈদিক ভাষা লৌকিকতা তথা বিকৃতি লাভ করবার পরে, বৈদিক ভাষাকে পরিমার্জিত করে সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত করে নেওয়া হয়েছিল। আর সেজন্যই বৈদিকের সঙ্গে প্রাকৃতের সম্বন্ধ যতটা ঘনিষ্ঠ, সংস্কৃতের সঙ্গে প্রাকৃতের সম্বন্ধ কিন্তু ততটা নিবিড় নয়। এথেকেই বোঝা যায় যে, — প্রথমে বৈদিক, তারপরে বৈদিকের বিকৃত রূপ, এবং সেটার থেকে প্রাকৃত এসেছে; সংস্কৃত ভাষার উৎপত্তি ঘটেছে পরে। সেজন্যই বয়সের দিক থেকে প্রাকৃত সংস্কৃত ভাষার অগ্রজ, যদিও — দুটিই বৈদিক ভাষার গর্ভজাত। ল্যাসেন তাঁর যুক্তির আরও কিছু প্রমাণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন যে, স্থানভেদে প্রাকৃতের রূপ ভেদ থাকলেও, সংস্কৃতের কিন্তু সেটা নেই; বা যদি থেকেও থাকে, — তাহলেও সেটার কোনো ঐতিহাসিক নিদর্শন এখন আর পাওয়ার কোন উপায় নেই। এথেকেই বোঝা যায় যে, সংস্কৃত ভাষা আসলে একটা — ‘planned language’। অনেক পরে বেশ ভেবেচিন্তে সেটার গঠন-নিয়ম ইত্যাদির একটা দৃঢ়বদ্ধ রূপ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রাকৃতের ক্ষেত্রে সেরকম কিছু ঘটেনি। সেজন্যই বোঝা যায় যে, প্রাকৃত অনেক আগের স্তরের ভাষা এবং সংস্কৃত ভাষার সৃষ্টি পরে হয়েছিল।
অধ্যাপক ‘Benefy’ অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, মৌর্য্য সম্রাট অশোকের সময়ে ভারতে দু’রকমের দেশি ভাষা প্রচলিত ছিল। সেগুলির মধ্যে একটি গুজরাটে, এবং অন্যটি মগধে চালু ছিল। ওই দুটি ভাষার গঠন আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, তখন ওই দুই প্রদেশে সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে প্রাকৃতভাষা কিন্তু একত্রে প্রচলিত ছিল না। সেখানে অতীতের কোনো একসময়ে সম্ভবতঃ সংস্কৃত ভাষাতেই সকলে কথা বলতেন, পরে সেটাই বিকৃত হয়ে একটাসময়ে প্রাকৃত ভাষায় পরিণত হয়েছিল। আবার অতীতের কোনো কোনো বৌদ্ধশাস্ত্রকার জানিয়েছিলেন যে, তাঁরা সংস্কৃত ভাষায় তাঁদের শাস্ত্রগুলি রচনা করেননি, সেগুলো তাঁরা প্রাচীন ভারতের মগধ অঞ্চলের জনসাধারণের কথিত ভাষায় রচনা করেছিলেন। কিন্তু এই মতকে স্বীকার করে নিলে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়, সেটা হল যে, — তাহলে কোন ভাষাটি আগে সৃষ্টি হয়েছিল — সংস্কৃত না প্রাকৃত? নাকি মগধ-অঞ্চলের সংস্কৃত-নিরপেক্ষ জনসাধারণের কথিত ভাষা? অধ্যাপক ‘Benefy’ এই প্রসঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট মতামত দিতে না পারলেও বলেছিলেন যে, খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে — অর্থাৎ, যে সময়ে বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল, সেই সময়কার জনসাধারণ সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতেন না; এর অন্ততঃ তিনশো বছর আগে জনসাধারণের কথ্য ভাষা হিসাবে সংস্কৃত ভাষাকে গণ্য করলেও করা যেতে পারে। কিন্তু তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় যে, সংস্কৃত ভাষারও আগে যাঁরা তখন ঐসব অঞ্চলে বাস করতেন — তাঁরা কোন ভাষায় কথা বলতেন? তাঁরা সবাই কি তখন বৈদিক ভাষায় কথা বলতেন, নাকি অন্য কোন ভাষায় কথা বলতেন, — যে ভাষা আর্যদের ভারতের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করবার আগে থেকেই প্রচলিত ছিল? বলাই বাহুল্য যে, এ সম্বন্ধে এখনও সঠিকভাবে কেউই কিছু জানাতে পারেননি।
নিরুক্তকার যাস্ক বলেছিলেন যে, বৈদিক-আর্য ভাষার অনেক বিশেষ্য পদ (যথা — দমূনা, ক্ষেত্রসাধা) যেমন প্রাকৃত থেকে গৃহীত হয়েছিল, তেমনি আবার সংস্কৃত ভাষার অনেক পদ বৈদিক ধাতু থেকে নেওয়া হয়েছিল। সেক্ষেত্রে — বৈদিক, সংস্কৃত এবং প্রাকৃত — এই তিনটি ভাষার পরস্পরের মধ্যে কোথাও প্রত্যক্ষ, তো কোথাও আবার পরোক্ষ সম্বন্ধ অবশ্যই ছিল। কিন্তু বৈদিক ভাষা বিকৃত হয়ে প্রাকৃতের সৃষ্টি হয়েছিল, নাকি প্রাকৃত ভাষা পরিশোধিত হয়ে সংস্কৃত ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল — এ সম্বন্ধে সর্ববাদিসম্মত কোনো মতামত দেওয়া সম্ভব নয়। তবে যাঙ্কের বক্তব্য থেকে যে জিনিসটি সম্বন্ধে একটা তির্যক ইঙ্গিত পাওয়া যায়, সেটা হল যে, — অতীতের কোন একসময়ে কম্বোজ দেশেও (বর্তমান যুগের কাম্বোডিয়া) সংস্কৃত ভাষা প্রচলিত ছিল। কম্বোজ দেশে তখন ‘শবতি’ ক্রিয়াপদের মাধ্যমে ‘গতিকর্ম’–কে বোঝানো হত, আর ভারতে সেটারই বিকৃত রূপ ‘শব’ — গতিকর্মহীন অর্থে প্রচলিত রয়েছে।
যাই হোক, প্রাকৃত ভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে ভারতের এবং বিদেশের পণ্ডিতেরা এখনও পর্যন্ত যা কিছু বলেছেন, সেগুলো সবই উপরে মোটামুটিভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিচার করলে দেখা যাবে যে, উপরোক্ত সমস্ত মতই কিন্তু আংশিকভাবে সত্যি। আর্যদের আদি ভাষা ছিল বৈদিক, যা এখনও বেদে এবং ব্রাহ্মণে রক্ষিত রয়েছে। আর্যদের ভারতের মূল ভূখণ্ডে আগমনের আগে ভারতের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা যেটাই হোক না কেন, আর্য-আধিপত্য নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে — নিজের ভাষার প্রচলিত শব্দসম্ভার-মিশ্রিত আগন্তুক বৈদিক ভাষাই অধিকাংশ মানুষের মনোভাব প্রকাশের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই ভাষা যেমন পুরোপুরিভাবে বৈদিক ছিল না, তেমনি আবার সম্পূর্ণভাবে দেশিও ছিল না। তবে তাতে বৈদিক ভাষার প্রাধান্য অবশ্যই ছিল। সেই বৈদিকই জনসাধারণের ব্যবহারের সামগ্রী হতে হতে কালক্রমে তাঁদের মুখে মুখে অন্যরকমের রূপ পেয়েছিল। কিন্তু শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এবং পণ্ডিতদের ভাষা আগের সেই বৈদিকই থেকে গিয়েছিল। তাহলে তখন বৈদিক ভাষার স্রোত দ্বিমুখী হয়েছিল, — একটি ছিল সেটার সরলতর ও সহজতর রূপ, যা তৎকালীন জনসাধারণের মুখে মুখে বেগবান ছিল; এবং অন্যটি ছিল শিষ্টজনের ব্যবহৃত ভাষা, সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রেই যেটার বিকাশ ঘটেছিল। এখন সেই অবস্থায় ওই দুই ধারার স্বরূপটি ঠিক কি ছিল, অর্থাৎ, — সেই দুই ধারার কোন ঐতিহাসিক নমুনা সংগ্রহ করবার চেষ্টা করা বর্তমানে নিষ্ফল হতে বাধ্য, কারণ — তখন সেই ভাষা লিপিবদ্ধ করবার কোন উপায় ছিল না। অতীতের যে সময়ে বেদ-ব্রাহ্মণ রচিত হয়েছিল, তখন আর্যরা ছাড়া অন্য কেউ সে ভাষা সম্বন্ধে কিছু জানতেন না। সেজন্য তাতে কোন বিকৃতি ঘটেনি। কিন্তু পরে যখন আর্য অনার্য মিলন সংঘটিত হয়েছিল, তখন প্রচুর অনার্য শব্দ এবং কিছু কিছু প্রাদেশিক শব্দও বৈদিক ভাষায় প্রবেশ করেছিল। অনার্যরাও তখন রাজভাষা বলে হয় বৈদিক ভাষাকে ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, নতুবা নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে সেই ভাষা ব্যবহার করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ফলে বৈদিক ভাষা বিকৃত হয়ে জনসাধারণের মুখে সহজতর ও সরলতর একটা রূপ পেয়ে গিয়েছিল। এটা ঘটতে বাধ্য ছিল, কারণ — বহুজন-ব্যবহৃত ভাষা সহজ না হলে চলে না। কিন্তু এরপরে সেকালের পণ্ডিতদের সামনে একটা নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছিল। হয় তাঁদের লৌকিকরূপে পরিবর্তিত বৈদিককেই সাহিত্যের ভাষায় পরিণত করতে হত, কিংবা সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে পণ্ডিতসমাজে এবং রাজকার্যে প্রাচীন ভাষাকেই আঁকড়ে থাকতে হত। বৈদিকভাষা — তখনকার পণ্ডিতদের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী দেবতাদের দ্বারা কথিত ভাষা ছিল, অতএব তাঁরা সেই ভাষার পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁরা ভালো করেই জানতেন যে, ব্রাত্যদের দ্বারা সেই ভাষা ব্যবহৃত হতে দিলে একদিন তাঁদের সমগ্র শাস্ত্রই দূষিত হয়ে যাবে। কিন্তু ইতিমধ্যে সেরকম কিছু বিপর্যয় ঘটে গিয়েছিল, ইতিমধ্যে খাঁটি বৈদিক ভাষার মধ্যে বহু অনার্যশব্দ এবং লৌকিকরূপে পরিবর্তিত বিকৃত বৈদিকশব্দ অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তখন পাণিনি-যাস্ক প্রমুখ বৈয়াকরণরা আদি বৈদিক ভাষাকে শিষ্ট, পরিচ্ছন্ন এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ একটা রূপ দিয়েছিলেন। সেই ভাষার আগাগোড়া ছিল — ঋজু নিয়ম, কঠোর শৃঙ্খলা এবং আশ্চর্য শিষ্টতা। সেই ভাষাই হল সংস্কৃত ভাষা। এই ভাষাটির যেমন গতি রয়েছে, তেমনি এর অ্যাকাডেমিক সৌন্দর্যও লক্ষ্যণীয়। সাহিত্যরচনা ও শাস্ত্ররচনার ব্যাপারে এই ভাষার কোন জুড়ি নেই। আবার অত্যন্ত কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ বলে সাধারণ মানুষের পক্ষে কোনোদিনই সংস্কৃত ভাষাকে যথেচ্ছ ব্যবহারের সামগ্রী করে তোলবার কোন উপায়ও নেই। এই ভাষা রীতিমত শিক্ষালাভ না করে বলবার বা লেখবার কোন উপায় নেই। ইতিমধ্যে লিপির উদ্ভব হয়ে গিয়েছিল, তাই সংস্কৃত ভাষাকে লিপিবদ্ধ করবার ব্যবস্থাও সম্পূর্ণ হয়েছিল; সুতরাং — ভাষাটির আর বিকৃত হওয়ার কোনো রাস্তা ছিল না। এইভাবে পাণিনি প্রমুখ বৈয়াকরণরা রীতিমত আটঘাট বেঁধে আদি বৈদিকভাষাকে একটি শিষ্ট, মার্জিত ও পরিচ্ছন্ন রূপ দিয়েছিলেন। সেটা এত কঠোরভাবে সম্পাদিত হয়েছিল যে, সংস্কৃত ভাষার মধ্যে কোথাও বিন্দুপ্রমাণ প্রাদেশিকতার চিহ্ন পাওয়া যায় না। অতীতের দক্ষিণভারতের পণ্ডিতদের দ্বারা রচিত সংস্কৃত গ্রন্থে কিংবা পূর্ব বা পশ্চিম-ভারতের পণ্ডিতদের দ্বারা প্রণীত সংস্কৃত গ্রন্থে — প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক বিশেষত্ব নিশ্চই কিছু কিছু পরিমাণে ছিল, সেটা থাকা স্বাভাবিকও। কিন্তু সেইসব গ্রন্থগুলি উত্তর-ভারতের সংস্কৃত পণ্ডিতদের হাতে গিয়ে পৌঁছানোমাত্র সেগুলির আঞ্চলিক এবং প্রাদেশিক বিশেষত্ব নিঃশেষে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে, পরবর্তীকালে উত্তর এবং দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিম-ভারতের যে কোনো অঞ্চলের সংস্কৃত ভাষায় লেখা গ্রন্থে কোথাও আঞ্চলিক বৈষম্য দেখতে পাওয়া যায় না। সর্বত্রই সেটা উত্তরভারতের মুনিঋষিদের প্রবর্তিত নিয়ম এবং ‘standard’–কে প্রাণপণে স্বীকার করে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষের মুখে মুখে দিন দিন ধরে বিকৃতিপ্রাপ্ত বৈদিক ভাষা নিয়ে তখন মাথা ঘামাবার মত কেউ ছিলেন না। ফলে বহু শাখায় প্রবাহিত হয়ে সেই ভাষাটি তখন একটি বিরাট স্রোতস্বতীর রূপ নিয়েছিল, সেটি এতটাই প্রবল বেগ আর বিস্তৃতি পেয়েছিল যে, সেটাকে কোন নিয়ম-শৃঙ্খলার মাধ্যমে আটকানোর সাধ্যও অন্য কারো ছিল না। সেই সৃষ্টিছাড়া, গতির আনন্দে পাগল, সর্বজনের মুখে উচ্ছ্বসিত লৌকিকরূপে পরিবর্তিত বৈদিকই শেষপর্যন্ত প্রাকৃত ভাষায় পরিণত হয়েছিল।
প্রাকৃত এবং সংস্কৃত — দুই ভাষারই জননী হল বৈদিক ভাষা, কিন্তু ভাষাগুলির জন্মের পর থেকেই সহোদরারা বৈমাত্রেয় ভগিনীর মত হয়ে গিয়েছিল। সেই দুটির মধ্যে একটি ভাষা মুক্তি পেয়ে সমৃদ্ধ হয়ে জনসাধারণের প্রেমে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল, এবং অন্যটি নিয়মশৃঙ্খলার বেদীতে দেবীর আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে শেষপর্যন্ত ভক্তির বাঁধনে বাঁধা পড়েছিল। তখন ভাষা দুটির মধ্যে একটি হয়েছিল প্রাণদায়িনী, এবং অন্যটি হয়েছিল জ্ঞানদায়িনী। পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মে শেষপর্যন্ত একদিন প্রাণেরই জয় হয়েছিল, এবং জ্ঞান — পুঁথির শুষ্ক পাতায়, পণ্ডিতদের নীরস মনে আর গবেষকদের ঘর্মসিক্ত অনুশীলনে বাধা পড়ে গিয়েছিল। এখনও পর্যন্ত প্রাকৃত ভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে ইতিহাস থেকে যা কিছু জানা যায়, উপরে সেইসব খুব সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হল। এবারে ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাক যে, ভারতের কোন অঞ্চল থেকে প্রথম প্রাকৃতের উৎপত্তি ঘটেছিল।
অতীতের কিছু কিছু পণ্ডিত অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, আর্যরা ভারতের মূল ভূখণ্ডে প্রথম যেখানে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন, অর্থাৎ — পঞ্চনদভূমি, সেখান থেকেই প্রাকৃতের উৎপত্তি হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের এই মতটি ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক কতদূর গ্রহণযোগ্য — সেকথাও বিবেচনা করতে হবে। আর্যরা প্রথমে যেখানে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন, দীর্ঘকাল ধরে সেই জায়গাটি তাঁদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ছিল। তাই সেখানে প্রথমে বৈদিক এবং পরে সংস্কৃত ভাষার প্রাধান্য থাকাই স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হয়। অনেকেই ‘ললিতবিস্তর’ গ্রন্থের গাথাভাষাকে প্রাকৃত ভাষার আদিরূপ বলে মনে করে থাকেন; কিন্তু সিংহভাগ গবেষকদের মতে সেটা আসলে তৎকালীন সংস্কৃত ভাষারই একটা কথিতরূপ, পরে সেই ভাষাই পালি ভাষায় পরিণত হয়েছিল। সেজন্যই উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রাকৃত ভাষার উৎপত্তি ঘটেছিল, — এই মতটি সকলে গ্রহণ করতে চান না। বরং, এই বিষয়ে অতীতের ভারতীয় পণ্ডিতেরা যা কিছু বলেছিলেন, সেগুলিকে অনুধাবন করে দেখা যেতে পারে।
পণ্ডিত লক্ষ্মীধর তাঁর ‘ষড়ভাষাচন্দ্রিকা’ গ্রন্থে বলেছিলেন, —
“প্রাকৃতং মহারাষ্ট্রোদ্ভববম”;
অর্থাৎ — মহারাষ্ট্র থেকেই প্রাকৃত ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। চণ্ডীদেব তাঁর ‘প্রাকৃতদীপিকা’ গ্রন্থে বলেছিলেন —
“এতদপি লোকানুসারাৎ নাটকাদৌ মহাপ্রয়োগদর্শনাৎ প্রাকৃতং মহারাষ্ট্র দেশীয়ং প্রকৃষ্ট ভাষণম্। তথাচ দণ্ডী — মহারাষ্ট্রাশ্রয়ং ভাষাং কৃষ্টং প্রাকৃতং বিদুঃ॥”
অর্থাৎ — লোক-ব্যবহার অনুসারে এবং নাটকাদি ও মহাকবিদের প্রয়োগ অনুসারে মহারাষ্ট্রদেশীয় প্রাকৃতই উৎকৃষ্ট ভাষা বলে গণ্য।
দণ্ডীও বলেছিলেন যে, মহারাষ্ট্র দেশে যে প্রাকৃতভাষা প্রচলিত রয়েছে, সেটাই শ্রেষ্ঠ।
রামতর্কবাগীশ তাঁর ‘প্রাকৃত-কল্পতরুর’ গ্রন্থের সূচনাতেই বলেছিলেন —
“সর্বাহু ভাষাস্বীহ হেতুভূতাং ভাষাং মহারাষ্ট্রভবাং পুরস্তাৎ।
নিরূপয়িষ্যামি যথোপদেশং শ্রীরামশর্মাহমিমাং প্রযত্বাৎ॥”
অর্থাৎ — মহারাষ্ট্রীয় ভাষাই সব প্রাকৃত ভাষার সার।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, — রামশর্মা, চণ্ডীদেব এবং লক্ষ্মীধর — এই তিনজন পণ্ডিতেরই বক্তব্য ছিল যে, মহারাষ্ট্র অঞ্চল থেকেই প্রাকৃতের উৎপত্তি ঘটেছিল। রামশর্মা আরও বলেছিলেন যে, মহারাষ্ট্র-প্রাকৃতই হল আদি প্রাকৃত, সেটার থেকে শৌরসেনী এবং শৌরসেনী ও মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতের মিশ্রণে মাগধী প্রাকৃতের সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃতকে যাঁরা আদি প্রাকৃত বলেননি, তাঁদের মধ্যে ‘প্রাকৃত-লক্ষণ’ গ্রন্থের প্রণেতা পাণিনি (সংস্কৃত ভাষার আদি বৈয়াকরণ প্রণেতা পাণিনি নন) অন্যতম ছিলেন। এছাড়া চণ্ড নামের আরও একজন বৈয়াকরণও অতীতে ‘প্রাকৃত-লক্ষণ’ নামে আরও একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, প্রাকৃত ভাষা চার রকমের; যথা — আর্যপ্রাকৃত, অপভ্রংশ, মাগধী এবং পৈশাচিকী। তিনি তাঁর গ্রন্থের কোথাও মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃতের কোনো উল্লেখ করেননি। পাণিনি প্রণীত প্রাকৃত-লক্ষণের টীকা যিনি রচনা করেছিলেন, তিনিও মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃতের কোনো পরিচয় দেননি। তবে বররুচি অবশ্য তাঁর ‘প্রাকৃতপ্রকাশ’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃত নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন। তাঁর মতে প্রাকৃত চার ধরণের; যথা — মহারাষ্ট্রীয়, শৌরসেনী, পৈশাচী এবং মাগধী। অন্যদিকে অতীতের অন্যতম প্রাকৃত বৈয়াকরণ হেমচন্দ্র ছ’রকমের প্রাকৃতের কথা জানিয়েছিলেন; যথা — মূলপ্রাকৃত, শৌরসেনী, মাগধী, অপভ্রংশ, পৈশাচী এবং চুলিকাপৈশাচী। তবে, এখানে যে কথাটা বিবেচ্য, সেটা হল যে — চণ্ডের আর্যপ্রাকৃত, বররুচির মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃত এবং হেমচন্দ্রের মূলপ্রাকৃত, — তিনটির প্রকৃতি তিনরকমের। যদি ইতিহাসে এমন দেখা যেত যে, এই তিনটির প্রকৃতি মোটামুটি একই রকমের ছিল, তাহলে হয়ত মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃতকে আদি প্রাকৃত বলতে কোনো বাধা ছিল না।
অতীতের বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা প্রাকৃত ভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে যা বলতে চেয়েছিলেন, সেটাও এই প্রসঙ্গে এখানে অনুধাবনযোগ্য। কচ্চায়নের (কাত্যায়নের) ‘পয়োগসিদ্ধি’ গ্রন্থ থেকে তাঁরা নজির দেখিয়ে বলতে চেয়েছিলেন —
“সা মাগধী মূলভাসা নরা যেয়াদিকল্পিকা।
ব্রহ্মানো চ সসুতালাপা সম্বদ্ধা চাপি ভাসরে॥”
অর্থাৎ — মাগধীই হচ্ছে মূলভাষা, এটিই সমস্ত ভাষার আদি কল্পক। এই অশ্রুতপূর্ব ভাষায় মানুষেরা, ব্রহ্মেরা, এমনকি সম্যকবুদ্ধেরাও কথা বলতেন।
গবেষকদের মতে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা মাগধী প্রাকৃতকেই আদি-প্রাকৃত বলতেন, এবং সেটার থেকেই পরবর্তী সময়ে পালি ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রাচীন জৈন পণ্ডিতেরা ‘পণ্ণবণাসুত্ত’ গ্রন্থের সাক্ষ্য তুলে ধরে জানিয়েছিলেন যে, অর্ধমাগধীই হচ্ছে আদি প্রাকৃত। উক্ত গ্রন্থের একজায়গায় বলা হয়েছিল —
“সে কিং তং ভাসারিয়া? জেনং অদ্ধমগাহাএ ভাসাএ ভাসেন্তি জন্ম ষ ণং বম্ভীলিবি পবত্তই॥”
অর্থাৎ — কি ভাষায় সেটার প্রয়োগ? যা দিয়ে অর্ধমাগধীভাষা প্রকাশ করা যায় সেটাই হল ব্রাহ্মীলিপি।
বৌদ্ধদের মতে মাগধী এবং জৈন পণ্ডিতদের মতে অর্ধমাগধী মূল প্রাকৃত হিসাবে বিবেচিত হওয়ার জন্য তাঁদের নিজের নিজের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থগুলির অধিকাংশই যথাক্রমে মাগধী এবং অর্ধমাগধীতে রচিত হয়েছিল। জৈন তীর্থঙ্করদের উপদেশগুলির অধিকাংশই আবার অর্ধমাগধীতে রচিত হয়েছিল বলে দেখা যায়। সম্রাট অশোকের শিলালিপিগুলির মধ্যে কিছু কিছু বৌদ্ধধর্মগুরুদের প্রভাবে মাগধী প্রাকৃতে রচিত হয়েছিল, বিশেষতঃ গুজরাট অঞ্চল থেকে ঐতিহাসিকেরা সম্রাট অশোকের যে সব শিলালিপি পেয়েছিলেন, সেগুলির সবক’টিই মূলে মাগধীপ্রাকৃত ছিল, এবং পরে সেগুলো বদলে গিয়ে মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃত হয়েছিল। তবে অশোকের পূর্বভারতের শিলালিপিগুলিতে মাগধীপ্রাকৃতই দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলির কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
অধ্যাপক ল্যাসেন জানিয়েছিলেন যে, বররুচির মতানুযায়ী — শৌরসেনী, মাগধী, মহারাষ্ট্রীয়, পৈশাচি — ইত্যাদি বিভাগে প্রাকৃতকে ভাগ করা হলেও, আসলে সেগুলোর মধ্যে মূলগতভাকে খুব বেশি পার্থক্য কিছু ছিল না; পার্থক্য ছিল সেগুলোর বহিরঙ্গে এবং সেটাও স্থানীয় প্রভাবের ফলেই হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন যে, অতীতে — শৌরসেনী পশ্চিমভারতের এবং মাগধী ভারতের পূর্বঅঞ্চলের কথ্য ভাষা ছিল। এই দুটি ভাষার মূল প্রাকৃতই, এবং সেগুলির পরিবর্তিত স্থানীয় লক্ষণাক্রান্ত রূপ হল — মহারাষ্ট্রীয় ও পৈশাচি। ল্যাসেন আরো জানিয়েছিলেন যে, আদতে পৈশাচি নামটি কাল্পনিক, আর মহারাষ্ট্রীয় নাম হলেও সেটা মহারাষ্ট্র-অঞ্চলের প্রাকৃত নয়। তখন মধ্যভারতের সর্বত্রই সেই প্রাকৃত প্রচলিত ছিল।
উপরোক্ত সমস্ত ঐতিহাসিক মতামত থেকে এই সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, অতীতের কোন একসময়ে ভারতবর্ষের সব জায়গাতেই একইধরণের প্রাকৃত ভাষাই প্রচলিত ছিল, — কেননা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত শিলালিপিগুলির এবং বররুচির ‘প্রাকৃত প্রকাশ’ গ্রন্থে আলোচিত বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃত ভাষার মূল গঠনভঙ্গী মোটামুটিভাবে একই রকমের। পরে বিভিন্ন সামাজিক এবং প্রাকৃতিক নিয়মে এক এক অঞ্চলের প্রাকৃতে এক এক রকমের স্থানীয় বিশেষত্ব যোগ হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, পূর্ব বাংলার এবং পশ্চিম বাংলার — উভয় বাংলারই মানুষের মাতৃভাষা হল বাংলা, কিন্তু বাংলার দুই অঞ্চলে বাংলা ভাষার নানা স্থানীয় বিশেষত্বও দেখতে পাওয়া যায়, — মূলতঃ সামাজিক এবং প্রাকৃতিক কারণেই সেটা ঘটেছে। অতীতে প্রাকৃতভাষার ক্ষেত্রেও যে এরকম কিছু ঘটেনি — সেটা বলা চলে না। কিন্তু এখন কেউ যদি বলেন যে, পূর্ব বাংলার বাংলাটাই হল আদি বাংলা, এবং সেটার পরিবর্তিত রূপ হল পশ্চিম বাংলার বাংলাভাষা, তাহলে সেক্ষেত্রে যেমন সুবিচার করা হয় না, তেমনি — মাগধী বা মহারাষ্ট্রীয় বা শৌরসেনী — এগুলির মধ্যে যে কোনো একটিকে আদি প্রাকৃত বলে রায় দিলেও সেই একই ধরণের অবিচার করা হয়।
গবেষকরা আঞ্চলিক বিশেষত্ব অনুযায়ী প্রাকৃত ভাষাকে চারটি জাতিতে ভাগ করে নিয়েছেন। সেগুলো হল — মাগধী, মহারাষ্ট্রীয়, শৌরসেনী, এবং পৈশাচি। এছাড়া মাগধীর আরেকটি ভাগ — অর্ধ-মাগধীর কথাও কোনো কোনো পণ্ডিত বলে থাকেন।
অতীতের সংস্কৃত নাটকে অশিক্ষিত, ইতরজনের কথ্য ভাষা হিসাবে মাগধী প্রাকৃত ব্যবহৃত হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে লিখিত বাংলা নাটকগুলিতে ঝি-চাকর বা নিম্নশ্রেণীর মানুষের মুখের ভাষা হিসেবে যেমন মেদিনীপুর, বাঁকুড়া বা পূর্ববাংলার গ্রামাঞ্চলের কথ্যভাষা ব্যবহার করা হত এবং এখনও যেমন কোনো কোনো নাট্যকার সেই ব্যবহার করে থাকেন, তেমনি অতীতের সংস্কৃত নাটকেও অশিক্ষিত ইতরজনের কথ্যভাষা হিসাবে মাগধী প্রাকৃত ব্যবহৃত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে যে, কালিদাস তাঁর ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’ নাটকে দুষ্মন্তের আংটিটি যে ধীবর রোহিত মৎস্যের পেটের ভেতরে পেয়েছিলেন — তাঁর মুখের কথাগুলি কিন্তু মাগধী প্রাকৃতে লিখেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, সেটার মাধ্যমে লোকটির সামাজিক পরিচয় বোঝানো এবং কিঞ্চিৎ হাস্যরসের সৃষ্টি করা। মাগধীর একটি স্তর হল — অর্ধমাগধী। এই ভাষার ব্যবহার অতীতের জৈন-সন্ন্যাসীদের শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলিতে বেশি পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া অশ্বঘোষ তাঁর নাটকেও এই ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। অতীতে এই ভাষার অন্য নাম ছিল — ‘জৈন-মহারাষ্ট্রীয়’ বা ‘জৈন শৌরসেনী’। মাগধী প্রাকৃতের একটা ঐতিহাসিক নমুনা রকম —
“অধ এক্কোদিয়শং মএ লোহিদমশ্চকে খণডাশো কপ্পিদে। যাব তশশ উদলবভন্তলে এদং মহালদণভাশুলং অঙ্গুলীঅঅং পেশকামি। পশ্চা ইধ বিক অস্তং ণং দংশঅন্তে যএব গহিদে ভাবমিশশেহিং এত্তিকে দাব এদশ শ আগমে। অধুণা মালেধ কুস্টেধ বা॥”
অর্থাৎ — তারপরে একদিন আমি একটা রুইমাছ যখন টুকরো টুকরো করে কাটছিলাম তখন সেটার পেটের ভেতরে এই মহারত্নসমুজ্জ্বল আংটিটা দেখলাম। পরে এই জায়গায় বিক্রির জন্যে এই মাছটাকে যখন দেখালাম তখন হুজুরেরা আমায় গ্রেপ্তার করেছেন। এই পর্যন্তই এর প্রাপ্তির বৃত্তান্ত। এখন আপনারা আমাকে মারুন বা কুটে ফেলুন।
অতীতে মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃত কবিতা বা গানের ভাষা হিসাবে সংস্কৃত নাটকে ব্যবহৃত হয়েছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। কালিদাস তাঁর ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’ নাটকের অধিকাংশ গানগুলির মধ্যেই মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃত ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। গবেষকদের মতে মিষ্টত্ব এবং চারুত্বের দিক থেকে বিচার করলে, মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃতই সম্ভবতঃ সমস্ত রকমের প্রাকৃতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেকালে গানের ভাষা হিসাবে এটিকে প্রয়োগ করবার কারণ ছিল যে, মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃতে পদমধ্যস্থিত অযুক্ত ব্যঞ্জনগুলি প্রায়ই লুপ্ত, — শৌরসেনী প্রাকৃতে সেটা হয়নি বলে শৌরসেনী একটু কর্কশ। সেটা না হলে শৌরসেনী এবং মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃতের রূপ প্রায় একইরকমের। অতীতের উচ্চশ্রেণীর রমণীর কথ্যভাষা হিসাবে মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃতের ব্যবহারকে ‘সাহিত্যদর্পণ’ গ্রন্থে অনুমোদন করা হয়েছিল। মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃত ভাষায় সেকালে অনেকগুলি কাব্য-গাথা রচিত হয়েছিল। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল — সেতুবন্ধ বা রাবণবধ, গাহা সতসই (গাথা সপ্তশতী), বাকপতি লিখিত গৌড়বাহ ইত্যাদি। মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃতের একটি ঐতিহাসিক নমুনা নিম্নরূপ —
“তুজঝণ আণে হিঅঅং মম উণ মঅণো দিবা-অ-রাত্তিং চ।
ণিক্কিব দাবই বলিঅং তুঅ হুত্ত মণোরহাহী অংগায়িং॥”
অর্থাৎ —তোমার হৃদয়ে কি হচ্ছে আমি জানি না। কিন্তু তোমাতে আমার সমস্ত ইচ্ছা কেন্দ্রীভূত, হওয়ায় মদনদেব আমার অঙ্গসমূহকে দিনরাত্রি প্রবলভাবে তাপিত করছে।
শৌরসেনী প্রাকৃত অতীতের সংস্কৃত নাটকগুলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর এবং অশিক্ষিত পুরুষের কথ্যভাষা হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। অনেকে মনে করেন যে, অতীতে মথুরা-অঞ্চলের কথ্যভাষা ছিল শৌরসেনী প্রাকৃত; কেননা — শূরসেন-অঞ্চল বলতে তখন ভারতবর্ষের মধ্যদেশের কেন্দ্রীয় অংশকে বোঝানো হত। এই ভাষায় সংস্কৃতের প্রভাব বেশি দেখতে পাওয়া যায়, কেননা ভারতের সেই অংশে তখন সংস্কৃতভাষার চর্চা প্রবল ছিল। গবেষকদের মতে মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃতের সঙ্গে শৌরসেনী প্রাকৃতের গঠনে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। শৌরসেনী প্রাকৃতের ঐতিহাসিক নিদর্শন নিম্নরূপ —
“পোরব জুত্তং ণাম তুহ পরা অসসমপদে সভাবুত্তাণহিদঅং ইমং।
জণং তধা সমঅপূব্বং সংভাবিঅ সংপদং ঈদিসেহিং পচ্চাচ্কথিদুং॥”
অর্থাৎ — পৌরব, একদিন আশ্রমপদে স্বভাবতঃ সরলহৃদয় এই ব্যক্তির কাছে সেরকমভাবে প্রতিজ্ঞা করে এবং তাঁকে আশ্বাস দিয়ে এখন এরকম ভাষায় তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা তোমার উপযুক্ত কাজই বটে!
অতীতে পৈশাচী প্রাকৃত ভাষায় তৎকালীন শিষ্ট সমাজের জন্য সাহিত্যগ্রন্থ খুব কমই রচিত হয়েছিল, কিন্তু সেকালের নিম্নস্তরের জনসমাজে প্রচলিত লোকসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে পৈশাচী প্রাকৃতের ব্যবহার সর্বাধিক ছিল। গুণাঢ্যের লেখা —
‘বড্ডকহা’ (বৃহৎকথা) — অতীতে পৈশাচী প্রাকৃত ভাষায় রচিত অন্যতম জনপ্রিয় গ্রন্থ ছিল; রোমাঞ্চকর রূপকথা এবং বিবিধ কাহিনী — উক্ত গ্রন্থটির বিষয়বস্তু। কিন্তু ঐতিহাসিকেরা মূল গ্রন্থটির সন্ধান এখনও পর্যন্ত পাননি, তবে মূল গ্রন্থটির কাহিনীগুলি সংস্কৃত অনুবাদের মাধ্যমে রক্ষিত রয়েছে। পৈশাচী প্রাকৃতের গঠনে প্রাকৃতের সরলতর রূপ অপভ্রংশের আদি লক্ষণটি ধরা হয়েছিল। পৈশাচী প্রাকৃতের একটি নমুনা এরকম —
“পত্তুণ কিং ফটচণো নিচতেহতাণা
অত্থাসণং ফচতি চমফণিসূতণস্স।
ভোত্তুন খোরতর তুকখ-সতাই পাপা
মোহাণধকারগহণং লপ কিং লফন্তি॥”
অর্থাৎ — যোদ্ধাদের পক্ষে নিজের দেহদানের ফলে জ্যামববধকারীর (অর্থাৎ কৃষ্ণের) অর্ধাসন লাভ করবার সৌভাগ্য হয়; কিন্তু পাপীদের পক্ষে ঘোরতর শতশত দুঃখভোগ করবার পরেও গভীর মোহান্ধকারে নিমজ্জিত হওয়া ছাড়া আর কি বা লাভ হতে পারে!
উপরে মাগধী, মহারাষ্ট্রীয়, শৌরসেনী এবং পৈশাচী প্রাকৃতের যে সব নিদর্শন তুলে ধরা হল, সেগুলো সবই অতীতের সাহিত্যরচনায় ব্যবহৃত প্রাকৃত ছিল; সেজন্য সেগুলিকে সাধারণভাবে সাহিত্যিক প্রাকৃত বলা যেতে পারে। এগুলিকে সাহিত্যিক প্রাকৃত বলবার উদ্দেশ্য হল যে, সেযুগের জনসাধারণের কথ্য ভাষা কিন্তু ঠিক এরকম ছিল না। উপরে উল্লেখিত প্রাকৃত ভাষার সমস্ত ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি তৎকালীন সংস্কৃত ভাষায় রচিত নাটকের নিম্নশ্রেণীর পুরুষ বা রমণীদের কথোপকথন, গান ইত্যাদি থেকে নেওয়া হয়েছে। সেজন্যই এটিকে সাহিত্যে ব্যবহৃত প্রাকৃত বলা হচ্ছে, কথ্য প্রাকৃত বলা হচ্ছে না। অতীতে যাঁরা প্রাকৃত ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন, তাঁদের আলোচনাকে অবলম্বন করেই প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য গ্রন্থগুলিতে, কিংবা আগাগোড়া প্রাকৃত ভাষাতে রচিত কাব্য-কাহিনীগুলিতে (যথা — গাহা সতসই, গৌড়বাহ, সেতুবন্ধ, বড্ডকহা ইত্যাদি), অথবা জৈনদের সাহিত্য গ্রন্থগুলিতে প্রাকৃতভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল। সংস্কৃত ব্যাকরণের ছাঁচে বররুচি, শাকল্য, চণ্ড, কোহল, ভামহ, কাত্যায়ন, হেমচন্দ্র, রামতর্কবাগীশ, নরচন্দ্র প্রমুখ এই সাহিত্যিক প্রাকৃতকে অবলম্বন করেই প্রাকৃত ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। সেই ব্যাকরণসম্মত সাহিত্যিক প্রাকৃতই — বিভিন্ন কবি-নাট্যকার খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে শুরু করে প্রায় ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত, এই এগারোশো বছর ধরে — সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন নাটকে প্রয়োজনানুযায়ী ব্যবহার করেছিলেন। সেজন্যই তাঁদের নাটকে, অর্থাৎ সাহিত্য গ্রন্থগুলিতে খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর প্রাকৃত — যেটা ষোড়শ শতাব্দীর প্রাকৃতও ছিল — সেটার আর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। কারণ, সেটা ব্যাকরণ স্বীকৃত সাহিত্যের জন্য ব্যবহৃত — ‘standard classical’ প্রাকৃত ছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে পঞ্চম শতাব্দীর প্রাকৃত বদল ও সহজ হতে হতে, অপভ্রংশের বেড়া পার করে আধুনিক ভারতীয় আর্যভাষার স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল। খৃষ্টীয় নবম-দশম শতাব্দীতে অপভ্রংশ থেকে বাংলাভাষার উৎপত্তি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বিভিন্ন পুঁথিপত্রে ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত নাটকে তখনও পর্যন্ত ‘সাহিত্যিক প্রাকৃত’ প্রচলিত ছিল। সেই কারণে সাহিত্যিক প্রাকৃতকে ঠিক লোকায়ত ভাষা বলা সম্ভব নয়। সেটা কৃত্রিম ও শিষ্ট ছিল, এবং একমাত্র সাহিত্যেই সেই ভাষা ব্যবহৃত হয়েছিল।
সূত্র: ফেসবুক
0 মন্তব্যসমূহ