কমিউনিস্ট কমরেডের গল্প - সুষুপ্ত পাঠক

সাত সকালে সৈকত দাস উত্তেজিতভাবে বলতে লাগল, কমরেড জোড়ালো প্রতিবাদ করতে হবে! চলেন ফার্মগেইট যাবো...


কমরেড গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার জুনিয়র কমরেডের এহেন উত্তেজনায় খানিকটা বিরক্ত। ছোকরা দীক্ষা নিয়েছে বেশিদিন হয়নি। বিপ্লব করতে মুখিয়ে আছে। লেনিন-মাও জীবনী পড়ে কবে বিপ্লব হবে সেকথাই তার সারাদিন মাথায় ঘোরে। ছোকরার কান্ড শুনে গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার মনে মনে হাসেন। সেদিন নাকি সে বাসায় রাখা সবস্বতী মূর্তি সবার অলক্ষ্যে আছাড় দিয়ে ভেঙেছে। সে কাহিনী এসে বলতেই গোলাম মোহাম্মদ মুচকি এসে বলেছিল, মাথা ঠান্ডা রাখো কমরেড...


কিন্তু সাত সকালে ফার্মাগেইট যেতে হবে কেন? সেখানে কি শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করেছে? অনেকদিন ধরে কোন ইস্যু নেই। একটা কিছু পেলে ব্যানার ট্যানার বানিয়ে রাস্তায় নামা যেতো। সেরকম কিছু হচ্ছে না। গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ফার্মগেইট কেন সৈকত?


-শূকরের মাংস কিনবো কমরেড!


-মানে?


-শূকরের মাংস রান্না করে তারপর রাস্তায় সে মাংস খেয়ে প্রতিবাদ করতে হবে...


-কিসের প্রতিবাদ? গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার বিরক্ত।


-বলেন কী আপনি জানেন না? হোস্টেলে না জানিয়ে গরুর মাংস খাইয়ে দিয়ে কর্তৃপক্ষ বলেছে একদিন গরুর মাংস খেলে কি হয়? হিন্দু ছাত্রদের সঙ্গে ইচ্ছে করে এটা করা হয়েছে খোঁজ নিয়ে জেনেছি। গত মাসে ভারতে গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে ঝামেলা হওয়ার পর সেখানকার কমরেডরা রাস্তায় নেমে গরুর মাংস খেয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। আমাদের সেরকম একটা কিছু করে দেখাতে হবে কমরেড...


গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার মৃদু ধমক দিয়ে সৈকতকে বুঝালেন, এসব কি সৈকত? আমরা মার্কসবাদীরা কখনো ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাবো না। আমরা মানুষের রুটি-রুজি ভাত কাপড়ের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হবো। গরু খাওয়া না খাওয়া ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট। মার্কসবাদীরা কোন ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামায় না।


-কিন্তু কমরেড, আপনিই তো ভারতের গরু কান্ডের পর ফেইসবুকে গরু আরো বেশি বেশি খেয়ে হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি রাখার কথা বলেছিলেন। আপনিই বলেছিলেন গরুর মাংস হচ্ছে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে কড়া জবাব...


-আরে তুমি কিচ্ছু বুঝো না। সেটা আর এটা এক জিনিস নাকি? একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে হিন্দুদের গরুর মাংস খাইয়ে দেয়াটা কি এমন বড় ঘটনা বলো?


-কমরডে ভারতের মত বিশাল দেশে গরু খাওয়া নিয়ে ঝামেলা তো ঘটেছিল একটি রাজ্যে। তাও সেখানকার ছোট্ট একটা এলাকায়। পুরো রাজ্যে নয়। কিন্তু তার রেশ তো অনেক বড় হয়েছিল?


গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার অনেক কষ্টে মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করলেন। বাল পাকনা পোলাপান দুই পাতা বিপ্লব পড়ে আমাকে জ্ঞান দিতে আসছে! এখনো পোলা গ্রামসির নাম শুনেনি? ওর বই পড়তে গেলে তো দাঁত ভেঙে যাবে!


-শোনো সৈকত, এখন রোজা চলছে আর তুমি প্রকাশ্যে মাংস খাওয়ার কথা বলছো? তাছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের অনুভূতিতে কি আঘাত দেয়া ঠিক? আমাদের এখন ফিলিস্তিন নিয়ে বড় রকমের প্রতিবাদ করা দরকার। জায়নবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে, ফিলিস্তিনি ভাইদের পক্ষে কথা বলতে হবে। কোকাকলা পেপসি বয়কটের ডাক দিতে হবে। ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দিতে হবে...।


-কমরেড ঠিক বলেছেন। আমাদের বাসায় ইন্ডিয়ান কোলগেট টুথপেষ্ট ছিল। তাই আজ দাঁত মাজিনি! বয়কট ইন্ডিয়া!


-গুড ভেরি গুড!


-কমরেড একটা কথা...


-আবার কি কথা?


-চীনও তো উইঘুরদের উপর জুলুম করছে। ওদের পণ্য বয়কটের ডাক দিলে কেমন হয়? মোদি ঢাকা আসার সময় রাস্তায় নেমেছিলাম। পুলিশের মাইর খাইছি। এবার চাইনিজ দুতাবাসের ডাক দেন কমরেড!


গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার মহা বিরক্ত হলেন। সাত সকালে এ কী আপদ! ছোকরা তো দেখছি আমাদের লাইন এখনো বুঝতে পারেনি! আন্তর্জাতিক লাইনে কে আমাদের বন্ধু কে শত্রু তা তো বুঝতে হবে? এতখানি সরল হলে কি রাজনীতি করা চলে?

-শোনো, সৈকত, এখন বাসায় যাও। এসব নিয়ে পরে তোমাকে বুঝাবো। তোমাকে আরো ক্লাশ করতে হবে বুঝছো?


শুক্রবার। গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার পকেট থেকে নামাজের টুপি বের করে পরলেন। সৈকত হাঁ করে চেয়ে দেখল।


-আপনি নামাজ পড়তে যাবেন নাকি কমরেড?


-আরে এগুলো তো রিচুয়াল! সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের বাইরে রেখে তো বিপ্লব হবে না! তাদেরকে নিয়েই বিপ্লব করতে হবে। শুক্রবার জুম্মা আমাদের কালচারের অংশ বুঝলা?


-ইয়ে, আমি যে তাহলে সরস্বতীর মূর্তি ভাঙার পর আপনি কিছু বললেন না?


-ওটা তো কুসংস্কার! দেখো, ইসলাম এখানে আসার পর ইসলামের মহান ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহাবস্থা দেখে জাতপাতে অতিষ্ঠ মানুষ ইসলাম কবুল করেছিল। ইসলামের একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে। ইসলাম হচ্ছে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে একটা বিপ্লব...।


সৈকত চুপ করে গেলো। তার কেমন যেন লাগছে। যে রকম বিপ্লবের জোশ নিয়ে সে সকালবেলা কমরেডের কাছে এসেছিল এখন তা কোথায় যেন মিইয়ে গেছে। তার বুকের ভেতর এখন একটা শূন্যতা। একটা দিকশূন্যতা। কমরেড গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার তিন রাস্তার মাঝখানে এসে ডানে মোড় নিয়ে মসজিদের দিকে চলে গেলেন। কিন্তু সে কোথায় যাবে?


২.


জসিম উদ্দীন র এজেন্ট! গোলাম মোহাম্মদ তালুকদারের ধারণা জসিম ভারতের র’ হয়ে কাজ করে। নইলে সে কেন খালি ইসলামের সমালোচনা করে? তাকে তো হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে দেখি না? হুম, ডালমে কুছ কালা হ্যায়...


জসিম উদ্দীনকে খানিকটা ভয়ই পান গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার। মানুষটার মুখে বড্ড ধার!সামনাসামনি মুখে যা আসে বলে ফেলেন। তাকে পেলেই খোঁচায়। ফেইসবুকে অনেকবার তর্ক হয়েছে। ব্লক করার উপায় নেই। একই পাড়ায় থাকেন, কি করে এড়াবেন?

জুম্মার নামাজ শেষে গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার বাসায় ফিরছিলেন। তার সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের নেতা আল্লামা আবদুল কুদ্দুস। কুদ্দুস সাহেব হাসতে হাসতে গোলাম মোহাম্মদ তালুকদারের গায়ে চাপড় মারছিলেন। দূর থেকে জসিম উদ্দীন এই দৃশ্যটা দেখে মুচকি হাসছিল।


জসিম উদ্দীনকে দেখে গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার এড়াতে চাইল। কিন্তু জসিম উদ্দীন পাকড়াও করল।


-কমরেড রোজা রাখছেন নাকি?


গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার মনে মনে প্রস্তুতি নিলেন। উপায় নেই। জসিম উদ্দীনের হাত থেকে বাঁচার উপায় নেই। মনের অশান্তি গোপন করে গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার শান্তভাবে বললেন, রোজা রাখতেই পারি। সমস্যা কি?


-ঠিক বলেছেন কমরেড! আজকাল নাস্তিকরাও রোজা রাখতে বাধ্য হচ্ছে। পাড়ার একটা চায়ের দোকানও দেখি খোলা নেই। দুদিন আগে মাইকিং হয়েছে দিনের বেলা চায়ের দোকান খোলা যাবে না। শুনেছেন নাকি?


-কী জানি কোন খবর জানি না...


-বলেন কী? হাজার মাইল দূরের যোগীর রাজ্যে কি হয় তার খবর ঘন্টায় ঘন্টায় আপলোড দেন আর পাড়ায় যে মোল্লারা চায়ের দোকান খুলতে দেয়নি তার খবর আপনার কাছে নেই?


-সব খবর কি আমাকে রাখতে হবে?


-অবশ্যই নয়। তবে নিপীড়িতদের পক্ষে আপনি সব সময় রুখে দাঁড়ান। চা বেচে যারা তারা তো গরীব মানুষ। তাদের রুটি-রুজি বন্ধ করছে মসজিদ মাদ্রাসার ফেতরাখোররা সেটার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না?


-আপনে দাঁড়ান, আপনারে কে না করছে?


-আমি তো দাঁড়াবোই। বলেই জসিম উদ্দীন ফস করে একটা সিগারেট ধরালো। 


রোজার ভরদুপুর। যেতে যেতে রোজাদাররা জসিম উদ্দীনকে দেখছিল। সেদিকে জসিম উদ্দীনের ভ্রুক্ষপ নেই। জসিম উদ্দীন সিগারেট ধরিয়ে যেন গোলাম মোহাম্মদ তালুকদারকে বুঝালো চায়ের দোকান খুলতে না দেয়ার বিরুদ্ধে এটাই তার প্রতিবাদ।


-তা কমরেড, এই যে মসজিদে আপনার সামনেই আজকে ইমামসাব যে বলল, নারীরা একা ঘরের বাইরে বের হলেই শয়তান তার পিছু নেয়। মেয়েরা চাকরি করতে যায় মানে জেনার পথে, দোযগের পথে হাঁটা দেয়... এই রকম বুখারী হাদিসের রেফারেন্স দেয়ার পরও আপনি নির্বাক কেন?


-আপনে মসজিদে ছিলেন নাকি?


-আরে মসজিদে যাওয়া লাগেনি। মাইকে হুজুরের কথা এইখানে বসেই আমি শুনছি। তা আপনি বুখারী হাদিস নিয়ে কিছু বলেন?


-দেখন জসিম, ধর্ম নিয়ে আমাদের মার্কসবাদীদের কোন কথা নেই। আমরা মানুষর ভাতের অধিকার, শ্রমের অধিকার নিয়ে কথা বলি। ধর্ম বিদ্বেষ আমাদের কাজ নয়?


-ওরে চোদনা! তাইলে ফেইসবুকে মনুসহিংতা কোট করে নারী বিদ্বেষী হিন্দু শাস্ত্র নিয়ে পোস্ট দিছিলেন কেন?


গোলাম মোহাম্মদ তালুকদারের চেহারা থতমত হয়ে গেলো। তাকে বলছে চোদনা? লোকটার আস্পর্দা তো কম না?


-আপনি কথা ঠিকঠাক করে বলেন জসিম সাহেব! আপনি কিন্তু লিমিট ক্রস করছেন?


-তাই? আপনি যে বলেন আমার কাছে মোদির টাকা আসে? আমি বিজেপির হয়ে ভাড়ায় খাটি? কোন প্রমাণ আছে? মোদি যদি কাউকে টাকা দেয় মুসলমানদের ক্ষতি করতে সেটা দিবে আপনাকে। ইসলামের পক্ষে চোখ বন্ধ করে রাখা, মাদ্রাসার পক্ষে থাকাই তো মুসলমানদের জন্য ক্ষতি। আমি তো এই গুলির বিরুদ্ধে। এতে মোদির কি লাভ?


-দেখন, একটা কথা বলি, আজ থেকে আপনি যেমন আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, আমিও আপনাকে নিয়ে মাথা ঘামাবো না...


-উঁহু, তা হবে না। আপনি মনুবাদের নিন্দা করবেন সেটা খুব ভালো। কিন্তু ইসলামের সমালোচনার সময় আসলেই বলেন মার্কসবাদ কোন ধর্মের সমালোচনা করে না সেটা হবে না! এরকম করলে আমি কমরেডদের লুঙ্গি খুলে ফেলবই... হা হা হা...


-তাহলে আমিও আপনাকে র এজেন্ট বলব! আপনি বিজেপির টাকা খান...! রাগে কাঁপতে কাঁপতে গোলাম মোহাম্মদ তালুকদার হনহন করে হাঁটতে লাগলেন।


সেদিকে চেয়ে জসিম উদ্দীনের হাসি থামতেই চায় না...।


©সুষুপ্ত পাঠক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ