ধর্মান্তরের গল্প - সুষুপ্ত পাঠক

রায় বাবুরা তখন জমিদার। ছোট জাতের লোকজন কাজকর্মে এসে চলে গেলে তাদের আসন গঙ্গাজলে পবিত্র করা হতো। বামুনদের কাছে ছোট জাতের নমঃশূদ্র আর মুসলমান একই কথা। তাদের থালা বাটি আলাদা। এমনটাই হয়ে এসেছে। রায়দের তখনকার বাবুদের ব্যবহার আচার ভালো ছিল। ছোট জাতের প্রতি এই আচরণ আচারের অংশ বলেই মনে করত তারা।


তবে রায়দের বন্ধু ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রিট শহিদুল হক, কিংবা বোরহান খান উকিল যখন রায় বাড়িতে আসত তাদের জন্য রুপোর থালা বাটি বের হতো। খাস কামড়ায় তারা আড্ডা দিত। শহিদুল হক, বোরহান খান উর্দু বলেন। যদিও তারা জাতিতে বাঙালি। রায়দের সঙ্গে শহিদুল হকদের সামাজিক সম্পর্ক অনেকদিনের। ১৯৪০ সালের পর সম্পর্কটা আর এক জায়গায় থাকেনি। শহিদুল হকের পুত্র নাজমুল হক তখন লীগের নেতা। রায় বাবুরা যে মুসলমানদের নিচু মনে করে তাদের জলও স্পর্শ করে না সে কথা তখন নাজমুল হক হাটে মাঠে বলে বেড়াচ্ছে। রায় বাড়ির গরীব প্রজাদের কাছে তখন নাজমুল হক নেতা। মুসলমানদের নেতা।


রায়দের সুভাষ রায় তখন বাড়িতে বসে এসব কথা শুনে মনে মনে হাসতেন। ছোটবেলায় নাজমুল তার কোলে উঠে খেলতেন। তিনি ‘বড় মিয়া’ বলে তাকে কত আদর করতেন। সেই নাজমুল এখন লীগের নেতা। রায়দের আর মুসলমানরা মানবে বলে হুংকার দিচ্ছে। মুসলমানদের নিজেদের দেশ করতে না পারলে হিন্দুদের পায়ের নিচে চিরকালই পড়ে থাকতে হবে...। নাজমুলের এরকম ভাষণ আজকাল হাটে মাঠে সর্বত্র শোনা যাচ্ছে...।


দাঙ্গা হয়েছিল। রায়দের সব শরিকরা দেশ ছেড়ে চলে গেছে। কেবল একঘর রয়ে গেলো। ১৯৪৭ সালের প্রথম ইদুল আজহার দিন রায় বাড়ির সামনে গরু ফেলে কুরবাণী দেয়া হলো। রায়দের ছেলে শংকর রায় সেদিন সারাদিন ঘর থেকে বের হয়নি। সন্ধ্যের অন্ধকারে যখন গরুর হাড়গোড় ছুড়ে আসল উঠোনে তখন শংকর রায় বিমর্ষ হয়ে বসে থাকল।


নাজমুল হকের ছেলে শামসুল হক পূর্ব পাকিস্তানে পাঞ্জাবী পাঠানদের হাতে বাঙালীদের বৈষম্যের শিকার দেখে দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ছিল। একদিন রাগ ক্ষোভ থেকে তারা কয়েকজন লীগ থেকে বেরিয়ে আলাদা লীগ বানালো। নাজমুল হক শ্লোগান দিতেন নারায়ে তাকবীর আল্লাহো আকবর। শামসুল হক শ্লোগান দেয়া শুরু করলো জয় বাংলা...!


এদিকে শংকর রায়ের দুই ছেলের বড়টি কমিউনিস্ট পার্টিতে জড়িত হয়ে পড়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। ৬৫ সালের দাঙ্গার সময় হুলিয়া জারি হলে বড় ছেলে প্রেমময় রায় ভারতে চলে যায়। ছোট ছেলে স্নেহময় রায় ১৯৭১ সালে কোলকাতা শরণার্থী হয়ে গেলেও দেশ স্বাধীন হবার পর রায়গঞ্জে ফিরে আসে পৈত্রিক বাড়িতে। ৬৫ সালে এনিমি প্রোপার্টি হিসেবে দখল হওয়া সম্পত্তি দেশ স্বাধীন হবার পর আশা ছিল নিজেদের দখলে ফিরে পাবে। কিন্তু দেখা গেলো স্বাধীন দেশেও এনিমি প্রোপার্টি আইনটি বাতিল হলো না।


স্নেহময়ের একমাত্র কন্যা প্রীতিময় এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। সংস্কৃতি কার্যক্রমেও জড়িত ছিল। সেখানেই পরিচয় শোভন হকের সঙ্গে। শোভন রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে। ধনী অভিজাত। তবু নাটক কবিতা নিয়ে মেতে আছে। আলাপের সূত্রে প্রীতিময় জানতে পারল শোভনের দাদাবাড়ি রায়গঞ্জে। শোভন নাজমুল হকের নাতি। রায়দের সঙ্গে তাদের অতিত গভীর সম্পর্ক কম বেশি তারা পরিবার থেকে জেনেছে। ফলে দ্রুত বন্ধুত্ব হতে দেরি হয়নি।

২.

বন্ধুত্বটা কখন যে ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে কে জানে! স্নেহময়ের ব্যক্তিগত কোন ধর্ম বিশ্বাস নেই। সে মনে প্রাণে মার্কসবাদী। শোভন নাটক কবিতা চর্চা করলেও সে ধর্ম মানে। ধর্ম পালন তাদের পরিবারে সে অর্থে নেই। কিন্তু তার বাবা ইনশাল্লাহ আলহামদুরিল্লাহ ছাড়া কথা বলেন না। হজ করে এসেছেন কয়েকবার। কিন্তু মোল্লাদের একদম পছন্দ করেন না। ইসলামী রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িক বলেন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলেন। কিন্তু তিনি মুসলমান। তিনি বাঙালি।


শোভন ইতস্তত করে বলল, প্রীতি, বাড়িতে আমাদের বিয়ে কোন সমস্যা নয়।...শুধু... তোমাকে মুসলমান হতে হবে...


প্রীতিময় আহত হয়ে বলে, শোভন, আমাদের মধ্যে তো ধর্ম বাঁধা হওয়ার কথা ছিল না?


শোভন বেতিব্যস্ত হয়ে বলল, প্লিজ প্রীতি, আমাকে ভুল বুঝো না। ধর্ম আমাদের মধ্যে আগেও ছিল না এখনো থাকবে না। জাস্ট ফরমালিটির জন্য ইসলাম গ্রহণ করবে। তোমাকে ধর্ম পালনের জন্য আমার তরফ থেকে কোনদিন কোন চাপ থাকবে না...


স্নেহময় মেয়ের বিয়ের সংবাদ পেয়ে বজ্রাহতের মত বসে রইলেন। রায়গঞ্জের শেষ রায়টি এবার ইতিহাস থেকে মুছে যাবে। স্নেহময় বাড়িটি বেচে কোলকাতা চলে যাবার মনস্থির করে ফেললেন। আশির দশকে রায় রাজবাড়ি বিক্রি হয়ে যাবার সংবাদ খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল। রায়দের রাজবাড়ি এখন ‘আল ইসলাম এরাবিক ব্যাংক সোসাইটি’।


প্রীতিময়ের শ্বশুর শামসুল হক অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেন। তিনি পুত্রবধুকে সাদরে গ্রহণ করলেন। তাকে নতুন নাম দিলেন রাবেয়া বসরি। খাবার টেবিলে বসে তিনি সবাইকে সতর্ক করে দিলেন, রাবু মাকে কেউ কখনো গরুর মাংস খেতে বাধ্য করবে না। তার কোনদিন মন চাইলে সে খানে। না চাইলে খাবে না। আমার মায়ের যেন কোন অসুবিধান না হয়...


প্রীতিময়ের শাশুড়ি হোসনে আরা বউকে নিয়ে খুশি। হোসনে আরা সরল মহিলা। ধর্ম প্রাণ মানুষ। স্বামী তাকে বারবার বলে দিয়েছে, শোনো, বউমাকে অহেতুক কিছু মানতে টানতে চাপ দিবে না খরবদার!


হোসনে আরা সেই মত বউকে কিছু বলে না। তবে কখনো সখনো টুপ করে বলে ফেলে, শোনো মা, একবার নামাজ পড়ে দেখবা কী যে শান্তি লাগে! ...জোর নাই...


প্রীতি মুখ টিপে হাসে। বিয়ের পর এই বাড়ির একটি মানুষকেও সে বৈরী হিসেবে পায়নি। সবাই খুব ভালো। তবু কোথায় যেন একটা এডজাস্টমেন্ট করতে খানিকটা সমস্যা হচ্ছে। এটাই কি কালচার? মানুষে মানুষে বাঁধা কিসে? এই মিথ্যে কালচার?


একদিন খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। শুক্রবার দিন বলে আজ বড় করে আয়োজন। ভাত সবজি ছোট মাছ বড় মাছ খাসির রেজালা মুরগি আর গরু।


প্রীতিকে শাশুড়ি নিজে বেড়ে খাওচ্ছেন। মাছ শেষে মাংস এলো। খাসির রেজালা দিয়ে প্রীতি ভাত মেখে খাচ্ছে।


তখন শাশুড়ি হোসনে আরা মুখে আঁচল চেপে বলল, ও আল্লা, তোমারে তো খাসির বদলে গরু দিয়া ফেলছি!


প্রীতিময় তখন অনেকখানি খেয়ে ফেলেছে। সে জীবনে গরু খায়নি। তাদের দলের অনেক হিন্দু ছেলে প্রথা ভাঙ্গার জন্য গরুর বিরিয়ানি এনে খেতো। কিন্তু তার কখনো গরু খেতে মন চায়নি। এটা সম্ভবত পারিবারি নাষিদ্ধতার কালচার। শাশুড়ির হঠাত সতর্কতায় তার বুকটা ধক করে উঠল। তারপর সামলে নিয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। কোন সমস্যা নেই। গরুর মাংস খেলে তো আর মরে যাবো না...


প্রীতি কথাটা আর শেষ করতে পারল না। তার পেট নাড়া দিয়ে একটা গোঁত্তা মারলো। সে কোনমতে বাথরুমের কমেডের সামনে গিয়ে মাথাটা নামালো। তারপর হড়বড় করে বমি করতে লাগল...


©সুষুপ্ত পাঠক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ