ভোজশালা কামাল মৌলানা মসজিদ আসলে রাজা ভোজ প্রতিষ্ঠিত সরস্বতী মন্দির - সমর পাল

ভোজশালা কামাল মৌলানা মসজিদ আসলে রাজা ভোজ প্রতিষ্ঠিত সরস্বতী মন্দির

ভোজশালা কামাল মৌলানা মসজিদ আসলে রাজা ভোজ প্রতিষ্ঠিত সরস্বতী মন্দির


আদালতের নির্দেশে হিন্দুরা পেয়েছে মসজিদে সরস্বতী পূজার অনুমতি! মধ্যপ্রদেশের ভোজশালা কামাল মৌলানা মসজিদ আসলে রাজা ভোজ প্রতিষ্ঠিত সরস্বতী মন্দির!


"ভোজবাজি", "ভানুমতীর খেল" ইত্যাদি শব্দগুলি আমাদের অতি পরিচিত। কিন্তু যা আমাদের অনেকেরই অজানা তা হল, এই শব্দগুলির উৎপত্তি কোথায়। ভোজবাজি বা যাদুবিদ্যা হল পারমার বংশীয় রাজা ভোজের সৃষ্ট বিদ্যা এবং ভানুমতী ছিলেন তাঁর কন্যা। মধ্যপ্রদেশে বা মালবদেশে রাজধানী গড়ে তোলেন রাজা ভোজ এবং নিজের নামানুসারে নগরীর নামকরণ করেন ভূজপাল। বর্তমানের ভোপাল বা ভূপাল সেই ভূজপালেরই অপভ্রংশ।


পারমার রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন সিন্ধুরাজার পুত্র ভোজরাজ। তিনি ১০১০ থেকে ১০৬০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত মালবদেশে রাজত্ব করেছিলেন। অসম সাহসী ভোজরাজের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল ভারত আক্রমণকারী গজনীর সুলতান মামুদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করা। সোমনাথের মন্দির ধ্বংস ও লুঠ করে সুলতান মামুদ মধ্যপ্রদেশ আক্রমণ করবার পরিকল্পনা করেন, কিন্তু ভোজরাজের রণকৌশল পারদর্শিতা ও প্রবল প্রতিরোধে তিনি রণেভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হন।


রাজা ভোজ শুধু বীরই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট পন্ডিত ব্যক্তি। তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য গ্রন্থ, যেগুলির বিষয়বস্তু ছিল সাহিত্য, দর্শন, ধর্মশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রয়োগবিজ্ঞান, স্থাপত্য ইত্যাদি। তাঁর রচিত প্রতিটি গ্রন্থ ছিল জ্ঞানের ভান্ডার। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছেন "একজন দক্ষ লেখক হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল সমগোত্রীয় পন্ডিতদের সমান"। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল, সমরঙ্গসূত্রধর (প্রযুক্তিবিদ্যার বিশ্লেষণ), রসরাজমৃগাঙ্ক (রসায়নশাস্ত্রের ব্যাখ্যা), রজমার্তন্ড (পতঞ্জলি যোগসূত্রের ভাষ্য), জ্যোতিষরাজমৃগাঙ্ক (জ্যোতির্বিদ্যা বিশ্লেষণ) ইত্যাদি। ইন্দ্রজাল বিদ্যা বা যাদুবিদ্যার ওপরেও তাঁর ছিল অসীম জ্ঞান ও দক্ষতা। ভোজরাজের এই যাদুবিদ্যা প্রদর্শনের ক্ষমতার নামই হয়ে যায় "ভোজবাজি", যা আজকে ম্যাজিক নামে পরিচিত।


রাজা ভোজ দেবী সরস্বতীর গুণগ্রাহী ছিলেন। তিনি তাঁর রাজ্যে সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির প্রসারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বিদ্বান ও গুণী ব্যক্তিদের তিনি উপযুক্ত সমাদর করতেন। মালব প্রদেশের ধারা নগরীতে  (বর্তমানে ধার নামে পরিচিত) তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক পাঠশালা, যা তৎকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করেছিল। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছিল "ভোজশালা" বা ভোজরাজের পাঠশালা। ভোজশালায় পড়ানো হত সংস্কৃত সাহিত্য, জ্যোতির্বিদ্যা, যোগবিদ্যা, সঙ্গীত, আয়ুর্বেদ, দর্শন প্রভৃতি বিষয়গুলি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্রেরা এখানে পড়তে আসতেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠিত ছিল দেবী সরস্বতীর মন্দির ও বিগ্রহ। তবে "ভোজশালা" শুধু মন্দির ছিলনা, রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি হাজারো ছাত্র ও জ্ঞানী মানুষের পদচারণায় এটি বিদ্যাশিক্ষার একটি মুখ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল।


এতদূর পড়ে পাঠকবৃন্দ ভাবতে পারেন যে প্রদত্ত ছবি ও ক্যাপশনের সঙ্গে এই লেখার কী সম্পর্ক! আসলে, এতক্ষণ যা বিবরণ দেওয়া হল, এটি ছিল মূল কাহিনীর ব্যাকগ্রাউন্ড। এবারে কাহানী মে ট্যুইস্ট। ১৩০৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রথমবার ভোজশালা আক্রমণ করেন মুসলিম আক্রমণকারী আলাউদ্দীন খিলজী। ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করা হয়েছিল যদিও তার অনেক আগে, ১২৬৯ খ্রীষ্টাব্দে। সেইসময়ে মালব প্রদেশে এসেছিলেন একজন মুসলিম ফকির, যাঁর নাম ছিল কামাল মৌলানা । দীর্ঘকাল তিনি মালব প্রদেশে অবস্থান করেন এবং সেখানকার হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করবার জন্য নানারকম কূটকৌশল প্রয়োগ করতে থাকেন। তিনি মালব প্রদেশ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি দিয়ে আলাউদ্দীন খলজীকে সাহায্য করলে, নিষ্ঠুর খিলজী ভোজশালা আক্রমণ করেন ও বহুসংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করে ভোজশালা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেন।


এর প্রায় একশো বছর পর, ১৪০১ খ্রীষ্টাব্দে আর এক মুসলিম আক্রমণকারী দিলাওয়ার খান ধার রাজ্য আক্রমণ করেন ও ভোজশালা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশে একটি দরগা নির্মাণ করেন। আবার ১৫১৪ খ্রীষ্টাব্দে মামুদ শাহ ভোজশালা আক্রমণপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের সরস্বতী মন্দিরের পাশে সেই ফকির মৌলানা কামালুদ্দিন সহ চারজনের সমাধি নির্মাণ করে দেন। এরপর থেকে ভোজশালার ধ্বংসপ্রাপ্ত সরস্বতী মন্দিরের কাঠামোর উপর নির্মিত মসজিদে মুসলিমরা নিয়মিত নামাজ পড়ে আসছেন। ১৭০৩ খ্রীষ্টাব্দে মালব প্রদেশ মারাঠারা দখল করে নিলে এখানে মুসলিম শাসনের অবসান হয়। পরবর্তীতে ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মালব প্রদেশ অধিকার করে এবং তারাও যথেচ্ছ ধ্বংসলীলা ও লুঠতরাজ চালায়। তারা দেবী সরস্বতীর মূর্তি ভোজশালা থেকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যায়, যা এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।


ভোজশালা প্রাঙ্গণ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যা থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় এখানে ছিল দেবী সরস্বতীর মন্দির। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি লিপি যেখানে "বিজয়শ্রীনাটিকা" নামক একটি গীতিনাট্য খোদিত রয়েছে এবং উল্লেখ করা হয়েছে, দেবী সরস্বতীর মন্দিরে রাজা অর্জুনবর্মণের সম্মুখে এই গীতিনাট্য পরিবেশিত হইল। এছাড়াও বিভিন্ন অংশে খোদিত রয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃত শ্লোকের অংশ, স্তোত্র, ভোজরাজের লিপি, গাণিতিক নকশা, সর্পিলাকৃতি জ্যামিতিক নকশা ইত্যাদি।


বর্তমানে ভোজশালার কামাল মৌলানার দরগা ও মসজিদ রয়েছে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্বাবধানে। ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দে ভারত সরকার ভোজশালার দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের (Archaeological Survey of India)) হাতে তুলে দেয়। ভোজশালায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা নামাজ পড়তে পারতেন কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা ভোজশালা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারলেও সেখানে তাদের পূজা করবার অধিকার ছিল না। ১৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দে মধ্যপ্রদেশ সরকার ভোজশালা প্রাঙ্গণে হিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করলে জনরোষ সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আদালতে গিয়ে ভোজশালাকে রাজা ভোজ নির্মিত দেবী সরস্বতীর মন্দির বলে দাবী করে সেখানে হিন্দুদের পূজা করবার অনুমতি ও মুসলিমদের নামাজ পড়া বন্ধ করবার দাবী জানান। বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন হয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আদালত ঐ স্থানে প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হলে, ভোজশালা প্রাঙ্গণে হিন্দুদের প্রবেশের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। আদালতের নির্দেশে বসন্ত পঞ্চমী বা সরস্বতী পূজার দিন এবং প্রতি মঙ্গলবার হিন্দুরা ভোজশালা প্রাঙ্গণে পূজা করবার অনুমতি পায় এবং মুসলিমরা প্রতি শুক্রবার নামাজ পড়বার অনুমতি পায়। সপ্তাহের অন্যান্য দিন যে কেউ প্রবেশ করতে পারেন, তবে অন্যান্য দিনে এখানে পূজা বা নামাজের অনুমতি নেই।


আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সব ঠিকঠাক চললেও, যদি কখনও বসন্তী পঞ্চমী শুক্রবার পড়ে তাহলেই সব হিসাবের গোলমাল হয়ে যায়। প্রশাসন ঐ দিনে সরস্বতী পূজা ও নামাজের ভিন্ন সময় নির্ধারিত করে দিলেও কোনও পক্ষই তা মানতে চায় না। দুই পক্ষই রণং দেহি মূর্তিতে ভোজশালা প্রাঙ্গণে এসে জমায়েত করতে থাকেন। তখন হাজারো পুলিশ আর আধা-সামরিক বাহিনী নামিয়ে শান্তি নিশ্চিত করতে হয়। বহুবার লাঠিপেটা করে, কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে পরিস্থিতি সামলাতে হয়েছে প্রশাসনকে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির বক্তব্য, ভোজশালা দেবী সরস্বতীর মন্দির, এখানে নামাজ পড়া বন্ধ করা হোক। অন্যদিকে মুসলিমদের নানা সংগঠনের দাবী, ভোজশালায় পূজা-অর্চনা বন্ধ করে তা সম্পূর্ণভাবে নামাজের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।


মধ্যপ্রদেশ তথা ভারতের রাজনীতিতে ভোজশালা একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ইস্যু। বিষয়টি এখনও আদালতের বিচারাধীন। এই লেখায় প্রাচীন ও ঐতিহাসিক ভোজশালার ইতিহাস সংক্ষেপে জানাবার চেষ্টা করলাম। এখন নিজের বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী আপনিই ভেবে দেখুন কোনটি ঠিক আর কোনটি ভুল।


তথ্যসূত্র:

  • Michael Willis - Dhār, Bhoja and Sarasvatī: from Indology to Political Mythology
  • Ahmad Nabi Khan - Islamic Architecture in South Asia: Pakistan, India, Bangladesh
  • সুবোধ কুমার চক্রবর্তী - রম্যাণি বীক্ষ্য (অবন্তী পর্ব)


সূত্র: ফেসবুক



আরো জানতে নিচের ভিডিওটি দেখুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ