কেন আমি সনাতনী হিন্দু হয়ে আজ গর্ববোধ করি? - রাজীব ধর

কেন আমি সনাতনী হিন্দু হয়ে আজ গর্ববোধ করি? - রাজীব ধর

একটা সময় আমি খুব সংশয়বাদী ছিলাম। আজ থেকে ৩ বছর আগেও আমার হিন্দু ধর্মের রীতিনীতি, পুজা, আস্থা, অর্চণা, এগুলি আমার কাছে নিছকই অর্থহীনই মনে হতো। যেহেতু আমি বাংলাদেশেই থাকি, হিন্দু পরিচয়, হিন্দু আইডেন্টিটি নিয়ে আমার অস্তিত্বটা ঠিক যেন নড়বড়ে ছিলো। আসলে আমার অস্তিত্ব সংকটে ভোগার যথার্থ একটা কারণ ছিলো। কারণ ছোট বেলা থেকেই আমরা বেড়ে উঠেছিলাম হিন্দুফোবিয়ার শিকার হয়ে। শৈশবে (শৈশব কেন বলছি, এখনো তো দেখা যায়) এখানের আরব্য ধর্মানুসারীরা আমাদের হিন্দু ধর্মকে কথায় কথায় ঠাট্টা-মশকরা করতো। তোদের অমুক প্রতিমা এমন, তোদের তমুক মুর্তি এমন। বাংলাদেশ মুসলমানদের দেশ, তোদের দেশ ভারত। কিন্তু আমরা কিছুই বলতে পারতাম না। আরব্য ধর্মানুসারী স্কুল-কলেজের অনেক বন্ধু আমাদের হিন্দু ধর্মকে নিয়ে অযাচিতভাবে নানা কথা বলে শোনাতো। কিন্তু আমরা তাদের ধর্ম নিয়ে কিছুই বলতাম না। কারণ একের পর এক বাংলাদেশের রাষ্ট্র চালকরা আমাদের শিখিয়েছে, এটা সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম রাষ্ট্র, তুমি তো হিন্দু, এদেশে তোমাদের সংখ্যা কম, তাই তোমরা সংখ্যালঘু।


অথচ এই বাংলাদেশের ১০০% ভুমিই ছিলো হিন্দুদের। আজ থেকে ৫ বা ৬ শ বছর আগেও এই বঙ্গভুমিতে স্থায়ীভাবে মুসলমান সাম্প্রদায়ের কোনো অস্তিত্বই ছিলো না। যদি প্রশ্ন করেন, তাহলে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের কোটি কোটি মুসলিমরা কোত্থেকে আসলো? এঁরা কি তাহলে হাজার হাজার কিলোমিটার দুরের আরব অঞ্চল থেকে ইসলাম ধর্মকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো? না রে ভাই, ওরা এক সময় সবাই ছিলো হিন্দু। আমার কথা বিশ্বাস না হলে, এদেশের হিন্দু-মুসলমানদের DNA পরীক্ষা করুন, DNA ই বলবে ওদের আদি পুরুষ কারা ছিলো? আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের কোটি কোটি মুসলমানদের পুর্ব পুরুষই ছিলো হিন্দুদের বংশধর। অখণ্ড ভারতে এই কোটি কোটি মুসলমানদের অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছে মোঃ ঘুরি, বখতিয়ার খিলজিদের তরবারির জোরেই। আজ আমাদের উপমহাদেশে ক্যামব্রিজ, ক্যালিফোর্নিয়া বা হাভার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও অনেক পুরোনো এবং জগতবিখ্যাত এক বিশ্ববিদ্যালয় থাকতো, তা হলো বর্তমান ভারতের বিহারে নালান্দা জেলার নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়। কোথাকার মুর্খ অসভ্য বর্বর বখতিয়ার খিলজিরা এসে বাংলা আক্রমন করার সময় এই জগতবিখ্যাত নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙ্গে লাইব্রেরীর লক্ষ লক্ষ বই পুড়িয়ে দিয়েছিল। ওরা তো মুর্খ, বর্বর। সৃষ্টি তো করতে জানে না, শুধু ধ্বংসই করতে জানে।


বাংলাদেশের হিন্দুরা সভ্যতা শুরু করেছিলেন ৪০০০ বছর (সেই সময় এই বঙ্গভুমি ছিলো বসবাসের অযোগ্য এক বিস্তৃত জঙ্গল ভুমি) আগেই। আর আরব্য ধর্ম ও সংস্কৃতি এই অখন্ড ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে গেড়ে বসেছিলো মাত্র ৫০০ বছর আগে। যেদিন উজবেকিস্তান থেকে পরাক্রমশালী হিন্দু বিদ্ধেষী বাবর এসে দিল্লি আক্রমন করে দিল্লির মসনদে বসেছিলো, সেদিন থেকেই। সেই সময়টা বোধহয় ১৫২৬ বা ১৫২৭ সালে হবে। সেদিন থেকেই দিল্লিতে বারবের হাত ধরেই প্রথম মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। উজবেকিস্তান থেকে আসা এই বারব-ই উত্তর প্রদেশে অযোধ্যার রাম মন্দির ভেঙে এর উপর বাবরি মসজিদ তৈরি করেছিলো। অথচ উজবেকিস্থান থেকে আসা এই বর্বর সম্রাট বাবরের নামে মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে হাজার হাজার মন্দির, মুর্তি ভাঙ্গা হয়েছিল। শুধু কি তাই, হিন্দুদের অনেক ঘরবাড়ি লুটপাট করা হয়েছিল। অনেক হিন্দু নারীকে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিলো। অনেক হিন্দু যুবকদের কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো। এই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক আক্রমণ নিয়ে আমাদের দেশের সাংবাদিকরা একটা ডকুমেন্টারি পর্যন্ত তৈরি করেনি। ১৯৯২ সালে ৬ই ডিসেম্বর সারা বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর উগ্রবাদী মুসলমানরা যে ভয়াবহ আক্রমণ করেছে, সেই ইতিহাসের সত্যতা পাওয়া যায় তসলিমা নাসরিনের লেখা উপন্যাস "লজ্জা" বই-এ। লজ্জা বই তসলিমা নাসরিনের কোনো কল্পিত উপন্যাস নয়, এটা সত্য ঘটনাকে অবলম্বন করেই লেখা হয়েছে। যে বইটি ছিলো অনেক তথ্যভিত্তিক। আর হিন্দুদের উপর হওয়া ভয়াবহ আক্রমণকে আড়াল করার জন্য তৎকালীন খালেদা জিয়া সরকার বইটিকে নিষিদ্ধ করে দেয়।


এইদেশে এখনো ৯০% আরব্য ধর্মানুসারীরা বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার মুখ রোচক গল্প করে থাকেন। কিন্তু বাবরি মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের উগ্র মুসলমানরা যে হাজার হাজার মন্দির ভেঙ্গেছে তা কিন্তু এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নিরবেই এড়িয়ে যান। আজ যদি ১ম মোঘল সম্রাট বাবর বেচে থাকতেন, তাহলে তার কাছ থেকে জানতে চাইতাম, আরে ভাই আপনি কে? আপনি কোত্থেকে আসছেন? আপনাকে কে অধিকার দিয়েছে যে, আমাদের আদি পুরুষ রামের মন্দির ভেঙ্গে এখানে নিজের নামে বাবরি মসজিদ তৈরি করার? আমাদের পুর্বপুরুষ হিন্দুরা কি আপনাদের সৌদি আরবে গিয়ে কখনো আক্রমণ করেছিলো? লুটপাট করেছিলো? সেখানে গিয়ে পুরুষদের হত্যা করে নারীদের গণিমতের মাল ভেবে ধর্ষণ করেছিলো? কিংবা ৫ বা ৬শ বছর আগে আমাদের হিন্দু আদি পুরুষরা ওখানে গিয়ে মসজিদ ভেঙ্গে কখনো মন্দির তৈরি করেছিলো? না। তো আপনি ঠিক কোন অধিকারে ভারতে এসে রাম মন্দির ভেঙ্গে নিজের নামে বাবরি মসজিদ তৈরি করেছিলেন? রাম মন্দিরের উপর এই মসজিদটি তৈরি করে হিন্দু-মুসলমান প্রথম দ্বন্দ্বটা আপনিই কি তৈরি করেননি?


হিন্দুদের বিয়ের রীতিনীতি, সাত পাকে বাঁধা, পুজা, অর্চণা, এগুলি আজকের নয়, হাজার হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতা। বাংলায় দুর্গা পুজা, মনসা পুজা, বিপুলা, লক্ষ্মীন্দর, এগুলি শুধু হিন্দুদের ধর্মই নয়, এগুলি হাজার বছর ধরে বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান ঐতিহ্য-ই বহন করে আসছে। আমাদের হিন্দু ধর্ম হলো ভারতীয় ধর্ম। আর ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মুসলমানদের ইসলাম ধর্ম হলো আরব থেকে বয়ে আসা আরবীয় ধর্ম। তো আমাদের হিন্দু ধর্ম, আমাদের হিন্দুত্ববাদীতাকে আপনি কোন এঙ্গেল থেকে অস্বীকার করবেন ভাই? বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের বিতারিত করার ইচ্ছা আপনি কোন নৈতিক মূল্যবোধ থেকে পোষণ করেন?


এই বাংলাদেশে আমরা হিন্দু ঘরে জম্ম নিয়ে অনেক কিছু গা সওয়া হয়ে গেছে। এদেশে হিন্দু-মুসলমানদের জন্য এক আইন এক সংবিধান থাকলেও কিন্তু দেশ ভাগের সেই ১৯৪৭ সাল থেকে এদেশের হিন্দুরা জম্মভুমির মায়া ও জান-মাল নিরাপত্তার স্বার্থে শয়ে শয়ে দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কই আমরা হিন্দুরা তো সুদুর সৌদি আরবে গিয়ে কোনো মুসলমানদের তাড়ায়নি। তো আমাদের হিন্দুদের আদি জম্মভুমি বাংলাদেশ থেকে আরব্য ধর্মানুসারী উগ্র মুসলমানরা ঠিক কোন অধিকারে নিশ্চিহ্ন করতে চাই?


অবশেষে বলি, আমি গত দুই-আড়াই বছর ধরে হিন্দু ধর্ম, তথা সনাতন সংস্কৃতি ও তার শেকড় কোথায়, এই হিন্দু ধর্ম কোথা থেকে আসলো, তার উৎপত্তি কোথা থেকে শুরু হলো তা নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছি। বহুদিন ধরে রিসার্চ করেছি। এগুলি পড়ে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আমাদের হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি বিদেশ থেকে আসা কোনো ধর্ম নয়। আমি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন এই সনাতন হিন্দু ধর্ম নিয়ে আজ গর্ববোধ করি। আমাদের আদি হিন্দুরা আজ থেকে ৭০০০ বছর আগেই ভারতের সিন্দু নদের তীরেই সভ্যতা শুরু করেছিলো। এই বাংলাদেশে মুসলিমরা দয়া করে হিন্দুদের থাকতে দেয়নি, বরঞ্চ ৫শ বছর আগে থেকে আমরা হিন্দুরাই আপনাদের দয়া করে থাকতে দিয়েছিলাম অঞ্চলে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক এসব মুসলিম লীগের নেতারা গাদ্দারী করে ১৯৪৭ সালে পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে ভারত থেকে আলাদা করেছিল। আপনি ধর্মের ভিত্তিতে একটা দেশকে জোরপূর্বক আলাদা করলেই এটা সাথে সাথে আরব্য সংস্কৃতির মুসলিম দেশ হয়ে যায় না। আপনি ইন্দোনেশিয়াকে দেখেন। ইন্দোনেশিয়া ৯৯% মুসলিমদের দেশ হয়েও ওরা এখনো ওদের আদি সংস্কৃতি হিন্দুর রীতিনীতি মেনে চলেন। ওদের টাকায় গনেশ দেবতার ছবি থাকে। আমাদের দুর্গাপূজা, মনসা পুজা, কালি পুজা, রাম নবমী, কৃষ্ণনাম, উপবাস ব্রত, এসব হিন্দুয়ানী ধর্ম ও সংস্কৃতি বাংলা সভ্যতার শুরু থেকেই ছিলো, আছে, এবং পৃথিবী বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত থাকবেই। যেসব উগ্রবাদীরা এসে বলেন, আমাদের ঠাকুর পুজা, অর্চনা, আরাধনা, পুজার বাদ্য বাজনা, এগুলি তাদের ধর্ম বিরোধী। তাহলে তাদের চোখে চোখ রেখে বলুন, আপনার সমস্যা হয় তো আপনি ভাই আরবে চলে যান। আমাদের ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতি হাজার হাজার ধরে এই অঞ্চলে ছিলো, আছে এবং চিরকাল থাকবে। পৃথিবীর কোন শক্তিই এগুলো দাবিয়ে রাখতে পারবে না। নমস্কার, জয় হিন্দু ধর্মের জয়। জয় সনাতন ধর্মের জয়।


রাজীব ধর

২২/৫/২৩ইং

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ