স্বামী বিবেকানন্দ : তেজোদীপ্ত হিন্দু সন্ন্যাসী নাকি আধুনিক মানবতাবাদী

স্বামী বিবেকানন্দ : তেজোদীপ্ত হিন্দু সন্ন্যাসী নাকি আধুনিক মানবতাবাদী

 

স্বামী বিবেকানন্দকে ঠিক হিন্দু সন্ন্যাসী বলা যায় না, যাই বলুন। ওরকম একজন আধুনিক, প্রগতিশীল মানুষ যার মধ্যে গোঁড়ামির লেশমাত্র নেই, তাকে কি ভাবে হিন্দু সন্ন্যাসী বলা যায়? যিনি জাতপাতে আবদ্ধ হিন্দু সমাজকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছিলেন নিয়মিত, কি করে তাঁকে হিন্দুধর্মের সাথে জড়ানো যায়? তিনি আসলে সব ধর্ম সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন, কোন ধর্মের তিনি নন। ওনাকে মানবতাবাদী বলাই সঠিক।


মোটামুটি বেশিরভাগ শহুরে শিক্ষিত বাঙালি এরকম ভেবেই থাকেন। কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যখন বিবেকানন্দের স্মরণে কোন অনুষ্ঠান পালন করে, সেখানেও দেখা যায় ‘সংস্কৃতিবান শিক্ষিত' মানুষেরা অতি-সতর্ক থাকেন যেন কোনোভাবেই ‘হিন্দু’ শব্দটি চলে না আসে কথা বা লেখার মধ্যে। ‘হিন্দু’ শব্দটি চলে এলেই এই ‘প্রগতিশীল ‘ সমাজ একঘরে করে দিতে পারে, ‘জাত’ যাওয়ার ভয়ে তাই ‘জাতপাতের উর্ধ্বে’ অবস্থানকারী মানুষদের এক ধরনের শপথগ্রহণ করতে হয়: বিবেকানন্দ আর হিন্দু, নৈব নৈব চ ।


“আমাদের বিশ্বাস- সব প্রাণীই ব্রহ্মস্বরূপ। প্রত্যেক আত্মাই যেন মেঘে ঢাকা সূর্যের মতো; একজনের সঙ্গে আর একজনের তফাত কেবল এই-কোথাও সূর্যের উপর মেঘের আবরণ ঘন, কোথাও এই আবরন একটু পাতলা; আমাদের বিশ্বাস-জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে এটি সকল ধর্মের ভিত্তিস্বরূপ; আর শারীরিক, মানসিক বা আধ্যাত্মিক স্তরে মানবের উন্নতির সার কথাটাই এই- এক আত্মাই বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে আপনাকে প্রকাশ করছেন।


আমাদের বিশ্বাস-এই হলো বেদের সার রহস্য।


আমাদের বিশ্বাস-প্রত্যেক ব্যক্তির অপর ব্যক্তিকে এইভাবে অর্থাৎ ঈশ্বর বলে চিন্তা করা উচিত ও তার সঙ্গে তেমনভাবে ব্যবহারও করা উচিত, কাকেও ঘৃনা করা বা কোনরূপে কারও নিন্দা বা অনিষ্ট করা উচিত নয়। আর এ যে শুধু সন্ন্যাসীর কর্তব্য তাই নয়, প্রত্যেক নরনারীরই কর্তব্য।


আমাদের বিশ্বাস-আত্মাতে লিঙ্গভেদ বা জাতিভেদ নেই বা তাঁতে অপূর্ণতা নেই।


আমাদের বিশ্বাস-সমুদয় বেদ, দর্শন, পুরাণ ও তন্ত্ররাশির ভিতর কোথাও এ কথা নেই যে আত্মায় লিঙ্গ, ধর্ম বা জাতিভেদ আছে।“


উপরের কথাগুলো স্বামীজির একটি চিঠির অংশবিশেষ। চিঠিটি 1894 সালের মার্চ মাসে স্বামীজি Chicago থেকে লিখেছিলেন ভারতে তাঁর এক ভক্তের উদ্দেশ্যে। কথাগুলোর মধ্যে জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায় কে কেন্দ্র করে কোনোরকম বিভেদের কথা আছে নাকি বিভেদ যে থাকতে পারে না, সেটাই বিশেষভাবে বলা আছে? এই যে সামগ্রিক সাম্যের কথা স্বামিজী উচ্চারণ করছেন তাঁর চিঠির মাধ্যমে, তিনি কি কোনো Secular Source এর উল্লেখ করেছেন? তিনি তো নাম নিচ্ছেন বেদ পুরাণ তন্ত্ররাশির। মানে স্বামীজি হিন্দু শাস্ত্র কে ভিত্তি করেই সাম্যের বাণী উচ্চারন করছেন, বিভেদহীন মানবিক সম্পর্কের কথা মেলে ধরছেন।


“...যেন প্রত্যেক জাতিরও এইরূপ একটি বিশেষ কেন্দ্রে জীবনীশক্তি সঞ্চিত আছে,তাহাতে হাত না পড়া পর্যন্ত কোন দুঃখবিপদই সেই জাতিকে বিনষ্ট করিতে পারে না।

ধর্মেই ভারতের এই জীবনীশক্তি। যতদিন হিন্দুরা তাহাদের পূর্বপুরুষগণের নিকট উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান বিস্মৃত না হইতেছে, ততদিন জগতে কোন শক্তি তাহাদের ধ্বংস করিতে পারিবে না।

যে ব্যক্তি সর্বদাই স্বজাতির অতীতের দিকে ফিরিয়া তাকায়,আজকাল সকলেই তাহাকে নিন্দা করিয়া থাকে। অনেকে বলেন ,এইরূপ ক্রমাগত অতীতের আলোচনাই হিন্দুজাতির নানারূপ দুঃখের কারণ। কিন্ত আমার বোধ হয়, ইহার বিপরীতটিই সত্য। যতদিন হিন্দুরা তাহাদের অতীত ভুলিয়া ছিল, ততদিন তাহারা হতবুদ্ধি হইয়া অসাড় অবস্থায় পড়িয়াছিল। যতই তাহারা অতীতের আলোচনা করিতেছে, ততই চারিদিকে নতুন জীবনের লক্ষণ দেখা যাইতেছে। অতীতের ছাঁচেই ভবিষ্যতকে গড়িতে হইবে, এই অতীতই ভবিষ্যত হইবে।

অতএব হিন্দুগণ যতই তাঁহাদের অতীত আলোচনা করিবেন, তাঁহাদের ভবিষ্যত ততই গৌরবময় হইবে; আর যে কেহ এই অতীতকে প্রত্যেকের কাছে তুলিয়া ধরিতে চেষ্টা করিতেছেন, তিনিই স্বজাতির পরম হিতকারী।“


স্বামীজির একটি চিঠির অংশ এটি । চিঠিটি উনি ১৮৯৫ সালে লেখেন আমেরিকায় বসে।।


স্বামীজি ভবিষ্যতের কথা ভেবেছেন অবশ্যই, কিন্ত ভবিষ্যতের কথা ভাবলে অতীতকে অগ্রাহ্য করতে হবে এরকম ‘প্রগতিশীল’ যে উনি ছিলেন না সেটা বুঝতে খুব জটিল চিন্তার প্রয়োজন আছে কি? ঐতিহ্য আর আধুনিকতার সঠিক মিশেলেই যে নতুন ভারতের জন্ম হতে পারে, এটা দৃঢ় ভাবে স্বামীজি বিশ্বাস করতেন। অতীত ভারতের জ্ঞান চর্চার কথা উত্থাপন করলেই যারা কুন্ঠিত হয়ে পড়েন, বৈদিক গণিত নিয়ে গবেষনার কথা বললেই যারা হৈ হৈ করে তেড়ে আসেন, সেই ‘আধুনিক’ ব্যক্তিসকল কি স্বামীজিকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন এ সব জানার পরে? স্বামীজি তাহলে কি প্রকৃত আধুনিক ছিলেন না, মানে মূল্যায়নের মানদন্ড যদি হয় ‘হিন্দু জাতির অতীতের থেকে দুরত্ব নির্মাণ’? শিক্ষিত শহুরে বাঙালির কাছে উত্তর কি আছে?


প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, দেশের কিছু সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কয়েক বছর হলো প্রাচীন ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে সামান্য হলেও গবেষণা শুরু করেছে। স্বামীজির চিন্তা ও দর্শনের প্রতি সঠিক শ্রদ্ধা প্রদর্শণ এ ধরনের কাজের মাধ্যমেই হতে পারে না কি, যতই ‘দেশ পিছিয়ে যাচ্ছে’ বলে হাহাকার করা হোক না কেন?


ধর্ম , জাতি আর সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে স্বামীজির মতামত খুব স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে শিকাগো থেকে ১৮৯৩ সালের নভেম্বর মাসে লেখা চিঠির এই অংশে :


“হিন্দু যেন কখনও তাহার ধর্ম ত্যাগ না করে। তবে ধর্মকে উহার নির্দিষ্ট সীমার ভিতর রাখিতে হইবে, আর সমাজকে উন্নতির স্বাধীনতা দিতে হইবে। ভারতের সকল সংস্কারকই এই গুরুতর ভ্রমে পড়িয়াছেন যে, পৌরোহিত্যের সর্ববিধ অত্যাচার ও অবনতির জন্য তাঁহারা ধর্মকেই দায়ী করিয়াছেন; সুতরাং তাঁহারা হিন্দুর ধর্মরূপ এই অবিনশ্বর দুর্গকে ভাঙিতে উদ্যত হইলেন। ইহার ফল কি হইল? -নিস্ফলতা।……তাঁহারা ধর্ম ও জাতিকে একসঙ্গে ভাঙিতে চেষ্টা করিয়া বিফল হইয়াছিলেন। এ বিষয়ে পুরোহিতগণ যতই আবোল-তাবোল বলুন না কেন, জাতি একটি অচলায়তনে পরিণত সামাজিক বিধান ছাড়া কিছুই নহে। ইহা নিজের কার্য শেষ করিয়া এক্ষণে ভারতগগনকে দুর্গন্ধে আচ্ছন্ন করিয়াছে। ইহা দুর হইতে পারে, কেবল যদি লোকের হারানো স্বাতন্ত্র্যবুদ্ধি ফিরাইয়া আনা যায়। ……….স্বাধীনতাই উন্নতির একমাত্র সহায়ক। স্বাধীনতা হরণ করিয়া লও, তাহার ফল অবনতি। আধুনিক প্রতিযোগিতা প্রবর্তিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে কত দ্রুতবেগে জাতিভেদ উঠিয়া যাইতেছে। এখন উহাকে নাশ করিতে হইলে কোন ধর্মের আবশ্যকতা নাই। আর্যাবর্তে ব্রাহ্মণ দোকানদার, জুতাব্যবসায়ী ও শুড়ি খুব দেখিতে পাওয়া যায়। ইহার কারণ কেবল প্রতিযোগিতা।“


বিবেকানন্দ জাতিভিত্তিক সমাজকে অচল বলেছেন। আধুনিকতার আলোতে সমাজের অগ্রগতির সাথে সাথে জাতিভেদ বা জাতি-ব্যবস্থাই যে অবলুপ্ত হবে,পরিষ্কার যেন উনি দেখতে পেয়েছেন। খোলামেলা প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই আধুনিক পৃথিবীতে ধসে পড়বে এই বৈষম্যকারী, জাতি-কেন্দ্রিক, আর্থ-সামাজিক কাঠামো- স্বামীজি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন। কিন্ত এই জাতি-ব্যবস্থার সাথে হিন্দুধর্মের কোনো আত্মিক সম্পর্ক যে নেই, তা কিন্ত বিবেকানন্দ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেছেন। কাজেই আধুনিকতার বিচারে জাতপাতের শেষ দেখতে চাওয়া আর হিন্দুধর্মের সন্ন্যাসী হওয়ার মধ্যে কার্যত কোনও বৈরিতাই থাকতে পারে না।


এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ‘হিন্দুত্বের’ Icon বলে যাকে প্রতিনিয়ত আক্রমণ করা হয়, সেই বীর সাভারকারও তীব্র বিরোধী ছিলেন জাতিভিত্তিক সমাজের । তিনি মনে করতেন Vertical Social Mobility নিশ্চিত না করা গেলে শক্তিশালী সমাজ তথা রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হবে না। ‘মানবতাবাদী’ বিবেকানন্দ ও ‘হিন্দুত্ববাদী’ Savarkar এর অবস্থান এক্ষেত্রে একই জায়গাতে। অবাক হওয়ার বিষয় সত্যিই। জ্বালা ধরাতেও পারে অবশ্য।


“The Swami was constantly preoccupied with the thought of Hinduism as a whole, and this fact found recurring expressions in references to Vaishnavism. As a Sannyasin, his own imagination was perhaps dominated by the conceptions of Shaivism.But Vaishnavism offered him a subject of perpetual interest and analysis.”


ভগিনী নিবেদিতা লিখেছেন তার The Master As I Saw Him গ্রন্থে। স্বামীজির চিন্তা আর চেতনা জুড়ে ছিল হিন্দুধর্ম আর সেই ধর্মের বিবিধ রূপ। হিন্দু সন্ন্যাসীর পরিচয় নিয়েই তিনি সগর্বে আত্মপ্রকাশ করেছেন। উদারতা, আধুনিকতা হিন্দুধর্মের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। হিন্দুধর্ম যে অনন্ত-প্রবহমান চেতনা।



সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ