কবি জসীম উদদীনের আত্মজীবনী ‘জীবনকথা’ গ্রামবাংলার সামাজিক চিত্র জানার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ বই। তার জীবনকাহিনী পড়তে গিয়ে বেশ ধাক্কা খেতে হবে পাঠককে। আপনি যখন দেথবেন জসীমউদদীনের শৈশবে, অর্থ্যাত মাত্র একশো বছর আগে মুসলমান বিবাহিত নারীরাও সিঁদুর পরছে তখন হজম করতে কষ্ট হবে! জসীম উদদীন লিখেছেন, তার মা বাপের বাড়ি থেকে আসার সময় হাট থেকে তার নানার কেনা নতুন শাড়ি পরে, কপালে সিঁদুর দিয়ে, চোখে কাজল দিয়ে রওনা দেয়ার জন্য তৈরি হলেন...। যদিও জসীম উদদীনের বাবা হাজি শরীয়তুল্লাহ’র ওহাবী চেতনার মানুষ ছিলেন, বাড়িতে গান বাজনা এলাউ ছিলো না। সেক্ষেত্রে মায়ের বাপের বাড়ি থেকে কপালে সিঁদুর পরে আসা তিনি এলাউ করতেন কিনা সেটা তিনি লিখেননি। সম্ভবত ‘মোল্লা বাড়ির বউ’ হিসেবে বাড়ি ঢোকার আগে সিঁদুর মুছে ফেলতেন!
ওহাবী আন্দোলন তখন নিভে গেলেও তার যে চেতনা তা মুসলমান সমাজে বয়ে চলেছে দিক নির্দেশন হিসেবে। তবু ‘গাস্বী’ ছিলো ফরিদপুর ও তত্সংলগ্ন অঞ্চলের সবচেয়ে বড় উত্সব। তখনো ঈদ প্রধান উত্সব হতে পারেনি! জসীম উদ্দীন লিখেছেন, এই গাস্বী উত্সবের মধ্যে কোন রকম ধর্মীয় বিষয় ছিলো না। তাই এই উত্সবটিকে হিন্দু মুসলমানের জন্য একটি জাতীয় উত্সব করা যেতে পারে। গাস্বী হচ্ছে ‘আশ্বিনে রাঁধে কার্তিকে খায়’ সেই লোকজ উত্সবটি।
জসীম উদ্দীনই বলেছেন, এই দেশে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বাস করেও কোন অভিন্ন উত্সবে তারা যোগ দিতে পারে নাই। তিনি নিজের শৈশবের কথা লিখতে গিয়ে বলছেন, সেকালে গ্রামগঞ্জে ‘পাকা মুসলমান’ বলতে কাউকে পাওয়া যেতো না। হিন্দুদের মত মুসলমানরাও লক্ষ্মীপুজা, হাওয়া সিন্নি, গাস্বী উত্সবে সমস্ত গ্রাম মেতে উঠত। ‘হাওয়া উত্সব’ মানে হাওয়া বিবির নামে সিন্নি চড়ানো হতো। এটা হতো লক্ষ্মীপুজার পরের পূর্ণিমাতে। সম্ভবত লক্ষ্মীপুজার একটা মুসলিম ভার্সন ছিলো এটি যেখানে দেবী লক্ষ্মীর বদলে আদমের স্ত্রী হাওয়াকে বসানো হয়। জসীম উদ্দীন গাস্বী উত্সবের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে বুঝা যাচ্ছে মুসলমানদের প্রধান উত্সব তখন সেই অঞ্চলের গাস্বী ছিলো- ঈদ নয়। এই দিন বাচ্চারা খুব ভোরে উঠে হলুদ টলুদ মেখে নদী থেকে স্নান করে এসে ভালো জামাকাপড় পরে ভালো নাস্তা খেতো। বাড়িতে ভালো ভালো খাবার রান্না হতো। গ্রামে গ্রামে চলত উত্সব। মেলা, গান বাজনা চলত সারারাত। কুস্তি হাডুডু নৌকাবাইচ হতো গ্রামে গ্রামে। গাস্বীতে হিন্দু মুসলমান মিলে পালন করত। গ্রামীণ এই পটভূমিকে ধ্বংস করে দেয় ‘ওহাবী আন্দোলন’। জসীম উদ্দীন লিখেছেন, তাঁর বাবা চিরকাল ধুতির সঙ্গে পায়জামা পরতেন আর মাথায় টুপি থাকত। তিনি ছিলেন গ্রামের মুসলিম কমিউনিটির সার্টিফিকেটধারী একজন ‘মোল্লা’ যিনি মুসলমানদের বিয়ে, জানাজা, আকিকা অনুষ্ঠান পরিচালনা করে পয়সা পেতেন। ভাবুন ধুতি পরে জানাজার নামাজ পড়ছে মুসলমানরা! ওহাবী আন্দোলন শুরুর পর জসীমউদদীনের বাবা ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি পরা শুরু করেছিলেন মুসলমানদের পোশাক হিসেবে সেকথা জসীম উদ্দীন তার আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন। জসীমউদদীনের পরদাদার নাম ছিলো ‘আরাধন মোল্লা’। তার বাবার পিতামহের এক ভাইয়ের নাম ছিলো ‘দানু মোল্লা’। দানু মানে কি দিনেশ? গ্রামে আরেকজন ঢোল বাদকের নাম জানা গেলো যাদব ঢুলি ও মদন ঢুলি। দুজনই মুসলমান! মুসলমানের নাম ‘যাদব’ আর ‘মদন’। তারা হিন্দুদের বিয়ের আসরেই কেবল ঢোল বাজাতেন তাই নয়, তারা শশ্মানের পুজার সময়ও ঢোল বাজানোর জন্য ডাক পেতেন। জসীম উদ্দীন লিখেছেন, তখন মুসলমানদের নাম রাখা হতো বাংলায় যেটাকে ওহাবীরা ‘হিন্দুদের মত নাম’ বলা শুরু করেছিলো। অথচ কমিউনিস্টরা ওহাবী আন্দোলনের খারাপ প্রভাবকে লঘু করতে বলেন ‘ওহাবী আন্দোলনের প্রভাব ছিলো খুবই সীমিত’! বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে ওহাবিজম কি করে মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক ও হিন্দু বিদ্বেষী করে তুলেছিলো সেই ইতিহাসকে কমিউনিস্টরা আড়াল করতে চেয়েছে তীতুমীর, শরীয়তুল্লাহ, দুদুমিয়াদের মত বড় জিহাদী খিলাফতবাদীদের জাতীয় বীর বানানো জন্য।
কবি জসীম উদ্দীনের পিতা গ্রামের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ইংরেজি শিখতে পারেননি কারণ তার শৈশবে দুদুমিয়ার নির্দেশ ছিলো মুসলমানদের জন্য ইংরেজি শেখা হারাম। ফলে জসীমউদদীনের পিতামহ ছেলেকে ইংরেজ পড়া থেকে বিরত করেন। ওহাবী আন্দোলন কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিলো এ থেকে স্পষ্ট হয়। অথচ আমাদের ইতিহাসের ভাষ্য হিন্দুদের কারণে মুসলমানরা পিছিয়ে পড়েছিলো! কবি জসীমউদদীনের শিক্ষা জীবন শুরু হয় এক নিবেদিত প্রাণ হিন্দুর খোলা পাঠশালা থেকে। তার পিতা যে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সেখানে দুজন মাস্টার ছিলেন। একজন তিনি, অপরজন শিক্ষার জন্য জীবনপাত করা একজন হিন্দু। তিনিই হেডমাস্টার ছিলেন। তিনিই স্কুলের ঘন্টা বাজাতেন। চরম দারিদ্রতাকে বেছে নিয়েছিলেন বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য। অথচ দেশভাগ হলো ঠিক কি কারণে? মুসলমানদের উন্নতি হবে না তাদের নিজেদের দেশ না হলে! কবি জসীম উদ্দীন লিখেছেন, পাঠশালায় পড়তে গিয়ে তিনি ‘হিন্দুপাড়া’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। হিন্দুদের বাড়িতে ফুল গাছ থাকে। হিন্দু বউরা বাড়িতে আলপনা আঁকে। আর নানা রকম উত্সব লেগেই থাকে। কিন্তু মুসলমান পাড়ায় কিছু নেই। মুসলমান পাড়ায় গান বাজনা নাই। ফুল গাছ নাই। ওহাবী আন্দোলনের পর মুসলমানদের গ্রামগুলিতে সব উত্সব বন্ধ হয়ে গেছে। জসীম উদদীনের ‘জীবনকথা’ বইতে অকপটে বাংলার গ্রামগুলিতে ওহাবী আন্দোলনের সর্বনাশের কথা লিখে গেছেন। যে সোজন বাদিয়ার ঘাট, নকশি কাঁথার মাঠ কাব্যে জসীম উদ্দীন যে গ্রাম বাংলার কাহিনী লিখেছেন তা ওহাবীদের কারণে আরবীয় মুসলমানিত্বে তখন আচ্ছন্ন হয়ে গেছে...।
জসীম উদ্দীন তার বাল্যে একটি তুলসী গাছ বন্ধুর বাড়ি থেকে এনে বাড়িতে লাগানোর পর ‘মুসলমানের বাড়িতে তুলসী গাছ লাগানোর’ বিরূপ সমালোচনা শুনতে হয়েছে প্রতিবেশীদের কাছে। যদিও সেই গাছ বড় হলে ঔষধী কাজে যখন প্রতিবেশীরা তুলসী পাতা চেয়ে নিতো তার বড় আনন্দ হতো। যে সমাজে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি এতকাল বসবাস করেও একটি গাছ যা প্রকৃতির সৃষ্টি তা সাম্প্রদায়িক কারণে অগ্রহণীয় হয়ে উঠে সেই সমাজকে জাহাজে চেপে ১২ হাজার মাইল দূর থেকে এসে কাউকে বিভেদ সৃষ্টি করতে হয় না। তারা তো নিজেরাই বিভেদ হয়েই ছিলো!
জসীম উদ্দীন তার সময়কার হিন্দু মুসলমান গ্রামবাসীর যে স্মৃতিচারণ করেছেন তাতে আজকের সময়ে এসে বেশ বিস্ময়কর লাগে। গ্রামে চৈত্র পুজা হিন্দুরা করলেও সে উপলক্ষ্যে যে মেলা হতো তাতে হিন্দুর মত মুসলমানদেরও প্রধান বিনোদন ছিলো। সেই মেলায় ‘ভাঙরা নাচের অভিনয়’ ছিলো বিনোদনের একটি উপকরণ। এখানে অভিনেতারা ভন্ড মোল্লা, ভন্ড ব্রাহ্মণ সেজে হাস্যরস সৃষ্টি করত। একজন মোল্লা সেজে প্রথমে আজান দিতো এভাবে-
হাইয়ালের ফালা হাইয়ালের ফালা,
আমার ধান খাওয়ায় কোন শালার বেটা শালা!!
আল্লাহআকবর আল্লাহআকবর
কানা মুরগী জব কর
এভাবে শুরু করে ভন্ড মোল্লাকে নিয়ে একে একে চলত হাস্যরস। একইভাবে ভন্ড ব্রাহ্মণ সাজত জুলফিকার মৃধা। তাদের এইসব হাস্যরস নিয়ে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা তখনো কাজ করত না। কিন্তু দিন বদল হচ্ছিলো...। আঁতুরঘরে গ্রাম্য যে গীতের উল্লেখ্য জসীম উদ্দীন করেছেন তা মুসলমান বাড়িতেও গাওয়া হতো। এই গীতটি জসীম উদ্দীন তার জীবনকথায় তুলে দিয়েছেন-
জন্মিল জন্মিত গোপাল
আমির অলীর ঘরেরে
গোপাল জন্মিল কার ঘরে?
চাচীর কোলে যা যা গোপাল জামা জুতা চাহেবে
গোপাল জন্মিল কার ঘরে।
খালার কোলে যা যা গোপাল মোহন বাঁশি চাহেরে
গোপাল জন্মিল কার ঘরে...
জসীম উদ্দীন এই গীতটি তুলে দিয়ে শেষে বলছেন, তার পিতা ওহাবী আন্দোলনের প্রতিভু হাজি শরীয়াতুল্লাহ’র অনুসারী ছিলেন বলে তার বাড়িতে বাচ্চা হওয়ার পর এরকম গান গাওয়া ছিলো কঠোরভাবে নিষেধ করা। আসলে ততদিনে তীতুমীর, শরীয়তুল্লাহ সব কেড়ে নিয়েছে। আমাদের সোনার বাংলাকে সোনার মদিনা বানাতে গিয়ে শশ্মান করে দিয়েছে! নইলে একদা মুসলমানের বাড়িতেও ‘গোপাল’ বলে যে শিশুটিকে আদর করা হচ্ছে, সম্বধন করা হচ্ছে সে হিন্দু কিনা সে প্রশ্ন কেউ তুলেনি। ওহাবী আন্দোলনের ফলে গ্রামীণ সমাজে তার গভীর প্রভাব পড়েছিলো। স্পষ্টভাবে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানরা নিজেদের আলাদা জাতি হিসেবে দেখতে শিখেছিলো। এই পাড়াগাঁ পর্যন্ত জয়া চ্যাটার্জির গবেষণা কোনদিন এসে পৌঁছবে না। হিন্দু কমিউনিস্টরা শত গলায় চেঁচিয়ে বলবে ওহাবী আন্দোলনের প্রভাব মুসলমানদের উপর খুবই কম ছিলো। এই ওহাবী তীতুমীরকে নিয়ে মহেশ্বেতা দেবী উপন্যাস লিখেছিলেন মহান বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামী দেখিয়ে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো দেশভাগের বিজ তখনই বোনা হয়ে গিয়েছিলো যখন ওহাবীরা সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছিলো...।
ওহাবীজম ইংরেজরা তৈরি করে দেয়নি। ইংরেজরা এদেশে এসে হিন্দু মুসলমান দুই ভাইয়ের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে শাসন করতে চেয়েছে- এই ইতিহাস বাম লিবারালদের কল্পনা প্রসূত। এমনকি কংগ্রেসের হিন্দু নেতাদের জাতীয়তাবাদী আচড়ণের কারণেই মুসলিম লীগ তৈরি হয়েছিলো এটিও একটি ফিকশন ছাড়া আর কিছু নয়। মুসলিম লীগের জন্ম হয়ে গিয়েছিলো সেদিন যেদিন বখতিয়ার খিলজি, মুহাম্মদ বিন কাসিম এই অঞ্চলে ঘোড়ায় চেপে এসেছিলো। ওহাবীজিম নতুন কিছু নয় সেই চৌদ্দশো বছর আগে বর্তমান সৌদি আরবে তার জন্ম। শরীয়তুল্লাহ সৌদি আরব থেকে দীক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে বাংলার মুসলমানদের কাফের হিন্দুদের থেকে পৃথক হওয়ার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেন। এই ইতিহাসকে লঘু না করলে ‘ইংরেজ আসিয়া হিন্দু মুসলমান দুই ভ্রাতাকে আলাদা করিয়া দিয়াছিল’ ন্যারেটিভ টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়!
খুব মজার একটা ব্যাপার হলো কবি জসীম উদদীনের ‘জীবনকথা’ বইয়ের কথা আমি প্রথম শুনি সুলিমুল্লাহ খানের একটি ভিডিওতে। ‘জীবনকথা’ পিডিএফ তখন পড়তে শুরু করে বুঝতে পারি সলিমুল্লাহ খান হয়ত এই বইটির নামই কেবল শুনেছেন কিংবা মলাট দেখেছেন, পড়েননি! কেননা এই বইয়ের সুখ্যাতি করলে সলিমুল্লাহ খানকে ওহাবী আন্দোলনকে সমালোচনা করতে হয়। জসীম উদদীন গ্রামীণ জীবনে উত্সব হারিয়ে যাবার জন্য ওহাবীদের দায়ী করেছেন। হিন্দু মুসলমান ঐক্যের কথা বলেছেন। জসীম উদদীনকে যেভাবেই দাঁড় করানো হোক, যে গ্রুপেই ফেলা হোক, আর যাই হোক, তিনি সলিমুল্লাহ খানদের দলের লোক নয় নিশ্চিত! জসীম উদ্দীন যে সখের কবিয়ালও ছিলেন জানা ছিলো না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করার সময়ও কবির লড়াই করত। হিন্দু পুরাণ সম্পর্কে তার জ্ঞান অনেক ছিলো। কবির লড়াইয়ে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্র সেজে উপস্থিতি ছন্দসহকারে কাব্যগীতি বলে যাওয়া কম কথা নয়। এরকম একজন ‘বাঙালি মুসলমানকে’ কি সুলিমুল্লাহরা মেনে নিতে পারে?
প্রথম প্রকাশ: সুষুপ্ত পাঠক
0 মন্তব্যসমূহ