মুখার্জী ও খাতুন। আজ এক প্রবাসী দম্পতির কথা লিখি। যদিও এমন গল্পের সাথে আমরা সকলেই কম-বেশি পরিচিত বা নিজ চোখে প্রতিদিন দেখছি তারপরও লিপিবদ্ধ করার ইচ্ছে যাতে করে আগামী প্রজন্ম অভিযোগ করতে না পারে “কৈ আমরা তো এসব বুঝি নি বা কেউ বলে নি। এমনও হয়?”
মুখার্জী আর খাতুনের পরিচয় ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে। এরপর পরিচয়, বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসা। যথারীতি দুই বাড়ির কেউই এই সম্পর্ক ভালো ভাবে নেয় নি। খাতুনের পরিবার শর্ত স্বাপেক্ষে ধর্মান্তকরণের মাধ্যমে এই সম্পর্ক মেনে নিতে পরের দিকে রাজি ছিল, কিন্তু মুখার্জীর পরিবার কোনো অবস্থাতেই এই সম্পর্ক মানতে রাজি ছিল না। মুখার্জীর দুটো বোন ছিল, তাদেরও তো বিয়ে দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত বাড়ির অমতেই দুজনে বিয়ে করেন এবং আলাদা থাকতেন।
মুখার্জী এবং খাতুন দুজনেই পড়াশুনায় বেশ ভালো ছিল, এবং ভালো চাকরিও করতেন। দুই বাড়ির পরিস্থিতি বুঝে তারা সিদ্ধান্ত নেন যে দেশের বাইরে সেটেল করবে, কারণ দেশে তাদের থেকেও কেউ নেই। নব্বইয়ের শেষে পাড়ি দেন ইউরোপ। দুজনেই আজ বেশ প্রতিষ্ঠিত। তাদের দুই ছেলে-মেয়ে, তারাও এখন ইউনিভার্সিটি যায়। এই পর্যন্ত পড়ে মনে হতে পারে। বাঃ কি সুন্দর! আমিও এমন অন্য ধর্মের একজনকে বিয়ে করে বাইরে সেটেল করবো বা মুক্তমনা দুজন মানুষ চাইলেই বিয়ে করে যে যার ধর্ম পালন করে মানবতার জীবন-যাপন করতে পারে। কিন্তু না। বহু বছর ধরে তাদের সম্পর্ক খারাপ হতে হতে আজ একদম তলানিতে। কিন্তু কেন?
বাচ্চারা একটু বড় হতেই খাতুনের মধ্যে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আস্তে শুরু করে। একটা লম্বা সময় পর্যন্ত মুখার্জী এবং খাতুন দুজনেই ঈদ এবং পূজায় অংশ নিলেও খাতুন আস্তে আস্তে পূজায় অংশ নেওয়া বন্ধ করে দেয়। খাতুনের কুর্তির লেংথ প্রতি-বছর একটু করে বাড়তে থাকে। এখন হিজাব পরেন। ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে যে গান-বাজনা বা সাহিত্য-চর্চা দিয়ে খাতুন আর মুখার্জীর প্রেম বা বন্ধুত্ব, আজ সেই গান-বাজনার উপর খাতুনের তীব্র অনীহা। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশে পরিচিত কেউ ছুটি কাটাতে গেলে খাতুনের আবদার থাকতো একটা ঢাকাই জামদানি বা টাঙ্গাইল সিল্ক এনে দেবার, সেই মানুষ শাড়ী ছেড়েছে বেশ কিছু বছর। যে খাতুন তার কৈশোর বা যৌবনে ভীষণ উদার-মুক্তমনা ছিলেন, আজ সে কার্যত ধর্মান্ধ। তার স্বামীর সামান্য কিছু ধর্মীয় রীতিনীতি পালনও তার সহ্য হয় না।
কথা ছিল বাচ্চারা ইউরোপের মত পরিবেশে উদার, মুক্তমনা হিসেবে বেড়ে উঠবে তথা “মানবতাই” হবে তাদের ধর্ম। কিন্তু না, বাচ্চারা মায়ের ধর্মকে গ্রহণ করেছে এবং তারা প্র্যাক্টিসড-গর্বিত মু স লি ম। নিজের বাড়িতেই আজ মুখার্জী ৩-১ এ পিছিয়ে। আজ প্রতিটা দিন মুখার্জীর কাছে মিথ্যে, অসহনীয় কষ্টের। আজ মুখার্জীর সামনে দুটো অপশন, এক: এই পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর বয়সে ডিভোর্স দিয়ে একা বাঁচা এবং সারাক্ষন ভুলের জন্যে অনুতাপ করা। দুই: ছেলে-মেয়ে-বৌয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ধর্ম পরিবর্তন করে মাথা নিচু করে বাকি জীবন অতিবাহিত করা।
কি কি হারালো মুখার্জী? নিজের মা-বাবা, দুটো ছোট বোন। নিজের সভ্যতা-সংস্কৃতি-ধর্ম-ঐতিহ্য। নিজের প্রেম, ভালোবাসা এবং জীবন সঙ্গিনী। তার সাথে সাথে সুখ-শান্তি, ভাবনা-চিন্তা। এমনকি নিজের ঔরসজাত দুটো সন্তানকেও। কি কষ্টের না? আমি বিশ্বাস করি, আজ মুখার্জী যদি অতীতে ফিরতে পারতেন তাহলে সবার আগে সে নিজেই ইউনিভার্সিটি জীবনের এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতেন। মা-বাবা আর ছোট দুই বোনকে আঁকড়ে ধরে আর পাঁচ জনের মত সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। কিন্তু সুখে থাকতে আমাদের ভূতে কিলায়! আজ আর সেই সুযোগ নেই ভুল শোধরানোর।
একটা বড় করে শ্বাস নিন। আপনিও মুখার্জীর মত মাঝ বয়সে এসে কাঁদবেন না তো?
@ Subhasish
0 মন্তব্যসমূহ