বাংলার সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন, ঢাকার রমনা কালীমন্দির। জনশ্রুতি, প্রায় ৫০০ বছর আগে বদরীনাথের যোশীমঠ থেকে গোপালগিরি নামে এক উচ্চমার্গের সন্ন্যাসী প্রথমে ঢাকায় এসে সাধন-ভজনের জন্য উপযুক্ত একটি আখড়া গড়ে তোলেন। সেখানেই আরও ২০০ বছর পরে মূল রমনা কালীমন্দিরটি নির্মাণ করেন আর এক বড় সাধু হরিচরণ গিরি। তবে পরবর্তী সময়ে এই মন্দিরের প্রধান সংস্কারকার্য ভাওয়ালের ভক্তিমতী ও দানশীলা রানি বিলাসমণি দেবীর আমলেই হয়। মূল মন্দিরটি ছিল দ্বিতল। ছাদের ওপর ছিল ১২০ ফুট উঁচু পিরামিড আকৃতির চূড়া। এটি "বাংলার গগনচুম্বী মন্দির নামে প্রসিদ্ধ ছিল"। রমনা কালীমন্দিরের উত্তর পাশে ছিল সাধিকা মা আনন্দময়ী স্মৃতিবিজড়িত আনন্দময়ী আশ্রম।
১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চ, দুটো দিন এই রমনা কালীমন্দিরের পবিত্র ভূমি ঘিরে পাকিস্তানি সেনারা যে বিভীষিকার রাজত্ব তৈরি করেছিল তার নৃশংস করুণ কাহিনি ইতিহাসের পাতায় চিরদিন লেখা থাকবে। ২৬'শে মার্চ দিবাগত রাত ২টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় একশ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। এক তীর্থভূমি রাতারাতি পরিণত হয়েছিল বধ্যভূমিতে।
'রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ গণতদন্ত কমিশন' সাক্ষ্য বিবরণে বলা হয়, ২৫ মার্চের কালরাত্রে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পর, ২৬ মার্চ সকাল এগারোটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী প্রথম মন্দির ও আশ্রম অঙ্গনে প্রবেশ করে। তারা মন্দির ও আশ্রমবাসীদের মন্দির থেকে না বেরোনোর জন্য বলে যায়। এ সময় পুরাণ ঢাকা থেকে সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত মুসলিম লীগ প্রার্থী এবং পরবর্তী কালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অন্যতম দোসর খাজা খয়ের উদ্দিনকে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে দেখা গেছে। ২৬ মার্চ গভীর রাতে রমনায় ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকান্ড প্রধানতঃ তারই উদ্যোগে সংঘটিত হয়।
পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সহযোগীদের নিয়ে ২৬ মার্চ রাত দু'টোর দিকে সান্ধ্যআইন চলাকালীন রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ঘেরাও করে। সেনাবাহিনীর সার্চ লাইটের আলোয় গোটা রমনা এলাকা আলোকিত হয়ে যায়। এরই মধ্যে শুরু হয় গোলাবর্ষণ। রমনা কালীমন্দিরে ঢুকে পাকিস্তানিরা মূর্তির দিকে এক ধরণের বিস্ফোরক ছুঁড়ে দেয়। অবশ্য কারো কারো মতে গোলাবর্ষণ করা হয়। ফলে, মূর্তিসহ মন্দিরের পেছনের অংশ উড়ে যায়। পরে মন্দির ও আশ্রম ধ্বংস করা হয়। মন্দির ও আশ্রম এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাতকরা ঢোকার সময় অনেকে ঘুমিয়েছিলেন, কেউ কেউ উৎকন্ঠায় জেগেছিলেন। কয়েকটি পরিবারের তখনো রাতের খাবার চলছিল। এই সময় আচমকা পাকিস্তানী বাহিনী হানা দিলে প্রাণ ভয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায়। আতঙ্কিতরা 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে শুরু করেন, মেয়েরা শাখা খুলে ফেলেন, সিঁদুর মুছে ফেলেন, মন্দির ও আশ্রমের বিভিন্ন স্থানে অনেকে লুকিয়ে পড়েন। পাকিস্তানি সেনারা বন্দুকের মুখে তাঁদের খুঁজে বের করে এবং মন্দিরের সামনে এনে তাঁদের দাঁড় করায়। পুরুষদের এক লাইনে এবং মহিলা ও শিশুদের অন্য লাইনে দাঁড় করানো হয় ।
পাকিস্তানি সেনারা সবার সামনে রমনা কালী মন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরিকে কলেমা পড়তে বাধ্য করে এবং তারপরেই পেট বেয়নেট দিয়ে ফেড়ে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। অতঃপর এভাবে আরো অনেককে কলেমা পড়িয়ে হত্যা করা হয়। কুৎসিত আনন্দ উল্লাস করতে করতে পাক সেনারা বলে, “নৌকায় ভোট দেবার মজা বোঝ এবার।” এরপর বাকি পুরুষদের ব্রাস ফায়ার করে হত্যা করা হয়। সাক্ষ্য-বক্তব্যে জানা যায়, এখানে প্রায় ৮৫ থেকে ১০০ জনকে হত্যা করা হয়। ভয়াল এ দৃশ্য দেখে মহিলাদের আর্তচিৎকার আরম্ভ হলে তাঁদের বন্দুক দিয়ে পেটানো হয়। এতে অনেকে অজ্ঞান হয়ে পড়েন । পাকিস্তানিরা অনেকের দেহ জড়ো করে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আহতদের অনেকে এতে পুড়ে মারা যান । সাক্ষ্যে কয়েকজন মহিলা ও শিশুর পুড়ে মারা যাবার কথা বলা হয়েছে। পাক সেনারা দু'জন যুবককে ধরে ‘ জয়বাংলা ' ধ্বনি দিতে বাধ্য করে এবং মুখের ভিতর গুলি করে তাদের হত্যা করে। এই হত্যাযজ্ঞের সময় রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছিল। আশ্রম ও মন্দিরের গোয়ালে প্রায় ৫০ টির মতো গরু ছিল, গরু গুলোকেও আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। ভয়াবহ আগুন, গোলাগুলি , মাংসপোড়া গন্ধ ও ভয়ার্ত চীৎকারে গোটা রমনা এলাকায় এক নারকীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয় ।
পাকিস্তানি বাহিনী রমনা অপারেশন শেষ করে ভোর চারটার দিকে ফিরে যাবার সময় লাইনে দাঁড় করিয়া রাখা মহিলাদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন যুবতী মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে যায়, যাদের আর কখনো ফিরে পাওয়া যায়নি। এদের সংখ্যা প্রায় একডজন বলে সাক্ষ্যদাতাদের কয়েকজন জানিয়েছেন। পাকিস্তানিরা রমনা ত্যাগ করার আগে নির্দেশ দেয়, যাদের বাঁচিয়ে রাখা হ’ল তারা যেন পরদিনই ভারতে চলে যায়। এক ভয়ঙ্কর শোকবিহ্বল পরিবেশে রাত কাটানোর পর সব হারিয়ে বেদনায় মুহ্যমান মন্দির ও আশ্রমবাসীরা রমনা ত্যাগ করে ভোর বেলা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। পেছনে রেখে যান রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের ধ্বংসস্তুপ আর শহীদ আপনজনদের লাশের দগ্ধাবশেষ অথবা ছাই ভস্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধের উষালগ্নে স্বাধীনতার বেদিমূলে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। ২৭ মার্চ তারিখ ভোরে পরমানন্দ গিরির স্ত্রী সুচেতাগিরি, মা আনন্দময়ী আশ্রমের সন্ন্যাসিনী জটালী মাসহ বেঁচে যাওয়া সবাই রমনা এলাকা ত্যাগ করেন ।
দৈনিক ইত্তেফাক-এর সহ সম্পাদক আহসানউল্লাহ গণতদন্ত কমিশনে প্রদত্ত সাক্ষ্যে বলেছেন, “রমনার ধ্বংসযজ্ঞের তিন দিন পর আমি সেখানে এসে আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষের স্তুপীকৃত কংকালের পাশাপাশি প্রায় ১৪ টির মতো বিকৃত লাশ দেখতে পাই। সেগুলো ফুলে পঁচা গন্ধ বেরিয়েছিল । ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির ও আশ্রমের ভিতরেও আরো ১০ টির মতো লাশ দেখতে পাই।” রমনার কালীমন্দিরের অদূরে শাহবাগ মসজিদের খাদেম প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল আলী ফকির বলেছেন, “রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা শুরু করার পর সবাইকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু' বলতে বলে। লাইনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো পুরুষ মহিলা সবাই তা সমস্বরে উচ্চারণ করেন। এর পরই গুলি করা হয়।”
এতো নাহয় গেল পাকিস্তানি আমলের বিভীষিকা, এরপর কি হল?
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ এ রমনা কালী মন্দির ও শ্রী মা আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংসের উপর এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল একাত্তরের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে অথবা মে মাসের প্রথম দিকে ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনায় পুনরায় পাকিস্তানি বর্বররা হামলা চালায়। স্বাধীনতার পর স্বাধীন বাংলাশেদের সরকারের গণপূর্ত বিভাগ মন্দির এবং আশ্রমের ধ্বংসাবশেষ বুলডোজার চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। চারপাশে মন্দিরের জমির নিয়ন্ত্রন তদানীন্তন রেস কোর্স ময়দান ঢাকা ক্লাব হয়ে এরপর গণপূর্ত বিভাগের হাতে হস্তান্তর করা হয়। মন্দির এবং আশ্রমবাসী যারা গণহত্যা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তারা ফিরে আসেন আবার এবং উক্ত স্থানে অস্থায়ী ভিটা করে বসতি স্থাপন করেন। সেখানে পূজা অর্চনার জন্য অস্থায়ী মন্দির স্থাপন করেন।
রমনার অদূরে জাতীয় তিন নেতার মাজার সংলগ্ন শাহবাজ জামে মসজিদের খাদেম ও রমনা কালী মন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরির বন্ধু আবদুল আলী ফকির স্বাধীনতার পর রমনা কালী মন্দির ও শ্রী মা আনন্দময়ী আশ্রমের ভক্তবৃন্দ ও অন্যান্য বাসিন্দাদের নিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন। তার সাথে ছিলেন প্রয়াত পরমানন্দ গিরির স্ত্রী সচেতা গিরি।
১৯৭৩ সালে সেখানকার বাসিন্দাদের পোস্তাগলায় পাঠানো হয়। সেখানে শ্মশান সংলগ্ন বালুর মাঠে তারা বসতি স্থাপন করেন। যদিও ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের সময় পুলিশ দিয়ে অস্ত্রের মুখে তাদের উৎখাত করা হয়। তাদের ভারতে চলে যেতে ‘উপদেশ’ দেওয়া হয়। আবার বাস্তুচ্যুত হন রমনা কালী মন্দিরের বাসিন্দারা। সুচেতা গিরি ভারত চলে যান। জটালি মা নব্বই এর দশকে মারা গেছেন। রমনায় প্রতি বছর দুর্গাপূজা করার উদ্যোগ নেন স্থানীয়রা। কিন্তু প্রতিবারই তাদের বাঁধা দেওয়া হয়। শুধু ১৯৮২ সালে একবার কালী পূজার অনুমতি দেওয়া হয়।
১৯৮৪ সালে মন্দির এবং আশ্রমের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে ঢাকার দেওয়ানী আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এরও বহু পরে এই ঘটনা তদন্ত করার জন্য ২০০০ সালের ২৭ মার্চ 'রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ গণতদন্ত কমিশন' গঠন করা হয়।
গণতদন্ত কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র - শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ক্যাফেটেরিয়া সংলগ্ন শিক্ষক লাউঞ্জে ১৩ এপ্রিল ২০০০ থেকে প্রায় পাঁচ মাস ধরে রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের নারকীয় গণহত্যাযজ্ঞে শহীদ পরিবারের সদস্য, আহত ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সামাজিক - সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাক্ষ্য ও বক্তব্য গ্রহণ করে। এ পর্যন্ত কমিশন শতাধিক ব্যক্তির সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করেছে।
কিন্তু বাংলাদেশের কোনো সরকার কখনোই এবিষয়ে তেমন কোনো সক্রিয় উদ্যোগ নেয়নি। পরে ২০০৬ সালে ভারত সরকারের উদ্যোগে ৭ কোটি টাকা ব্যয় করে রমনা কালীমন্দির আবার নতুনভাবে নির্মাণের কার্যক্রম করা হয়। পুজার্চ্চনাও শুরু হয়। তারপর ২০২১ সালে স্থাপনার কাজ হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ এসে তা উদ্বোধন করেন আর রমনা কালীমন্দির ফিরে পায় তার ৫ শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য।
কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও এতোদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হল কেন? তাও অন্যদেশের সরকার এসে নির্মাণ করে দিল। কেন?
কেন তা বোধহয় সবাই জানি।
নিবেদনে — 🕉 শাস্ত্রপৃষ্ঠা
তথ্যসূত্রঃ
- ১। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং শ্রী শ্রী রমন কালী মন্দির ও শ্রী মা আনন্দময়ী আশ্রম (- অশোক কুমার ঘোষ)।
- ২। ১৯৭১ সালে রমনা কালী মন্দিরের গণহত্যার ভুলে যাওয়া ইতিহাস - বাংলাদেশ অগ্নিবীর।
- ৩। প্রথম আলো ২৪/০৩/১৭।
- ৪। উইকিপিডিয়া।
1 মন্তব্যসমূহ
এতটা হিন্দুবিদ্বেষ বুকে নিয়ে তারা বেঁচে থাকে কীভাবে? হিংসা ছাড়া তাদের ধর্মে বোধহয় আর কিছু নেই। ঘটনাকাণ্ডে মনে হয় বাংলাদেশের বেশিরভাগ মুসলমান হিন্দুবিদ্বেষী নোংরা মানসিকতার। ঈশ্বর তাদের শাস্তি দেবেই। বাংলাদেশের এই ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে নালিশ করা দরকার।
উত্তরমুছুন