বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘হিন্দুরা’ যুদ্ধ করেছিলো কিনা? - সুষুপ্ত পাঠক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘হিন্দুরা’ যুদ্ধ করেছিলো কিনা? - সুষুপ্ত পাঠক

 

মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে হিন্দু নেই, ভাষা আন্দোলনে শহীদদের মধ্যেও কোন হিন্দু নেই…


মূলত ‘বাঙালী মুসলমান জাতীয়তাবাদীদের’ কাছ থেকে ইদানিংকালে এই রকম ইতিহাস বা প্রশ্ন আসতে শুরু করেছে। এর কি কোন ভিত্তি আছে?


শুরুতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও এই যুদ্ধে ভূমিকা ও অবদানের কৃতিত্ব নিয়ে যে রাজনীতি ঘটেছিলো সেটি না বললে এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঘোষিত প্রথম ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ জগতজ্যোতি দাস এর খেতাব স্বাধীনতার পর কেড়ে নেয়া হয়েছিলো। জগতজ্যোতি দাসের গ্রুপের নাম ছিলো ‘দাস পার্টি’ যা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের জন্য ত্রাস হয়ে উঠেছিলো। কী পরিমাণ আক্রোশ তিনি সৃষ্টি করেছিলেন যে তার লাশ পেয়ে পাকিস্তানীরা ও রাজাকাররা বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে বেনোয়েট দিয়ে খুঁচিয়ে জনসাধারণকে দেখিয়েছিলো পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে কাজ করলে ফল এরকমই হবে। জনগণ ভুলে গেছে সে দৃশ্য। নইলে কি করে তারা ‘মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে হিন্দুরা নাই কেন’ এই রকম ইতিহাসে মাথা দোলায়?


বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে প্রায় অস্বীকার করা হয়েছে। যে কারণে ‘বীরশ্রেষ্ঠদের’ সকলেই সেনাসদস্য। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীদের অবদানকেও প্রায় অস্বীকার করা হয়েছে! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চারটি খেতাব দেয়া হয়েছে, বীরশেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিস্কার হবে- বীর উত্তম দেয়া হয় ৬৮জনকে তার মধ্যে বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা মাত্র ৫ জন! অথচ পুরো মুক্তিযুদ্ধে জানবাজী করে সম্মুখ সমরে শত্রুর কাছে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলো সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সমাজ থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারা। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা উচিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর সদস্যদের অকুতভয় লড়াকু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যেভাবে প্রাণ দিয়েছিলো তার জন্য কোন খেতাব রাখা হয়নি। কয়েকজন বিদেশী স্বেচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের জন্যও কোন খেতাব রাখা হয়নি। সেখানে ‘হিন্দু’ জনগোষ্ঠিকে মুক্তিযুদ্ধে যে একটা আলাদা পর্দা দিয়ে হাইড করা হবে সেটা কি খুব অবাক করা বিষয়? যে আদিবাসী পাহাড়ী জনগোষ্ঠির মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো সেটা কতজন জানে? শুধু চাকমা রাজা রাজাকার ছিলেন সেই ইতিহাসকে বড় করে দেখানো ছাড়া ঐ জনগোষ্ঠির মানুষদের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকাকে কেন গোপন করা হয়েছে? আপনারা কি কেউ জানেন তিনশো সাঁওতাল তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো? কেউ সাঁওতাল মুক্তিযোদ্ধাদের নেতা সাগরাম মাঝি, বিশ্বনাথ টুডু নাম শুনেছেন? রাজা মপ্রু’র নাম শুনেছেন? রাখাইন মুক্তিযোদ্ধা উ-মংয়ান, উ-ক্যহ্রচিং, উ-উসিতমং… মণিপুরী মুক্তিযোদ্ধা সাধন সিংহ, অনিতা সিংহ, বাণী সিনহা, নীলমনি চট্টপাধ্যায়, নন্দেশ্বর সিংহ, বিজয় সিংহ…। নীলমনি চট্টপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ১২০০ মুক্তিযোদ্ধার একদল গড়ে উঠেছিলো! তাদের নাম কি আমাদের মূলধারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নেয়া হয়? চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় রাজাকার ছিলেন এটা বলতে ভালো লাগলে বারবার বলুন সমস্যা নেই কিন্তু এই রাজপরিবারের আরেক সদস্য কেকে রায় যে মুক্তিযুদ্ধে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন সেটি কেন বলেন না? রসময় চাকমা ভারতে মুক্তিযুদ্ধের টেনিং নিতে গেলে তাকে দলে নেয়া হয়নি! কেন? চাকমাদের পাকিস্তানপন্থি বানানো হয়েছিলো। পুরো আদিবাসী জনগোষ্ঠিকে মুক্তিযুদ্ধে স্থান দিলে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ সফল হবে কিভাবে? বাঙালি জাতীয়তাবাদ দিয়ে পাঞ্জাবী পাঠান মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়ে সফল হলেই সেটা যে ‘বাঙালী মুসলমান জাতীয়তাবাদ’ হবে সেটা হয়ত তাদের মনে মনে ছিলো! আজকে যখন ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন তোলা হয় মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুরা যুদ্ধ করেছিলো কিনা- তখন জগতজ্যোতির নামই শুনেনি এমন তরুণদের গুণে শেষ করতে পারবেন না। জ্যোতির যুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সেক্টর কমান্ডার সিআর দত্ত?…


বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘বাঙালি মুসলমানের যুদ্ধ’ এরকম একটা কন্ঠস্বর প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কয়েকবছর ধরে হচ্ছে। এটা করতে সঠিক সময় তারা বেছে নিয়েছে। কারণ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর অনেক ইতিহাস সংরক্ষণের অভাবে মুছে যাচ্ছে। ধরুণ আজকের কোন প্রজন্ম যদি অস্বীকার করে কোলকাতার থিয়েটার রোডে প্রবাসী সরকার গঠন করতে যে বাড়িটি ভারত সরকার দিয়েছিলো তা সত্য নয়- আপনি কি দেখাতে পারবেন ইতিহাসের সেই বাড়িটিকে? চিন্তা করতে পারেন একটা জাতি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছে যে বাড়িতে বসে সেই বাড়িটি ভারত সরকার বারবার তাগাদা দিয়েছে জাদুঘর করে রাখার জন্য কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কর্ণপাতই করেনি! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুদের টার্গেট করে পাকিস্তানীরা এসেছিলো এটা বলার পর কয়েক বছর আগে আমাকে আরএসএস বিজেপির এজেন্ট বানিয়ে দিয়েছিলো কথিত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ লোকজন। আমি প্রশ্ন করেছিলাম বাংলাদেশের যতগুলি গণহত্যার ইতিহাস পাওয়া যায় তার ৯৯ ভাগই কেন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা ঘটেছিলো? নিয়াজীর আলাদা করে হিন্দু কিলিংয়ের খবর জানিযেছিলেন মার্কিন সাংবাদিক অ্যান্টনি মাসকারেনহাস। ধর্ষিত নারীদের বড় অংশ ছিলো হিন্দুরা। ৬৪-৬৫ সালে হিন্দুদের উপর দ্বিতীয় দফা জেনোসাইড শুরু হলে হিন্দু মধ্যবিত্তদের প্রায় ৯৯ শতাংশ ভারতে চলে যায়। এরাই ছিলো শিক্ষিত শ্রেণী। এদের রাজনৈতিক অবস্থান ছিলো বামপন্থা। মুক্তিযুদ্ধ এদের অংশগ্রহণ সম্ভব হয়নি কারণ তারা ততদিনে ভারতের নাগরিক। যারা মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় হিসেবে দারুণ ভূমিকা নিয়েছিলেন শরণার্থী শিবিরে। কিন্তু শরণার্থীদের সংখ্যায় হিন্দুদের যদি ৯৯ ভাগ বলি তো ভুল হবে? মোট শরণার্থীর সংখ্যা ছিলো ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন। তার মধ্যে হিন্দু শরণার্থী ছিলো ৬৯ লাখ ৭১ হাজার! মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, গবেষক, লেখক মফিদুল হক জানিয়েছেন শরণার্থীদের অধিকাংশই ছিলো হিন্দু। শত্রু সম্পত্তি করে তাদের সয়-সম্পত্তি দখল করার মচ্ছব করার সুযোগ করে দিয়ে, একাত্তরে তাদেরই শরণার্থী বানিয়ে, স্বাধীনতার পর শত্রু সম্পত্তি আইনকে টিকিয়ে রেখে তাদের সম্পত্তি ভোগ দখলের সুযোগ করে দেয়া জাতি তো প্রশ্ন তুলবেই মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুদের ভূমিকা কি?


pathoksusupto

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ