আমাদের সৌরপরিবারে পৃথিবীই এমন এক গ্রহ যেখানে প্রচণ্ড গরম ও প্রচণ্ড শীত দুটিই রয়েছে। গীতপ্রধান অঞ্চলের বরফে বাস করা কোন প্রাণী যেমন প্রচণ্ড উষ্ণতাপূর্ণ মরুভূমি অঞ্চলে বেঁচে থাকতে পারে না। তবে পৃথিবীতে এমন এক প্রাণী রয়েছে যে, প্রচণ্ড গরম সহ্য করার পাশাপাশি প্রচণ্ড ঠাণ্ডাও সহ্য করে বেঁচে থাকতে পারে। এই বিশেষ প্রাণীটির নাম হচ্ছে টারডিগ্রেড। ১৭৭৩ সালের অগস্ট মাসে এই প্রাণীটির খোঁজ সর্বপ্রথম পান জার্মান প্রাণীবিজ্ঞানী জোহান। টারডিগ্রেড (English: Tardigrade) (Latin: Tardigrada) হচ্ছে একটি অতিক্ষুদ্র প্রাণী। এটি 'জল ভালুক' বা 'Water Bear' নামেও পরিচিত।এই জীব পৃথিবীর অতি প্রাচীন জীবগুলোর একটি।এটি এতই ছোট যে একে শুধু মাইক্রোস্কোপ দিয়েই দেখা যায়।এটি সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন জার্মান বিজ্ঞানী Johann August Ephraim Goeze , 1773 সালে এবং তিন বছর পর এর ল্যাটিন নাম (Tardigrada: অর্থ- ধীর পদক্ষেপকারী) দেন ইতালীয় বিজ্ঞানী Lazzaro Spallanzani.এই আট পা ওয়ালা প্রাণী যা জলে ভাসমান অবস্থায় থাকে, এটি প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে।এটি ৩০ বছর পর্যন্ত বিনা খাদ্য গ্রহণে বেঁচে থাকতে পারে।তাছাড়াও এটি শূন্য ডিগ্রি থেকে হাজার ডিগ্রি তাপমাত্রায় বেঁচে থাকে।এমনকি এটি মহাশূন্যেও বেঁচে থাকতে পারে।গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে, যদি এই প্রাণী খাদ্য না পায় তবে এর শারীরিক প্রক্রিয়া অনেকটাই স্থির হয়ে যায় যা একে বহুবছর বিনা আহারে বাঁচিয়ে রাখে।এর আকার মাত্র শূণ্য দশমিক ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১ মি.লি. মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই প্রাণীর রয়েছে ছোট ছোট আটটি পা এবং নিজস্ব এক পাচনতন্ত্র। ক্ষুদ্র এই প্রাণীটির পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম স্থান অয়মিয়াকনে বাস করতেও সমস্যা হয় না। শীতকালে অয়মিয়াকনের তাপমাত্রা নেমে যায় প্রায় -৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের কাছাকাছি। সেখানে তারা কোনো বাধা ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে। আবার সাধারণত জল ফুটতে থাকে ১০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। কিন্তু টারডিগ্রেড ১৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও বেঁচে থাকতে পারে। সমুদ্রের সবচেয়ে গভীর স্থান মারিয়ানা ট্রেঞ্চে জলের চাপ থাকে অনেক বেশি। এমনকি সেখানের পরিবেশেও সে টিকে থাকতে পারে।
টারডিগ্রেডের আরও একটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হল, এ প্রাণীটি প্রায় ৪০ বছর পর্যন্ত বিনা খাওয়া দাওয়া করেই বাঁচতে পারে। খাবার না খেয়ে এতো লম্বা সময় বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানী পরিভাষায় বলা হয়ে থাকে 'ক্রিপ্টোবায়োসিস'। এই প্রক্রিয়ায় এই প্রাণীটি নিজের শরীরের সব মেটাবলিজম প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয় ও এর ফলে জলের পরিমাণ একদম কমে গিয়ে তার নিজের শরীর সম্পূর্ণ শুষ্ক হয়ে যায়।এ অবস্থায় এই প্রাণীটির শরীরে মাত্র ৩ শতাংশ জল থাকে। এই প্রক্রিয়ার সময় এই প্রাণীর কোনো শক্তি বা খাদ্যের প্রয়োজন হয় না এবং এই পরিস্থিতিতে সে লম্বা হাইবারনেশনে চলে যেতে পারে। পরিস্থিতি সুবিধার হলে প্রাণীটি আবার নিজের মেটাবলিজম প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবে শুরু করে এবং খাবারের খোঁজে বেরিয়ে আসে। উদ্ভিদ কোষের ফ্লুইড, ব্যাকটেরিয়া এবং এর থেকে ছোট আকারের প্রাণীই মূলত এর খাবার।টারডিগ্রেড বা জল ভালুক এক অদ্ভুত প্রাণী, যার পুনর্জন্ম রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আসলে জলে-স্থলের কঠোরতম অঞ্চলেও টিকে থাকার ক্ষমতা থাকায় সর্বংসহা ক্ষুদে মূলত জলজ এই প্রাণীকে পুনঃসঞ্জীবিত করা যেতে পারে।টারডিগ্রেড বা পানি ভালুক এক অদ্ভুত প্রাণী, যার পুনর্জন্ম রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আসলে জলে-স্থলের কঠোরতম অঞ্চলেও টিকে থাকার ক্ষমতা থাকায় সর্বংসহা ক্ষুদে মূলত জলজ এই প্রাণীকে পুনঃসঞ্জীবিত করা যেতে পারে।১৯৯৫ সালে শুকনো টারডিগ্রেডকে ৮ বছর পর জীবনে ফিরিয়ে আনার পর বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে না যে, টারডিগ্রেডকে মৃত্যুর পর ফের বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। ১৯২২ সালে জার্মান বিজ্ঞানী এইচ বাওম্যান গবেষণা করে জানান যে, একটি টারডিগ্রেড যখন শুকিয়ে যায়, সে তার মাথা ও আট পা গুটিয়ে নেয়। সেলগুলোও এমনভাবে স্থবির থাকে, যা মৃত্যুর মতো। তার শরীরের সব জলের স্খলন ঘটে। শুষ্ক তুষের মাঝে টনচেনফরম প্রক্রিয়ায় রাখা হলে এটি কয়েক দশক ধরে টিকে থাকতে পারে।
এ সকল পরিস্থিতে বেঁচে থাকা টারডিগ্রেডের মতই বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষদের যেকোন ভাবে নিজেদের ধর্ম এই ভূখণ্ডের সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হবে। এ কথা স্মর্তব্য, যে প্রাণীর অভিযোজন ক্ষমতা যত বেশি, সে পরিবেশে ততবেশি টিকে রয়েছে। সকল প্রতিকূল পরিস্থিতেকেই নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, স্মৃতি, তন্ত্রসহ সকল শাস্ত্রে বর্ণিত পবিত্র এই বঙ্গ ভূখণ্ড থেকে একদিন হয়ত ভূমিপুত্র হিন্দুরাই হারিয়ে যাবে। তাদের কথা শুধু ইতিহাস, এবং পুরাতত্ত্বে লেখা থাকবে। আবার হয়ত এমনও হতে আফগানিস্তান, পাকিস্তানের মত পুরাতাত্ত্বিক ইতিহাসও ধ্বংস করে দেয়া হতে পারে। যেন তাদের কথা কেউ জানতে না পারে। সে দিন যেন দেখতে না হয়, তাই সকল পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে নিজেদের অস্তিত্ব এবং স্বতন্ত্রতা টিকিয়ে রাখতে হবে। মহাভারতের শান্তিপর্বে বলা হয়েছে, ধর্ম এবং অধর্ম দেশকালে প্রতিষ্ঠিত। দেশ এবং কালের বাস্তবতায় এর রূপ পরিবর্তিত হয়।
অদস্যানুপাদানং দানমধ্যয়নং তপঃ।
অহিংসা সত্যমক্রোধ ইজ্যা ধৰ্মস্য লক্ষণম্ ॥
স এব ধৰ্মঃ সোঽধর্মো দেশকালে প্রতিষ্ঠিতঃ।
আদানমনৃতং হিংসা ধর্মো হ্যাবস্থিকঃ স্মৃতঃ ॥
(মহাভারত:শান্তিপর্ব, ৩৬.১০-১১)
"চৌর্য্য না করা, দান, অধ্যয়ন, তপস্যা, হিংসা না কবা, সত্য ব্যবহার ও ক্রোধ বর্জ্জন—এইগুলি ধৰ্ম্মের লক্ষণ।
দেশ এবং কাল অনুসারে সেই চুরি না করা প্রভৃতি ধৰ্মও হয়, আবার অধর্মও হয়। কেন না, বিপদের সময়ে চুরি করা, মিথ্যা বলা, কিংবা হিংসা করা প্রভৃতি ধর্মই হয়ে থাকে।"
তাই দেশকালের বাস্তবতাকে মাথায় নিয়ে, দেশপ্রেমকে সম্বল করে এই ভূখণ্ডের শাশ্বত সংস্কৃতি রক্ষায় এগিয়ে যেতে হবে।
তথ্য সহায়তা:
১. টারডিগ্রেড সংক্রান্ত তথ্যগুলো ইন্টারনেটে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
লিংক: ফেসবুক
0 মন্তব্যসমূহ