সংখ্যালঘুদের জমি দখলের শীর্ষে ভালুকার মোস্তফা পরিবার

সংখ্যালঘুদের জমি দখলের শীর্ষে ভালুকার মোস্তফা পরিবার
সংখ্যালঘুদের জমি দখলের শীর্ষে ভালুকার মোস্তফা পরিবার

মুহাম্মদ আবুল কাশেম, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি, ৩০ নভেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম 


ময়মনসিংহের ভালুকায় সংখ্যালঘুদের জমি দখলের শীর্ষে রয়েছে ভালুকা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা ও তার পরিবারের নাম।


সংখ্যালঘুদের বিভিন্নভাবে জিম্মি করে তাদের জমিজমা লিখে নেওয়া মোস্তফা পরিবারের নেশায় পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় সংখ্যালঘু ও ভুক্তভোগীদের পরিবার। শুধু সংখ্যালঘু নয়, সুযোগ পেলে নিজ দলের রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের জমি দখল করতেও পিছপা হন না তিনি।


এছাড়া সরকারি চাকরি দেওয়ার নামে হতদরিদ্র পরিবারের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অনেক অভিযোগ রয়েছে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে। গোলাম মোস্তাফা ভালুকা উপজেলার তালিকাভুক্ত রাজাকার সিরাজউদ্দীন খান ওরফে সুরুজ খানের মেয়ের জামাতা।


অভিযোগ আছে, গোলাম মোস্তফার ভাগনে বর্তা গ্রামের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কালিচরণ এর পৈতৃক জমি মনির এবং আকরামের নেতৃত্বে জোরপূর্বক জবরদখল করে ক্ষান্ত হননি। চামিয়াদী, কাঁঠালী বরচালা, হাজীর বাজার এলাকার বহু সংখ্যালঘুসহ নিজ দলীয় লোকের জমি জবরদখল করে নেন। মূলত এরা গোলাম মোস্তফার নিজস্ব বাহিনী হিসাবে সব জায়গায় বিচরণ করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বেড়ায় বলে শত শত অভিযোগ রয়েছে।


এদিকে সংখ্যালঘুদের জমি দখলকারী হিসাবে আলোচিত গোলাম মোস্তফা নিজেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রার্থী ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ভালুকা এলাকা ঘিরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জমি দখল, মিথ্যা মামলা দিয়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রতারণা করার প্রতিবাদে কয়েক দফা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করছে ভালুকার আদিবাসী পরিবারগুলো। সর্বশেষ সোমবারও তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা ও তার অপকর্মের শাস্তি দাবি করে মানববন্ধন করেছে ৫ শতাধিক আদিবাসী পরিবার।


সরেজমিন যুগান্তর অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার নারাঙ্গী এলাকার সংখ্যালঘু হরেন্দ্র, অমৃল্য চন্দ্র, জিতেন্দ্র, মাখন, নকুল ও রাজিন্দ্রের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ২ একর ৫৯ শতাংশ জমি (যার বাজার মূল্য ৬৭ লাখ টাকা) কেনার কথা বলে বায়না বাবদ দুবারে ৩ লাখ টাকা দিয়ে এবং জমির নির্ধারিত বাকি মূল্য পরিশোধ না করে, ওই জমির শরিকদের জিম্মি করেন। পরে জোরপূর্বক সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের স্ত্রী নাজমা খানমের নামে লিখে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।


আরও জানা যায়, ওই জমিতে নারাঙ্গি এলাকায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের দীর্ঘ একশ বছরের পুরোনো একটি শ্মশান ঘাটও রয়েছে। সেই গোলাম মোস্তফা পরিবারের দখলের হাত থেকে ওই শ্মশান ঘাটও রেহাই পাইনি। দিন-দুপুরে আদিবাসীদের ওপর হামলা ও মারধর করে এ শ্মশান ঘাট নিজের দখলে নেন। এরপরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের নামে থানায় মামলা করেন।


এ নিয়ে তৎকালীন সময়ে তারা ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে ধরনা দিয়ে উদ্ধার করতে পারেননি শ্মশান ঘাট ও তাদের জবরদখল হওয়া জমি।


উপজেলার চামেয়াদী এলাকায় আকতার ও মোক্তার দুই সহোদরসহ একাধিক পরিবারকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ৬ একর জমি দখল করেন। জমি দখলে বাধা দেওয়া স্থানীয় যুবলীগের নেতাসহ একাধিক ব্যক্তির নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে নিরীহ লোকজনকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করারও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও জমি জবরদখলে কেউ বাধা সৃষ্টি করলে তার বাহিনী দিয়ে হামলা চালায়। চামেয়াদি এলাকায় সাবেক এ উপজেলা চেয়ারম্যানের জমি কিনে ও বসবাস করতে না পারায় তার ভয়ে জমিতে আসছে না বলে জানান ভুক্তভোগীরা।


এছাড়াও ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ের কাঁঠালী বরচালা নামক এলাকায় চেয়ারম্যানের স্ত্রী নাজমা খানম ও ভাগনে মনিরের নামে উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে অসহায় সংখ্যালঘু পরিবারের দুই একরের কিছু বেশি জমি চারপাশে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে দখল করে রেখেছেন। এ পরিবারটির এখনো গোলাম মোস্তফার ভয়ে আতঙ্কে জীবনযাপন করছেন। বাপ-দাদার রেকর্ডকৃত সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও জমিতে যেতে পারছেন না। তারা ভয়ে এ প্রতিবেদকের কাছে বলেন, জমি লাগবে না আমাদের সুস্থভাবে মরতে দিন। এ জমির বিষয়ে কোনো সাংবাদিককের সঙ্গে কথা বলছি গোলাম মোস্তফা ও তার ভাগিনা আরিফ জানতে পারলে আমাদের এলাকাছাড়া করাবে এবং একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বেন বলেও জানান।


স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নারাঙ্গী, চামিয়াদী ও মামারিশপুর, কালিচরণবর্তা, কাঁঠালী বরচালা, হামিদ হাজীর বাজার ছাড়াও গোলাম মোস্তফা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক স্থানে জবরদখল করা বেশকিছু জমি রয়েছে। ভালুকার নারিঙ্গী এলাকার হতদরিদ্র আদিবাসী বজেন্দ্র বর্মণের ছেলেকে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিয়ন পদে চাকরি দেওয়ার নামে পরিবারটির কাছ থেকে নগদ ১ লাখ টাকা ঘুস নিলেও চাকরি দেননি। ছেলের চাকরি প্রসঙ্গে আদিবাসী বজেন্দ্র বর্মণ যুগান্তরকে বলেন, গোলাম মোস্তফা আমার ছেলে বিপ্লবকে পিয়ন পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে নগদ ১ লাখ টাকা নিয়ে পরে আমার ছেলের জায়গায় বিএনপি নেতা এমদাদ মাস্টারের ছেলেকে চাকরি দেয়। গোলাম মোস্তফা তাদের বাড়ি গিয়ে ছেলে বিপ্লবের চাকরির জন্য তার মেয়ের হাতে চাকরির ১ লাখ টাকা দিয়ে আসতে বললে আমি চাকরি পাওয়ার আশায় তার মেয়ের হাতে এক লাখ টাকা দিয়ে আসি। অদ্যাবধি টাকাটা ফেরত দেননি। অথচ আদিবাসী কোটায় তার ছেলেকে চাকরি দিতে প্রয়াত মন্ত্রী প্রমোদ মানকিন ও এমপি আমান উল্লাহ সুপারিশ করা সত্ত্বেও চাকরি দেননি এবং ঘুস নেওয়া সেই লাখ টাকাও ফেরত পাইনি বলে অভিযোগ করেন। ঘুসের টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হয়েছেন কয়েক দফা।


নিজেদের জমি বেদখল হওয়া প্রসঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দা অচিন্ত্য বর্মণ বলেন, জমি জোর করে জবরদখল করায় আমরা আদালতে মামলা করি। মামলা করার পরে স্থানীয় ভাবে আপসের প্রস্তাব দেয় গোলাম মোস্তফা পরিবার। পরে আমরা আদালতে ২০০৭ সালের ১০ অক্টোবর দুপক্ষের আপস মীমাংসার মাধ্যমে আলোচনা সাপেক্ষে ৬৭ লাখ টাকা জমির দাম ধার্য করেন। পরে ৩ লাখ টাকা বায়না বাবদ দিয়ে বাকি টাকা দিতে টালবাহানা শুরু করেন। আজ দিই কাল দিই করে আমাদের পাওনা টাকা না দিয়ে, ভাড়াটিয়া লোকজন নিয়ে আমাদের জমি জোরপূর্বক দখল করে নেন নেতা গোলাম মোস্তফা। এছাড়া আমরা সংখ্যালঘু বলে, বিভিন্ন সময় আমাদের ওপর তার ভাগিনা আরিফকে দিয়ে নির্মম নির্যাতন চালান মোস্তফা ও তার লোকজন। আমরা জমি জবরদখল করার সময় বাধা দিলে মারধর করেন। পরে উলটো আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিও করা হয়। সংখ্যালঘুদের জমি উদ্ধার ও ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।


পৈতৃক সূত্রে জমির শরিক নারাঙ্গীর স্থানীয় বাসিন্দা মাখন, রাজিন্দ্র, অমূল্য চন্দ্র ও জিতেন্দ্র বলেন, আমাদের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ২ একর ৫৯ শতাংশ জমি কেনার নামে শুধু বায়না বাবদ ৩ লাখ টাকা দিয়ে বাকি ৬৪ (চৌষট্টি লাখ) টাকা দেই দিচ্ছি করে আর দেয়নি গোলাম মোস্তফা। জমির টাকা না দিয়ে উলটো আমাদের মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক তার স্ত্রী নাজমা খানমের নামে বায়নাপত্র করে জমি লিখে নেন। জমির বাকি টাকা না দেওয়ায় এখনো জমির রেজিস্ট্রি পর্যন্ত হয়নি। ওই জমির দলিলও আমাদের নামে কিন্তু আমাদের জমি জোর করে দখলে নিয়েছে গোলাম মোস্তফা চেয়ারম্যান। গোলাম মোস্তফার কারণে আমরা ভালুকায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের কেউ ভালো নেই। সে আদিবাসীদের সম্পত্তি যেখানে দেখে সেখানে জবরদখল করে। আমরা এ জমি ফেরত না পেলে প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর নামে বিনা টাকায় দিয়ে দেব। তারপরেও আমরা ভালুকার আদিবাসী সম্প্রদায় গোলাম মোস্তফা পরিবারের নির্যাতন থেকে মুক্তি চাই। আমাদের এখন এক মাত্র ভরসার জায়গা প্রধানমন্ত্রী। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চাই আমাদের যেন উনি বাঁচান।


এছাড়া ভুক্তভোগী গোপাল জানান, কাকার কাছ থেকে জমি কেনার নামে শুধু বায়নার টাকা দিয়ে জমি দখলে নিয়েছে। এখন জমি বিক্রির টাকা চাইতে গেলে টাকাও দেন না এবং জমিতে যেতে দেন না। শুধু আমাদের জমি দখলে নিয়েছে এমনটি নয়। আপনারা খোঁজখবর নিয়ে দেখেন ভালুকাতে আমাদের মতো অনেক আদিবাসী ভুক্তভোগী রয়েছেন যারা মোস্তফার ভয়ে কোনো কথা বলার সাহস পায় না।


ভালুকা থানার আদিবাসী সম্প্রদায়ের চেয়ারম্যান মহেন্দ্র বর্মণ বলেন, গোলাম মোস্তফা উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে তার হস্তক্ষেপে অতুল বর্মণ গংদের ২ একর ৫৯ শতাংশ জমির মূল?্য ৬৭ লাখ টাকার বিপরীতে বায়না বাবদ দুবারে ৩ লাখ টাকা দেন। জমির বাকি টাকা পরিশোধ না করে তারাই ভোগ-দখলে রেখেছেন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এই জমির মধ্যে ২২ শতাংশের শ্মশান ঘাট রয়েছে সেটাও গোলাম মোস্তফা জোরপূর্বক দখল করে রেখেছেন। শ্মশান ঘাটে সব সময় তালা মেরে রাখেন তারা। সে কারণে লাশ সৎকার পর্যন্ত করা যায় না।


এ ব্যাপারে ভালুকা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সাম্পাদক গোলাম মোস্তফার সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরে তার ব্যবহৃত মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠিয়েও যোগাযোগ করা যায়নি।


সূত্র: যুগান্তর

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ