গায়ত্রী মন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রসঙ্গে বুদ্ধ - কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

গায়ত্রী মন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রসঙ্গে বুদ্ধ - কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

জগতে সকলের উচিত ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী মন্ত্রের জপ করা। শ্রীমদ্ভগবদগীতার মধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, গীতযোগ্য শ্রুতির মধ্যে তিনি বৃহৎসাম এবং জগতের সকল ছন্দ বা মন্ত্রসমূহের মধ্যে গায়ত্রী ছন্দের গায়ত্রী মন্ত্র। 


বৃহৎসাম তথা সাম্নাং গায়ত্রী ছন্দসামহম্।

মাসানাং মার্গশীর্ষোঽহমৃতূনাং কুসুমাকরঃ৷৷

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১০.৩৫)

"আমি গীতযোগ্য শ্রুতির মধ্যে বৃহৎসাম, ছন্দসমূহের মধ্যে গায়ত্রী ছন্দ, মাসসমূহের মধ্যে অগ্রহায়ণ এবং ষড় ঋতুর মধ্যে ঋতুরাজ বসন্ত।"


গায়ত্রী ছন্দের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে ঋগ্বেদ সংহিতার প্রথম সূক্ত গায়ত্রী ছন্দে শুরু হয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে বলেছেন যে, জগতের সকল ছন্দ বা মন্ত্রসমূহের মধ্যে তিনি গায়ত্রী ছন্দের গায়ত্রী মন্ত্র। বেদে গায়ত্রী মন্ত্রকে সাবিত্রী মন্ত্রও বলা হয়। মন্ত্রটি বেদের সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্র। পাপনাশক জীবের হৃদয়কে শুদ্ধদাত্রী গায়ত্রী বা সাবিত্রী মন্ত্রটি হল: 


ॐ ভূর্ভুবঃ স্বঃ

তৎ সবিতুর্বরেণ্যং

ভর্গো দেবস্য ধীমহি।

ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ।।

(ঋগ্বেদ সংহিতা:৩.৬২.১০)

"সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়কর্তা; প্রাণস্বরূপ, দুঃখনাশক এবং স্বর্গীয় সুখস্বরূপ; জ্যোতির্ময়, সর্বরক্ষক বরণীয়, ঐশ্বর্যযুক্ত পরমাত্মার ধ্যান করি। সেই বরণীয় প্রেরণকর্তা যেন আমাদের বুদ্ধিকে শুভ কার্যে প্রেরণ করেন।"


 ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ভগবান বুদ্ধ উভয়ই ভগবান বিষ্ণুর অবতার। তাঁরা উভয়েই ক্ষত্রিয় রাজবংশে অবতীর্ণ হন। ভারতবর্ষের প্রধান দুই বংশ চন্দ্র এবং সূর্যবংশে তাঁরা অবতীর্ণ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চন্দ্রবংশে এবং ভগবান বুদ্ধ শ্রীরামচন্দ্রের সূর্যবংশে অবতীর্ণ হন।  দ্বাপরযুগের শেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতারলীলা সংবরণের আড়াই হাজার বছর পরে বর্তমান কলিযুগের শুরুতেই নেপালে অবস্থিত শাক্যবংশে ভগবান বুদ্ধ অবতার রূপে আবির্ভূত হন। তাঁরা উভয়েই একই সত্ত্বা হওয়ায়,গায়ত্রী মন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বর্ণিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাক্যের সম্পূর্ণ অনুবর্তন পাওয়া ত্রিপিটকের সুত্ত পিটকে ভগবান বুদ্ধের অনুশাসনে। সেখানে ভগবান বুদ্ধ বলেছেন, সকল যজ্ঞের মধ্যে যেমন  অগ্নিহোত্র যজ্ঞ শ্রেষ্ঠ; তেমনিভাবে সকল ছন্দরাশির মধ্যে সাবিত্রী বা গায়ত্রী।


“অগ্নিহুত্তমুখা যঞ্ঞা, সাবিত্তী ছন্দসো মুখং, 

রাজা মুখং মনুস্ সানং, নদীনং সাগরো মুখং। 

নক্‌খত্তানং মুখং চন্দো, আদিচ্চো তপতং মুখং,

পুঞঞং আকঙ্খমানানং, সংঘো বে যজতং মুখ'ন্তি। 

(সুত্ত পিটক: সুত্তনিপাত, মহাবগ্গ,সেল সুত্তং, ২১-২২)

" সকল যজ্ঞের শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ অগ্নিহোত্র যজ্ঞ। তেমনি সকল ছন্দরাশির মধ্যে সাবিত্রী বা গায়ত্রী শ্রেষ্ঠ। মানুষের মধ্যে রাজা শ্রেষ্ঠ  এবং নদীর বা জলাশয়ের মধ্যে সাগর শ্রেষ্ঠ।  

 তারকাদের মধ্যে চন্দ্র শ্রেষ্ঠ। জ্বলন্ত জিনিসের মধ্যে সূর্য শ্রেষ্ঠ।  যোজনাকারীদের মধ্যে সংঘ শ্রেষ্ঠ। "


"সাবিত্তী ছন্দাসো মুখং"- ছন্দসমূহের মাঝে সাবিত্রীর  শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি ত্রিপিটকে একাধিক স্থানেই বর্ণিত হয়েছে। বিষয়টি সুত্ত পিটকের  সুত্তনিপাতের মহাবগ্গের সেল সুত্তে যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি সুত্তপিটিকের মজ্ঝিমনিকায বা মধ্যম-নিকায়ে বর্ণিত হয়েছে। 

রাত্রি অতিবাহিত হলে কেণিয় জটিল স্বীয় আশ্রমে উৎকৃষ্ট খাদ্য-ভোজ্য প্রস্তুত করে ভগবান বুদ্ধকে  নিবেদন করলেন,“ভো গৌতম সময় হয়েছে, ভোজন প্রস্তুত।” তখন ভগবান পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিধান করে পাত্র-চীবর ধারণপূর্বক কেণিয় জটিলের আশ্রমে ভিক্ষুসংঘসহ সজ্জিত আসনে উপবেশন করলেন। কেণিয় জটিল স্বহস্তে বুদ্ধপ্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে উৎকৃষ্ট খাদ্য-ভোজ্য দ্বারা সন্তর্পিত বা পরিতৃপ্ত করলেন। সংপ্রবারিত করলেন। ভগবান ভোজন শেষ করে পাত্র হতে হস্ত অপসারণ করলে কেণিয় জটিল এক নীচ আসন নিয়ে একপ্রান্তে বসলেন। তখন একপ্রান্তে, উপবিষ্ট কেণিয় জটিলকে ভগবান বুদ্ধ বললেন:


"অগ্নি-হোত্র, যজ্ঞে মুখ্য, সাবিত্রী-ছন্দের প্রধান,

মানবের শ্রেষ্ঠরাজা, নদীমাঝে সমুদ্র মহান।

নক্ষত্রের মুখ্য-চন্দ্র, তাপীদের আদিত্য প্রধান,

 পুণ্যকামী দাতুদের, দক্ষিণার্হ সঙ্ঘই মহান।”

( সুত্তপিটিক: মধ্যম-নিকায়, সেল সূত্র, ৯২)


ভগবান বুদ্ধ কেণিয় জটিলকে এই গাথাদ্বারা নির্দেশনা প্রদান করে আসন হতে উঠে প্রস্থান করলেন।সাবিত্রী মন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি ত্রিপিটকে বারংবার উল্লেখ, সুস্পষ্টভাবে সিদ্ধান্ত প্রদান করে যে ভগবান বুদ্ধের অনুশাসনে গায়ত্রী মন্ত্রের অবস্থান।বেদমন্ত্রের জন্য ছন্দের জ্ঞান অপরিহার্য। কারণ চারবেদের অধিকাংশ মন্ত্রই ছন্দোবদ্ধভাবে রচিত। বৈদিক ছন্দ সাতটি। গায়ত্রী, উষ্ণিক্, অনুষ্টুপ, বৃহতী, পঙক্তি, ত্রিষ্টুপ, জগতী। বৈদিক ছন্দকে অক্ষরছন্দ বলা হয়। কারণ মন্ত্রের অক্ষরের সংখ্যা গুণে গুণে নির্ণয় করতে হয়। অক্ষর বলতে কোনবর্ণ নয়, শব্দ উচ্চারণের স্বল্পতম প্রয়াসকে বোঝানো হয়। যাকে আমরা ইংরেজিতে 'Syllable' বলি। গায়ত্রী ছন্দে অক্ষরের সংখ্যা ২৪টি, উষ্ণিক ছন্দে ২৮টি, অনুষ্টুপ ছন্দে ৩২টি, বৃহতী ছন্দে ৩৬টি, পঙক্তি ছন্দে ৪০টি, ত্রিষ্টুপ ছন্দে ৪৪টি এবং সর্বশেষে জগতী ছন্দে অক্ষরের সংখ্যা ৪৮টি। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অসাধারণ গাণিতিক বিন্যাসে বৈদিক ছন্দের উদ্ভব। 


গায়ত্রী থেকে জগতী পর্যন্ত প্রত্যেকটি ছন্দে পর্যায়ক্রমে চারটি করে অক্ষরের বৃদ্ধি ঘটেছে। ছন্দের অত্যন্ত  প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ঋষি কাত্যায়ন বলেছেন, 


“যিনি ঋষি ছন্দ দেবতা ও মন্ত্রের বিনিয়োগ না জেনে মন্ত্রের দ্বারা যাগ করেন বা অধ্যয়ন-অধ্যাপন করেন, তিনি কাঠের গুঁড়ির মত কেবল ভারবাহী হন অথবা গর্তে পতিত হয়ে পাপে আচ্ছন্ন হন (কাত্যায়ন: ১.১)।”


একারণেই ছন্দ জানার জন্য ছন্দোগ্রন্থের প্রয়োজন। ছন্দ সম্পর্কে যাস্কের নিরুক্তে বলা হয়েছে,


 "ছন্দাংসি চ্ছাদনাৎ (৭.১২)।"


আচ্ছাদন করে বলে তাকে ছন্দ বলে। কি থেকে আচ্ছাদন? পাপ থেকে আচ্ছাদন। অর্থাৎ যা মৃত্যু থেকে রক্ষা করে অমৃতে নিয়ে যায় তাই ছন্দ। 


গায়ত্রী মন্ত্র এবং গায়ত্রী ছন্দ এক নয়। দুটি স্বতন্ত্র  বিষয়। বন ও বৃক্ষের মধ্যে যেমন পার্থক্য অথবা জলবিন্দু বা জলাশয়ের মধ্যে পার্থক্য ঠিক তেমনি। গায়ত্রী ছন্দে বেদ এবং বেদ পরবর্তীতে পুরাণদি শাস্ত্রে ঋষি-মুনি কর্তৃক অসংখ্য মন্ত্র এবং শ্লোকের রচনা হয়েছে। তবে এখানে একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, ভগবান বুদ্ধ তো তাহলে গায়ত্রী ছন্দের কথা বলেছেন যে, ছন্দের প্রধান ছন্দের শ্রেষ্ঠ গায়ত্রী। তবে সেই ছন্দের প্রধান গায়ত্রী বুদ্ধবচনটি কেন শুধু গায়ত্রী মন্ত্র বা


 "তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ।।(ঋগ্বেদ সংহিতা:৩.৬২.১০)" 


এ মন্ত্রটিকেই নির্দেশ করবে?  এর সুস্পষ্ট উত্তর ভগবান বুদ্ধই দিয়ে দিয়েছেন তাই এ নিয়ে কোন প্রকার দ্বিধান্বিত হওয়ার সুযোগ নেই। ভগবান বুদ্ধ বলেছেন, "সাবিত্তী ছন্দসো মুখং"। অর্থাৎ  সকল ছন্দরাজির প্রধান বা শ্রেষ্ঠ সাবিত্রী। গায়ত্রী ছন্দে অসংখ্য মন্ত্র রয়েছে। কিন্তু গায়ত্রী ছন্দে রচিত সাবিত্রী মন্ত্র একটিই। গায়ত্রী মন্ত্রের মধ্যে এটি শ্রেষ্ঠ মন্ত্র হওয়ার, মন্ত্রটি গায়ত্রী মন্ত্র হিসেবেও পরিচিত। তাই ভগবান বুদ্ধ নিজেই সুস্পষ্টভাবে সাবিত্রী মন্ত্র বলে দেয়ায় এ নিয়ে আর কোন নূন্যতম সন্দেহের অবকাশ নেই। তিনি যদি ত্রিপিটকে "সাবিত্তী ছন্দসো মুখং" না বলে বলতেন যে "গায়ত্তী ছন্দসো মুখং" ; তবে এ নিয়ে সংশয়ের অবকাশ ছিলো। কিন্তু ভগবান বুদ্ধ 'সাবিত্রী' শব্দটির প্রয়োগ করায়, অসংখ্য মন্ত্রের মধ্যে ঋষি বিশ্বামিত্র দৃষ্ট ঋগ্বেদ সংহিতার তৃতীয় মণ্ডলের বাষট্টি সুক্তের দশম মন্ত্রকে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে। পরিশেষে বলবো,  বৈদিক সাবিত্রী শব্দের অর্থ কি এটি জানতে কোন বড় গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। যেকোন সংস্কৃত বা বাংলা অভিধানে সাবিত্রী শব্দটিতে একটু চোখ বুলালেই হবে। কিন্তু বর্তমানে সমস্যা হচ্ছে, অধিকাংশ মানুষই কোন বিষয়কে না জেনেই তা নিয়ে ভালো-মন্দ মন্তব্য করে বসেন। আর এতেই সরল সাধারণ বিষয়গুলোই সমস্যাময় জটলতায় রূপ নেয়। এ জাতীয় বিষয়গুলো জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং যুগপৎ দুঃখজনক। 



কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


https://www.facebook.com/KushalBaranBD/posts/pfbid0PxeiJYFrNBKqzpjtZoYSnFXDU4BtWdqin7hyWVgUJeZVjM2Evo1iL4GjSsB3eJgUl

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ