বুদ্ধ সনাতন আর্যধর্মেরই প্রচার করেছেন - কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

বুদ্ধ সনাতন আর্যধর্মেরই প্রচার করেছেন - কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী


ভগবান বুদ্ধের প্রসঙ্গ আসলেই আমরা অনেকেই বলে থাকি যে, ভগবান বুদ্ধ কেন একটি নতুন স্বতন্ত্র ধর্মের প্রতিষ্ঠা করলেন। বিষয়টি নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকের মাঝে একটি চাপা ক্ষোভ দেখা যায়। কেউ কেউ হয়ত অজ্ঞানতাবশত সেই চাপা ক্ষোভ প্রকাশও করে ফেলেন। আমরা যদি ভগবান বুদ্ধের বাণী হিসেবে খ্যাত ত্রিপিটকের দিকে দৃষ্টি দেই, তবে আমরা সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাবো ভগবান বুদ্ধ সর্বদা সনাতন ধর্মের কথাই বলেছেন। ত্রিপিটকের সুত্ত পিটক বা সূত্র পিটকের অন্তর্গত খুদ্দক (ক্ষুদ্রক) নিকায়ের অন্তর্ভুক্ত ধর্মপদে বলা হয়েছে:


নহি বেরেন বেরানি সম্মন্তী’ধ কুদাচনং,

অবেরেন চ সম্মত্তি এস ধম্মো সনন্তনো। 

(ধর্মপদ: যমক বর্গ,৫)


"জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনও শত্রুতার উপশম হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়; ইহাই সনাতন ধর্ম।"


পালি ভাষায় ভগবান বুদ্ধের মুখে ত্রিপিটকে বলা, "এস ধম্মো সনন্তনো"  বাক্যটি সংস্কৃত ভাষায় মনুসংহিতাতেও পাওয়া যায়। এই বাক্যটির সাথে ভগবান বুদ্ধ বলেছেন, জগতে কারো সাথে শত্রুতা না করতে এবং ভগবান মনু বলেছেন, সদা  সত্য কথা এবং প্রিয় কথা বলতে। সংস্কৃত এবং পালি এ দুটি ভাষায় বর্ণিত দুটি বাক্যের ভাবটি প্রায় একই,  তা হল সকলের কল্যাণ। 


সত্যং ব্রূয়াৎ প্রিয়ং ব্রূয়ান্ন ব্রূয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্। 

প্রিয়ঞ্চ নানৃতং ব্রূয়াদেষ ধর্মঃ সনাতনঃ।। 

(মনুসংহিতা: ৪.১৩৮)


" সর্বদা সত্য কথা বলবে, প্রিয় কথা বলবে, কিন্তু সত্য কথাও যদি শ্রোতার মর্মভেদী অপ্রিয় হয় তা বলবে না; আবার মিথ্যা প্রিয় বাক্য বলবে না।—এই হলো বেদোপদিষ্ট সনাতন ধর্ম।"


এই শ্লোকের টীকায় কুল্লূক ভট্ট  সনাতন ধর্মের দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, তা হল "এষ বেদমূলতয়া নিত্যো"। অর্থাৎ সনাতন ধর্মের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য, প্রথমত এ ধর্মটি নিত্য বা শাশ্বত এবং দ্বিতীয় পরমেশ্বরের শাশ্বত বেদ এ ধর্মের মূলে রয়েছে।


ভগবান বুদ্ধ ত্রিপিটকে তাঁর শিষ্যদের বারংবার আর্যদের অনুশ্রুত শাশ্বত মার্গে চলতে বলেছেন। তিনি  অমৃতপদ লাভের উপায় বলেছেন:


অপ পমাদো অমতপদং পমাদো মচ্চুনো পদং,

 অপ্ পমত্তা ন মীয়ন্তি যে পমত্তা যথা মতা।

এতং বিসেসতো ঞত্বা অপ্‌মাদমূহি পণ্ডিতা,

 অপমাদে পমোদন্তি অরিয়ানং গোচরে রতা। 

 তে ঝায়িনো সাততিকা নিচ্চং দল্ হপরাক্কমা,

ফুসন্তি ধীরা নিব্বানং যোগক্‌খেমং অনুত্তরং।

(ধর্মপদ: অপ্রমাদ বর্গ, ১-৩)


"অপ্রমাদ অমৃতপদ লাভের উপায়, প্রমাদ মৃত্যুর পথ। অপ্রমত্ত ব্যক্তিরা অমর, যারা প্রমত্ত তারা মৃতের ন্যায়।

অপ্রমাদের এ বৈশিষ্ট্য জ্ঞাত হয়ে পণ্ডিতগণ অপ্রমাদে আনন্দ লাভ করেন এবং আর্যদের অনুশ্রুত পথে বিচরণ করেন।

সে সকল ধ্যানী, অধ্যবসায়ী, উদ্যোগী ও নিয়ত দৃঢ়পরাক্রমশীল, তাঁরা ক্রমে প্রশান্ত নির্বাণ লাভ করেন।"


 আর্যধর্ম যে বৈদিক সনাতন ধর্ম, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাই ভগবান বুদ্ধ আর্যোপদিষ্ট ধর্মেপথে চলার নির্দেশনা দিয়ে বৈদিক সনাতন ধর্মমার্গে চলতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, পণ্ডিত ব্যক্তি তিনিই যিনি সর্বদা আর্যগণের প্রদর্শিত আর্যোপদিষ্ট ধর্মপথে রত থাকেন। 


ধৰ্ম্ম—পীতি সুখং বিপ্লসন্নেন চেতসা, 

অরিয়প্ পবেদিতে ধম্মে সদা রমতি পণ্ডিতো ।

(ধর্মপদ: পণ্ডিত বর্গ, ৪)


"ধর্মপ্রীতি মুগ্ধ ব্যক্তি সুখে ও প্রসন্নচিত্তে বাস করেন। পণ্ডিত ব্যক্তি সর্বদা আর্যগণের প্রদর্শিত আর্যোপদিষ্ট ধর্মপথে রত থাকেন।"

ভগবান বুদ্ধের কাছে যে ধর্মের জ্ঞান সঞ্চিত ছিলো, তা শাশ্বত আর্যধর্মের জ্ঞান। ভগবান বুদ্ধের শিষ্যগণ তাঁর কাছে অতুলনীয় বীর্যসম্পন্ন আর্যধর্মের জ্ঞানই প্রার্থনা করেছেন। এ আর্যধর্মের জ্ঞানবারি অজ্ঞানকে নিবারণ করে এবং মুক্তির তৃষ্ণাকে সিক্ত করে।


পরোবরং অরিযধম্মং বিদিতা,

 মা মোহযী জান’মনোমবীর;

বারিং যথা ঘম্মনি ঘম্মতত্তো,

 বাচাভিকঙ্খামি সুতং পবস। 

(সুত্তপিটক: সুত্তনিপাত,চূলবগ্গ, বঙ্গীস সুত্তং, ১১)


"আপনি অতুলনীয় বীর্যসম্পন্ন  আর্যধর্মকে যথার্থভাবে  জেনে এবং সর্বজ্ঞ হয়েও আমাদেরকে অজ্ঞানতাবিষ্ট করবেন না। গ্রীষ্মকালে ঘর্মাক্ত কলেবর ব্যক্তির যেমন জলপানের ইচ্ছা হয়, আমিও তদ্রুপ আপনার সুভাষিত বাক্য শ্রবণেচ্ছুক। আপনি আমাকে আপনার জ্ঞানবারি বর্ষণ করুন।"


ত্রিপিটকের সুত্তপিটকের সুত্তনিপাতের চূলবগ্গের কিংসীল সূত্তে ভগবান বুদ্ধ বলেছেন, বেদজ্ঞ ব্যাক্তি নিজে মুক্ত হয়ে  অন্যকে মুক্ত করতে সক্ষম হন। যাঁরা আর্য প্রবর্তিত ধর্মে বা বৈদিক ধর্মে রত, তাঁরা বচনে, মননে এবং কর্মে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন।


বিঞ্ঞাত সারানি সুভাসিতানি সুতঞ্চ বিঞ্ঞাত সমাধিসারং, ন তস্স পঞ্ঞা চ সুতঞ্চ বড্ ঢতি, যো সাহসো হোতি নরো পমত্তো।

ধম্মে চ যে অরিযপবেদিতে রতা,

 অনুত্তরা তো বচসা মনসা কম্মুনা চ।

তে সন্তি সোরচ্চ সমাধি সন্ঠিতা, 

সুতস্স পঞ্ঞায চ সারমজ্ঝগূতি।

(সুত্তপিটক: সুত্তনিপাত,চূলবগ্গ, কিংসীল সুত্তং,৬-৭)


"যিনি কেবল সুভাষিত বাক্যসমূহের মাধ্যমে সারবস্তুকে (নির্বান) জ্ঞাত হন, এবং শ্রুতির বা বেদের মাধ্যমে জ্ঞাত হন সমাধিসারকে, সেই ব্যাক্তি সহসা প্রমত্ত ব্যাক্তিতে পরিণত হন। কারণ তাঁর  শ্রুতিজ্ঞান (বেদজ্ঞান) এবং প্রজ্ঞা দ্রুতই শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।

যাঁরা আর্য প্রবর্তিত ধর্মে (বৈদিক ধর্মে) রত, তাঁরা বচনে, মননে এবং কর্মে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন। শান্তি, কোমলতা এবং সমাধিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে তাঁরা শ্রুতি এবং প্রজ্ঞার সার লাভ করে থাকেন।"



কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


https://www.facebook.com/KushalBaranBD/posts/pfbid024QW8QcSBpLNYEYQtbiWyzi2A1t5KcQ6NQqLpHzJBAJ38uwicqvUUmy3eFVoVsV9il


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ