ভগবান বুদ্ধ বেদবিরোধী নন - কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

ভগবান বুদ্ধ বেদবিরোধী নন - কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

ভগবান বুদ্ধ সুত্ত পিটকের সুত্তনিপাতের চূলবগ্গ - ধম্ম নাবা সুত্তে বলেন, যিনি বেদজ্ঞ তিনিই সকলকে উদ্ধারে সমর্থ হন। ধম্ম নাবার অর্থ হল ধর্মের নৌকা। অর্থাৎ ধর্মের নৌকায় চড়ে ভবসমুদ্র পাড়ি দেয়া। মানুষ যাঁর কাছ থেকে ধর্মের শিক্ষা লাভ করে, তাঁকেই পূজনীয় বরণীয় বলে গ্রহণ করে তাঁর পূজা করে। দেবগণ যেমন দেবরাজ ইন্দ্রের পূজা করে, ঠিক তেমনভাবে মানুষও শিক্ষা প্রদানকারী শিক্ষককে পূজা করে বা শ্রদ্ধা করে। পূজা লাভ করে বা শ্রদ্ধায় প্রীতি লাভ করে সেই শিক্ষাগুরু প্রসন্ন হয়ে তিনি সেই যোগ্য অধিকারীকে বহুশ্রুত ধর্মের রহস্য প্রকাশ করেন। শিক্ষাগুরু থেকে জ্ঞান লাভ করে সেই মেধাবী শিষ্য বিচারশীলতার সাথে ধর্মানুধর্ম অনুশীলন করে প্রতিভাদীপ্ত ও দক্ষতা লাভ করেন। কিন্তু পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ক্ষুদ্র হৃদয়ের, নির্বোধ, শাস্ত্র সম্পর্কে অনভিজ্ঞ এবং ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তির সেবাপরায়ণ, সেই ব্যক্তি ধর্মকে কখনো বুঝতে পারে না। তাই তিনি আমৃত্যু সন্দেহযুক্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।


যম্মা হি ধম্মং পুরিসো বিজঞ্ঞা, 

ইন্দংব নং দেবতা পূজযেয্য; সো পূজিতো তস্মি পসন্নচিত্তো, বহুসুতো পাতুকরোতি ধম্মং। 

তদট্ ঠিকতান নিসম্ম ধীরো, ধম্মানুধম্মং 

পটিপজ্জমানো, বিঞ্ঞূ বিভাবী নিপুণো চ হোতি, 

যো তাদিসং ভজতি অপ্ মত্তো।

খুদ্দঞ্চ বালং উপসেবমানো, অনাগতথঞ্চ উসূর্যকঞ্চ;

ইধেব ধম্মং অবিভাবযিতা, অবিতিকঙ্খো মরণং উপেতি।

(সুত্তপিটক: সুত্তনিপাত,চূলবগ্গ, ধম্ম নাবা সুত্তং,১-৩)


"মানুষ যাঁর কাছে ধর্ম শিক্ষা করে, দেবগণ যেমন ইন্দ্রের পূজা করেন, ঠিক তেমনভাবে মানুষ শিক্ষককে পূজা করেন। পূজা লাভ করে, পূজাদানকারীগণের প্রতি প্রসন্ন হইয়া, বহুশ্রুত শিক্ষক ধর্ম প্রকাশ করেন।

যেই মেধাবী বিচারশীলতার সাথে ধর্মানুধর্ম অনুশীলনে রত সে ব্যক্তি বিজ্ঞ, প্রতিভাদীপ্ত ও দক্ষতা লাভ করে  থাকেন।

যেই ব্যক্তি ক্ষুদ্র হৃদয়ের, নির্বোধ, অর্থ অজ্ঞাত এবং ঈর্ষান্বিত ব্যক্তির সেবাপরায়ণ হয় এই জগতে সেই ব্যক্তি ধর্ম বুঝতে  পারব না। তিনি সন্দেহযুক্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।"


ধর্মকে উপলব্ধি করা বহুশ্রুতদের ধর্মের ব্যাখ্যা যারা না শোনে তারা মূর্খের ন্যায় কেবল সংসাররূপ স্রোতস্বিনী নদীর তীব্র স্রোতেই ভেসে যায়। তারা নিজেকে যেমন উদ্ধার করতে পারে না, তেমনি অন্যদেরকেও উদ্ধার করতে পারে না।


যথা নরো আপগ' মোতরিত্বা, মহোদকং সলিলং সীঘসোতং, সো বুয্হমানো অনুসোতগামী,

 কিং সো পরে সক্ খতি তারযেতুং।

তথেব ধম্মং অবিভাবযিত্বা, বহুসুতানং অনিসাময'থং; সয়ং অজানং অবিতিন্নকঙ্খো, কিং সো পরে সক্ খতি নিজ্ঝপেতুং। 

(সুত্তপিটক: সুত্তনিপাত,চূলবগ্গ, ধম্ম নাবা সুত্তং,৪-৫)

"যে মানুষ গভীর তীব্র স্রোতস্বিনী নদীত স্রোতের অনুকূলে কেবল ভেসে যায়, – সে কি উপায়ে অন্যকে উদ্ধার করতে সক্ষম হবে? 

সেইরূপ ধর্মকে উপলব্ধি না করে বহুশ্রুতদের ধর্মের ব্যাখ্যা না শুনে মূর্খ এবং সন্দেহ পরায়ণ হয়ে কি উপায়ে সে অন্যজনকে প্রবুদ্ধ করিবে?"


 কারা এই সংসার সমুদ্র থেকে পার হতে পারেন? - এই প্রশ্নের উত্তরে ত্রিপিটকে ভগবান বুদ্ধের সিদ্ধান্ত হল 

 যিনি বেদকে সম্যকরূপে জানেন, অর্থাৎ যিনি বেদজ্ঞ;  যিনি ভাবিতাত্মা; যিনি বহু শাস্ত্র বৈদিক আচার্যের মুখে শুনে বহুশ্রুত হয়েছেন; যিনি ভয়হীন একমাত্র  তিনিই   উত্তরণ করতে সক্ষম হন। তাঁরা কৌশলী এবং  দক্ষতার সাথে দৃঢভাবে নৌকায় আরোহণ করে সাফল্যের সাথে নিজের সাথে সাথে অন্যদেরও পার করতে পারেন।


যথাপি নাবং দল্‌হমারুহিত্বা, ফিযেন 

রিত্তেন সমঙ্গিভূতো, সো তারযে তথ 

বহূপি অঞ্ঞে, তত্তূপযঞ্ঞূ কুসলো মুতীতা।

এবম্পি যো বেদগূভাবিতত্তো বহুস্সুতো হোতি অবেধ ধম্মো সো খো পরে নিজ্ঝপযে পজানং সোতাবধানূপনিসূপপান্ন।।

(সুত্তপিটক: সুত্তনিপাত,চূলবগ্গ, ধম্ম নাবা সুত্তং,৬-৭)

"যেমন কৌশলী দক্ষ, মতিমান মানুষ দৃঢভাবে নৌকায় আরোহণ করে দাঁড় ও হালের সাহায্যে সে নিজেকেসহ অন্যান্য ব্যক্তিদেরও পার করে দিতে পারে।

তেমনি যিনি বেদজ্ঞ, ভাবিতাত্মা, বহুশ্রুত, ভয়হীন, তিনিই উত্তরণ করতে সক্ষম হন। যাঁরা শুনতে আগ্রহী এবং মনোনিবেশ সম্পন্ন হন।"


অর্থাৎ ভগবান বুদ্ধ নৌকার উদাহরণ দিয়ে সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, বেদজ্ঞ ব্যাক্তিই নিজে মুক্ত হয়ে  অন্যকে মুক্ত করতে সক্ষম হন।সুত্তনিপাতের চূলবগ্গের কিংসীল সূত্তে বলা হয়েছে :


বিঞ্ঞাত সারানি সুভাসিতানি সুতঞ্চ বিঞ্ঞাত সমাধিসারং, ন তস্স পঞ্ঞা চ সুতঞ্চ বড্ ঢতি, যো সাহসো হোতি নরো পমত্তো।

ধম্মে চ যে অরিযপবেদিতে রতা,

 অনুত্তরা তো বচসা মনসা কম্মুনা চ।

তে সন্তি সোরচ্চ সমাধি সন্ঠিতা, 

সুতস্স পঞ্ঞায চ সারমজ্ঝগূতি।

(সুত্তপিটক: সুত্তনিপাত,চূলবগ্গ, কিংসীল সুত্তং,৬-৭)

"যিনি কেবল সুভাষিত বাক্যসমূহের মাধ্যমে সারবস্তুকে (নির্বান) জ্ঞাত হন, এবং শ্রুতির বা বেদের মাধ্যমে জ্ঞাত হন সমাধিসারকে, সেই ব্যাক্তি সহসা প্রমত্ত ব্যাক্তিতে পরিণত হন। কারণ তাঁর  শ্রুতিজ্ঞান (বেদজ্ঞান) এবং প্রজ্ঞা দ্রুতই শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।

যাঁরা আর্য প্রবর্তিত ধর্মে (বৈদিক ধর্মে) রত, তাঁরা বচনে, মননে এবং কর্মে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন। শান্তি, কোমলতা এবং সমাধিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে তাঁরা শ্রুতি এবং প্রজ্ঞার সার লাভ করে থাকেন।"


বেদজ্ঞদের শ্রেষ্ঠত্বের সাথে সাথে বেদজ্ঞদের সংজ্ঞা এবং বৈশিষ্ট্যও ভগবান বুদ্ধ ত্রিপিটকে বলেছেন।তিনি বলেছেন, যিনি জ্ঞাতব্য সকল জ্ঞান অর্জন করে মুক্তির পথে অনাসক্ত হয়ে আছেন,  সর্ববিদ্যায় শিক্ষিত সেই ব্যক্তিই বেদজ্ঞ। বেদ সম্যকরূপে  জানলে সকল বিদ্যাই লাভ করা যায়। তাই যিনি বেদবিদ্যাকে জানেন, সেই বেদজ্ঞের আর কোন বিদ্যা বা কোন জ্ঞাতব্য বিষয়ই অজ্ঞাত থাকে না।


কিং পত্তিমাহু বেদগুং, (ইতি সভিযো) 

অনুবিদিতং কেন কথঞ্চ বীরিযবাতি;

 আজানিযো কিন্তি নাম হোতি,

 পুট্‌ঠো মে ভগবা ব্যাকরোহি। 

বেদানি বিচৰ্য্য কেবলানি, (সভিযাতি ভগবা) 

সমণানং যানিধথি ব্রাহ্মণানং,

সব্ববেদনাসু বীতরাগো,

 সব্বং বেদমতিচ্চ বেদগূ সো।

(সুত্তপিটক: সুত্তনিপাত, মহাবগ্গ,সভিয় সুত্তং,১৯-২০)

"সভিয় ভগবান বুদ্ধকে বললেন; কিসের প্রাপ্তিতে বেদজ্ঞ বা সর্ব্বোচ্চ জ্ঞান লাভ করা যায়? অনুবিদিত বা তীক্ষ্ণ জ্ঞানসম্পন্ন বলে কে উক্ত হন? বীর্যবানই বা কে? আজানীয় বা উচ্চজাতিসম্পন্ন বলে কে অভিহিত? আমি জিজ্ঞাসা করছি, হে ভগবান! আমায় প্রকাশ করুন।

উত্তরে ভগবান সভিয়কে বললেন, হে সভিয়! শ্রমণ ও ব্রাহ্মণদের জ্ঞাতব্য সকল জ্ঞান অর্জন করে যিনি সকল প্রকার বেদনায় বীতরাগ বা অনাসক্ত হয়ে আছেন ; সর্ববিদ্যায় শিক্ষিত সেই ব্যক্তিকেই বেদজ্ঞ বলে অভিহিত করা হয়।"


স্মর্তব্য যে ভগবান বুদ্ধ ত্রিপিটকে বারবার মুক্তির প্রতিরূপ 'নির্বাণ' শব্দের সাথে সাথে সমাধি' শব্দটিরও একাধিক স্থানে উল্লেখ করছেন। সমাধি শব্দটি একটি সুপ্রাচীন বৈদিক শব্দ। ভগবান বুদ্ধ পূর্ববর্তী ভারতীয়  ষড়দর্শনের অন্তর্গত মহর্ষি পতঞ্জলিকৃত 'যোগদর্শন' গ্রন্থে সমাধি সম্পর্কে সুবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। ভগবান বুদ্ধ বেদ বেদজ্ঞদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তিনি বেদের এত ভূয়সী প্রশংসা  করার পরেও, বর্তমানে অনেকের মুখে শুনতে পাওয়া যে,  ভগবান বুদ্ধ নাকি বেদোপদিষ্ট আর্যধর্মের বিরোধী। কথাগুলো শুনলে বড্ড হাসি পায়, এদের অজ্ঞানতা দেখে। এরা বেদ এবং ত্রিপিটক এ শাস্ত্রগুলো পাঠ না করেই নিজস্ব ভাবনা  থেকে এ কথাগুলো ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এদের মধ্যে ভারতের একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদদের অনুসারীরা অন্যতম। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। 


কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


https://www.facebook.com/KushalBaranBD/posts/pfbid0cthuQTmzQhP3d6NzWwawUsVdumuRPx2UxwT6H7XSJeyA4sZSSL6pwbXCn3jm6UWol

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ