বাঙালির শাঁখা সিঁদুর - তমাল দাশগুপ্ত

বাঙালির শাঁখা সিঁদুর - তমাল দাশগুপ্ত
চন্দ্রকেতুগড়ের একটি মাতৃমূর্তি, হাতে খাঁজকাটা কাজসহ শাঁখার বালা


চন্দ্রকেতুগড়ের মাতৃমূর্তিতে হাতে শাঁখার বালা দেখা যায়। যেরকম শাঁখার বালার খাঁজকাটা মণিমণ্ডিত কাজ আজও প্ৰচলিত বাঙালির মধ্যে। হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকে বাঙালির পূর্বসূরীরা একটানাভাবে শাঁখার বালা পরে আসছেন, এটাই স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত ছিল। হরপ্পা সভ্যতায় শাঁখা সিঁদুর প্ৰচলিত ছিল, আমি এর আগে বলেছি। সিঁদুর কথাটাই খুব সম্ভব সিন্ধুর থেকে এসেছে। ওদিকে হরপ্পা আসলে সমস্ত স্থানীয় ভাষায় হড়প্পা লেখা হয়, হড়পা বান থেকে এই নাম। নিঃসন্দেহে হরপ্পা সভ্যতার উত্তরাধিকার আজকের মাতৃধর্মী বাঙালি বহন করে।


কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হল, আমি জানতে পারলাম একশ্রেণীর চাড্ডি ও ছাগু গবেষক শাঁখার বালার সঙ্গে বিভিন্ন বিচিত্র সব সংযোগ খুঁজে পাচ্ছেন। গোবলয়-আর্যাবর্ত থেকে দ্রাবিড় দক্ষিণ ভারত, আর্যাবর্ত প্রতীক অগস্ত্য মুনির পরিযান থেকে দক্ষিণ ভারতের পাণ্ড‍্য সাম্রাজ্য, কি নেই সেখানে!


শুধু এই ব্রাত্য আর্য, অবৈদিক আর্য, আউটার এরিয়ান বাঙালিই নেই। অথচ বাংলা ভাষাটা আউটার এরিয়ান ভাষা, অর্থাৎ বেদবহির্ভূত যে আর্যরা ভারতে এসেছিলেন, বৈদিক আর্য আসার বেশ অনেকটা সময় আগে, বাংলা হল সেই অবৈদিক আর্যভাষা। অবৈদিক আর্য শুনে আকাশ থেকে পড়ার কিছু নেই, পৃথিবীর মোট আর্যভাষী জনগোষ্ঠীর অতি ক্ষুদ্র অংশই বৈদিক ছিল। নীহাররঞ্জন পর্যন্তও দেখবেন যে বাঙালির উৎসে এই অবৈদিক, অ্যালপাইন আর্যদের কথা ইতিহাসবিদ মহলে স্বীকার করা হত। এই সেদিনও টোনি জোসেফের আর্লি ইন্ডিয়ান্স বইতে আউটার এরিয়ান তত্ত্বের স্বীকৃতি আছে। কিন্তু এদের দেখুন, এইসব বিজাতীয় বলয়ের দালালদের দেখুন। এদের জন্য বাঙালির নিজের কিছুই নেই। দ্রাবিড়বলয় আর গোবলয়ের দালালদের এই গজকচ্ছপ যুদ্ধে বাঙালির ভিটে উচ্ছেদ হয়ে যাবে। আমাদের ইতিহাস তো এদের সক্রিয় ষড়যন্ত্রে মুছে গেছেই, এবার আবহমান-সমকালীন সংস্কৃতিকেও বেদখল করবে।


বেদের ছেলে বাপন, আর মূলনিবাসী ঘোঁতন, আর্যাবর্ত চাড্ডি আর দ্রাবিড়বাদী ছাগু - এদের দাবি হল বাঙালির নিজের বলে কিছু নেই, থাকতে পারে না। সব এদের অবৈধ বাবারা গোবলয় থেকে, দক্ষিণ ভারত থেকে, আরব থেকে, নিদেনপক্ষে মহিষাসুরের পূর্বপুরুষ অসুরবানিপালের বাপের বাড়ি থেকে কিংবা সুদূর আফ্রিকা থেকে বয়ে এনেছে। 


সিরিয়াস ব্যাপারে ব্যঙ্গ করতে চাই না। কিন্তু এই ধারাবাহিক অসভ্যতা কেন? বাঙালির আবহমান শাঁখাকে বেদের ছেলে বাপন আর বেদের মেয়ে জ্যোৎস্নারা চাইলেই কি বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারবেন? হরপ্পা সভ্যতার সমসাময়িক পাণ্ডু রাজার ঢিবি থেকে দুহাজার বছর আগে পর্যন্ত যে চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডাই সভ্যতা, সর্বত্র মাতৃধর্ম, সর্বত্র তন্ত্র, এবং সর্বত্র চক্রবলয় ও সিঁদুর আছে। জেন্ডার নিউট্রালভাবেই আছে। আমরা মাতৃধর্মের অনুসারী, আমরা সবাই মাথায় সিঁদুরের তিলক দিই। অনেক তান্ত্রিক হাতে শাঁখার বালা পরেন। কাপালিকরা হাতে শাঁখার বালা ধারণ করেন। এছাড়া তন্ত্রে মানুষের মাথার খুলিকে মহাশঙ্খ আখ্যা দেওয়া হয়, যা থেকে শঙ্খের গুরুত্ব বোঝা যায়। বাঙালির শেকড়ে আছে সাংখ্য দর্শন, সাংখ্য দর্শনের প্রকৃতিই আমাদের দুর্গা কালী জগদ্ধাত্রী পুজোয় প্রকাশিত হন, বঙ্কিম বলেছিলেন। অনেক প্রাচীন গ্রন্থে এই সাংখ্য দর্শনকে শাঙ্খ‍্য নামেও ডাকা হয়, শঙ্খ এতই গুরুত্বপূর্ণ।


শাঁখা জলের প্রতীক, আবার সমুদ্রে নিহিত বাণিজ্যসম্পদের প্রতীক। প্রাচীন কাল থেকে আমাদের মধ্যে জলদেবী পূজিত হতেন আজও হন নানা রূপে, মা নীলা/নীলসরস্বতী অন্যতম। এবং শ্রী/লক্ষ্মী সহ সমস্ত সমৃদ্ধির দেবীও শাঁখায় পূজিত। শঙ্খ তন্ত্রধর্মী প্রতীক, পরে বৈষ্ণবসহ অন্যান্য ধর্ম আত্মসাৎ করেছে। চক্রও তন্ত্রের প্রতীক, চক্র হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই জগদকারণ জগদযোনি, অর্থাৎ মাতৃযোনি হিসেবে, আদিতম যন্ত্র হিসেবে তন্ত্রধর্মে ব্যবহৃত (প্রাচীন ভারতের মাতৃকা উপাসনার ধর্মে  চক্র প্রতীক বিষয়ে ইতিমধ্যেই গবেষণা হয়েছে), যা পরে বৈষ্ণব ধর্মে গৃহীত। শাঁখার বলয়ও চক্র।  এই চক্র শুধু মাতৃযোনি নয়, তন্ত্রধর্মে কালপ্রবাহেরও চিহ্ন, সেজন্য মা কালীর সঙ্গেও জড়িত শাঁখার বালা।


দেখছেন চন্দ্রকেতুগড়ে একটি মাতৃমূর্তি। হাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে খাঁজকাটা কাজসহ শাঁখার বালা।


© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta 


অসংখ্য মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে চন্দ্রকেতুগড় থেকে, ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নবিভাগের আদৌ কোনও উদ্যোগ ছাড়াই। সরকারি উদাসীনতায় এবং একশ্রেণীর অসাধু ক্ষেত্র গবেষকের যোগসাযোগে প্রায় সবই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।


হরপ্পা সভ্যতায় শাঁখা সিঁদুর নিয়ে আগে লিখেছিলাম, লিংক


সূত্র: ফেসবুক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ