কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ এবং দ্বিতীয়া তিথিতে বাঙালী হিন্দুর ঘরে-ঘরে অনুষ্ঠিত ভাইফোঁটা উৎসব সকলের কাছেই পরিচিত, প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবটি এখন একান্তভাবেই একটি লোকাচার-রূপে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু কতদিন আগে থেকে যে এই প্রথাটি বাঙালী হিন্দুদের ঘরে প্রচলিত হয়েছে, ইতিহাস থেকে সেটার স্পষ্ট কোনো হদিশ না পাওয়া গেলেও, বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রের সাহায্যে সেটার একটা চেষ্টা করা সম্ভব। ভাইফোঁটা প্রসঙ্গে ঐতিহাসিকেরা এখনও পর্যন্ত প্রাচীনতম যে উল্লেখটি পেয়েছেন, সেটা ভারতের অন্য প্রান্তে অবস্থিত মুম্বাইয়ের অনহিলবাড় পাটনে আবিষ্কৃত একটি প্রাচীন তালপাতার পুঁথিতে পাওয়া গিয়েছিল। খৃষ্টীয় তেরোশো শতাব্দীর শেষার্ধে সর্বানন্দসুরি নামের একজন প্রাচীন আচার্য তাঁর ‘দ্বীপোৎসবকল্প’ গ্রন্থে লিখেছিলেন যে, জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরের জীবনাবসান হওয়ার পরে রাজা নন্দিবর্ধনের বোন তাঁর ভাইয়ের শোক নিবারণ করবার জন্য কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে তাঁকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে অন্নগ্রহণ করিয়েছিলেন, এবং সেই থেকেই ভারতে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পালনের প্রথা চালু হয়েছিল। এই বিবরণের যদি কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকে, তাহলে বলতে হয় যে, খৃষ্টপূর্ব ৫২৭ অব্দ থেকেই ভারতবর্ষে এই প্রথার সূত্রপাত ঘটেছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে দুটি প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রথমতঃ, মূলতঃ বাঙালী হিন্দুদের ঘরেই এই প্রথাটি প্রচলিত কেন? এবং দ্বিতীতয়ঃ, প্রথাটির সঙ্গে ফোঁটা দেওয়ার রীতি আর যম-যমুনা সম্পর্কিত ছড়াই বা কি ভাবে গড়ে উঠেছে? আগে দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা যাক।
যম এবং তাঁর ভগিনী যমীর উল্লেখ ঋগ্বেদে পাওয়া যায়। যমী সেখানে যমকে বিবাহ করতে চাইলে যম তাঁকে সেই বিবাহের অসঙ্গতি বুঝিয়ে নিবৃত্ত করেছিলেন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যম সেখানে যমীকে বলেছিলেন যে, অতি আদিমকালে ভ্রাতা-ভগিনীর মধ্যে বিবাহ প্রচলিত থাকলেও পরে সেই রীতি অনুচিত বলে গণ্য হয়েছিল। দেবতারা যমীর সেই আকাঙ্ক্ষার কথা জানতে পারলে ক্রুদ্ধ হবেন, অতএব যমী যেন নিজের জন্য অন্য স্বামীর সন্ধান করেন। পরবর্তীকালের হিন্দু পুরাণগুলিতে যমীকে আর বিশেষ দেখতে পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র মার্কণ্ডেয়পুরাণে বলা হয়েছে যে, তিনি মত্ত বলরামের স্নানের আহ্বানে সাড়া দিতে অনিচ্ছুক হলে তাঁর হলের প্রবল আকর্ষণে যত্রতত্র গমন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি নাকি যমুনা নদীরূপে পরিচিত হয়েছিলেন। স্পষ্টতঃই এই বিবরণ অতীতের নদী নির্ভর সেচ ব্যবস্থা, এবং কৃষি ও শস্য উৎপাদন সম্পৃক্ত আচার হিসেবে স্ত্রী-পুরুষের সম্মিলন ইত্যাদির ঐতিহাসিক ইঙ্গিতবাহী একটি রূপক। আবার ভ্রাতার পরিবর্তে অন্য পুরুষকে নিজের স্বামীরূপে গ্রহণ করবার যে সামাজিক প্রথার সূচনা কৃষির পত্তনের আগেই ঘটেছিল, সেটারও হদিশ ঐ বৈদিক বিবরণের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে, যমী (বা যমুনা) কর্তৃক যমকে নিজের স্বামীরূপে বরণ করতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাতা হওয়ার পরিণতিতে পরবর্তীতে তিনি যে বলরামের সহগামিনী হয়ে গিয়েছিলেন, এমন সংস্কারই প্রাচীন পুরাণে প্রতিফলিত হয়েছে বলে দেখা যায়। কালক্রমে জনমানসে সেই বৈদিক এবং পৌরাণিক কারণটা বিস্মৃত হয়ে পরিবর্তিত সামাজিক কাঠামোতে বোন-কর্তৃক ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় কপালে ফোঁটা দেওয়ার রীতিতে অব্যাহত থেকে গিয়েছে।
স্বভাবতঃই, এই ফোঁটা দেওয়া এবং একই সাথে ছড়া পড়বার মধ্যে একটা আদিম জাদুবিশ্বাসের ধারানুসণ দেখা যায় বলে মনে করা যেতে পারে। ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনার মাধ্যমে মৃত্যু-দেবতাকে প্রতিরোধ করবার এই জাদুবিশ্বাস সম্পৃক্ত আচার স্বাভাবিকভাবেই যম, এবং তাঁর সূত্র ধরে যমী তথা যমুনাকে, এই প্রথার পালনীয়তার কারণ হিসেবে গড়ে তোলা লৌকিক কাহিনীর মধ্যে নতুন করে ও নতুন তাৎপর্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আবার হেমন্তের মুখপাতে ফসল তোলার প্রাক্কালে বোন তাঁর ভাইকে আয়ু ও সমৃদ্ধি কামনা করে বরণ করছেন, অতীতের কৃষিকেন্দ্রিত সমাজে এটা খুবই স্বাভাবিক একটা প্রথা ছিল।
কার্তিক মাসে যম পুজোর যে লৌকিক প্রথা ‘যমপুকুর ব্রত’ বলে পরিচিত, এই প্রসঙ্গে সেটারও উল্লেখ করবার দরকার রয়েছে। সেখানেও যমরাজা-যমরাণীকে সাক্ষী রেখে পিতা এবং ভাইয়ের ‘লক্ষেশ্বর’ হওয়ার মন্ত্র পড়া হয়, অর্থাৎ মৃত্যুদেবতাকে পূজার মাধ্যমে তুষ্ট রেখে ভাইয়ের হিতকামনা করবার এই ব্রতাচারটি মূলতঃ ভাইফোঁটারই সমগোত্রীয়। আবার যেহেতু যমপুকুর ব্রততে সুপ্রসব কামনা করা হয়, সেহেতু এটি উর্বরতা-কেন্দ্রিক ধর্মাচার বলেও সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে গণ্য। সুতরাং এই ব্রতটির সঙ্গে শস্য উৎপাদক সমাজের সম্পর্কটাও নিবিড় বলে দেখা যায়।
কার্তিকের অমাবস্যায় দীপাবলী উৎসবের মাধ্যমে প্রেতবিতাড়নের আদিম যে সংস্কার প্রতিফলিত হয়, তারপরে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পালন - সেটাও মূলতঃ মৃত্যুরোধক সংস্কারজাত। ফোঁটা দিয়ে যমের ‘দুয়ারে কাঁটা’ দেওয়ার জন্য জাদুকেন্দ্রিক ছড়া উচ্চারণ যে আদতে প্রাগৈতিহাসিক সূত্রবাহী, সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ফসলী ঋতুর সূত্রপাতে এটি পালন করা প্রাচীন ইতিহাসের অনুষঙ্গকে আকর্ষণ করলেও, বর্তমানে প্রথাটি প্রচলিত থাকবার মধ্যে আর কোনো আদিম বা প্রাচীন ধর্মচিন্তা প্রবল নেই; বর্তমানে এটি একটি সুন্দর সামাজিক প্রথা হিসেবেই প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। শুধু যমোপসানার ধর্মকেন্দ্রিক চিন্তাটুকু বিলীয়মান যমপুকুর ব্রত পালনের মধ্যে থেকে গিয়েছে।
সেই কারণেই যে স্মৃতিশাস্ত্রগুলি একদা হিন্দু সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করত, সেখানে ভাতৃদ্বিতীয়া উপলক্ষে যে স্মার্ত মন্ত্র তৈরী করা হয়েছিল -
‘যমরাজের, বিশেষতঃ যমুনার প্রীতির জন্য আমার ভাইকে এই অন্ন গ্রহণ করালাম’
- এই মর্মে, সেটিও বর্তমানে অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে প্রচলিত বাংলা ছড়ায় যমকে আর প্রীত করবার আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং তাঁর ‘দুয়ারে কাঁটা’ দিয়ে লড়াই করবার একটা মনোভাবই দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যেই সম্ভবতঃ ভাতৃদ্বিতীয়ার একান্তভাবে বাঙালীয়ানা বিষয়টি লুকিয়ে রয়েছে। বাঙালীর লৌকিক ধর্ম এবং আচারবিধি মূলতঃই প্রাগার্য প্রত্ন-অস্ট্রিক প্রত্ন-দ্রাবিড় সংস্কৃতির ধারাকে ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছে বলে স্মৃতিশাস্ত্র সেখানে অনুপ্রবিষ্ট হতে পারেনি। সেই কারণে বঙ্গদেশে ভাইফোঁটাও একটি ব্রতধর্মী পার্বণে পরিণত হয়ে গিয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু ভারতের অন্যত্র, বিশেষতঃ উত্তর ও পশ্চিম ভারতের আর্য সংস্কৃতির বলয়ে স্মৃতির বিধান অনুযায়ী এই একই তিথি দীপাবলী উৎসবের অবিচ্ছিন্ন অংশরূপে পালিত হয়ে থাকে; এবং যম-যমুনার সঙ্গে সেখানে কেন চিত্রগুপ্তের পূজোও করা হয় সেকথা সহজবোধ্য। সেখানে ভাইয়াদুজ অথবা যমদ্বিতীয়া নামে পরিচিত এই দিনের উৎসব বাঙালী হিন্দু ঘরের বোনেদের মত যমের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেনি। পক্ষান্তরে পশ্চিম ভারতে এই একই দিনে নববর্ষ, হিন্দীভাষী বলয়ে দোয়াত-কলম পুজো ইত্যাদি নানা উপলক্ষে লৌকিক উৎসব প্রচলিত থাকলেও, মূলতঃ শাস্ত্রীয় মন্ত্র-বিধান ইত্যাদির মাধ্যমেই সেগুলি পালন করা হয়ে থাকে। কিন্তু বাঙালীর ঐতিহ্যের যে একটি নিজস্বতা রয়েছে, ভাইফোঁটার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত অনুসন্ধান করলে সেটা নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারা যায়।
0 মন্তব্যসমূহ