দেবী লক্ষ্মী বৈদিকাল থেকে পূজিত হলেও বাঙালির ঘরে আজ দেবী লক্ষ্মী ঘরের মেয়েতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। তাই পৃথিবীতে দেবী লক্ষ্মীর প্রতিমা চতুর্ভুজা হলেও বঙ্গে দেবীর প্রতিমা দ্বিভুজা। প্রায় প্রত্যেকটি বাঙালি হিন্দুর ধরে লক্ষ্মীদেবীর আসন রয়েছে। সেই আসনে নিত্য পাঠ হয় লক্ষ্মীর পাঁচালী। তবে প্রতিদিন যদি পড়তে সময় না পায়, তবে অন্ততপক্ষে প্রতি পূর্ণিমা বা বৃহস্পতিবার বাঙালি নারীরা লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়বেই। কোন সূদুর অতীতে কোন ব্যক্তি লক্ষ্মীর পাঁচালীর রচয়িতা, তা হয়তো আজ কেউ বলতে পারবে না। বহুকাল ধরেই বঙ্গের ঘরেঘরে লক্ষ্মীর পাঁচালী প্রচলিত। বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, নোয়াখালী, সিলেট, যশোর, খুলনা, বরিশাল,রংপুর, ফরিদপুর ইত্যাদি বৃহত্তর অঞ্চলে পাঁচালীটির বিভিন্ন প্রকারের পাঠান্তর পাওয়া যায়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরাতেও পাঁচালীটি সামান্য পাঠান্তর পাওয়া যায়। তবে সামান্য পাঠান্তর অঞ্চলভেদে থাকলেও, কখনো আমূল পাঠান্তর পাওয়া যায় না। মূলধারা এবং মূলকহিনীটি সর্বত্রই প্রায় এক। বঙ্গে প্রচলিত এ লক্ষ্মীর পাঁচালীতে যে পরিমাণে নীতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে, যা এক কথায় অভূতপূর্ব। যদি কেউ কোন কঠিন কঠিন সংস্কৃত গ্রন্থ না পড়ে; শুধু লক্ষ্মীর পাঁচালীই পড়ে তবে সে সেই লক্ষ্মীর পাঁচালীতে পঠিত জ্ঞান দিয়ে নির্দ্বিধায় নিজের পরিবার এবং নিজের দায়িত্ব কর্তব্য অবলীলায় পালন করতে পারবে। পাঁচালীতে নর-নারীদের কুক্রিয়া থেকে মুক্ত হয়ে সদাচার পালন করতে বারংবার বলা হয়েছে। এই সদাচারের অভাবেই জীব দুর্ভিক্ষ সহ অসহ্য যাতনা পায়। অন্নের অভাবে ক্ষুধায় কষ্টে কাতর হয়ে অনেক জীব আত্মহত্যা পর্যন্ত করে। কেউ প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র কন্যাগণে পরিত্যাগ পর্যন্ত করে।
"সতত কুক্রিয়া রত নর-নারীগণ।
অসহ্য যাতনা পায় দুর্ভিক্ষ ভীষণ।।
অন্নাভাবে শীর্ণকায় বলহীন দেহ।
ক্ষুধা কষ্টে আত্মহত্যা করিতেছে কেহ।।
কেহ প্রিয় প্রাণাধিক পুত্র কন্যাগণে।
করিতেছে পরিত্যাগ অন্নের কারণে।।"
দিবানিদ্রা ভালো নয়, এতে আলস্যতা বৃদ্ধি পায়। বিবিধ প্রকারের অনাচার, কদাচার, ক্রোধ, অহংকার এবং অলসতা মানুষের জীবনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলছে। ফলে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে তার কর্তব্য কর্ম ভুলে যাচ্ছে। বিকট শব্দে হাসি দেয়া এবং চিৎকার করা কথা বলা নারীপুরুষ নির্বিশেষে কারো জন্যেই উচিত নয়। নারীদের একদমই উচিত নয়, নারীগণ যেহেতু গৃহের লক্ষ্মীস্বরূপিণী। সন্ধ্যাকালে যেহেতু উপাসনার সময়, তাই সে সময়ে বেহুশ নয়নে ঘুমানো সম্পূর্ণভাবে অনুচিত। লোকশ্রুতি যে, সন্ধ্যাকালেই লক্ষ্মীদেবী তাঁর আসনে উপবেশন করে আশীর্বাদ করেন। লক্ষ্মীস্বরূপিণী নারীগণের দয়া, মায়া এবং লজ্জাদি লক্ষ্মীর চিহ্ন। কিন্তু সেই চিহ্নাদি বিসর্জন দিয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে অনেক নারী যেথায় সেথায় গমন করছে। যা একান্তই শোভন নয়, অত্যন্ত দৃষ্টিকটু।
"দিবানিদ্রা অনাচার ক্রোধ অহঙ্কার ।
আলস্য কলহ মিথ্যা ঘিরিছে সংসার ॥
উচ্চহাসি উচ্চভাষা কহে নারীগণে।
সন্ধ্যাকালে নিদ্রা যায় বেহুস নয়নে ॥
দয়া মায়া লজ্জাদি দিয়া বিসর্জন।
যেথায় সেথায় করে স্বেচ্ছায় গমন ॥"
যে সকল গৃহে সন্ধ্যাকালে ধূপের ধূনা এবং প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করা না হয়, লক্ষ্মীদেবী সে সকল গৃহে অবস্থান করেন না। ধূপের ধূনা এবং প্রদীপের আধ্যাত্মিক উপকারিতা সাথে সাথে অন্যান্য প্রচুর উপকারিতা রয়েছে। সন্ধ্যাকালীন সময়ে ধূপের ধূনায় মশা-মাছি সহ বিভিন্ন পোকামাকড় দূরে চলে যায়। পরিধেয় কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে, এই ভেবে যারা প্রভাতে গোময়ের ছড়া দেয় না, দেবী লক্ষ্মী তাদের প্রতি অপ্রসন্ন হন। গোময়ের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে জীবাণুনাশক ক্ষমতা রয়েছে। তাই গ্রাম এলাকায় আজও মাটির ঘরের অভ্যন্তর সহ উঠানে গোময় দ্বারা লেপন করা হয়।
"না দেয় প্রদীপ তারা প্রতি সন্ধ্যাকালে ।
ধূপধূনা দিতে লজ্জা মনে মনে গণে ॥
প্রভাতেতে নাহি দেয় গোময়ের ছড়া ।
ম'লায় নষ্ট হবে তার পোষাক পড়া ॥"
শ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে, জগতের সকল জীবের মাঝেই তিনি আছেন, কিন্তু জগতে সকল নারীর মাঝেই তার স্বয়ং প্রকাশ।প্রত্যেকটি নারীর মাঝেই আদ্যাশক্তি মহামায়া রয়েছেন। কিন্তু এরপরেও অনেকে নিজ অভ্যন্তরীণ সেই মহাশক্তিকে উপলব্ধি করতে না পেরে অকার্যে কুকার্যে সময়কে অতিবাহিত করে। এভাবে তারা নিজের জীবনকে অন্ধকারের কাছে স্বেচ্ছায় সমর্পণ করে। ইন্দ্রিয়ের সুখের পিছনে ছুটে তারা ইন্দ্রিয়াতীত পরমশান্তিকে ভুলে যায়।
"লক্ষ্মী অংশে নারীজাতি করিয়া সৃজন ।
পাঠায়েছে মত্ত্যধামে সুখের কারণ ॥
বৃথা এ সুখেতে তারা ভুলিয়া আমায়।
অকার্যে কুকার্যে তারা সময় কাটায় ॥"
অনেক নারীরাই সংস্কারহীন হয়ে শ্বশুর-শাশুড়ীগণের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করে। তাদের উপরে অনেক অশ্রাব্য বাক্যরূপ বাণ প্রয়োগ করে তাদের মনে অহেতুক কষ্ট দেয়। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে, তারাও একটি সময়ে শ্বশুর-শাশুড়ীগণের বয়সে পৌছাবে। তখন তাদের সাথে যদি এমনিই আচরণ হয়, তবে তারা তখন কি করবে? কারণ, মানুষের জীবনে কৃত প্রত্যেকটি ক্রিয়াই প্রতিক্রিয়া হয়ে তারই জীবনে পুনরায় ঘুরে ঘুরে আসে। কর্মফল থেকে কেউ বাঁচতে পারে না। অনেক নারীরাই আছে বিয়ের পরে, স্বামীর পরিবারের সাথে স্বামীকে দূরত্ব তৈরি করে স্বামীকে নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। স্বার্থপরের মত সকল কিছুই চিন্তা করে।স্বামীর আত্মীয় স্বজনকে কোন সমাদর করে না। আবার সংসারে এমন অনেক নারীরা আছে, যারা শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় স্বজনকে বাদ দিয়ে শুধু নিজের বাবার বাড়ির আত্মীয় পরিজনকে নিয়েই সদা ব্যস্ত থাকে। লজ্জাদি গুণ যত নারীর ভূষণ পরিত্যাগ করে, অনেকে লজ্জাহীন হওয়ার সাথে সাথে লক্ষ্মীহীন এবং শ্রীহীন হয়ে যাচ্ছে। অতিথিকে সনাতন ধর্মে দেবতা বলে অবিহিত করা হয়েছে। কিন্তু অনেকেই গৃহে আগত অতিথি দেখলে বিরক্ত হয়ে যায়। সেই বিরক্ত আরও বেড়ে যায়, যদি সেই অতিথির থেকে কিছু কলা-মূলা পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে। নারীরা সংসারের লক্ষ্মী। সংসারকে ধরে রেখেছে নারীরা।কিন্তু বর্তমানকালে আধুনিকতার নামে অনেক নারীরা গৃহের গৃহস্থালি সকল কর্ম পরিত্যাগ করে অলস সময় কাটায়। অনেক স্বামীকে অকারণে অবহেলা করে। স্বামী এবং সংসারের অন্য পরিবার পরিজনের কোন কথা না শুনে স্বেচ্ছাচারী হয়ে যায়। এতে সেই পরিবারের পারিবারিক বন্ধন ধীরেধীরে বিনষ্ট হয়ে যায়।
"শ্বশুর-শাশুড়ীগণে নহে ভক্তিমতি।
বাক্যবাণ বর্ষে সদা তাহাদের প্রতি ॥
স্বামীর আত্মীয়গণে না করে আদর।
থাকিতে চাহে সদা হয়ে সতন্তর ॥
লজ্জাদি গুণ যত নারীর ভূষণ।
একে একে হৃদি হতে করেছে বর্জন ॥
অতিথি দেখিলে তারা কষ্ট বাসে মনে।
স্বামীর আগেতে খায় যত নারীগণে ॥
পতিরে করিছে হেলা না শুনে বচন।
ছাড়িয়াছে গৃহস্থালী ছেড়েছে রন্ধন ॥"
নারীদের যেমন গৃহের লক্ষ্মীস্বরূপিণী বলা হয়েছে, তেমনিভাবে পুরুষেরাও গৃহের নারায়ণের স্বরূপ বলা হয়। এই কারণে কোন আদর্শিক সুখি দম্পতি দেখতে আমরা আজও তাদের 'লক্ষ্মী-নারায়ণের জুটি' বলে অবিহিত করে থাকি। তাই সংসারে নারীদের মত পুরুষদেরও সমান দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে সংসারে। কিন্তু বর্তমানকালে কিছু পুরুষ শুধুই বৃথা পরিহাস করে, সর্বদা মিথ্যা কথা বলে সময় কাটায়। এতে লক্ষ্মীদেবী অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেন।যে গৃহে নারী পুরুষ উভয়েই অসত্যকে আশ্রয় করে, অলক্ষ্মীকে আহ্বান করে; সেই গৃহে লক্ষ্মীদেবী অত্যন্ত চঞ্চলা হয়ে গৃহ পরিত্যাগ করেন। পরিণামে সংসারটি ছারখার হয়ে যায়।তিনি সেই পাপের আগারে বাস করতে পারেন না। মানবের ঈর্ষা, দ্বেষ, হিংসা,পরশ্রীকাতরতা, কুটিলতা বিনাশের কারণ। যে স্থানে এ বিষয়গুলো থাকে, সেখানে দেবী লক্ষ্মী বসবাস করতে পারেন না। যে সংসারে যেমন বীজ রোপণ করবে, সে ঠিক তেমনিই ফল পাবে। যদি বিষবৃক্ষ রোপন করে, তবে বিষফল পাবে। পক্ষান্তরে শ্রীবৃক্ষ রোপন করলে শ্রীফল পাবে। তাই শুধু নিজের সুখ নিয়ে ব্যস্ত থেকে যারা সংসারে দেব, দ্বিজ এবং গুরুজনদের ভক্তি শ্রদ্ধা করে না; তারা কখনো লক্ষ্মীর আশীর্বাদ এবং কৃপা পায় না। শুধু জিহ্বার তৃপ্তির জন্যে যারা, সামনে যা পায় তাই খায় তারা অকালে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। যারা গোমাংস, মলমূত্রাদি অমেধ্য, অভক্ষ্য ভক্ষণ করে, তাদের শরীরে বিবিধ রোগব্যাধি বাসা বাঁধে। তাই অভক্ষ্য কখনই ভক্ষণ করা উচিত নয়। কিন্তু কেউ যদি সকল তামসিকতা বর্জন করে সদাচারী হয়ে শুদ্ধ জীবন যাপন করতে পারে; তবে লক্ষ্মীদেবী সুস্থিরা হয়ে সারা দিনরাত্রি তার গৃহে বসবাস করে।
"পুরুষেরা পরিহাসে সময় কাটায়।
মিথ্যা ছাড়া সত্য কথা কভু নাহি কয় ॥
সতত ইহারা মোরে জ্বালাতন করে।
চপলার প্রায় তাই ফিরি ঘরে ঘরে ॥
ঈর্ষা-দ্বেষ-হিংসাপূর্ণ মানব হৃদয় ।
পরশ্রীকাতর চিত্ত কুটিলতাময় ॥
দেব-দ্বিজ ভক্তিহীন তুচ্ছ গুরুজন।
কেবল আপন সুখ করে অন্বেষণ ॥
রসনার তৃপ্তি জন্য অভক্ষ্য ভক্ষণ ।
তারি ফলে নানা ব্যাধি অকালে মরণ ॥
যে গৃহে এইরূপ পাপের আগার।
অচলা হইয়া তথা থাকি কি প্রকার।।
বর্জিয়া এসব দোষ হলে সদাচারী।
নিশ্চলা থাকিব সেথা দিবা-বিভাবরী ॥"
শাস্ত্রে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ। এ কারণে কেউ যদি আত্মহত্যা করে, তবে শাস্ত্রে তার কোন পারলৌকিক কৃত্যাদি নেই। আত্মহত্যা মহাপাপ এবং যিনি করেন তিনি সরাসরি নরকে গমন করেন।বিষয়টি লক্ষ্মীর পাঁচালীতে দেবী লক্ষ্মীর মুখে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। সাধারণত নারীদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তবে লক্ষ্মীর পাঁচালী আত্মহত্যার প্রবণতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিষেধক হিসেবে অত্যন্ত কার্যকরী। যেহেতু বাঙালি গৃহের নারীরা প্রতিনিয়ত লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ে। তাই দেবী লক্ষ্মীর আত্মহত্যার বিরুদ্ধে এ সুস্পষ্ট নির্দেশনায় অনেক নারীরা জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট পাড়ি দিলেও আত্মহত্যা পথকে পরিত্যাগ করে। কারণ অধিকাংশ হিন্দু বাঙালি নারীদের জীবনে লক্ষ্মীর পাঁচালীর প্রভাব অপরিসীম।
"নারায়ণী বলে শুন আমার বচন।
আত্মহত্যা মহাপাপ নরকে গমন।।"
আজকে যে আমরা ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্প নিয়ে বিশ্বে এত আলোচনা করছি- এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্মীদেবীর পাঁচালীতে পাওয়া যায়। যা সত্যি বিস্ময়কর। পাঁচালীতে বলা হয়েছে, প্রতিদিন পরিবারের সকল সদস্যদের বরাদ্দকৃত চাল থেকে একমুষ্টি চাল আলাদা করে একটি পাত্রে রাখতে হবে। সেই পাত্রের নাম 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার'। প্রত্যেকটি গৃহে এ 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' স্থাপন করতে হবে। কখনো যদি গৃহে চাল না থাকে, তবে সেই সঞ্চয়কৃত চালই দুঃসময়ে গৃহস্থকে রক্ষা করবে। পাঁচালীতে নারীদের আলস্যদোষ ত্যাগ করে দেশের অবস্থা চিন্তন করে সূতা কাঁটতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ নিজেরাই যেন নিজেদের স্বদেশী বস্ত্র উৎপন্ন করতে পারি - এ বিষয়টি লক্ষ্মীর পাঁচালীতে সুস্পষ্ট। কিন্তু এ বিষয়টি আমরা দেখি ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে।
"লক্ষ্মীর ভাণ্ডার স্থাপি সব ঘরে ঘরে।
রাখিবে তণ্ডুল তাতে এক মুষ্টি করে।।
সঞ্চয়ের পথ ইহা জানিবে সকলে ।
দুঃসময়ে সুখী হবে তুমি এর ফলে ॥
আলস্য ত্যজিয়া সূতা কাট বামাগণ ।
দেশের অবস্থা মনে করিয়া চিন্তন ॥"
দেবী লক্ষ্মী অহংকারীর অহংকারপূর্ণ গর্বিতবাক্যকে সহ্য করতে পারেন না। অহংকারী ব্যক্তিকে দেবী পরিত্যাগ করেন। এ কারণেই দেখা যায়, অনেক অহংকারী গর্বিতবচনের ব্যক্তিকে দেবী লক্ষ্মী পরিত্যাগ করায়; তারা পরবর্তীতে সহায় সম্বলহীন নিঃস্ব হয়ে যায়। পহাড়ের চূড়া থেকে পাহাড়ের খাদে গিয়ে পতিত হয়। জগতে ধন সম্পদের পিছনে যেমন বিবিধ কর্মপ্রচেষ্টা রয়েছে, তেমনি সেই কর্মের পিছনে রয়েছে দৈবীকৃপা। কিন্তু অত্যন্ত অহংকারীকে দৈব কখনো কৃপা করে না।
"গর্বিত বচন লক্ষ্মী সহিতে না পারে।
অহঙ্কার দোষে দেবী ছাড়িল উহারে।।"
লক্ষ্মীর পাঁচালীর আরেকটি বড় শিক্ষা হলো যৌথ পরিবারের শিক্ষা। অর্থাৎ পরিবারের সকল সদস্য মিলেমিশে একসাথে থাকা। কিন্তু বর্তমানে নাগরিক জীবনে আমরা দিনেদিনে অত্যন্ত স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। আমাদের পূর্বের যৌথ পরিবারগুলো দিনেদিনে ভেঙে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে একটু একটু করে আমরা দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। এই যৌথ পরিবারগুলো আমাদের শক্তি ছিলো।
"মিলিল ভ্রাতারা পুনঃ আর বধূগণ।
সাধুর সংসার হল পূর্বের মতন।।"
ভাবতে অবাক লাগে যে, লক্ষ্মীর পাঁচালীর মধ্যে এতটা আধুনিক, বাস্তবসম্মত, সময়োপযোগী নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।এ কারণেই বলা হয়, বাঙালি নারী যদি চায় তবে শুধু লক্ষ্মীর পাঁচালীর জ্ঞানেই তাঁর সম্পূর্ণ সংসারকে সুন্দর করে পরিচালিত করা সম্ভব। এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই। তাই বলা হয়, এক লক্ষ্মীর পাঁচালীতে যে জ্ঞান এবং নৈতিকতার শিক্ষা আছে, সেই জ্ঞান ও নৈতিকতার শিক্ষা জগতে বিরল। পাঁচালীর শেষে নারদ মুনি বলেছেন, সকলই আদ্যাশক্তি দেবী মহামায়ার কৃপাতেই হয়। তিনি যদি কৃপা না করেন, তবে কিছুই সম্ভব নয়। তিনিই সৃষ্টির ব্রহ্মাণী সরস্বতী, স্থিতির বৈষ্ণবী লক্ষ্মী এবং প্রলয়ের অধিশ্বরী মাহেশ্বরী কালিকা। তিনি এক, তিনিই বহু। তিনিই স্থির, তিনিই গতি। তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি। সকল সৃষ্টি সহ এ জগত তিনিই প্রসব করেছেন। তাই তিনি সকল কারণের কারণ জগতেশ্বরী। বিভিন্ন রূপে এবং বিভিন্ন নামে তিনি এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পরিব্যাপ্ত।
"এত শুনি মুনিবর বলে হৃষ্ট মনে ৷
কি হলে প্রসন্ন দেবী হবে নরগণে ॥
ওহে দয়াময়ি তুমি না করিলে দয়া ৷
পারে কি লভিতে নর তব পদ ছায়া ॥
সৃষ্টি-স্থিতি প্রলয়ের তুমি অধিকারী
জগত প্রসূতি তুমি জগত ঈশ্বরী ।"
তথ্য সহায়তা:
১.দেবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (সঙ্কলিত), লক্ষ্মীর পাঁচালী
২.বসন্তকুমার চক্রবর্ত্তী (সঙ্কলিত), লক্ষ্মীর পাঁচালী
৩. দিলীপ রায়( সম্পাদিত),লক্ষ্মীর পাঁচালী
**********
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
https://www.facebook.com/KushalBaranBD/posts/pfbid02C9aFdWdFbJQezPBJccR2VRygyKX86XDGarkfLjzmbUqdCBwjVxJX8Gb3KBKK5nQGl
0 মন্তব্যসমূহ