প্রবারণা উৎসব সম্পর্কে কিছু তথ্য

প্রবারণা উৎসব সম্পর্কে কিছু তথ্য

আশ্বিন মাস। আজ পূর্ণিমা। তো কি হয়েছে? তো প্রবারনা হয়েছে। তো কোজাগরী হয়েছে। আর রাসলীলা হয়েছে। কোজাগরী আর রাসলীলা নিয়ে আরেকদিন বলব, আজ প্রবারনা নিয়ে বলি।   


প্রবারনা কি? পালি ‘প্রবারণা’ শব্দটির অনেক অর্থ- নিমন্ত্রণ, আহ্বান, মিনতি, অনুরোধ, নিষেধ, ত্যাগ, শেষ, সমাপ্তি, শিষ্টাচার, বিধি, তৃপ্তি বা সন্তুষ্টির বিষয়, ক্ষতিপূরণ, প্রায়শ্চিত্ত, ঋণ পরিশোধ ইত্যাদি। বৌদ্ধ মতে প্রবারনা বলতে বুঝায় ভিক্ষুদের বর্ষাবাস পরিসমাপ্তি, বর্ষাবাস ত্যাগ, বর্ষাবাস ত্যাগের কার্য ইত্যাদি। এখন যখন আমরা প্রবারনার কথা বলি তখন মূলত বর্ষাবাসের পরিসমাপ্তি এবং এই সংক্রান্ত অনুস্থানাদি ও উপচারিকতা এইসবই বুঝি। অনুষ্ঠান ও উদযাপনের মধ্যে আছে ফানুস উড়ানো, ফানুসকে আমরা ছোটবেলায় বলতাম ওয়াইগ্যা। ওয়াইগ্যা এটা কোন ভাষার শব্দ আমি জানিনা। 


বর্ষাবাস ব্যাপারটা জানেন তো? বুদ্ধত্ব লাভের পর গৌতম বুদ্ধ সংঘ সংগঠিত করলেন। সংঘ হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মের তিনটি স্তম্ভের একটি- বুদ্ধ, ধম্ম ও সংঘ- অর্থাৎ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সংগঠিত প্রতিষ্ঠান। সংঘের সদস্য ভিক্ষুরা গ্রামে নগর সমাজে গিয়ে গৃহীদের মধ্যে বুদ্ধের বাণী প্রচার করবে, এইটাই ছিল সাধারণ নিয়ম। বুদ্ধ তখন রাজগৃহে একটি বিহারে অবস্থান করছিলেন। আষাঢ় মাস শুরু হয়ে গেছে। এটা তো দুই হাজার আড়াই হাজার বছর আগের কথা। তখন তো রাস্তাঘাট বিজলিবাতি গাড়িঘোড়া এইরকম ছিল না, আর ঘন জঙ্গলও ছিল অনেক। বর্ষার সময় বিহার থেকে বের হলে ভয় থাকতো বৃষ্টিতে রাস্তা খারাপ থাকতো, পোকা মাকড় কাঁটা জল সাপ এইসবের ঝুঁকি বেড়ে যেত।   


আর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে যাতায়াত সে তো কঠিন কাজ। তাইলে ভিক্ষুরা কি করবে? গৌতম বুদ্ধ তখন ভিক্ষুদের বললেন যে আষাঢ়ের পুর্নিমা থেকে আশ্বিনের পুর্নিমা এই তিন চাঁদের মাস অধিক পরিভ্রমণ ত্যাগ করে নিজ নিজ বিহারে অবস্থান করবে, ধর্ম তথা শীল সমাধি প্রজ্ঞা এইসব অনুশীলন করবে। ভিক্ষুগণ প্রতিটি অষ্টমী অমাবস্যা প পূর্ণিমা তিথিতে পাঠ, আবৃত্তি, দেশনা এবং এইরকম নানা বিনয়ভিত্তিক কার্যাদি করবে। তবে কোনো ভিক্ষু অসুস্থতার কারণে আষাঢ়ী পূর্ণিমায় বর্ষাবাস অধিষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে না পারলে তিনি মধুপূর্ণিমা থেকে কার্তিক পূর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাস বর্ষাবাস পালন করতে পারেন। আশ্বিনের পূর্ণিমাতে অর্থাৎ আজকের পূর্ণিমাতে বর্ষাবাস শেষ হয় আর এই দিনটিকে বলা হয় প্রবারনা। এর কিছুদিন পর হবে কঠিন চীবর দান। 


প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব হিসাবেই পালিত হয়। আর এর অংশ হিসাবে আকাশদীপ বা ফানুস উড়ানো হয়। বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে এই পূর্ণিমাতেই গৌতম বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে তাঁর মাতৃদেবীকে অভিধর্ম দেশনার পর অবতরণ করেন এবং মানব জাতির সুখ, শান্তি ও কল্যাণে দিকে দিকে স্বধর্ম প্রচারের জন্য তার ভিক্ষু সংঘকে নির্দেশ প্রদান করেন। ফানুস উড়ানোর সাথে এই যাত্রার একটা সম্পর্ক আছে, আমি বিস্তারিত জানিনা। আমাদের দেশে প্রবারনা পূর্ণিমা সবসময়ই পালন হয়- বেশব ভালোভাবেই পালন হয়। আমি তো সেই শৈশব থেকেই দেখে আসছি এই পূর্ণিমার দিন সন্ধ্যায় আকাশে উড়ে যাচ্ছে ফানুস। আজকেও নিশ্চয়ই কক্সবাজার রাঙ্গামাটির সাথে দেশের নানা জায়গায় আসমানে উড়ে যাবে শত শত ফানুস।


আপনি এই প্রবারনা পূর্ণিমায় কি করবেন? প্রবারণা পূর্ণিমাতে বৌদ্ধরা মোমবাতি জ্বালিয়ে বুদ্ধকে স্মরণ করে, কোথাও কোথাও রথযাত্রার মতো করে বুদ্ধযাত্রাও হয়। মিষ্টান্ন বিতরণ, সন্ধ্যায় উত্তম খাওয়া দাওয়া এইসব হয়। আর ফানুস উড়ানো সেটা তো বলেছিই। ভিক্ষুদের জন্যে এই দিন বর্ষাবাসের সমাপ্তি অর্থাৎ নতুন করে কর্মযজ্ঞ শুরু হওয়ার দিন। এখন হয়তো বর্ষা বা শীত বসন্ত যাতায়াত কাজকর্মের জন্যে খুব বেশী পার্থক্য বহন করে না। তবু ভিক্ষুরা এই দিনে নিজেদেরকে প্রস্তুত করে, নিজেদের ভুল ভ্রান্তি পরস্পরের সাথে আলোচনা করে, আর বিনয় ধর্ম পালন করে। এটা তো বৌদ্ধ গৃহী ও ভিক্ষুদের কথা। কিন্তু আপনি যদি বৌদ্ধ নাও হন, আপনিও পালন করতে পারেন প্রবারনা। কিভাবে?   


‘প্রবারণা’ শব্দটির অর্থ তো বলেছি, নিমন্ত্রণ, আহ্বান, মিনতি, অনুরোধ, নিষেধ, ত্যাগ, শেষ, সমাপ্তি, শিষ্টাচার, বিধি, তৃপ্তি বা সন্তুষ্টির বিষয়, ক্ষতিপূরণ, প্রায়শ্চিত্ত, ঋণ পরিশোধ এইসব। আপনি নিজের মনে এই শব্দগুলি ধরে নিজেই নিজের বিগত দিনের আচরণগুলি নিজের মনে প্রতিফলন করুন। নিজের ভ্রান্তিগুলি চিহ্নিত করতে চেষ্টা করুন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন যে আটটা পথ মেনে চলবেন। এগুলি কি? খুব কঠিন কিছু না- সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সঙ্কল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রযত্ন, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। এগুলির অর্থ তো এমনিতে খুব কঠিন কিছু নয়, বিস্তারিত ব্যাখ্যাও জেনে নিতে পারেন। না, একদিন এই চর্চাটা করলে আপনি হয়তো একদম সাধু সন্ত হয়ে যাবেন না- কিন্তু বলা যায় না, চমৎকার একটা জীবনের সূচনা হলেও হয়ে যেতে পারে। 


এই হচ্ছে প্রবারণা। আপনাদের সবাইকে প্রবারণা পূর্ণিমার শুভেচ্ছা। আপনার জীবন সুখের হোক, আনন্দময় হোক। জগতের সকল প্রাণ সুখী হোক।


সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ