কুষ্টিয়ায় শিক্ষিকার ধর্মীয় অবমাননার ‘সত্যতা পায়নি’ পুলিশ

কুষ্টিয়ায় শিক্ষিকার ধর্মীয় অবমাননার ‘সত্যতা পায়নি’ পুলিশ

বিদ্যালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের ওই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কোনো ‘সত্যতা মেলেনি’ বলে পুলিশ জানিয়েছে।


হাসান আলীকুষ্টিয়া প্রতিনিধি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

Published : 26 August 2022, 02:03 PM

Updated : 26 August 2022, 02:03 PM



কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় একদল লোক এক স্কুল শিক্ষিকার উপর হামলার চেষ্টা করেছে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তুলে; যার সত্যতা মেলেনি বলে পুলিশ জানিয়েছে।


ওই সময় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ডাকে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং ওই শিক্ষিকাকে নিরাপদ হেফাজতে নিয়ে যায়। পরে তাকে নিরাপত্তা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।


ভেড়ামারা থানার ওসি মুজিবর রহমান জানান, 

ভেড়ামারা উপজেলার মোকারিমপুর ইউনিয়নের দামুকদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বুধবার এ ঘটনা ঘটে।


ওই বিদ্যালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষিকা জয়ত্রী রানী সিংহ রায়ের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কোনো ‘সত্যতা মেলেনি’ বলেও জানান ওসি মুজিবর।


ওই বিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্তের জেরে এক ছাত্রকে পিটুনি দেওয়ার কারণে এলাকার কিছু লোক এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।


স্থানীয়রা জানান, সোমবার দুপুরে বিদ্যালয় চত্বরে ৮ম শ্রেণির এক ছাত্র তার সহপাঠী এক ছাত্রীর গায়ে পাথর ছুড়ে উত্ত্যক্ত করেছে অভিযোগ পান শিক্ষিকা জয়ত্রী। তখন তিনি ওই ছাত্রকে স্কেল দিয়ে পিটুনি দেন।


এর জেরে ওই ছাত্রের অভিভাবকসহ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটা বৈঠক হয়, যেখানে বিষয়টির সুরাহা হয় বলে ওই ছাত্রের অভিভাবক ও বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের দাবি।


পুলিশ ও স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, ওই ছাত্রকে মারধরের দুইদিন পর বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বহিরাগত একদল লোক ফেইসবুকে শিক্ষিকা জয়ত্রী রানীর বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মকে কটূক্তির অভিযোগ এনে পোস্ট দেয় এবং বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর টপকে ভিতরে প্রবেশ করে ওই শিক্ষিকার উপর হামলার চেষ্টা করে।


কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থানীয় আরও লোকজন শিক্ষিকা জয়ত্রীর বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকে।


পরিস্থিতি সামাল দিতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খবর দেয়। সংবাদ পেয়ে ভেড়ামারা থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে এবং ওই শিক্ষিকাকে উদ্ধার করে নিরাপদ হেফাজতে নেয়। ওইদিনই পুলিশ তাকে নিরাপত্তা দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়।


তবে ধর্মকে কটূক্তির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে পুলিশ ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।


অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, 

“গত সোমবার ক্লাশ চলাকালে কিছু ছেলে সহপাঠী মেয়েদের গায়ে পাথর ছুড়ে মারছিল। সেটা দেখে জয়ত্রী ম্যাডামকে নালিশ করে এক ছাত্র। ম্যাডাম বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইলে ক্লাশের আরও বেশ কিছু ছাত্র হইচই করতে থাকে।


“এতে ম্যাডাম ক্ষিপ্ত হয়ে নালিশকারী ওই ছাত্রকে স্কেল দিয়ে মারধর করেন। একজন শিক্ষক হিসেবে তার ব্যবহার খুবই খারাপ। ওই ম্যাডাম দিন দিন চরম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে ছাত্রদের উপর। সেজন্য আমরা ওই ম্যাডামের বিচার চেয়েছি।”


এ কারণে তারা বিক্ষোভ করেছে বলে জানায় এই শিক্ষার্থী।


ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দামুকদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষী খায়রুল ইসলাম বলেন, 

“আসলে ঘটল এক ঘটনা, আর সেটাকে বানিয়ে ফেলল অন্য ঘটনা। কিছুই বুঝতে পারলাম না। ঘটনার সূত্রপাত হলো ছেলেরা মেয়েদের গায়ে পাথরকুচি ছোড়া নিয়ে। সেই ঘটনায় ম্যাডাম মারধর করল এক ছাত্রকে।”


মার খাওয়া ওই ছাত্র ক্লাশ থেকে বেরিয়ে গিয়ে বহিরাগত কিছু লোকজন নিয়ে এসে আজগুবি এক অভিযোগ দাঁড় করাল বলে খায়রুলের অভিযোগ।


তিনি বলেন,

“ম্যাডাম যে মারধর করেছে সেসব কোনো কথা নেই, সে নাকি ইসলাম ধর্মকে কটূক্তি করেছে। কিন্তু কবে করেছে কে শুনেছে, কী বলেছে তার কিছুই আমরা তদন্ত করে পাচ্ছি না।”


মার খাওয়া ওই ছাত্রের বাবা বলেন, 

“আমার ছেলে মার খাওয়ার বিষয়ে আমি শিক্ষকদের সাথে কথা বলে সেটা নিষ্পত্তি করে নিয়েছি। অথচ কোত্থেকে একদল বহিরাগত লোক এসে ধর্মীয় উস্কানি সৃষ্টি করে গোটা এলাকার শান্তিশৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটাচ্ছে – তাদের বিচার চাই। এখানে থানার ওসি, ইউএনওসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে আমার আবেদন যে কুচক্রীমহল এই ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করল তাদের খুঁজে বের করা দরকার। তা নাহলে বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরবে না।”


বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মোকারিমপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন বলেন, 

“একটি মেয়ের গায়ে পাথর ছুড়ে মারার ঘটনা থেকে সৃষ্ট ঘটনাটিকে স্থানীয় কিছু মৌলবাদী লোক ধর্মীয় শ্লোগান দিয়ে এলাকার শান্তি নষ্ট করছে। আমি পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেছি এর সাথে যারা জড়িত তাদের যেন কোনভাবেই ছেড়ে দেওয়া না হয়। সেই সাথে এটাও বলছি ওই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ যদি সত্য হয় তাহলে তার বিরুদ্ধেও আমরা ব্যবস্থা নেব।”


দামুকদিয়া মাধ্যমিক প্রধান শিক্ষক মোনিনুল ইসলাম বলেন, 

“আমার ওই শিক্ষক যে ইসলাম ধর্মকে কটূক্তি করেছে এমন কোনো অভিযোগ আজ পর্যন্ত আমার কোনো ছাত্র-ছাত্রী বা শিক্ষক বা আশপাশের লোকজন নিয়ে আসেনি। হঠাৎ একটা কুচক্রী মহল হীনস্বার্থে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।”


তার ভাষ্য,

 “গতকাল যদি তাৎক্ষণিক পুলিশ এসে ওই শিক্ষিকাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে না যেত তাহলে ওরা ওকে মেরেই ফেলত। আমি আগামী শনিবার ম্যানেজিং কমিটির জরুরি মিটিং ডেকেছি; যাতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মনোরম পরিবেশ ফেরাতে পারি।”


এ ঘটনায় আইনি পদক্ষেপের বিষয়টি ওই সভায় আলোচনা হবে বলে তিনি জানান।


এ বিষয়ে আক্রান্ত শিক্ষিকা জয়ত্রী রানীর পারিবারিক স্বজন হিসেবে কুষ্টিয়া জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় জাসদের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আলীম স্বপন বলেন,

 “পারিবারিকভাবে জয়ত্রী রানী সিংহ রায় একটা অভিজাত পরিবারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ইসলাম ধর্মকে কটূক্তি বা ধর্ম অবমাননাকর কথা বলবেন এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।”


রাজনৈতিক কারণে স্থানীয় সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই উস্কানি ছড়িয়েছে দাবি করে তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন।


এ বিষয়ে ভেড়ামারা থানার ওসি মুজিবর রহমান বলেন, 

“জয়ত্রী রানী সিংহ রায় ইসলাম ধর্মকে কটূক্তি বা অবমাননাকর কথা বলেছে এমন অভিযোগের কোনো সত্যতা পাইনি।


“তবে এই অভিযোগ তুলে যারা বিভিন্ন ভাবে সোস্যাল মিডিয়া ও ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে উস্কানী সৃষ্টি করেছে তাদের ইতোমধ্যে পুলিশের সাইবার শাখা শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে এবং এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক উস্কানিদাতা ইতোমধ্যে নিজেদের ভুল স্বীকার করে তাদের পোস্ট ডিলিট করে দিয়েছে।”


ওসি বলেন, বিষয়টি খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে পুলিশ। সেই সাথে ওই বিদ্যালয়সহ আক্রান্ত শিক্ষিকার নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব রকম উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।


ওইদিন শিক্ষিকাকে থানায় কিছুক্ষণ রেখে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও ওসি জানান।


https://bangla.bdnews24.com/samagrabangladesh/c7kzzyfi5f

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ